মিথ্যার দশ পা দেখা

জন উইক

মিথ্যা খুবই সাধারণ একটি বিষয় মনুষ্য সমাজে। সরাসরি মিথ্যা বলার চাইতে বিভিন্ন মাধ্যমের মারফতে মিথ্যা বলা বেশী সহজ মানুষের কাছে। তাই প্রিন্টিং, রেডিও-টিভি এবং সর্বশেষ ইন্টারনেট-প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি উত্থানের ফলে মানুষের মিথ্যা বলার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু এই মিথ্যাটা আসলে কী? এ ব্যাপারে খোঁজ নিলে অক্সফোর্ড ইংরাজি অভিধান থেকে জানা যায়ঃ

ধোঁকার উদ্দেশ্যে অসত্য কিছু বলাই হচ্ছে মিথ্যা।

কিন্তু এই সংজ্ঞা মিথ্যাকে ঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। ফলে আরো একটু বিস্তারিত করা হয়েছে তাকেঃ

মিথ্যা হচ্ছে কোন একজনের বক্তব্য যে নিজে তা বিশ্বাস করে না কিন্তু বলে এই উদ্দেশ্যে যাতে অন্য কেউ এটি বিশ্বাস করে। (আইজেনবার্গ)

অর্থাৎ মিথ্যা হলোঃ

(১) একজনের বক্তব্য

(২) সে নিজে তা বিশ্বাস করে না, সে বিশ্বাস করে এটি মিথ্যা

(৩) এটি বলতে হবে আরেকজনকে

(৪) এবং বক্তার এই অন্য ব্যক্তিকে ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্য থাকতে হবে।

এই হলো মোটামোটি মিথ্যার প্রথাগত সংজ্ঞা। তবে এতে আপত্তি আছে। একদল দার্শনিক মনে করেন মিথ্যা হওয়ার জন্য “ধোঁকার উদ্দেশ্য” দরকার, আরেকদল মনে করেন মিথ্যা হতে গেলে “ধোঁকার উদ্দেশ্য” থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই।

এখন প্রশ্ন আসে ধোঁকা কী। ধোঁকার সংজ্ঞা হিসেবে অক্সফোর্ড ইংরাজি অভিধানে বলা আছেঃ

যা মিথ্যা তা বিশ্বাস করানো।

একে আরো বিস্তারিত করে এমন করা হয়েছেঃ

ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মিথ্যা বিশ্বাস তৈরী করা, যা মিথ্যা বলে পরিচিত।

এই সংজ্ঞার ক্ষেত্রে দেখা যায় ধোঁকার সাথে মিথ্যার সম্পর্ক আছে। তবে মিথ্যা বলা ছাড়াও ধোঁকা দেয়া সম্ভব। যেমন,

আপনি ব্যাগ গোছালেন বাইরে বেড়ানো যাবার নাম করে, চোরকে ধরার জন্য। যাতে আপনি নেই দেখে সে ঘরে আসে আর আপনি তাকে ধরে ফেলেন। এখানে মিথ্যা বলা হলো না কিন্তু ধোঁকা হলো (কান্ট)।

অথবা, ফেইসবুকে বিখ্যাত টিভি সেলেব্রিটি বা বিখ্যাতদের নামকে এমনভাবে লেখা যাতে মনে হয় সে আপনার পরিচিত। এটি অসত্য নয়, কিন্তু ধোঁকা হয়।

এই হলো মিথ্যা ও ধোঁকা বিষয়ে একেবারে প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা। এসব নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা আছে। দার্শনিকেরা মিথ্যা, ধোঁকা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকেন।

 

করিম রহিম ও পুলিশি তদন্ত

আকবর আলি খান তার বই আজব ও জবর আজব অর্থনীতি’র ভোগোলজি ও অর্থনীতিঃ ‘না মিথ্যা, না সত্য’ অধ্যায়ে করিম ও রহিমের একটি গল্প ধরে নিতে বলেছেন।

