গুরুদয়াল চৌধুরীর গল্প
আমার লাঠিটা কি এই জায়গায় রাখতে পারি?
- পারেন।
থ্যাংক ইউ। আমার নাম…আপনি হয়ত আঁচ করতে পেরেছেন। আমার নাম গুরুদয়াল চৌধুরী। এই বৃদ্ধ বয়েসে দেখেন কী একটা ঝামেলায় পড়ে…যাইহোক এটা কোন ব্যাপার না। জগত সকল সময়েই রহস্যময়, এবং কতো রহস্য ও অদ্ভুত জিনিস আছে চারপাশে তা আপনার মতো আর কে জানে…হে হে হে।
- আপনি জানেন।
হ্যা, তা বলতে পারেন। হে হে হে। অল্প বিস্তর আমি জেনেছি। ছোটকাল থেকেই এটা আমার নেশা। সকল অদ্ভুত জিনিসের প্রতি। তবে এই নেশাটার পেছনে একটা গল্প আসলে আছে, যেটি হলো কারণ। আমি অনেক ভেবে, সূত্র মিলিয়ে বুঝতে পেরেছি পরে। আমার গল্প সেখান থেকেই শুরু করি তাহলে?
- করেন।
আপনি কি আগ্রহ পাচ্ছেন? এই যে ওরা এসেছে আপনার কাছে, কয়জন এসেছে আমি জানি না, তবে এসেছে সে খবর আমার কাছে আছে, আপনি কি আগ্রহ পাচ্ছেন।
- পাচ্ছি। আপনি বলে যান।
গল্পটা অনেক আগের। আমার বাবা আখলাক চৌধুরীর মা সালেহা চৌধুরীর একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দেখলেন এক অমাবস্যার আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়েছে চাঁদ আর ছুটে এসে চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে গেছে।
এই অদ্ভুত স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য তিনি স্বপ্ন বিশারদদের আনালেন। তাদের প্রায় সবাই বললো যে খুবই ভাগ্যবান চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়িতে এমন সন্তান জন্ম নিবে যে বংশের মর্যাদা আরো আরো বাড়িয়ে তুলবে।
কেবল একজন স্বপ্ন বিশারদ সেখানে ছিলেন, একজন পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি শুধু বললেন, এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা এমন না। স্বপ্নটি অদ্ভুত। চৌধুরী বাড়িতে খুবই বিস্ময়কর কিছু ঘটনা ঘটবে যার রেশ বহুদিন পর্যন্ত রয়ে যাবে।
বলাবাহুল্য এই পন্ডিতের মত গ্রহণযোগ্য হয় নি। এবং তিনি কোন প্রকার পুরস্কারও পান নি। তাকে একরকম তাড়িয়েই দেয়া হয়েছিল।
এই স্বপ্নের কিছুকাল পরে আমার বাপ আখলাক চৌধুরীর জন্ম নয়। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি বড় হন, ও বিয়ে করেন আমার মা হাফেজা বেগমকে। তিনি উচ্চবংশীয়া মহিলা ছিলেন।
কিন্তু বিয়ের পরেই তার আচরণে অদ্ভুততা দেখা দেয়। মাঝে মাঝেই তিনি আমাদের বাড়ির পেছনের আম বাগানে হারিয়ে যেতেন।
এমনো হয়েছে একদিন দুইদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে আম বাগানে পাওয়া যায়।
সার্বক্ষণিক দাস দাসীদের পাহাড়ার ব্যবস্থা করেও তাকে ঘরে রাখা যেত না। তিনি হারিয়ে যেতেন। হারিয়ে যাবার এক অদ্ভুত ও অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে তিনি যেন জন্মেছিলেন বা তার উপর ভর করেছিল সেই আশ্চর্য ক্ষমতা।
আপনি কি আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি জানেন?
- পুকুরে?
জি হ্যা। উনি এক রাতে, সেদিন আকাশে বড় চাঁদ উঠেছিল, ঐদিন আমাদের পুকুরে ডুবে যান। আর উঠে আসেন নি। এটা আমার জন্মের একমাস পরে।
- উনি কেন আত্মহত্যা করেছিলেন এ ব্যাপারে আপনার কোন মত আছে?
