ফিল্ম বা বই নিয়া যেইসব লেখালেখি হয় এর মধ্যে এক টাইপ হল ভালো হয়েছে, খারাপ হয়েছে, এরকম হলে ভালো হতো, ওরকম হলে ভালো হতো, নির্মাতা বা লেখকের এই করা উচিত ছিল, ঐ করা উচিত ছিল ইত্যাদি; এগুলি সাধারণত আমার অপছন্দের। কেবল দর্শক অনুভূতি হিসাবে এর মূল্য বিদ্যমান। এবং নির্মাতা বা লেখকরে উপদেশ দেয়া টাইপ আলোচনা বিরক্তিকর।
পরিচিতিমূলক এক ধরনের রিভিউ আছে, যা কেন ফিল্মটা গুরুত্বপূর্ন, পরিচালক কে ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ন থাকে। এগুলি নতুন আগ্রহী দর্শকদের কাজে লাগে।
অনুভূতি টাইপ এমন আলোচনার বাইরে আছে ফিল্ম সমালোচনা। সমালোচনা বলতে দীর্ঘ কাঠখোট্টা প্রবন্ধ হতে হবে, বা মার মার কাট কাট আলোচনা হতে এমন কোন কথাই নাই।
ফিল্মের গল্প, বইয়ের গল্প বুঝার বা ব্যাখ্যার প্রয়াস হিসেবে সমালোচনা গুরুত্বপূর্ন। অনেক ক্ষেত্রে ফিল্ম আলোচনা হয় আলোচকের নিজের ভিউ বা মত বা দর্শনরে উপস্থাপনের মাধ্যম। স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেকের বেশীরভাগ ফিল্ম আলোচনা এমন বলে তিনি জানান।
যে সব ধরনের আলোচনা হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক এবার।
এক- সাইকোলজিক্যাল আলোচনা হতে পারে
এই আলোচনায় সাইকোলজির দিক থেকে দেখা হবে গল্পরে বা কোন ক্যারেক্টাররে। এই সাইকোলজি ফ্রয়েডিয়ান সাইকোএনালিসিসও হতে পারে। এইরকম আলোচনা এই ব্লগে আছেঃ
২। শাটার আইল্যান্ড, ট্রমা ও লিঞ্চের লস্ট হাইওয়ে
এই ক্ষেত্রে আলোচনা করার জন্য বা এইভাবে বুঝার জন্য সাইকোলজি এবং সাইকোএনালিসিস নিয়া আপনার পড়া থাকতে হবে অল্প বিস্তর।
দুই- শ্রেণী ভিত্তিক আলোচনা হতে পারে
ফিল্মরে শ্রেণীর দ্বন্দ্ব হিসেবেও দেখা যেতে পারে। বা এই ধরনের দ্বন্দ্ব উপস্থিত আছে দেখতে পেলে তা ধরেই ব্যাখ্যা হাজির করা যেতে পারে। ফিল্মে উপস্থাপিত গল্পের সম্পূর্ন ভিন্ন একটা দিক পাইতে পারেন এইভাবে দেখলে।
যেমনঃ
বোঝেনা সে বোঝেনা সিনেমা বিষয়ে যা বুঝলাম
বাংলা ফিল্মে প্রেম ও জাত পাতের বিচার
এইদিক দিয়া বুঝার জন্য সমাজ ও সমাজের শ্রেণী নিয়া আপনার ধারণা থাকা দরকার। কিছু মার্ক্সিস্ট টেক্সট পড়া থাকলে ভালো।
তিন- গল্পরে ভাঙ্গতে পারেন
ফিল্মে কী বুঝানো হইছে তা কেবল এর নির্মাতাই সঠিক জানেন, এমন কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু, আপনি যখন গল্প দেখবেন ও বুঝবেন তখন কেবলমাত্র নির্মাতা যে অর্থ ভেবেছিলেন তাই থাকে না গল্পে। আপনে নিজের অভিজ্ঞতায় ফিল্মরে বুঝেন এবং তখনো অর্থ তৈরী হয়।
তাই ফিল্ম আলোচনায় আপনি গল্পকে নানাভাবে দেখতে পারেন। এরকম কয়েকটি লেখাঃ
ব্লু ভেলভেটঃ অন্যের জিএফ ভাগাইয়া নেবার গল্প?
