আঙুল মানুষের একটা ইন্টারেস্টিং জিনিশ। সাধারণত বিশজন আঙুল থাকেন মানুষের। এক হাতের পঞ্চ আঙুলের কথা ধরেন। এরা যেন আলাদা আলাদা পাঁচ জন লোক, তারা একসাথে বাস করেন। সাধারনত মানুষ এতই ব্যস্ত থাকে যে, আলাদাভাবে এই পাঁচ জনের খোঁজ নিতে পারে না। তখন তারা এই পাঁচ জনকে একজন হিশেবেই ধরে নেয়।
আলাদাভাবে কোন কারণে উল্লেখ করতে হলে তাদের আলাদা নাম ধরে ডাকা হয়। অন্যথায়, আঙুল নামেই একটা সমষ্টির মধ্যে তাদের রাখা হয়। প্রবাদে বলা হয়েছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ। কারো আঙুল ফুলে গলাগাছের সাদৃশ্য নিতে থাকলে, এইটা কখনোই সুখকর কোন অনুভূতি হবে না। কিন্তু প্রবাদের অর্থ, হঠাৎ ধনী হইছেন এমন ব্যক্তি। সেটা মানলেও এখানে স্পষ্ট করে বলা নাই, কোন আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখানে কিন্তু বিংশ আঙুল সমাজরে একটা আঙুল হিশেবে ধরে নেয়া হইছে।
হাতের পাঁচ আঙুল সমান না, এই প্রবাদে আঙুলদের নিজস্ব আলাদা অস্তিত্ব, তাদের ব্যতিক্রমতা তুলে ধরে মানুষের ব্যতিক্রমতা ইত্যাদির কথা বলা হইছে । এই প্রবাদে পঞ্চ আঙুলের আলাদা অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হইল। এবং স্বীকার করা হইল তাদের আলাদাত্বের কথা। গুরুত্বপূর্ন বিষয়, এই আলাদত্ব বেশিরভাগ সময়ে দৃষ্টগোচর হয় না মানুষের কাছে, অথবা মানুষেরা এইটাকে এত গুরুত্ব দিয়া নিতে চায় না।
আঙুল নামে বিংশ আলাদা আলাদা আঙুলদিগকে এক করিয়া দেখা, মানুষ বলে পুরা মানবজাতিরে এক করিয়া দেখার মত কি? না, কারণ মানুষ বলে পুরা মানবজাতিরে সেই হিশাবে এক করিয়া দেখা হয় না। আলাদা জাতি, আলাদা গোষ্টি ইত্যাদি ভাগ বিভাজন থাকলেও ব্যক্তি হিশাবেও মানুষরে আলাদা কইরা দেখা হয়। হাতের পঞ্চ আঙুল সমান না, এই কথার মাধ্যমে মূলত আলাদা মানুষের আলাদত্বই বুঝানো হয়, আঙুল এইখানে রূপক মাত্র।
মানুষেরা নিজেদের মধ্যে একটা ভাগ করে, “আমরা” এবং “তারা” বলে। এইটা এক কমপ্লিকেটেড ভাগ বিভাজন। কারণ আমরা’ ভাগে যাদের রাখা হয় তাদের সবাই একইরকম নাও হইতে পারে চিন্তায় বা আদর্শে। একইভাবে ‘তারা” সবাই একইরকম নাও হইতে পারে। ফলে এই ধরনের জেনারাইজড ভাগ বিভাজন একটা সমস্যাসংকুল বিষয়।
জ্যাক দেরিদা এনিম্যাল বলে পশুদের ভাগ কইরা ফালানোটাকে মনে করেন ঠিক না। কারন একটা কুত্তা, একটা চামচিকা, একটা ছাগল, একটা বিলাইর বাচ্চা পরস্পর থেকে কত আলাদা। তাদের এই বিরাট আলাদত্ব একটা হিশাবে আনার মত বিষয় । জেনারাইজড ভাবে এদের এনিম্যাল শ্রেণীতে রাখা মানুষদের তাদের প্রতি করা অন্যায়, এমনকী তাদের খাওয়া ইত্যাদিরে উৎসাহীতই করে।
একইভাবে আঙুলদের ক্ষেত্রেও হইতে পারে। অথবা হাত বা পদযুগল। হস্তরা যে দুইজন আছেন তারা কিন্তু এক না। পদরাও আলাদা। ডান হস্ত এবং বাম হস্ত তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়া আছেন। তেমনি ডান পদ এবং বাম পদ পরষ্পর হইতে আলাদা।