আকবর আলি খান
আজব ও জবর আজব অর্থনীতি

গল্পটি হলো এরকম, করিম মিয়া ও রহিম শেখ দুই শত্রু। গ্রামে থাকে তারা। গ্রামে খুন হলো আজিজ মেরধা। গ্রামের লোকেরা সন্দেহ করতে শুরু করল আজিজের খুনের জন্য দায়ী হাত কাটা আসমত। কিন্তু করিম কোন ধরনের প্রমান ছাড়াই অভিযোগ করল খুন করেছে রহিম শেখ। করিম মিয়া মনে মনে জানত সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে দেখা গেল আসলেই খুন করেছে রহিম শেখ। এখন কথা হলো করিম সত্য না মিথ্যা বলেছে? এই প্রশ্ন রাখেন আকবর আলি খান। তার প্রবন্ধটি ছিল ভোগোলজি নিয়ে, এর অর্থ যা সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, আবোল তাবোল ইত্যাদি।

কিন্তু আমরা এই গল্পে করিম সত্য না মিথ্যা বলেছে তা মিথ্যার সংজ্ঞায় ফেলে দেখতে পারি।

করিম যা বলেছিল তা সে জানত মিথ্যা, এবং সে পুলিশ বা গ্রামের লোকদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যেই বলেছে, যাতে তারা এই ধোঁকা ধাঁধায় পড়ে রহিমকে হেনস্থা করে (অর্থাৎ তার আরো উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে হেনস্থা করা), ফলে মিথ্যার সংজ্ঞামতে করিম মিথ্যা বলেছিল। পরবর্তীতে তার মিথ্যা বক্তব্য সত্য হিসেবে বের হয়ে আসায় তার ঐ সময়ে বলা মিথ্যা সত্য হয় না।

 

সত্য মিথ্যা এবং নৈতিকতা

কোন পূর্ব স্থিরিকৃত নৈতিকতার বিচারে সত্য ও মিথ্যাকে দেখার ক্ষেত্রে সমস্যাও বিদ্যমান। ধরা যাক একজন নিরীহ লোককে খুন করার জন্য এগিয়ে আসছে বিখ্যাত খুনী জন উইক। নিরীহ লোকটির এসে আশ্রয় নিল আপনার চকির তলে, মানে খাটের নিচে। জন উইক এসে আপনার দরজায় কড়া নাড়ল। আপনি দরজা খুলে দিলেন। জন উইক জিজ্ঞেস করল, কুতুবুদ্দিন কি এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে?

আপনি যদি সত্য বলেন তাহলে কুতুবুদ্দিন খুন হবে। ধরা যাক কুতুবুদ্দিনের সাথে আপনার একসময় হালকা বাকবিতন্ডা হয়েছিল ফেইসবুকের কোন পোস্টে। সুতরাং, আপনি ভাবলেন এই তো সুযোগ। বললেন, ইয়েস জন উইক স্যার, হি ইজ হিয়ার, আন্ডার মাই চকির তল।

আপনি সত্য বলেছেন। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য অসৎ। খারাপ উদ্দেশ্যে বলা সত্য মিথ্যার চাইতে খারাপ, এটা যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। এই সত্যের জন্য আপনাকে বাহবা দেয়া যায় না।

জন উইক

আবার আরেক অবস্থা ভাবা যাক। জন উইকের প্রশ্নের উত্তরে আপনি মিথ্যা বললেন। বললেন, না, কুতুবুদ্দিন এদিকে আসে নি।

আপনি মিথ্যাই বলেছেন। আপনি দুধর্ষ খুনী জন উইককে ধোঁকা দিয়েছেন মিথ্যা বলে। কিন্তু একটা লোক প্রাণে বেঁচে গেল এজন্য।

এছাড়াও আরেকটি অবস্থার কথা ভাবা যায়। জন উইকের প্রশ্নের উত্তরে আপনি বললেন, আমি অন্য ঘরে ছিলাম।

এখানে আপনি সরাসরি মিথ্যা বলেন নি। আপনি একটি কথার মারপ্যাচ খেলেছেন এবং তার মাধ্যমে জন উইককে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন।

কথার মারপ্যাচের মাধ্যমেও ধোঁকা দেয়া যায়। কিন্তু একে মিথ্যার চাইতে কম খারাপ হিসেবে দেখা হয়। মিথ্যাকে খারাপ হিসেবে দেখা হয় এজন্য যে এটা মিথ্যা বলা ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়। কিন্তু কথার মারপ্যাচ পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে না। জন উইক পালটা প্রশ্ন করতে পারে সরাসরি, আমারে সরাসরি বলো কুতুবুদ্দিন এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে কি না?