এইভাবে বুঝতে গেলে আপনি দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন বা বিণির্মান নিয়া জানতে পারেন। এবং সতর্কভাবে গল্পরে দেখতে চেষ্টা করতে হবে।
চার- পঠন পাঠন ও অভিজ্ঞতার সাথে মিলাইয়া দেখা
আপনি ফিল্মরে নিজের পড়া এবং পূর্বে দেখা ফিল্ম ও অভিজ্ঞতাসমূহের আলোকেই বুঝবেন। তাই এক্ষেত্রে আলোচনায় গেলে সম্পর্কিত অন্য সব বিষয়াবলী যদি আনেন তখন বুঝাটা মজার ও গভীর হইয়া উঠতে পারে।
যেমনঃ নো কান্ট্রি ফর ওল্ডম্যান
অন্য পরিচালকের প্রভাব কোন পরিচালকের কাজ আপনে পাইতে পারেন, পূর্বের ভালো ফিল্ম দেখার অভিজ্ঞতা থাকলে। এটা আপনারে নির্মাতার মনোভাব বুঝতে সাহায্য করবে। যেমন, ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আনাতোলিয়ায় পানি গড়াইয়া যাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখে আমার তারকোভস্কির স্টকারের কথা মনে হয়। পরে সার্চ দিয়া দেখি আনাতোলিয়ার পরিচালক নুরী বিলগে সিল্যান তারকোভস্কির দ্বারা অনুপ্রাণিত।
পাঁচ- রূপকতার ব্যাখ্যা
অনেক ফিল্ম থাকে রূপকে ভর্তি। আপনি সেই রূপক ধরে ধরেই এর গল্প বুঝার চেষ্টা করতে পারেন। তখন যে গল্প দেখানি হইছে তার চাইতে ভিন্ন একটা গল্পও ধরা দিতে পারে।
যেমনঃ নকচারনাল এনিম্যালস
রূপক ব্যাখ্যার জন্য ঐ পরিচালক কী ধরনের রূপক নিয়া কাজ করেন ইত্যাদি জানা থাকলে ভালো। আর্ট হিস্টরী এবং ফিল্ম হিস্টরী নিয়া জানা থাকলে কাজে দিবে। আর্ট হিস্টরী সহজে জানতে পারবেন খান একাডেমি থেকেই। ফিল্ম হিস্টরীর জন্য বই টই আছে, খুঁজলেই পাইবেন।
ছয়- ফিলসফি, প্রাসঙ্গিক সমাজ, রাজনীতি বা অন্য যেকোন তত্ত্বের মাধ্যমে
ফিল্মের গল্পে কোন দার্শনিক তত্ত্বের আভাস আছে কী না, বা তা যদি আপনার চোখে ধরা পড়ে তখন এটা ধইরাও এগুতে পারেন। এবং ফিল্মের ঐ মেসেজটা সামনে আনতে পারেন আপনার আলোচনায়।
যেমনঃ দে লীভ, প্লেটো এবং অনিয়ন্ত্রিত পুজিবাদ
হিচককের রোপ এবং নীচার উবারম্যানশ
ট্রুমান শোঃ সত্য বাস্তবতা, মিথ্যা বাস্তবতা
আমি একবার ভ্রাদিমির প্রপ মরফোলজি অব ফোকটেইলের যে থিওরী দিছিলেন সেই অনুসারে আপসাইড ডাউন ফিল্ম নিয়ে লেখতে চাইছিলাম। এই ফিল্ম একটি আধুনিক রূপকথা, প্রপের তত্ত্বের সাথে যায়। পরে সময়াভাবে আর লেখা হয় নাই।
সাত- নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে
নিজের বক্তব্য, দর্শন উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবেও ফিল্মের গল্প ব্যবহার করা যায়, সে অনুযায়ী ব্যাখ্যা হাজির করে। যেমন, প্রতিযোগীতা বিষয়ক এই লেখায় দ্য প্রেস্টিজ ফিল্মকে আনা হইছে বা মিথ্যা বিষয়ক এই লেখায় আনা হইছে কিয়ানু রিভসের জন উইক ফিল্মরে।
উপরে যেসব বিষয় উল্লেখ হলো তা ফিল্ম বা গল্প বা কোন ক্যারেক্টার বুঝার সূতা। এইসব সূতার কোন একটা বা কয়েকটা ধরে আগানো যায় গল্প বুঝতে। কিন্তু এমন অনেক জায়গা হয়ত পাইবেন যা বুঝাই যাচ্ছে না। তখন কী হবে? এক্ষেত্রে প্রাচীন রোমান দার্শনিক** মিশেল ডি মন্টেইনরে স্মরন করা যায়। মন্টেইন তার বিখ্যাত প্রবন্ধগুলার একটাতে লিখে গেছেন, যখন বই পড়তে গিয়ে কঠিন কোন জায়গার মুখে পড়তেন তখন তিনি একবার কামড় বসানোর ট্রাই করতেন। এতে না হইলে আরেকবার। দুইবারে না পারলে তিনি স্বাভাবিকভাবে একে ছাইড়া দিয়া সামনে অগ্রসর হইতেন। আমি মনে করি এই জ্ঞাণীর পন্থাটি ভালো।
আর না বুঝায় কোন সমস্যা নাই। কারণ না বুঝাই আমাদের সামনের দিকে ঠেলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত এই মত দিয়া গেছেন।
আপডেটঃ ২৪ অক্টোবর, ২০১৭
**প্রাচীন রোমান দার্শনিক নয়, মিশেল ডি মন্টেইন মধ্যযুগীয় ফ্রেঞ্চ দার্শনিক। জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৫৩৩, মৃত্যু ১৩ সেপ্টেম্বর ১৫৯২।
ফিল্ম বুঝা নিয়া প্রশ্ন করেছিলেন এই ব্লগের একজন পাঠক, Rakib Rashid. তার উত্তরে এই পোস্ট।