যে সবার বন্ধু সে কারো বন্ধু নয়, এই কথার অর্থ বিশদ ব্যাখ্যা দাবী করে। কারণ কয়েকটি জিনিস আছে বুঝার মত।
কোন একটি এনভায়রনমেন্টে প্রথমত আমরা ধরে নিচ্ছি মানুষের দুইটি প্রধান নিড রয়েছে। এক টিকে থাকা, দুই বংশ বিস্তার। চাকরি বাঁচানো, বৈষয়িক লাভের হিশাব, নেটওয়ার্কিং ইত্যাদিকে এই দুই ঝুলির একটিতে ফেলা যায়।
কোন সিস্টেমে, যারা কোন পক্ষ নেয় তারা একটি রিস্ক নেয়। রিস্ক হল একটি মূল্য, যা নিতে হয় এর বিনিময়ে লাভ পাওয়াটাকে ন্যায্য করে নিতে।
আপনি ব্যবসায় ১০০ টাকা ইনভেস্ট করলেন। এই ব্যবসা লস হতে পারে। এই যে ঝুঁকি নিলেন, এর কারণে আপনি ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত লাভের ন্যায্যতা দেন।
স্বাভাবিক ভাবে কোন কিছু পেতে হলে রিস্ক নিতে হয়। আপনি অফিসে যেতে হলে রাস্তায় বের হতে হবে, এটাও রিস্ক যেহেতু রাস্তায় গাড়ি চলে, বা অন্য বিপদের আশংকা কম বেশি থাকে।
যারা রিস্ক নিয়ে কোন লাভ অর্জন করে আমরা তখন তার লাভকে ঠিক মনে করি (সাধারণত পন্থাটি বৈধ হলে)। কারণ এর জন্য সে ত্যাগ স্বীকার করেছে।
স্বার্থের দিক থেকে দেখলে, সবচাইতে লাভজনক স্ট্র্যাটেজি হল, রিস্ক ছাড়া লাভ। বা যত কম রিস্ক নেয়া যায়। এটি মানুষের প্রবণতা। ক্যালকুলেশন এবং বুদ্ধির ব্যবহারে রিস্ক কমানো যায়, কিন্তু একেবারে রিস্ক না নেয়া যায় না। বিশেষত মানুষের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা সমাজে আচার আচরণের ক্ষেত্রে। যেমন, একজন কলিগ চুরি করছে আপনি দেখলেন, এখানে রিস্ক না নেয়া হল তার সম্পর্কে রিপোর্ট না করা। কিন্তু এটি আপনার ক্ষেত্রে ন্যায় আচরণ হয় না।
যারা সবার বন্ধু তারা যে স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করে সেখানে তারা নিজের রিস্ক কমাতে যায়, এটি স্বার্থপর অবস্থান, কোনরূপ ভালোমানুষী নয়।
ধরেন নায়ক আলমগির ও ভিলেন হুমায়ুন ফরিদী। তারা দুই আদর্শ নিয়ে ফাইট করছেন। কম্যুনিটিতে ফরিদী মাদক সাপ্লাই দেন, আবার সমাজ সেবা মূলক কাজ করেন। অন্যদিকে পুলিশ অফিসার আলমগির মাদক দূর করে যুব সমাজকে রক্ষা করতে চান। তিনি ফরিদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেগেছেন।
ধরা যাক, সেই এলাকার একজন ব্যবসায়ী টিপু। তিনি আলমগিরের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখেন, কারণ তার মনে হয় হয়ত এই যুদ্ধে আলমগির জিতে যাবেন। আলমগিরকে তার ভালো লাগে। তিনি চান সমাজে মাদক কমুক। তবে এটি তার মূল কনসার্ন না। তিনি নিজেরটা আগে ভাবেন। তার আরেক হিসাবে ফরিদী না থাকলে এলাকায় ফরিদীর অন্যায় প্রভাবও কমবে। এতে ব্যবসার দিক থেকে লাভবান হবেন টিপু। পাড়ার চায়ের টং দোকানে আলমগিরের সাথে চা খেতে প্রায়ই দেখা যায় টিপুকে। তিনি আলমগিরকে বড় ভাই জ্ঞান করেন।
আবার টিপুর এটাও মনে হয়, ফরিদীর শক্তি কম না। ফলে ফরিদীও জিতে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ফরিদী যদি জিতেন আর টিপু যদি আলমগিরের পক্ষ আগে নিয়ে থাকেন তাহলে ফরিদী টিপুকে এক হাত দেখে নিবেন। টিপু এতে ভয় পান। এই ঝুঁকি টিপু নিতে চান না। ফলে তিনি ফরিদীর সাথেও ভালো সম্পর্ক রাখেন। ফরিদীর বাসায় পার্টি হলে সেখানে হাসিমুখ শ্যাম্পেন হাতে তাকে দেখা যায়।
এখানে টিপু সবার বন্ধু। সবাই বলতে এই দু’জন।
আলমগির জিতলে টিপু সুবিধা পাবেন।
আবার ফরিদী জিতলেও টিপু সুবিধা পাবেন। তখন তিনি বলতে পারবেন, ভাই, ঐ সময় কিন্তু আমি আপনার পাশে ছিলাম।
এখানে ফরিদীর নিজের একটা আদর্শ বা চিন্তা আছে। তার জন্য ফরিদী লড়েন।
আলমগিরের একটা আদর্শ বা লক্ষ্য আছে। তার জন্য তিনি লড়েন।
আর টিপু’র আছে নিজ স্বার্থ চিন্তা। এজন্য তিনি দুপক্ষে থাকেন। তিনি আলমগির বা ফরিদী কারোরই বন্ধু না। দুজনকে ব্যবহার করছেন। রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে টিপু নিজের বুদ্ধির তারিফ করেন। আবার নিজের নিরাপত্তাহীনতা জনিত কাপুরুষতাকে আড়ালে নিতে তিনি নিজেকে বলেন, আমি তো আসলে কাটা দিয়ে কাটা তুলছি। যেই জিতুক জিতে যাব তো আমি।
সমাজে এই টিপুদের সংখ্যা বেশি হলেই একটি সমাজ নষ্টের দিকে যায়। যে প্রকাশ্য খারাপ সে মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছে। যে খারাপের বিরুদ্ধে লড়ছে সে ঝুঁকি নিচ্ছে। তারা হারলে ভুগবে। কিন্তু যে উভয়পক্ষেই আছে সে উভয় পক্ষের সুবিধাটা পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঝুঁকি নিচ্ছে না।
এই কারণে আমি প্রথমেই যারা সবার বন্ধু এদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করি, ও সবচাইতে খারাপের তালিকায় এদের রাখি। এই ব্যাকবোনলেস গার্বেজগুলা যেন আপনার সাথে সম্পর্ক রাখতে না পারে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। আমরা সাধারণত এদের অল্পবুদ্ধি দেখে এদের ক্ষতি করার ক্ষমতাকে এড়িয়ে যাই। আপনি ফরিদী বা আলমগির যেই হোন না কেন, আপনাদের উভয়েরই প্রধান শত্রু এই গার্বেজগুলা।