যেহেতু প্রথমবার আপনি কথার মারপ্যাচ খেলেছেন, দ্বিতীয়বার সত্যের অধিক কাছাকাছি উত্তর দিতে হবে।

যাইহোক, আমরা যদি মনে করি আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি আমরা যে কাজটি করব এর সাথে যুক্ত সব ব্যক্তির যাতে এতে সর্বোচ্চ ভালো হয়, সেক্ষেত্রে কুতুবুদ্দিনকে বাঁচাতে মিথ্যা বলাটা আমাদের জন্য নৈতিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

 

হামবাগ, ননসেন্স ও ভোগোলজি

ভোগোলজি শব্দটির তৈরী করেছেন পরিমল রায় তা জানা যায় আকবর আলি খানের প্রবন্ধ থেকেই। আকবর আলি খান লিখেছেনঃ “নির্দোষ ভোগোলজির উদাহরণ হচ্ছে ননসেন্স (যেমনঃ সুকুমার রায়ের কিছু ছড়া) আর ফেরেববাজ ভোগোলজির উদাহরণ হলো হামবাগ ও বুলশিট।”

হামবাগ বা বুলশিট মিথ্যা নয়, মিথ্যার কাছাকাছি এবং তার উদ্দেশ্য থাকে অসৎ। বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ও ফেইসবুক ইউজারদের পোস্টের এক বিশাল অংশ থাকে এই বুলশিট। যা সত্য নয়, মিথ্যার কাছাকাছি, উদ্দেশ্য অসৎ (অসৎ বলতে যা উপস্থাপন করা হচ্ছে তা নয়, লাইক বা হিট বাড়ানো। এমনকী অন্য ধরনের অসততাও থাকতে পারে), ফলে এগুলি মিথ্যার চাইতেও খারাপ। অনলাইনে গুজব বা মিথ্যা তত্ত্বের প্রবাহমানতা (বা ফ্লো) এর জন্য আবার দরকারী, যা নিয়ে গুজব তত্ত্ব লেখাটি পড়া জরুরী

বুলশিট বা আবোলতাবোলকে মিথ্যার চাইতেও খারাপ বলেছেন অধ্যাপক ফ্রাংফার্ট, কারণ এখানে যে আবোলতাবোল বলছে সে নিজেই জানে না সত্য কী। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদী সত্য কী জেনেই মিথ্যা বলতে যায়।

তবে সাধারনভাবে দেখলে এদের সব একরকম মিথ্যাই।

বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হলমার্ক কেলেঙ্কারী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “চার হাজার কোটি টাকা বড় অঙ্কের অর্থ নয়।” এটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। এটাকে ভোগোলজির এক দারুণ উদাহরণ বলা যেতে পারে কারণ কথাটি মিথ্যে নয়, আবার সত্যও নয়। এর উদ্দেশ্য ছিল অসৎ, মন্ত্রী মিডিয়ায় হলমার্ক কেলেঙ্কারী নিয়ে আলোচনা দেখে বিরক্ত হয়েই উক্তিটি করেন। অর্থাৎ, তার কথাটি ছিল এই আলোচনা বন্ধ করা। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা তো হবেই।

 

সিংগলটনের মৃত্যু, নাসাউতে স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন ও ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট

ব্ল্যাক সেইল আমেরিকান একটি ঐতিহাসিক টিভি সিরিজ, যাকে রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের উপন্যাস ট্রেজার আইল্যান্ডের প্রিক্যুয়েল বলা হয়ে থাকে। ট্রেজার আইল্যান্ডে যে কাহিনী দেখানো হয়েছে তার দুই দশক আগের অবস্থা ব্ল্যাক সেইলে। গোল্ডেন এইজ অব পাইরেসী বা ডাকাতির/জলদস্যুতার স্বর্নযুগে এর পটভূমি।

ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট ওয়ালরাস জাহাজের ক্যাপ্টেন, দুধর্ষ জলদস্যু সর্দার। একসময় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে কাজ করত। কিন্তু পরবর্তীতে ডাকাত হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ, সে চায় ডাকাতদের ব্ল্যাকমার্কেট নাসাউ দ্বীপে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। যেখানে জলদস্যুরা স্থায়ীভাবে থাকবে।

ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট
ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট, পিছনে জন লং সিলভার।

এক জাহাজ আক্রমণ করে সে সংগ্রহ করে বিখ্যাত স্প্যানিশ সম্পদশালী জাহাজ আর্কা দ্য লিমা’র শিডিউল। কিন্তু সেই শিডিউল থেকে এক পাতা ছিঁড়ে নেয় ধূর্ত জন লং সিলভার, যে জন লং সিলভারকে আমরা স্টিভেনসনের উপন্যাসে পাই ভিলেন হিসেবে।

এদিকে ওয়ালরাসে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আরেকজন শক্তিশালী ডাকাত সিংগলটন। সিংগলটন ভোটাভোটির ডাক দেয়। সে সদস্যদের বুঝায় এবং বেশীরভাগ সদস্য তার পক্ষে আছে জেনে ভোটাভোটির মাধ্যমে ফ্লিন্টকে ক্যাপ্টেন্সী থেকে সরাতে চায়।

এদিকে ফ্লিন্ট সিংগলটনকে আর্কা দ্য লিমা’র শিডিউল থেকে কাগজ ছিঁড়ে চুরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং তাদের দুজনের ফাইট হয়। শেষপর্যায়ে ফ্লিন্ট সিংগলটনকে মেরে ফেলে। এবং একটি কাগজ বের করে দেয় বিলি জোনসের হাতে।

বিলি জোনস দেখতে পায় কাগজটি খালি। অর্থাৎ, চুরি যাওয়া কাগজ এটি নয়। সিংগলটন কাগজ চুরি করে নি। বিলি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে সে কী করবে এবং শেষ পর্যায়ে ফ্লিন্টের পক্ষই নেয়। কাগজের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ এটাই সেই কাগজ।

ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট অতঃপর এক অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে ডাকাত সদস্যদের চাঙ্গা করে। তার উপর বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। মৃত সিংগলটন চোর প্রমাণিত হয়। তার মৃতদেহের উপর মুত্রত্যাগ করে জলদস্যুরা।

এখানে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, এবং তার প্রভাবে বিলি জোনসও মিথ্যার আশ্রয় নেয়। পরবর্তী প্রথম সিজনেরই একটা পর্বে ফ্লিন্ট তার বন্ধু ও কোয়ার্টার মাস্টার মিস্টার গেইটসকে বলে, এরা (জলদস্যুরা) যদি আর্কা দ্য লিমা’র সম্পদ পায় তো কী করবে? দুইদিনেই মদ ও নারীতে তা উড়িয়ে ফেলবে। এর চাইতে আমি যে নাসাউতে স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন দেখছি তা তাদের জন্য ভালো।

তার এই স্বপ্ন এবং সবার জন্য ভালো করতে যাওয়ার কারণে একসময় তার হাতে বিলি জোনস, এবং মিস্টার গেইটসকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়। প্রতিবারই মিথ্যার আশ্রয় নেয় ফ্লিন্ট। এমনকী তার কাছে শিডিউল বা লগ বুকের একটা অংশ যে নেই তাও জানত না ডাকাত সদস্যরা, কিন্তু তাও জন লং সিলভারের স্মৃতির উপর নির্ভর করে ফ্লিন্ট ওয়ালরাস অভিযান শুরু করে আর্কা দ্য লিমার সম্পদ আহরনে।

