কিছু প্রশ্ন এবং ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারি’র উত্তর

ইয়্যুবাল (বা জ্যুবল) নোয়াহ হারারি তার বই স্যাপিয়েন্স এবং হোমো দিউস লিখে বেশ সাড়া ফেলেছেন চিন্তাশীল লোকদের মাঝে। তিনি একজন প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদের মত মানবের ইতিহাস এবং তার ভবিষ্যত নিয়ে লিখেছেন। হারারি’র সহজে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তাকে দিয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তার পড়ালেখা তাকে দিয়েছে তুলনামূলক গভীর দৃষ্টিভঙ্গী। গার্ডিয়ান পত্রিকায় ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারি’র এই প্রশ্নোত্তরগুলি প্রকাশ হয়েছে ১৯ মার্চ ২০১৭ তারিখে। এখানে তাকে প্রশ্ন করেছেন পাঠক, লেখক, ইতিহাসবিদ সহ আরো অনেকে। হারারি এর উত্তর দিয়েছেন। এর মধ্য থেকে কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তর বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছি এখানে।

সহজভাবে বলতে গেলে এই উত্তরগুলিতে যেসব বিষয় এসেছে সেগুলি হলোঃ মাল্টিডিসিপ্লিনারি নলেজ এপ্রোচ বা কোন বিষয় যথাযথভাবে বুঝতে বিভিন্ন ফিল্ড থেকে বই পড়ার গুরুত্ব, মানবজাতির ক্ষমতার ভ্রান্তি, মানুষের গল্প তৈরী এবং এ সংস্লিষ্ট বিভ্রান্তি যা তাকে বাস্তবতা বুঝতে বাঁধা দেয়, প্রযুক্তিগত উন্নতিমূলক মানবের ভবিষ্যত, এনিম্যাল ফার্মিং ইত্যাদি বিষয় আছে; যা এই ব্লগের মূল বিষয়গুলির মধ্যে পড়ে।

 

#মানব জাতির সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা

“মানবজাতির নিজেরে নিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল ধারনাটি কী?” নাট্যকার লুসি প্রেবল এই প্রশ্ন করলেন লেখক, ইতিহাসবিদ ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারিকে।

হারারি উত্তর দিলেন “হয়ত এটাই যে বেশী ক্ষমতা আর পরিবেশের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করে আমরা আরো বেশী সফল আর সুখী হতে পারব এ ধারণা। আবার দুনিয়ার হাজার বছরের ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে দেখা যায়, আমরা প্রচুর প্রচুর ক্ষমতা অর্জন করেছি কিন্তু ক্ষমতা মনে হয় না সেগুলি লৌহ যুগের মানুষদের চাইতে আমাদের খুব বেশী তুষ্ট করতে পেরেছে।”

 

#মাল্টিডিসিপ্লিনারি এপ্রোচ

বিখ্যাত উদ্যোক্তা আরিয়ানা হাফিংটন জিজ্ঞেস করেন, “এটা স্পষ্ট যে আপনি কোন জিনিসের সবদিক তথা বড় চিত্রটি দেখে কথা বলেন, তো আপনার কাজের জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গীগুলি অর্জনের করতে আপনি কী করেন?”

হারারি উত্তর দিলেন, “আমি সব ফিল্ড, সব বিষয়ের উপর লিখিত প্রচুর বই পড়ি। আমি সাধারনত বড় প্রশ্ন নিয়ে শুরু করি, যেমন অতীতের চাইতে মানুষ এখন বেশী সুখী কি না, কেন সব মানব সমাজে পুরুষেরা নারীদের উপর কতৃত্ব করে এসেছে ইত্যাদি। এরপর আমি আমার নিজের উত্তরকে অনুসরন না করে প্রশ্নটাকেই অনুসরন করতে থাকি, এমনকী যদি এমন হয় আমি স্পষ্ট কোন তত্ত্ব তৈরী করতে পারছি না, তবুও।”

[পড়া নিয়ে এই ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত লেখা পড়ুনঃ বই পড়ে লাভ কী? ]

 

নোয়াহ হারারি

 

#আমাদের গল্প তৈরী জনিত বিভ্রান্তি

এন্ড্রু এনথনি, যিনি সঞ্চালক ছিলেন; জিজ্ঞেস করলেন,  “মেডিটেশন আপনার কী উপকার করে?”

হারারি উত্তর দেন,  “প্রধানত এটা আমাকে বাস্তবতা দেখতে সাহায্য করে। আমরা যখন সমাজকে, আমাদের নিজেদেরকে পর্যবেক্ষন করতে যাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক নানা ধরনের গল্প, ব্যাখ্যা তৈরী করে এবং সেই বাস্তবতার সাথে মিশিয়ে দেয়। ফলত আমরা বাস্তবতাকে দেখতে পাই না। যেসব গল্প, ব্যাখ্যা আমরা তৈরী করি বা অন্য লোকেরা তৈরী করে ও আমরা ওগুলি বিশ্বাস করি; সেই গল্প ও ব্যাখ্যাগুলি বাস্তবতা দেখতে আমাদের বাঁধা দেয়। মেডিটেশন আমার কাছে হলো কোনরূপ গল্প দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে বাস্তবতা যেভাবে আছে তাকে সেভাবেই দেখা।”