আঙুলেরাও আলাদা আছেন। ছোট আঙুল যেইটা আছেন ডাইন হাতে, আমরা তারে কনি আঙুল বলি। ছোট বেলায় এই আঙুলের সমান উচ্চতার এক লোকের গল্প শুনতাম। যে বিভিন্ন অদ্ভুত কর্মকান্ড কইরা বেড়াইত এবং তার মায়ের দুঃখ ঘুচাইত। তার মা ছিলেন রাজার ছোট বউ। ছোট বউয়ের ঘরে কনি আঙুলের সমান বাচ্চা হইলে রাজা তারে বনবাসে পাঠাইয়া দেন। এই বাচ্চা পরে বড় হয়, সেই আমাদের নায়ক। বিভিন্ন ভাবে সে তার বীরত্ব দেখাইয়া যাইত। পরে সে রাজকন্যারে বিয়া করে। এরকম কিছু একটা ছিল গল্পে, পুরা মনে নাই।
এইসব আঙুলের আলাদত্ব বুঝা যায় কোন একজন আঙুল যদি আহত হন। একজন আঙুল অল্প কেটে গেলে হঠাৎ কইরা যেন তিনি আলাদা হইয়া পড়েন। হাতের নড়াচড়ায় কিংবা নড়াচড়া না করা অবস্থাতেও তিনি তার আলাদা অস্তিত্ব জানান দিতে থাকেন।
বিংশ আঙুল যারা আছেন তাদের দিয়া নানাবিদ গুড এবং ব্যাড কর্ম করা হয়। এর মাঝে একটা আছে মিডল ফিংগার দেখানি, এবং দেখাইয়া বলা ফাক ইউ। এইটা ইংরাজ কালচার, সেই কালচার ইংরাজদের এককালীন প্রজা ও তাদের সন্তানাদির মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। ১৪১৫ সালে এজিনকোর্টের যুদ্ধে ফ্রেঞ্চ আর ইংরাজ হইছিল মুখামুখি। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ফ্রেঞ্চরা ভাবছিল জিতে যাবে। তারা ঘোষনা দিছিল তারা যুদ্ধে জিতবে এবং অতঃপর সকল চুদিরভাই ইংরাজ সৈন্যদের মধ্য্যাঙ্গুলি কাইটা ফেলবে। যাতে ইংরাজরা প্লাক গাছ হইতে তৈরী তাদের বিখ্যাত ধনুক দিয়া তীর ছুড়তে না পারে। উল্লেখ্য যে ইংরাজরা ঐ তীর ছোড়ায় বিখ্যাত ছিল।
সেই যুদ্ধে ইংরাজরা পঞ্চম হেনরীর নেতৃত্বে জয়ী হয়। এবং জিতার পরে তারা ফ্রেঞ্চদিগকে মধ্যাঙ্গুলি দেখাইয়া বলছিল, দেখো চুদির ভাইয়েরা, আমরা এখনো তোমাদিগকে প্লাক করতে পারি। প্লাক ইউ।
এইটা মিডলফিংগার দেখানি রীতি বা ইয়ের একটা ইতিহাস।
ফিংগার দেখাইয়া অপমান করার যে রীতি বা ইয়ে আগে দেখতাম সেইটা ছিল বুড়া আঙুল দেখাইয়া বলা, ইউ আর মাই বাল। মনে হয় এইটার প্রমিত শুদ্ধতা বুড়া আঙ্গুল দেখাইয়া বলা, কচু।
বাল বা কচু এইখানে তুচ্ছতা অর্থে। বুড়া আঙুলরে তাই এইখানে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হইত সম্ভবত। কিন্তু ফেইসবুকের কল্যানে এখন সেই বুড়া আঙুল হইছে থাম্বস আপ। মানে ধরেন, সাবাশি বা ওকে।
জেনারেশনের পরিবর্তনে, সময়ের যাতাকলে, প্রযুক্তির বলে এইভাবে একই জিনিসের অর্থও বদলে যাইতে থাকে কখনো কখনো। এইটা এক লক্ষণীয় বিষয়।