নেতারা বা রাষ্ট্রনেতারা যেসব মিথ্যা বলেন, তার সাথে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের এই মিথ্যাগুলি মিলিয়ে দেখা যায়। ফ্লিন্টের মতোই তারা অনেক সময় মনে করেন মিথ্যাগুলি তাদের বলতে হচ্ছে দেশের ভালোর জন্য, জনগনের ভালোর জন্য এবং কখনো কখনো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা দিতে। আর ওয়ালরাসের ডাকাত সদস্যদের মত জনগণ ধোঁকা খায় এবং তা জানতেও পারে।

 

নেতাদের মিথ্যা বলা

কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হুসেন মঞ্জু একটা সত্যি কথা বলেছেন, সাংবাদিকদের তিনি বলেন ‘মন্ত্রী-মিনিস্টার হল তোমাদের কাছে মিছা কথা বলার জন্য।’ মন্ত্রীদের মিথ্যা বলতে হয়, রাষ্ট্রনেতাদের বলতে হয়। নেতাদের মিথ্যা বলা নিয়ে একটি বই লিখেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন জে মার্শহেইমার। বইটির নাম হোয়াই লিডারস লাই। তার এই বইটিতে তিনি রাষ্ট্রনেতাদের বা নেতাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মিথ্যা বলার ধরনকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করেছেন বা এইসব প্রকারের মিথ্যা তিনি চিহ্নিত করেছেনঃ

১। ইন্টার-স্টেইট লাই – দুই দেশের মধ্যেকার মিথ্যা। কোন রাষ্ট্রনেতা-রাষ্ট্রনেত্রী বা কোন কারনে ধরা যাক অন্য দেশের রাষ্ট্রনেতা বা নেত্রীর কাছে একটা মিথ্যা বললেন স্ট্র্যাটেজিক কোন সুবিধা পাবার জন্য, তখন সেটা হবে ইন্টার স্টেইট বা আন্তঃদেশীয় মিথ্যা। এ ধরনের মিথ্যায় সাধারণত মিলিটারী শক্তি বেশী আছে এমন বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন তার নিউক্লিয়ার শক্তি/মিসাইল ক্ষমতা নিয়ে প্রায়ই মিথ্যা বলে থাকেন। ১৯৬০ সালে ইজরায়েল নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম বিষয়ে আমেরিকাকে মিথ্যা বলেছিল এই ভয়ে যে আমেরিকা জানলে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম বন্ধ করতে চাপ দিবে। তারা আমেরিকাকে মিথ্যা বলে ধোঁকা দিতে পেরেছিল সফলভাবে।

২। ফিয়ারমঙ্গারিং – এটা রাষ্ট্রনেতা বা নেতা নিজের দেশের লোকদের সাথে এটা করেন বিদেশী কোন থ্রেট নিয়ে সাধারনত। রাষ্ট্রনেতা এর আশ্রয় নেন যাতে জনগণ বিদেশী থ্রেটের ভয়াবহতা বুঝতে পারে এবং কার্যকর পদঃক্ষেপ নিতে রাষ্ট্র বা সরকারকে সমর্থন করে। যেমন, ইরাক আক্রমনের সময় আমেরিকার রাষ্ট্রনেতারা তাদের জনগনের সাথে মিথ্যা বলে ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে বিশ্বাস করিয়েছিলেন। এটা ফিয়ারমঙ্গারিং বা ভীতি তৈরী।

৩। স্ট্র্যাটেজিক কভার আপ – কোন গৃহীত পদ্বতি ব্যর্থ হলে তা ধামাচাপা দিতে এই মিথ্যা বলা হয়। এটা নিজের দেশের লোকের সাথে যেমন হয়, বাইরের দেশের সাথেও হতে পারে। রাষ্ট্রনেতারা এই মিথ্যা বলেন যাতে যে পদ্বতি ব্যর্থ হয়েছে তা প্রকাশ না হয় এজন্য, এবং প্রকাশিত হলে আরো নানা খারাপ সমস্যা তৈরী হতে পারে, সেগুলি থেকে বাঁচতেই বা রাষ্ট্রকে বাঁচাতেই। এর বাংলা নাম দেয়া যায় পদ্বতিগত ধামাচাপা।

