অতি সংক্ষিপ্তাকারে মায়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাস
প্রায় একশো বছরের বেশী সময় মায়ানমার ছিল ব্রিটিশ কলোনি। তখন নাম মায়ানমার হয় নি, নাম বর্মা। ১৯৪৮ সালে, তাদের নেতা জেনারেল অং সান এর হত্যাকান্ডের পরে বর্মা স্বাধীনতা ঘোষনা করে। এই জেনারেল অং সান মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও বর্তমান ক্ষমতাসীন পলিটিক্যাল পার্টির নেত্রী দাও অং সান সুচির পিতা।
বর্মায় জাতি আছে প্রায় ১৩৬ টা। তার মধ্যে প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ বর্মান। শুরু থেকে দেশ বর্মা জাতিগত সংঘাত এর ভিতরে পড়ে যায়।
১৯৬২ সালে চলে যায় মিলিটারী শাসকের অধীনে। ছাব্বিস বছর এইমত থাকে। এই সময়ে আমেরিকাসহ নানা দেশ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে বর্মার উপরে। আর সামরিক জান্তা বেছে নিয়েছিল একলা চলরে (আইসোলেশনিস্ট) সোশ্যালিস্ট ব্যবস্থা, যাতে অর্থনীতির গতি হয় মন্থর। করাপশন বাড়ে, ব্ল্যাক মার্কেটের আধিপত্য জোরদার হয়।
১৯৯০ সালে ইলেকশনে সামরিক জান্তা হেরেছিল সুচির এনএলডি পার্টির কাছে। কিন্তু তারা তা মানে নি। সুকিকে গ্রেফতার করে (হাউজ এরেস্ট এবং প্রিজনে) রাখে পনের বছরের অধিক। যাইহোক, আবার ২০১২ সালে ইলেকশন হয়। সুচির পার্টি জিতে ক্ষমতায় আসে।
এই খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে মায়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাস। বর্মা মায়ানমারে পরিণত হয় ২০০৫ সালে। সামরিক সরকার নাম বদলায় কারন বর্মা নামে খালি বর্মীজ জাতি প্রাধান্য পায়, এমন যুক্তি ছিল তাদের।
সুচির পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও ২৫ পার্সেন্ট সিট আর্মির দখলে, ২০০৮ এর সংবিধান অনুসারে। আর্মি নিয়ন্ত্রিত মন্ত্রনালয়ের মধ্যে আছে, প্রতিরক্ষা, হোম এফেয়ারস, সীমান্ত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন জায়গাগুলি।
ফলে, ধীরে ধীরে জনসমর্থন সাথে নিয়ে সামরিক বাহিনীর এই ক্ষমতা কমানোই এখন গণতান্ত্রিক সরকারের একটি লক্ষ্য।
রোহিঙ্গা এবং মায়ানমারারের জাতিগত সংঘাত নিয়েঃ
এক। মায়ানমারের ১৯৮২ এর নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক নয়। মায়ানমারের সামরিক জান্তা ও ওখানকার প্রতিষ্ঠিত মত হল রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। ঐতিহাসিক সত্য যাইহোক না কেন, মায়ানমারের এমন ধারনা গুরুত্বপূর্ন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ঐ অবস্থা বুঝতে। কারণ কোন দেশ বা জাতি যখন এমন কোন থিওরীতে বিশ্বাস করে তখন সে সত্য কী তা খুঁজতে যায় না। যেমন, জার্মানীতে নাৎসীরা প্রকৃত আর্য ধারনায় ছিল, যদিও ঐতিহাসিক ভাবে তা অসত্য, কিন্তু ড্যামেজ যা হবার তা হয়ে গিয়েছিল।
দুই। মায়ানমারে শতাধিক জাতি বিদ্যমান, এবং কেবলমাত্র রোহিঙ্গারাই যে ইনসারজনেট গ্রুপ তৈরী করে যুদ্ধ করছে এমন নয়। কাচিন, কায়িন, কায়াহ ইত্যাদি স্টেইটে বিভিন্ন ধরনের স্বশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। তাদের অনেকে জাতীয়তাবাদী, এবং স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়ছে। মায়ানমারকে এমনো বলা হয় দেশটি দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
তিন। রাখাইন স্টেইটে শতকরা ৪৪ জন শিশু দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। বেশীরভাগ লোকেরাই রাখাইন বুদ্ধ, তবে রোহিঙ্গা মুসলিমরা এর চাইতে খুব নয়। ৫২% বুদ্ধ, ৪১% মুসলিম। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জায়গায়, এবং উপকূলীয় এলাকায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৮০% এর উপরে। লোকবল একেবারে কম না হওয়ায় দাঙ্গায় রোহিঙ্গারা যে রাখাইনদের আক্রমণ করে না এমন ভাবা ভুল হবে। পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
চার। রাখাইনরা জনসংখ্যার দিক থেকে মায়ানমারের ৫ থেকে ৭ ভাগ। অর্থাৎ তারা নিজেরাও সংখ্যালঘু।
পাঁচ। ২০১১ সালে মায়ানমার আর্মি কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। কাচিনরা আরেক সংখ্যালঘু, ধর্মে খ্রিস্টান এবং জনসংখ্যায় মাত্র ২%। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ঐ অভিযানে প্রচুর লোক স্থানচ্যূত হয়। মায়ানমার আর্মি রেইপ, টর্চার, হত্যা ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে অভিযানে আর্মি একই পন্থা অবলম্বন করে থাকে।
রোহিঙ্গা ইস্যু ও সুচির নিরবতা
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচি কেন নিরব এ নিয়ে সবাই প্রশ্ন করে থাকেন। কিন্তু, আপনাকে দেখতে হবে ইলেকশনের প্রচারের সময় সুচি কেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান নি, কেন তার পার্টি থেকে মুসলিম প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।
কেন?