[এই বিষয় নিয়ে এই ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল গল্প বলা প্রানিটি নামক লেখা এবং ন্যারেটিভ ফ্যালাসি বা বর্ননাগত বিভ্রান্তি বিষয়ে আরেকটি লেখাও আছে। ]

 

#ভালো জীবন কাটানোর উপায়

একজন পাঠক গ্যারী বেকার প্রশ্ন করলেন, “একজন মানুষ যিনি ভালো জীবন কাটাতে চান এবং পৃথিবীতে অনাগত এবং আগত মানুষদের ভালো’র জন্য অবদান রাখতে চান, তাকে আপনি কী উপদেশ দেবেন?”

হারারি উত্তর দেন,  “নিজেকে আরো ভালোভাবে জানুন, জানুন জীবন থেকে আপনি সত্যি সত্যি কী চান। কারন অন্যথায় প্রযুক্তি মানুষকে চালনা করতে চায়, এবং প্রযুক্তি মানুষের লক্ষ্য পুরনের একটা বস্তু না হয়ে, মানুষকে তার লক্ষ্য পুরনের জন্য এক দাসে পরিণত করে। এবং জীবন থেকে আপনি সত্যি সত্যি কী চান তা জানাটা খুব কঠিন। আমি বলছি না তা খুব সহজ কাজ।”

আবার একই পাঠক জিজ্ঞেস করেন,  “আমরা যদি মৃত্যুকে পরাজিত করতে পারি তাহলে কি জীবনের অর্থ তৈরী করা সম্ভব হবে, যেমন সাউল বেলো বলেছিলেন, “আয়নাতে আমরা যদি কিছু দেখতে চাই তাহলে এর পেছনে কালো আস্তরনটা দরকার?”

হারারি উত্তরে বলেন,  আমার মনে হয়, হ্যাঁ আমরা পারব। যখন আমার বৃদ্ধ হওয়া জয় করে ফেলব তখন আরো অনেক সমস্যার উদয় হবে কিন্তু জীবনের অর্থশূন্যতার সমস্যা হবে না। শেষ তিন শতাব্দিতে পৃথিবীতে যত মতাদর্শ তৈরী হয়েছে প্রায় এদের সবক’টাই মৃত্যু নিয়ে মাথায় ঘামায় না, অথবা তারা এটা মনে করে না মৃত্যু জীবনের অর্থের উৎস। পূর্বের সংস্কৃতিতে, অর্থার পৃথিবীর মূল ধর্মগুলিতে জীবনের অর্থের জন্য মৃত্যু গুরুত্বপূর্ন। উদাহরনস্বরূপ, খ্রিস্টিয়ানিটিতে মৃত্যু ছাড়া জীবনের কোন অর্থ নেই। সব অর্থই আসে মৃত্যুর পর আপনার সাথে কী হবে এর উপর ভিত্তি করে। কিন্তু গত তিন শতাব্দিতে আমরা দেখলাম সমাজতন্ত্র, কম্যুনিজম, লিবারালিজম, ফেমিনিজম ইত্যাদি মতবাদের উৎপত্তি যেগুলিতে জীবনের অর্থ তৈরীর ক্ষেত্রে মৃত্যুর দরকার পড়ে না।

 

#শিকার-সংগ্রহ সমাজ বনাম আধুনিক কৃষিসমাজ

লেখক ও সাইকোথ্যারাপিস্ট ফিলিপ্পা প্যারী জিজ্ঞেস করেন, “শিকার-সংগ্রহের (হান্টার-গেদারার) সমাজ থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজে সরে আসা কি মানবজাতির জন্য ভুল ছিল? যদি হয়ে থাকে, আমরা কীভাবে এখন অবস্থার উন্নতি করতে পারি?”

হারারি উত্তরে বলেন,  “এটা নির্ভর করে আপনি কোন দিক থেকে দেখছেন তার উপর। আপনি যদি মিশরের ফারাও বা প্রাচীন চীনের সম্রাটের দিক থেকে দেখেন তাহলে এটা ছিল খুবই ভালো আইডিয়া। আবার যদি মিশরের কোন কৃষানী মহিলার দিক থেকে দেখেন তাহলে এটা বড় ভুল হয়েছে। স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত সমাজের দিক থেকে যদি দেখেন তাহলে এটা খুবই ভালো হয়েছে। আবার বাংলাদেশে মিষ্টির দোকানে দিনে বারোঘন্টা কাজ করা কোন শ্রমিকের দিক থেকে দেখলে তা খুবই বাজে হয়েছে মনে হবে।

