গল্প পাঁচ – জোনাথন সাহেবের গল্প

জোনাথন সাহেবের গল্প

আমার নাম রবার্ট। রবার্ট সাত্রিয়ানি। কিন্তু আমি একসময় পরিচিত ছিলাম জোনাথন সাহেব নামে। পেশায় আমি একজন ধাত্রী। সন্তান প্রসবকালে যিনি সাহায্য করে থাকেন। আপনি কি জানেন সক্রেটিসের মা একজন ধাত্রী ছিলেন?

  • না, এটা আমার জানা ছিল না।

যাই হোক, আপনি আপনার কাছে এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে। আপনি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে থাকবেন। ওরা আমার কথা কী বলেছে আমি জানি না। আমারো একটা গল্প আছে। সেটা বলতে আমি আপনার কাছে এসেছি। এবং আপনার সাহায্য নিতে।

  • তাহলে শুরু করুন।

ধাত্রীবিদ্যা আমার পৈত্রিক পেশা। আমার পিতার নাম জিমি সাত্রিয়ানি। আমার পূর্বপুরুষেরা ইংরাজদের সাথে এদেশে এসেছিলেন। আপনি কি আমার নাম শুনে ভেবেছিলেন আমি শাদা চামড়ার লোক হব?

  • আমি আগে থেকে কিছু ভেবে রাখি না।

বেশিরভাগ লোকই ভেবে রাখে। তারা জোনাথন সাহেব নাম শুনে ভাবে শাদা চামড়ার ইংরাজ দেখবে। কিন্তু আমার গায়ের রঙ কালো।

আমার পূর্বপুরুষেরা ধাত্রীবিদ্যায় খুবই ভালো ছিলেন, তাই হয়ত ইংরাজরা তাদের একজনকে নিয়ে এসেছিল এদেশে। আমি ঠিক জানি না। আমি এই পেশায় এসেছি আমার পিতার মাধ্যমে। এবং আমার যখন খুব অল্প বয়েস তখন আমার পিতা গত হন, এবং আমি তার কাজগুলি দেখতে শুরু। আর তখন থেকেই চৌধুরী পরিবারের সাথে আমার জানাশোনা।

আমার বাবা কিছু ডাক্তারি বিদ্যা শিখেছিলেন। ফলে সাধারণ অসুখ বিসুখে মানুষ তার শরণাপন্ন হতো। বাবার মৃত্যুর পর তারা আমার কাছে আসতে শুরু করে। বাবার কাছ থেকে আমি চিকিৎসার অনেক বিষয় শিখেছিলাম। এছাড়া ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করেও আমি শেখতাম। এটা আমার নেশা ছিল।

এলাকার সবচাইতে প্রভাবশালী পরিবার চৌধুরীরা। আমার বাবার সাথে তাদের অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল। আমার সাথেও হয়। আমার চিকিৎসা জীবনের শুরুতেই একটা জটিল সমস্যায় আমি পড়ে যাই এই চৌধুরী বাড়িতেই।  আপনি আমার কথা শুনছেন তো?

  • হ্যা, আমি শুনছি। আপনি বলে যান।

গুরুদয়াল চৌধুরীর মা হাফেজা বেগমের সমস্যা দেখা দেয়। এমন জিনিস আমি আগে কখনো দেখি নি।

তিনি মাঝে মাঝেই যেন উধাও হয়ে যেতেন। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না।

এছাড়া, প্রতি পূর্ণচন্দ্রের রাতে তিনি চৌধুরী বাড়িত সামনে ঘুরে ঘুরে নাচতেন।

আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে নানাকিছু বলতেন।

তার অবস্থা দেখে আমার ভয় শুরু হলো। কারণ তখন আমার বয়েস কম আর এমন জিনিস আমি কল্পনাও করি নি। কম বয়েসে এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কী বলেন?

  • হ্যা, ঠিক। বলে যান।

গুরুদয়াল চৌধুরীর বাবা আখলাক চৌধুরী বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় বড় কবিরাজদের আনালেন। কিন্তু কেউ কোন সুরাহা করতে পারলো না। কোন ঝাড় ফোঁক বা ওষুধে কাজ হলো না।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ভদ্রমহিলার উন্মাদগ্রস্থতার সাথে চাঁদের কোন গভীর সম্পর্ক আছে।

এরপর গুরুদয়াল চৌধুরীর জন্ম হলো। ধাত্রী হিসেবে তখন আমিই ছিলাম।

গুরুদয়াল কি তার কোমড় থেকে নিচ পর্যন্ত যে অন্যরকম ছিল সে কথা বলেছেন?