বাম হাতের চতুর্থ আঙুলে বিয়ার আংটি পড়ানি নাকী রীতি। এই রীতির কারণ হিশাবে বলা হয়, হার্ট থেকে একটা শিরা নাকী সরাসরি চইলা আসছে এই চতুর্থ আঙুলে। এই শিরার নাম ভেনা এমোরিস, বা ভেইন অব লাভ। প্রাচীন রোমানরা এই অদ্ভুত তত্ত্ব বাইর করছিল। যাদের হার্ট লুতুপুতু লাভে চুবানো থাকে তারা এইটা বিশ্বাস করেন মে বি। এই যে একটা শব্দ লুতুপুতু, ব্লগে অনেক ব্যবহার হইছে। আমি ভাবছিলাম এইটা মনে হয় নয়া শব্দ। এইরকম কোন শব্দ বাংলায় আছে বা ছিল কী না, তা জানার আগ্রহ হইছিল। পরে যখন বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়তেছিলাম তখন দেখলাম তিনি এই ধরনের লাভরে বলছেন পুতুপুতু লাভ। আধুনিক লুতুপুতু সম্ভবত সেই পুতুপুতু থেকেই আসছে। যাহাই হোক, দুই শব্দই এক বিশেষ ধরনের লাভরে ব্যঙ্গ করতে ইউজ হইয়া থাকে।
হাতের চতুর্থ আঙুলে বিয়ার আংটি পড়ানোর রীতি লইয়া চাইনিজদের থিওরী আরো ইন্টারেস্টিং। তাদের কথা হইল হাতের একেকজন আঙুল একেকটা জিনিস নির্দেশ করেন। যেমন বুড়ি আঙুল আপনের ফাদার মাদার, এর পরের আঙুল ভাই বইন, এর পরের আঙুল মানে মিডল ফিংগার হইলেন আপনে, এরপরেরটা, মানে যেইটাতে বিয়ার রিং পড়ানি হয় সেইটা আপনের বউ বা জামাই, এর পরের আঙুল, কড়ে বা কনি আঙুল হচ্ছেন আপনার কিউট সন্তানাদি।
চাইনিজ তত্ত্বমতে মিডল ফিঙ্গার নিচা কইরা দুই হাত এক করবেন। বুড়া আঙুল অপর বুড়া আঙুলের লগে, কড়ে আঙুল কড়ের লগে এইভাবে মিলাইবেন। এরপরে মিডল ফিংগার দুই সংযুক্ত রাইখা অন্য আঙুল গুলা সরানির ট্রাই করবেন। দেখবেন বুড়া আঙুল, কড়ে আঙুল, পয়লা আঙুল ইত্যাদি সহজে আপনে সরাইতে পারবেন, কিন্তু রিং ফিংগার দুই সরাইতে পারবেন না।
এর দ্বারা কি বুঝা গেল? বুঝা গেল একসময় আপনি মা বাপের লগে থাকতে পারবেন না, আলাদা ঘর সংসার হইবে আপনার, মা বাপরে ছাড়তে হইবে। অতঃপর একসময় আপনার সন্তানাদিও আপনারে ছাইড়া যাবে, তাদের ঘর সংসার হইবে। আপনার ভাই বনের লগেও আপনে একসাথে থাকতে পারবেন না সারাজীবন। খালি রিং ফিংগার তথা জামাই বা বউই সারাজীবন আপনার লগে থাকবেন।
এইটাই বুঝাইতে চায় এই পরীক্ষা, যদিও এর যৌক্তিকতা নিয়া চিন্তা করলে হতাশই হইতে হবে। এইটা সত্যি হইলে বিবাহ বিচ্ছেদ কীভাবে এর দ্বারা ব্যাখ্যায়িত হবে তা ভাবার বিষয়।
বুড়া আঙুল বা থাম্বস ফিংগার কী না এই নিয়া বিতর্কও আছে। বুড়া আঙুল অন্য চাইরজন আঙুলের মত নন। তিনি আলাদা। মানবজাতির প্রকৃতিই হইল আলাদা কিছুরে গ্রহণ করতে না চাওয়া। ডিবেট ওআরজি জনপ্রিয় বিতর্ক বিষয়ক একটি ওয়েবসাইট যেখানে কোন জনপ্রিয় বিতর্কের পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য করা যায়। সেই সাইটে বুড়া আঙুলকে আঙুল বলার পক্ষে আছে ৬৩ ভাগ ভোট, বাকী ৩৭ ভাগ এর বিরুদ্ধে। এনাটমিক্যালি বুড়া আঙুলকে আঙুলের দলে রাখতে হলেও, অন্য আঙুল হইতে উনার আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য তারে আঙুল হইতে আলাদা রাখার পক্ষের মতও বেশ শক্তভাবেই উপস্থাপিত হয়।