সময়ের ঘড়িকে উলটাপথে চালনা করার সুযোগ নেই। আট বিলিয়ন লোক নিয়ে আবার শিকার-সংগ্রহের সমাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। এখানে মূল প্রশ্নটা হলো, কীভাবে আমরা বর্তমান অবস্থাকে সুবচেয়ে ভালো করতে পারি এবং কৃষিবিপ্লবের সময়ে যে ভুলগুলি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যেন না করে থাকতে পারি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) এবং জৈব প্রযুক্তি (বায়োটেকনোলজি) এর ক্ষেত্রে যে নতুন বিপ্লব তাতেও এই বিপদের সম্ভাবনা আছে যে, একটি ক্ষুদ্র সম্ভ্রান্ত লোকেরা সব ক্ষমতা ও সুফল একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিবে। এবং বেশীরভাগ মানুষই পূর্বের চাইতেও বেশী খারাপ অবস্থার মধ্যে পতিত হবে।”

 

#এনিম্যাল ফার্মিং এর অপরাধ

আরেকজন পাঠক জেসী রিজ প্রশ্ন করেন, “আপনি বলেছেন পশুখামার প্রক্রিয়া (এনিম্যাল ফার্মিং) হয়ত “সভ্যতার সবচেয়ে বড় অপরাধ”। এটি শেষ করতে সমাজের জন্য আপনার উপদেশ কী?”

হারারি’র উত্তর,  “আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় সুযোজ কোষভিত্তিক কৃষি বা নির্দোষ মাংস, যেখানে কোষ থেকে মাংস উৎপাদন করা হয় প্রাণী থেকে নয়। আপনি স্টিক চাইলে কোষ থেকেই স্টিক এর মাংস তৈরী করতে পারবেন, এর জন্য গরু পালন এবং তাকে হত্যা করতে হবে না। এটা হয়ত সাইন্স ফিকশনের মতো শুনাবে কিন্তু বাস্তবে এটা শুরু হয়ে গেছে। তিন বছর আগে ওরা প্রথম কোষ থেকে হ্যামবার্গার বানিয়েছে। এটা ঠিক তাতে খরচ হয়েছে ৩০০,০০০ ডলার কিন্তু প্রথম দিকে কোন প্রযুক্তিতে এমনটা হয়েই থাকে। কিন্তু এখন এই ২০১৭ সালে, আমি যতটুকু জানি এই ধরনের হ্যামবার্গারের দাম ১১ ডলারে নেমে এসেছে। এর সাথে জড়িত যারা আছেন, কাজ করছেন তাদের দাবী যথেষ্ট অর্থায়ন এবং যথার্থ গবেষনা হলে হত্যা করা প্রাণীর মাংসের চাইতে এইসব মাংসের দাম কমিয়ে আনতে পারবেন তারা, ১০ বছর বা এরকম সময়ের মধ্যে, সময়ের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না।

সুপারমার্কেট এবং ম্যাকডোনাল্ডে যেতে এখনো অনেক পথ পারি দিতে হবে একে কিন্তু এটাই একমাত্র কার্যকরী সমাধান আছে আমাদের। আমি নিরামিষাশী কিন্তু আমার মধ্যে এই বিভ্রান্তি নেই যে আমি পৃথিবীর বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে বুঝাতে পারব মাংস, দুধ ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য। কিন্তু আমরা যদি কোষ থেকে মাংস তৈরী করতে পারি, তাহলে তা দারুণ হবে। এর পরিবেশগত ভালো দিকও রয়েছে, আজকের দিনে পশুখামারের জন্য যেসব প্রচুর পরিবেশ দূষন হয়, এটি এইসব দূষন থেকেও আমাদের মুক্তি দিবে।”

 

#মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা মস্তিষ্ক

ইতিহাসবিদ বেথানি হিউজ জিজ্ঞেস করেন, “আধুনিক মস্তিস্ক বা বুদ্ধিমত্তা” শব্দটি আপনার কাছে অর্থবহ কি? যদি হয় তাহলে কখন থেকে এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার উদ্ভব হলো?

এর উত্তরে হারারি বলেন,  “বুদ্ধিমত্তা (মাইন্ড) নিয়ে আমরা খুব কম জানি।  এটা কি, এর কাজ করার প্রক্রিয়াটা কেমন, কীভাবে এর উদ্ভব হলো এসব নিয়ে আমরা জানি না। যখন মস্তিষ্কের বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরনগুলি বৈদ্যুতিক চার্জ নিঃক্ষেপ করে, তখন এর ফলে কীভাবে আমাদের ভালোবাসা, রাগ ইত্যাদি মানসিক অভিজ্ঞতাগুলি তৈরী হয়? এ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনাই নেই। যেহেতু আমরা এর সম্পর্কে খুবই কম জানি তাই এটা জানি না যে কীভাবে এবং কেন এর প্রথম উৎপত্তি হয়েছিল। পাথুরে যুগের শেষদিকে লাসকাউক্স এবং আলতামিরার গুহায় যেসব মানুষেরা ছবি এঁকেছিল তাদের মস্তিষ্ক এবং আমাদের মস্তিষ্ক মৌলিকভাবে একইরকম, এমন আমরা ধারণা করি। এবং আমরাও এও অনুমান করি নিয়েনডারথ্যালের মস্তিষ্ক আমাদের চাইতে আলাদা ছিল যদিও ওদের মস্তিষ্ক ছিল আমাদের চাইতে বড়। বর্তমানে যেসব তথ্য আমাদের কাছে আছে সেগুলি বুঝার জন্য অনেক অনেক কম।”