আমার হিসাব বলে, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন আমার কারণে। আমার জন্মের পরে একটা সামাজিক চাপের মুখে তাকে পড়তে হয়, কারন আপনি তো জানেন আমার কোমড় থেকে নিচ পর্যন্ত মানুষের মতো না।
- তাহলে?
খরগোশের মত, আমি কি আপনাকে আমার পা দেখাব?
- না তার দরকার নেই। আপনি বলে যান।
হ্যা, যা বলছিলাম। আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি, এবং আমার এইরূপে জন্ম নেয়া আমাকে রহস্যের প্রতি চির আগ্রহী করে তোলে।
প্রাথমিক ভাবে আমি জগতের অনেক অদ্ভুত রহস্যের বিষয়ে জেনেছিলাম আমাদের পারিবারিক এক কর্মচারী কবিরাজ শামশির জাতকের কাছে। এই কবিরাজের একটি ছেলে ছিল, নুরু।
- শামশুজ্জামান নুরু?
হ্যা, শামসুজ্জামান নুরু।
- উনি বলেছেন তার নাম শামশুজ্জাম্মান, শামসুজ্জামান নয়।
আরে একটা হলেই হলো। শামশু আর শামসুতে কী তফাত! নামই তো।
- আচ্ছা।
হ্যাঁ, এই নুরু। এও আপনার কাছে তাহলে এসেছে। এর প্রতি আমার মনোভাব কিন্তু খুব একটা ভালো না। কারণ আমার স্ত্রীকে ফুঁসলিয়ে সে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে।
আমি বিয়ে করেছিলাম একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। আমার স্ত্রী নুরুন্নাহারের সাথে আপনার কথা হয়েছে নিশ্চয়ই। সুন্দরী মহিলা। তার সাথে দেয়া হয়েছিল জোলেখা বানুকে। সেও সুন্দরী। আপনি হয়ত তাকেও দেখে থাকবেন।
এরা কিন্তু খুবই সরল মনের ছিল। দুনিয়ার প্যাঁচ তারা বুঝত না। আর এদিকে শামসুজ্জামান নুরু তার বাপের কাছ থেকে অনেক জাদুকরি চাল শিখে নিয়েছিল। ওগুলি দিয়েই সে এই দুই নারীকে সে বশ করে।
আর আরেকটি ব্যাপার…আপনার কাছে কিছু লুকানো ঠিক না…তাই আমি বলতে চাই…
- বলুন।
আমার নিচের যে অবস্থা, মানে কোমড়ের নিচ থেকে খরগোশের মত, এই জন্য একটা হীনম্মন্যতা আমার মধ্যে কাজ করতো। আমি তাই কখনো আমার স্ত্রীর সামনে নিচের অংশ অনাবৃত করি নি। একরকম ভয় ও দ্বিধায়। আমি ভেবেছিলাম যে, কোনভাবে আমি আমার নিচের অংশকে স্বাভাবিক মানুষের মত করে ফেলার ওষুধ বের করে ফেলব এবং এরপরে আমি তার সামনে যাব। কিন্তু সেই সময় আর পেলাম না। তার আগেই নুরু…সে কিভাবে কাজটা করেছে তাও আমি পরে বুঝতে পেরেছি।
- কীভাবে?
তার বাপ বিভিন্ন লতাপাতা দিয়ে একটা ওষুধ বানাতে জানতেন। এটা সে শিখে নিয়েছিল। খুবই অদ্ভুত সে ওষুধ। একবার খেলে যৌনশক্তি অনেক বেড়ে যায়। আপনি বিশ্বাস করতেও পারবেন না। আমিও বিশ্বাস করতাম না। একবার খেয়েছিলাম, এবং এরপর আমার বাড়ির দাসীদের অনেকে তিন চারদিন হাঁটতে পারে নি, আমি বড়াই করছি না, এটা সত্যি কথা।
- আচ্ছা।
যাই হোক, নুরুর মাধ্যমে আমার স্ত্রী যখন অন্তঃস্বত্তা হয়েছিল তখনো আমি কিছু মনে করি নি। কিন্তু জোনাথন সাহেব জানালেন বাচ্চা হয়েছে খরগোশের, তখনই আমার মাথা ঘুরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এখানে কেবল নুরু নয়, আরো কিছু রহস্য আছে, যার শুরু আমার দাদীর স্বপ্ন থেকে, এবং আমার জন্ম ও আমার মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে রহস্য প্রবাহিত।
জোনাথন সাহেবকে আমি বললাম এই কথা কাউকে না জানাতে।
কিন্তু চতুর জোনাথন অনেককে জানিয়ে একটা হুলস্থুল তৈরি করে, খরগোশের বাচ্চাটি নিয়ে পালিয়ে গেলেন।
আমি মরিয়া হয়ে তাকে ধরতে লোক পাঠালাম। এদিকে ব্যস্ত থাকায় বুঝতেই পারলাম না কখন নুরু, নুরুন্নাহার ও জুলেখাও পালিয়ে গেছে।
- এখন আপনি কীজন্য এসেছেন আমার কাছে?