এমনিতেই মায়ানমারের লোকেরা, বিশেষত বৌদ্ধ মোনক গোষ্ঠি মনে করেন সুচি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মী। সুচি‘র ক্ষমতায় আসার পেছনে বৌদ্ধ মোনক এবং সাফরন বিপ্লবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুতরাং, কোন ধরনের পরিবর্তন তিনি করতে চাইলে তা বৌদ্ধ মোনকদের সাথে নিয়েই করতে হবে।
তিনি যদি, রোহিঙ্গাদের নির্যাতন (এথনিক ক্লিনজিং) করা হচ্ছে (আসলেই তা করা হচ্ছে মানবাধিকার সংস্থার বরাতে।) তা স্বীকার করে নিয়ে বিবৃতি দেন তাহলে তিনি বৌদ্ধদের, এবং মেজরিটি মায়ানমারের লোকের সমর্থন হারাবেন।
[সাধারণত এমনিতেই রাষ্ট্রনায়কেরা অনেক পরেও তাদের করা এথনিক ক্লিনজিং/গণহত্যা স্বীকার করে না। যেমন, আর্মেনিয়ান গণহত্যা/জাতিগত নিধন অস্বীকার করে তুরস্ক।]
যে দেশ দশকের পর দশক মিলিটারী জান্তার অধীনে ছিল তার মিডিয়া এবং প্রচার মাধ্যম কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। এবং এইসব মিডিয়া থেকে নিউজ পেয়ে তাদের জনগণও তাদের দেয়া তথ্যগুলিও কেবল জানতে পারছে। ফলে, রোহিঙ্গাদের জন্য মায়ানমারে খুব সহমর্মীতা নেই। তারা মনে করে রোহিঙ্গা ইস্যু পশ্চিমাদের, বাংলাদেশের বা মুসলিমদের ষড়যন্ত্র। তাদের, বিশেষত রাখাইন বৌদ্ধদের এই ভয়ের আগুনে ঘি ঢেলেছে বর্তমান বিশ্বের আইএস বা এইরকম উগ্রবাদী তৎপরতা।
সুচি যদি ক্ষমতায় না থাকেন তাহলে তিনি জনসমর্থন নিয়ে সংবিধানের আইন বদলে রোহিঙ্গাদের নাগরিক বানাতে পারবেন না। তার বিরোধী পক্ষ সামরিক বাহিনী। তিনি যদি খুব দ্রুত সব বদলাতে যান, তাও সমস্যা আছে। আর্মিকে সুচির পার্টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এছাড়া যেসব স্বশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে অস্ত্র বিরতি আছে তারা এই সুযোগে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে।
ফলে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য সুচিকে মাথা ঠান্ডা রেখে ধীরে এগুতে হবে। একজন বিচক্ষণ নেত্রীর মত তিনি তা করছেন। যদি মায়ানমার তার হাত ধরে জাতিগত সংঘাত ছেড়ে, পূর্ন গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়; তাহলে সুচি নেলসন ম্যান্ডেলার সমকক্ষ হয়ে উঠবেন ইতিহাসে।
রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান এটাই, রোহিঙ্গাদের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক বানানো। অন্যথায়, রাখাইন স্টেইটে বৌদ্ধ-রোহিঙ্গা দ্বন্দ্ব অবসান হবার উপায় নেই।
রাখাইন বৌদ্ধরা এই ভয়ে থাকে যে মুসলিম রোহিঙ্গারা সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে, এবং তাদের ধ্বংস করবে। হয়ত তাদের এই ভয়ের পিছনে যৌক্তিক কারণও আছে। অথবা ভয় ভয়ই, যৌক্তিকতা বিচার করে তা হয় না। এবং মনে রাখতে হবে ঐ অঞ্চল দরিদ্র, মায়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম অঞ্চল। ফলে সংঘাতের পিছনে অর্থনৈতিক কারণও থাকবে স্বাভাবিক ভাবেই। সুচি রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিবৃতি দিলে একটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরী হতে পারে রাখাইন স্টেইটে। ভীত বৌদ্ধদের হাতে তখন একটা উপায় থাকবে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য, তা হলো রোহিঙ্গাদের মেরে বিতারন করা।
সুচি আর্মিকেও আদেশ দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে পাঠাতে পারবেন না। কারণ আর্মি তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
উপরন্তু, রাখাইন স্টেইটের অন্য বিদ্রোহী গ্রুপ (যেমন, আরাকান আর্মি) সুবিধা নিতে পারে, বা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে পারে।
ফলে একটা সংঘাতময় রাখাইন স্টেইট পাওয়া যাবে। যেসব রোহিঙ্গারা এখনো অন্তত মার খাচ্ছে না, তারাও হয়ে উঠবে রক্তাক্ত।