৪। ন্যাশনালিস্ট মিথমেকিং – এই ধরনের মিথ্যা নেতারা বলে থাকেন তাদের রাষ্ট্রের ইতিহাস নিয়ে, তারা একটি গর্বের ইতিহাস তুলে ধরেন। তাদের জাতি এবং মানুষেরা সব সময় “ভালো” পক্ষে ছিল এবং তাদের শত্রুরা “খারাপ” – এরকম অতি সাধারন প্যাটার্নের “আমরা” ও “তারা” ফর্মূলায় এসব মিথ্যা তৈরী হয়। উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা, বৃহত পরিসরে ঐক্য বৃদ্ধি করা যা নেশন স্টেইট বা জাতিরাষ্ট্রের জন্য দরকারী, দেশের জন্য যুদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করার জন্য দরকারী। এর বাংলা নাম দেয়া যায় জাতিয়তাবাদী কল্পবিস্তার।

৫। লিবারেল লাইজ – মাঝে মাঝে বিশ্বসমাজে, রাজনীতিতে ও দেশে প্রচলিত উদার রীতিনীতির বিরুদ্ধে যেতে হয় কোন রাষ্ট্রকে। অন্য একটি রাষ্ট্রের প্রতি অন্যায় আচরণ করতে হয় বা অন্য দেশের সাথে অন্যায় করছে এমন কোন রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতায় যেতে হয়। এইসব ক্ষেত্রে নিজের কাজের ন্যায্যতা দানের জন্য রাষ্ট্রনেতা গল্প তৈরী করে জনগনকে বা বিশ্ববাসীকে শোনান, ব্যাখ্যা দেন কেন তাকে ঐ কাজ করতে হল। এর বাংলা নাম হয়ত উদার মিথ্যা দেয়া যায়।

৬। সোশ্যাল ইম্পেরিয়ালিজম – যখন রাষ্ট্রনেতারা অন্য দেশ সম্পর্কে জনগনকে মিথ্যা বলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি কারণে। যেমন, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতারা পরস্পর সম্পর্কে মিথ্যা বলেন তাদের জনগনকে। এ ধরনের মিথ্যা বলা হয় দেশের সমস্যা থেকে জনগনের দৃষ্টি সরানোর জন্য। ইংরাজির বিপরীতে বাংলা করলে একে বলতে হয় সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ।

৭। ইগ্নোএবল কভার আপস – যখন রাষ্ট্রনেতারা নিজেদের বা মিত্রদের বাঁচাতে গৃহীত কোন ব্যর্থ পদ্বতি মিথ্যা বলে ধামাচাপা দিতে চান। একে বলা যায় স্বার্থপর ধামাচাপা।

অধ্যাপক জন জে মার্শহেইমার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নেতাদের মিথ্যা বলা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তাই শেষের দু প্রকারের মিথ্যাকে তিনি বাদ দিয়েছেন, কারণ এগুলি ব্যক্তিগত স্বার্থে বলা মিথ্যা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতারা এই দুই ধরনের মিথ্যাই বেশী ব্যবহার করেন, যেহেতু এখানে নিজেদের স্বার্থটাই তাদের দেখতে হয় বেশী। ফলে আমরা আমাদের নেতাদের মিথ্যা দেখতে হলে এই দুইটিই প্রধানত খুঁজতে হবে এবং আর খুঁজতে হবে আবোলতাবোল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই মিথ্যাগুলির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। তাই ভবিষ্যতে শুধুমাত্র এসব মিথ্যার ভূ-রাজনৈতিক বিষয় আশয় নিয়ে কোন লেখা তৈরী করতে পারি হয়ত। এছাড়া, আমাদের নেতাদের মিথ্যা নিয়েও হালকা কোন লেখা হতে পারে বেশ কিছু উদাহরণ সহকারে।

