নিজেকে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনার মট কী?
হতে পারে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন একটি প্রশ্ন আপনার জন্য।
কিন্তু আসলে মট কী?
আগেকার দিনে কোন দূর্গকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এর চারপাশে খালের মত খনন করে রাখা হত। একে পরিখাও বলে। এই পরিখাই হলো মট।
নিচের ছবিগুলি লক্ষ করুন।
এছাড়া যুদ্ধের সময় কোন শহরকে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যও এমন খাল বা পরিখা খনন করা হতো। যেমন হয়েছিল ৬২৭ কম এরাতে / খ্রিস্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধের সময়। ইসলামের নবী মুহাম্মদ তখন মদিনা শহরে, এবং কুরাইশরা ও আরো কয়েকটি গোত্র মিলিত হয়ে আক্রমণ করতে এসেছিল মদিনা বা ইয়াতরিব শহর। সেই সময়ে পারস্যের সালমান ফার্সির পরামর্শে মদিনা শহরের যেদিক দিয়ে শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা আছে সেদিকে খাল খনন করা হয়। পারস্যে এই স্ট্র্যাটেজি প্রচলিত ছিল। কিন্তু আরবে ছিল না। ফলে আরব আক্রমণকারীরা এই খালের কারণে মারাত্মক অসুবিধার মুখে পড়ে। ৭০০০ জন বেশি সৈন্য, এবং অস্ত্র শস্ত্রের দিক থেকে শক্তিশালী হয়েও সেই যুদ্ধে তাই তারা হেরেছিল মদিনায় অবস্থানকারী মুসলমানদের সাথে। এই খাল বা পরিখার নামেই যুদ্ধটিকে ডাকা হয় খন্দকের যুদ্ধ নামে।
এটি ছিল একটি মট।
ইকোনোমিক মোটের ধারণা এই খাল তথা মটের অনুসারেই করা হয়েছে। এটির প্রচলন করেন ওয়ারেন বাফেট। ১৯৮১ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার ইনভেস্টমেন্ট ফিলসফি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন,
‘ইনভেস্টিং এর মূল এটা না যে কোন ইন্ড্রাস্ট্রি সমাজে কীরকম প্রভাব ফেলবে, কত বড় হবে ইত্যাদি অনুমান করা, বরং মূল পয়েন্ট হল কোন কোম্পানির কম্পিটিটিভ এডভান্টটেজ বের করা, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন হোল সেই এডভান্টেজটি কতটুকু টেকসই বা কত দীর্ঘসময় টিকবে তা বের করা। যে পণ্য বা সেবার অনেক প্রশস্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী মট আছে তার চারপাশে, সেগুলিই ইনভেস্টরদের মুনাফা দিয়ে যাবে।’
এই হলো ইকোনমিক মটের ধারনা। একটি ইউনিক কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ কোন কোম্পানির যেটি হবে দীর্ঘস্থায়ী, এবং যার জন্য কোম্পানিটি মার্কেটে প্রতিযোগিতায় তার প্রতিযোগিদের চাইতে সব সময় এগিয়ে থাকবে।
একটি কোম্পানির উচিত তার চারপাশে প্রশস্ত মট তৈরি করা, এবং সেটাকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা। তাহলেই তার সফলতা নিশ্চিত প্রায় হয়ে উঠে।
মট বের করতে মিখায়েল ই পর্টারের ফাইভ ফোর্সের মডেল দ্বারা এনালাইজ করা যায়। স্ট্র্যাটেজির ক্ষেত্রে মিখায়েল ই পর্টার একটি অনন্য নাম, এবং তার ফাইভ ফোর্স মডেল মার্কেটের প্রতিযোগিতা বুঝার জন্য ভালো একটি মডেল।
এক – নতুন কেউ মার্কেটে একই বিজনেস নিয়ে আসতে চাইলে বাঁধার পরিমাণ কী।