আপনার কাছে মানুষ যে জন্য আসে, রহস্যের সমাধান পেতে। জীবনের জন্য সমাধান পেতে। আমি কিন্তু আজো মীমাংসা করতে পারি নি এটি কী হয়েছিল, এবং এই রহস্যের হেতু কী?
- এমন কী হতে পারে না যে আপনার স্ত্রীর গর্ভে মানুষের বাচ্চাই হয়েছে আর জোনাথন সাহেব মিথ্যা কথা বলেছেন। আপনি কি স্বচক্ষে খরগোশের বাচ্চা দেখেছেন জন্মাতে?
না, নিজ চোখে দেখি নি। আমি কালো একটা জিনিস দেখেছি যা কোনভাবেই মানুষের বাচ্চা নয় এটা আপনাকে নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি। আর জোনাথন সাহেব কেন এই মিথ্যা বলবেন? তার এখানে লাভ কী?
- মানুষের কোথায় কী লাভ, এর সবটা কি আমরা বুঝতে পারি গুরুদয়াল সাহেব? আপনি তাহলে ওদের খুঁজেই বেড়িয়েছেন সারাজীবন। এবং আমার কাছেও এসেছেন এদের খুঁজে। তাই নয় কি?
সারাজীবন বলা ঠিক হবে না। অনেক সময়। আমার জানার অদম্য ইচ্ছা যে আসলে এর পেছনে রহস্যটা কী। এর অর্থ কী। আমার ধারণা তারা জানে। তবে আমি এর পেছনে সারাজীবন ব্যয় করি নি কারণ অর্ধেক জীবন আমি ব্যয় করেছি আমার নিম্নাবস্থা অর্থাৎ কোমড়ের নিচের অংশ স্বাভাবিক করার ওষুধ বের করে। গত তিন বছর আগে এক সাধুর সাহায্যে আমি তা করতে স্বক্ষম হই।
- অর্থাৎ, আপনি নিচের অংশ স্বাভাবিক মানুষের মত করতে পেরেছেন?
জি পেরেছি। যে তীব্র মনোবেদনা আমার ছিল, আমার মনে হচ্ছিল নিচের অংশকে স্বাভাবিক করতে পারলে তা কমে যাবে। কিন্তু তা কমে নি। কারণ আমি এই ধাঁধাটা মীমাংসা করতে পারছিলাম না। আমার দাদীর স্বপ্নের অর্থ আসলে কী, এবং এরপরে যা যা ঘটলো তা কেন ঘটলো।
আমি নিজ থেকে একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দাঁড় করিয়েছি কিছু প্রমাণের উপর ভিত্তি করে।
- আচ্ছা, সেটি আরেকদিন শুনব। আজ আর নয়। আপনাদের সবার গল্প শুনে আমার বিষয়টা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে এবং আমি অন্যভাবে এটি সমাধানের কথা ভাবছি।
সেটি কীভাবে?
- তা এখনো জানি না। আমি ফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করব এ ব্যাপারে। আজকের আলাপ এখানেই শেষ হোক।
কিন্তু আমার ব্যাখ্যাটি শুনলে হয়ত আপনি আরো কিছু বুঝতে পারতেন?
- না, আর শুনব না। যতটুকু দরকার ছিল ততটুকু শোনা হয়ে গেছে। গুরুদয়াল চৌধুরী আপনি আসুন, আগামী দিন দেখা হবে।
ওকে, বিদায়।
- বিদায়।