  • হ্যা।

সেটাও এক বিস্ময়কর ঘটনা ছিল আমার জন্য। এবং এর প্রায় এক মাস পরেই গুরুদয়াল চৌধুরীর মা তাদের বাড়ির সামনের পুকুরে ডুবে হারিয়ে যান। তার মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হলো সমস্ত পুকুরের পানি সেঁচা হলেও সেখানে মাছ বা কোন প্রাণীর দেখা মিলে নি।

এবং আপনি জানেন কি না জানি না, ঐ পুকুরটাতে রাত বিরাতে লাল নীল নানা রঙের ঝিকিমিকি আলোর রশ্মি দেখা যেত প্রায়ই। এসব কথা কি আপনি আগে শুনেছেন ওদের কাছে?

  • কিছু কিছু শুনেছি। আপনি আপনারটা বলে যান।

গুরুদয়ালের পরিবারকে এলাকার অনেকেই মনে করতো অভিশপ্ত। একসময় তারা প্রতাপশালী জমিদার ছিল। এবং অনেক খারাপ কাজ তারা করেছেন এমন বলা হতো। সেই জন্যই অভিশাপ লেগে তাদের এই অবস্থা।

আমি আগেই আপনাকে বলেছি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থদের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল অনেক। আমার বাবার সংগ্রহে এরকম অনেক বই ছিল। বেশিরভাগই চিকিৎসা নিয়ে। আমি সেগুলি পড়তাম। এরকমই একটা বহু পুরনো বই পড়তে পড়তে আমি এমন একটা ঘটনার কথা পাই, যার সাথে গুরুদয়াল চৌধুরীদের পরিবারের মিল যেন খুঁজে পাই। সেই গল্পটা বলব নাকি?

  • প্রয়োজন মনে হলে বলুন।

গল্পটা না বলি। সেটা, ঐ অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটেছিল অনেক অনেক বছর আগে। স্কটল্যান্ডের একটা কৃষক পরিবারে।

ওই বিষয়টি পড়ার পরে আমি পরবর্তী সূত্রের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বইয়ের বর্ণনা  মতে আমি হিসাব করে বুঝতে পারি গুরুদয়াল চৌধুরীর স্ত্রীর মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘটনাটি ঘটবে।

আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম। এবং প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও গুরুদয়াল চৌধুরীদের বাড়িতে যেতাম কোন কাজ না থাকলেও।

তারপর একদিন আমার ডাক এলো। হুট করেই গুরুদয়ালের স্ত্রীর প্রসব ব্যথা উঠেছে।

ঐদিন আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ কোন ঘটনার কথা মনেও ছিল না। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। গুরুদয়াল চৌধুরীর লোকেরা এসে যখন ডাকলো, তখন অন্য কিছু না ভেবে ভাবলাম গুরুদয়ালের স্ত্রীর প্রসব ব্যথাই উঠেছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। গেলাম।

কিন্তু যখনই আমি প্রসবিত বস্তুটি দেখলাম, তখন আমার সারা গা কেঁপে উঠল। আর আমার মনে পড়ে গেল এতো বছর ধরে আমি এই ক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিলাম। এটাই ছিল আমার হিসাব এবং অত্যাশ্চর্য পুরনো বইটির কাহিনীকে সত্য করে দেয়ার মুহুর্ত। আমার গা কাঁপতে লাগলো। প্রথমে আমি কিছুক্ষণ বুঝতে পারছিলাম না কী করব।

ঘরে কেউ ছিল না।

গুরুদয়াল চৌধুরী ঘরে প্রবেশ করতেই আমি বস্তুটিকে আমার চটের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। আর তাকে বললাম, তার স্ত্রী খরগোশের বাচ্চা প্রসব করেছেন।

গুরুদয়াল এক কথায় মেনে নিলেন। তিনি বললেন,  এটাকে মাটি চাপা দিতে হবে আজই, আপনি কাউকে বলবেন না।

আর এদিকে গুরুদয়ালের স্ত্রী নুরুন্নাহার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল।

আমার সাথে একজন সহকারী ছিল। আমি তার মাধ্যমে কয়েকজন লোককে খবর পাঠালাম এই বলে যে, গুরুদয়ালের স্ত্রী খরগোশের বাচ্চা প্রসব করেছে।

এই কথা দ্রুত ছড়িয়ে গেল। আপনি তো বুঝতেই পারছেন এসব কথা কতো দ্রুত ছড়ায়। গুরুদয়ালের বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল।

আর এই সুযোগে আমি আমার চটের ব্যাগটি নিয়ে পালিয়ে আসি।

  • কেন আপনি এটি নিয়ে আসলেন?