আপনার চায়ের দোকান আছে রাস্তার মোড়ে। একজনের সেখানে চায়ের দোকান দিতে দশ হাজার টাকা, পুলিশের অনুমতি এবং ক্ষমতাশালী স্থানীয় একজন ব্যক্তিকে ৫ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হবে, এমন হলে এগুলি নতুন একটি একই ধরণের বিজনেস আসার সামনে বাঁধা। এই বাঁধা যত বেশি হবে আপনার জন্য তত ভালো।
দুই – ক্রেতা বা কাস্টমারের পাওয়ার – ক্রেতা বা কাস্টমারের ক্ষমতা বেশি থাকলে তা আপনার জন্য খারাপ। ধরা যাক, আপনার চায়ের দোকানের পাশে আরো কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। আপনার কাস্টমারদের কাছে তখন অপশন বেশি, এটা তাদের ক্ষমতা।
তিন – সাপ্লাইয়ার বা ওয়ার্কারের পাওয়ার – সাপ্লাইয়ারদের (বা আপনার জন্য যারা কাজ করে তাদের) পাওয়ার যত কম হবে তত আপনার জন্য ভাল। আপনি সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে যত কম দামে কাঁচামাল কিনতে পারবেন তত আপনার জন্য বেটার।
চার- বিকল্প পণ্যের হুমকি – আপনার পণ্যের বিকল্প বা একই রকম পণ্য মার্কেটে আসার সম্ভাবনা যত কম হবে, তত আপনার জন্য ভালো। কারণ, এই সম্ভাবনা বেশি হলে, বিকল্প পণ্য চলে আসলে সহজে, আপনি মার্কেটে আপনার অবস্থান হারাতে পারেন।
পাঁচ – প্রতিযোগিতার অবস্থা – মার্কেটে একই ধরণের অন্যান্য কোম্পানিদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা কম। কিছু কিছু মার্কেট আছে যেখানে প্রতিযোগিতা বেশি। আবার প্রতিযোগিতা এড়ানোর জন্য নিশ মার্কেটও খুঁজে বের করা যায়।
এই মডেল দ্বারা চিন্তা করে কেউ তার বিজনেসের ইউনিক স্ট্রেংথের জায়গা বের করতে পারেন, যেখান থেকে তিনি মট তৈরি করে সেটা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস শপিফাই এর কথা বলা যায়। ২০১৭ সালে শপিফাই এর রেভেনিউ ছিল ৬৭৩ মিলিয়ন ডলার, এবং তাদের পার্টনারদের রেভিনিউ ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
২০১৮ সালে রেভিনিউর দিক থেকে তারা এক বিলিয়ন ডলারের উপরে চলে গেছে।
তাদের ক্লোজ প্রতিদ্বন্ধী বিগ কমার্স ও মাজেন্টো। ২০১৭ সালে বিগ কমার্সের রেভিনিউ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার, এবং মাজেন্টোর ছিল ১৫০ মিলিয়ন ডলার। যা শপিফাই এর সাথে তুলনা করলে অনেক কম।
শপিফাই এর এই বেশি রেভিনিউ এর কারণ হল তাদের পার্টনারশিপ ইকোসিস্টেম। একজন শপিফাইয়ের মত ই কমার্স প্লাটফর্ম বানাতে পারবেন সহজে, কিন্তু তারা যে পার্টনারশিপ ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে এটা বানাতে পারবেন না। শপিফাই যা রেভিনিউ অর্জন করে, তাদের পার্টনারেরা তার চাইতে বেশি রেভিনিউ জেনারেট করে। পার্টনারেরাই শপিফাইকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিগ কমার্স ও মাজেন্টো পার্টনারশিপ ব্যবস্থায় এখনো যায় নি।
শপিফাইয়ের মট হল তার পার্টনারশিপ ইকো সিস্টেম।
ওয়ার্ডপ্রেসের মট হল তার প্লাগিন ডিরেক্টরি, এবং ওপেন সোর্স ব্যবস্থা। এই প্লাগিন ডিরেক্টরিতে অনেক অনেক ডেভলাপারেরা এবং কোম্পানিরা কাজ করছে, নিজেরা প্রফিট করছে। কিন্তু এটাই আবার ওয়ার্ডপ্রেসকে সিএমএস মার্কেটে শক্তিশালী করছে দিন দিন, বর্তমানে ইন্টারনেটের প্রায় ৩৩% ওয়ার্ডপ্রেস কন্টেন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে। এটি দিন শেষে ওয়ার্ডপ্রেসের বিজনেসকেই শক্তিশালী করছে ও অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করছে।