 

ভাইরাল প্রশ্ন ও তার উত্তর          

সম্প্রতি ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাসের স্ক্রিণশট ভাইরাল হয়েছে। এটা শেয়ার করে লোকে হাসাহাসি করছে। স্ট্যাটাসটিতে একজন মেয়ে প্রশ্ন করেছেন, তার সারমর্ম হলো,

তিনি রোজা থাকা অবস্থায় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর পারেন না তাই বানিয়ে বানিয়ে লিখে আসেন। তিনি শুনেছেন মিথ্যা বললে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। এখন তিনি যে বানিয়ে উত্তর লিখছেন এতে তার রোজা মাকরুহ হবে কি না।

প্রশ্ন

আমি ধরে নিলাম বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে উনি সরাসরি মিথ্যা বুঝান নি। কারণ আগের লাইনে তিনি লিখেছেন ঠিকমত পারেন না উত্তর। ঠিকমত না পারার অর্থ কিছু পারা।

রোজা মাকরুহ হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে আমি যাবো না। তবে আমরা দেখতে পারি তার বানিয়ে উত্তর লেখা “মিথ্যা” হয় কি না।

তিনি যদি সত্য উত্তরের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন মিথ্যা উত্তর দিয়ে থাকেন শিক্ষকদের ধোঁকা দেয়ার জন্য তাহলে তিনি জেনেশুনেই মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন, এবং তার উদ্দেশ্য ধোঁকা দেয়া, ফলে তার বানিয়ে উত্তর দেয়া মিথ্যার মধ্যে পড়বে।

আর তিনি যদি তার কল্পনাশক্তির সাহায্যে যথাসম্ভব সত্যের কাছাকাছি গিয়ে একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন, তখন তিনি জেনেশুনে মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন না। নিজের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে, এক দু’বার পড়ার স্মৃতি থেকে, কমন সেন্স থেকে ঠিকমত না পারা প্রশ্নগুলির একটা উত্তর দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য যদি শিক্ষককে ধোঁকা দেয়া না হয় তাহলে তিনি কখনোই মিথ্যা বলছেন না। সত্যে পৌছানোর চেষ্টা তার আছে। তখন সেই উত্তর মিথ্যা হবে না।

 

উপসংহারঃ

মিথ্যার সমস্যাটা কী? মিথ্যা বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়। এই কারণেই মিথ্যাকে নৈতিক ভাবে খারাপ দেখা হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে মানুষে মানুষে সম্পর্কই তৈরী হতে পারবে না। আর মানব সভ্যতার এই উন্নতি মানুষে মানুষে সহযোগীতার কারণেই। প্রাচীন মানুষেরাও বুঝতে পেরেছিলেন মিথ্যার কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে এই সহযোগীতা বজায় রাখা সম্ভব নয়, অর্থাৎ সভ্যতাই টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। তাই মিথ্যা হয়েছে নিন্দনীয়। মিথ্যার বিপদও এটাই, মিথ্যাবাদীর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। যার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই তার মিথ্যারও কোন শক্তি থাকে না।

অনলাইনে গুজব ও মিথ্যা নিউজ প্রতিরোধের উপায় গুজব তত্ত্বে বলেছিলাম, এদের বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙ্গে দেয়া। এটাই একমাত্র কার্যকর উপায় বলে আমি মনে করি।

আর শেষকথা হলো, এই পোস্টের শিরোনাম “মিথ্যার দশ পা দেখা” আসলে একটি আবোলতাবোল, যা মিথ্যার কাছাকাছি। হয়ত রূপকার্থে এটি বুঝাচ্ছে এই লেখায় মিথ্যা সম্পর্কিত কিছু আছে, সেদিক দিয়ে ঠিক আছে; কিন্তু আক্ষরিক অর্থ বিবেচনায় শিরোনামটি পুরোপুরি সত্য নয়।