আমার ইচ্ছা ছিল রয়েল সোসাইটির সামনে এটিকে উপস্থাপন করার। আপনি বুঝতে পারছেন কত বড় জিনিস এটি?

  • না।

এটি হলো সেই জিনিস যার মাধ্যমে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে ভ্রমণ করা যায়। আরেক মহাবিশ্বের স্বত্তারা এটি নুরুন্নাহারের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবীতে এনেছে। যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল গুরুদয়াল চৌধুরীর দাদীর স্বপ্নের মধ্য দিয়ে বা আরো আরো আগে থেকে। সেই প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে এসে সম্পন্ন হয়েছে অনেক পরে, নুরুন্নাহারের মাধ্যমে।

আর আরেকটা ব্যাপার, আপনি কি লক্ষ করেছেন এই নুরুন্নাহার, জোলেখা বা নুরু বা গুরুদয়ালের মধ্যেকার অস্বভাবিকতা?

তাদেরকে শুরু থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছে। সম্ভবত তাদের জন্মের আগে থেকে তাদের নির্বাচন করা হয়েছে। এবং তারা একটি বিশেষ কাজকে সমাধান করে চলেছে, এবং করবে।

  • সেই কাজ কী?

সেই কাজ কী আমি জানি না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল এই বাক্সটি বিজ্ঞানীদের হাতে পৌছানো। বিজ্ঞানীরা পেলে এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন মহাবিশ্বে মানুষের ভ্রমণ হয়ত সম্ভবপর হয়ে উঠত। এবং আপনি কি মনে করেন ভিন মহাবিশ্বের স্বত্তারা, যারা ভর করেছে নুরুন্নাহার নুরু জোলেখা বা গুরুদয়ালের উপরে, যারা কোন ভয়ংকর উদ্দেশ্য ছাড়া এখানে এসেছে? তাদের যে শক্তি, ক্ষমতা সে অনুপাতে মানুষের কিছু নেই। সুতরাং, তারা যেকোন রকম ভয়ংকর কাজ করতে পারে।

  • আচ্ছা, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, ভিন মহাবিশ্বের নির্বাচিত লোকদের মধ্যে আপনি একজন না। আমার জানামতে সবচেয়ে বেশি সময়কাল ধরে এই বস্তুটি আপনার কাছেই রয়েছে?

হ্যা, তা ঠিক বলেছেন। আমার কাছেই রয়েছে। আমি রক্ষা করে চলেছি এটাকে। আমি রক্ষা করে চলেছি, এটাই প্রমাণ করে আমি ওদের কেউ না। আমি আলাদা।

  • আলাদা মানেই যে আপনি মানুষের দলে তার কি কোন প্রমাণ আছে?

তা নেই। কিন্তু তা মনে করা যায়। কারণ আমার দ্বারা মানুষের কোন ক্ষতি কখনো হয় নি। আমি ওদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি এত দিন ধরে। এখন আমার মনে হয়েছে, আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।

  • এমন মনে হবার কী কারণ?

ঐ দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন বইতে এমন লেখা ছিল। আপনার মত একজনের কথা। যার মাধ্যমেই সকল রহস্যের শেষ হয়।

  • এটা ভুল বললেন সাত্রিয়ানি। রহস্য কখনো শেষ হয় না। আমার মাধ্যমে তো নয়ই।

কিন্তু এছাড়া আমার কোন উপায় তো নেই। বইয়ের সব ইঙ্গিত আপনাকেই যেন নির্দেশ করে। আমি আপনাকে কালো বাক্সটি দেখাতে চাই এখন।

  • সাত্রিয়ানি সাহেব, এখন আমি বাক্সটি দেখব না। আজ আর সময় নেই। আপনি বরং আগামী মঙ্গলবারে আসুন।

কিন্তু বাক্সটি দেখলে আপনি দেখতে পেতেন কেমন প্রাণবন্ত এটি, শুনতে পেতেন এর হৃদস্পন্দন। দেখতে পেতেন কেমন লাল নীল আলোক রশ্মি বের হয় এর মধ্য থেকে। এটি হয়ত আপনাকে সমস্ত ব্যাপারকে বুঝতে সাহায্য করবে। আপনি একবার দেখুন প্লিজ?

  • না সাত্রিয়ানি। আপনি আসুন। মঙ্গলবারে কথা হবে।