ইকোনমিক মট হল সেই কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ যা দীর্ঘস্থায়ী। ইন্ড্রাস্ট্রির উপর নির্ভর করে কয়েক বছর, কয়েক দশক, এমনকি কয়েক শতক পর্যন্ত কোন কোম্পানির মত বজায় থাকতে পারে।
ইনভেস্টরেরা প্রশস্ত ও টেকসই মট দেখে ইনভেস্ট করলে সে বিজনেস থেকে লম্বা সময় ধরে লাভ পেয়ে যান। এ নিয়ে এ বিষয়ের একজন এক্সপার্ট প্যাট ডর্সির বই আছে, নাম লিটল বুক দ্যাট বিলডস ওয়েলথ। নিচের ছবিটি সেই বই থেকে নেয়া। ছবিতে দেখানো হচ্ছে কীভাবে ইকোনমিক মট যুক্ত কোম্পানি দীর্ঘ সময় ধরে রিটার্ন দিয়ে যায়।
কোন ধরণের সেক্টরে কী ধরণের মট থাকে সাধারণত, এ নিয়ে ইনভেস্টমেন্ট রিসার্চ কোম্পানি মরনিংস্টারের রিসার্চ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আছে নিচের ছবিতে,
মর্নিংস্টারের রিসার্চ অনুযায়ী চার ধরণের মট সাধারণত দেখা যায়।
ল কস্ট প্রডিউসার – মানে আপনি কম্পিটিটরদের থেকে কম দামে বানাতে পারেন পণ্য।
হাই সুইচিং কস্ট – আপনার পণ্য একবার ব্যবহার করা শুরু করলে এটি ছেড়ে অন্য প্রোডাক্ট ব্যবহার করার কষ্টকর এবং ব্যয়সাপেক্ষ হলে। এটা আপনার জন্য বড় সুবিধা।
ইন্ট্যানজিবল এসেট – ব্র্যান্ড ভ্যালু, খ্যাতি, প্যাটেন্ট কপিরাইট ইত্যাদি।
নেটয়ার্ক ইফেক্ট – এটি হল যখন কোন মানুষ পণ্যটি বা সেবাটি ব্যবহার করে তখন অন্যদের কাছে এর ভ্যালু বেড়ে যায় এমন অবস্থা। যেমন ফেইসবুকের ক্ষেত্রে হয়েছে। ফেইসবুকের গুরুত্ব হল, এখানে আপনার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের একাউন্ট আছে। তারা ব্যবহার করছে। তারা না করলে (বা কেউ না করলে) কেবল আপনি ব্যবহার করলে এটি মূল্যহীন হত।
যেমন মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে। শুধু আপনার কাছে একটি মোবাইল ফোন আছে কিন্তু আর কারো কাছে নেই। এমন হলে আপনার মোবাইল ফোনের কোন ভ্যালু থাকে না (কথা বলাকে মূল উপযোগিতা ধরলে) । এটি দিয়ে কী করবেন? ভ্যালু বাড়তে থাকবে তত বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করতে থাকবে তত। অর্থাৎ ভ্যালু হয় ও বাড়ে নেটওয়ার্কে।
একটা কোম্পানি যদি নেটওয়ার্ক ইফেক্টের সুবিধা পেতে থাকে তাহলে তার জন্য এটি বিরাট সুবিধা হয়ে দেখা দেয়।
নেটয়ার্ক ইফেক্টের কারণে প্রোডাকশন কস্ট অল্প বাড়লেও ভ্যালু বেড়ে যায় অনেক বেশি। নিচের গ্রাফ থেকে জিনিসটা বুঝা যেতে পারে,
এন এফ এক্স ডট কমের রিসার্চ অনুযায়ী গত ২৩ বছরে টেক ইন্ড্রাস্ট্রিতে যত ভ্যালু এসেছে তার ৮০ ভাগ নেটয়ার্ক ইফেক্টের কারণে।
ব্যবসার ক্ষেতরে মট যেমন দরকারী দীর্ঘকালীন স্ট্যাবিলিটি ও প্রফিটের জন্য, ব্যক্তির জন্যও পার্সোনাল মট দরকারী।
এই মট হবে, নিজের ইউনিক যোগ্যতা ও স্কিলের সমন্বয়ে একটি সিস্টেম যেটি আপনাকে এগিয়ে রাখবে অন্যদের চাইতে কাজে।
এই জিনিশ, মানে এগিয়ে রাখা, যোগ্যতা ইত্যাদি শুনতে শ্যালো মনে হলে দুইটি লেখা পড়তে পারেন,
দুনিয়া আপনার কাছ থেকে নিতে চায়