বুড়া আঙুলের গঠনগত চরিত্র ভিন্ন হওয়ার কারণে তারে আলাদা রাখার প্রয়াস। একইভাবে অন্যান্য আঙুল যারা আছেন তাদের দিকে তাকাইলেও ভিন্নতা চোখে পড়বে। গঠনগত ভাবে একইরকম হইলেও কড়ে আঙুল কখনো মধ্যাঙুল নন, বা মধ্যাঙুল কখনো রিং ফিংগার হবেন না। তারা চেহারা এবং কাজে কর্মে আলাদা। তাদের এই আলাদত্ব বুঝতে পারা আমাদের তাদের আলাদা অস্তিত্ব সম্পর্কে আরো সচেতন কইরা তুলতে পারে মনে হয়।
এই সচেতনতা আমাদের সামগ্রিক সচেতনতার জন্য দরকারী। একেকজন আঙুল, তাদের কার্যকলাপ ইত্যাদি আলাদাভাবে বুঝতে পারা, তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করে দিতে পারে। এর ফলস্বরূপ তাদের প্রতিটি অস্তিত্বের প্রতি আমাদের আলাদা দায়িত্ব নিয়ে আমরা ভাবতে পারব, যেটা জেনারালাইজ ধারণায় সম্ভব নয়।
আঙুলদের দিয়া মানুষ যেইসব কাজকর্ম করেন এর মাঝে একটা হইল সিগারট খাওয়া। আঙুল দিয়া কীভাবে একজন সিগারটকে ধরেন তা থেকে তার সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝা যাইতে পারে বলে জানাইছিলেন লস এঞ্জালসের একজন সাইকোএনালিস্ট ডক্টর উইলিয়াম নিউট্রা। তিনি তার প্যাশেন্টদের উপর পরীক্ষা করেন, তাদের সিগারট ধরা পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর, মহিলাদের দু ধরনের সিগারট ধরা আর পুরুষদের সাত ধরনের ধরা বিষয়ে তার বক্তব্য পেশ করেন ১৯৫৯ সালে ক্যাপার নামের এক ম্যাগাজিনে। তিনি বলেছেন এইটা খালি পুরুষদের বেলায় প্রযোজ্য। মহিলাদের ক্ষেত্রে এইটা তেমন কাজ করে না। ডক্টর সাহেবের সাইকোএনালিসিস নিচে চিত্রের মাধ্যমে প্রদত্ত হইল।
আঙুল শিল্পে, বিশেষত মূর্তিতে কেমন হবে তা ভারতের হিন্দুশাস্ত্রীয় শিল্পকারেরা ঠিক করে দিয়াছিলেন। অবন ঠাকুর তার ভারতশিল্পে মূর্তিতে উল্লেখ করেছেন প্রাচীন শাস্ত্রে আছে মূর্তির আঙুল হবে শিম্বীফলম। অর্থাৎ, শিম বা মটরশুটির ফলের মত।
আরেকটি শিল্পকীর্তিতে দুইজন লোকের আঙুল বিখ্যাত ও তাৎপর্যপূর্ন। ইতালিয়ান শিল্পী রাফায়েলের রেনেসাকালীন সময়ের কীর্তি ফ্রেসকো আর্ট স্কুল অব এথেন্সে প্লেটো এবং এরিস্টটলের আঙুলেরা। এই ফ্রেসকোতে প্লেটোর আঙুল দেখানো হয়েছে উপরের দিকে। তিনি আসমানের দিকে আঙুল রাইখা কিছু নির্দেশ করতেছেন। আর তার ছাত্র এরিস্টটল তার হাত তথা আঙুল দিয়া পৃথিবীর তথা ভূমির দিকে নির্দেশ করতেছেন। দুইজনের হাতেই আছে তাদের নিজেদের লেখা বই। প্লেটো এবং এরিস্টটলের দর্শনের পার্থক্য এইভাবে দেখাইছেন রাফায়েল। ভাববাদী প্লেটোর উপরের আঙুল এবং বাস্তববাদী এরিস্টটলের ভূমির দিকে আঙ্গুল বা হাত। ফ্রেসকো থেকে নেয়া নিচের ছবি।
আঙুলদের নিয়া এই লেখাটা এখন শেষ করতে হয়। লেখাটাও টাইপ করা হইতেছে আঙুলদের সাহায্যে। পয়লা আঙুল যিনি আছেন ডান হাতের, আমার ক্ষেত্রে তিনিই বেশী পরিশ্রম করেন লেখা টাইপের ক্ষেত্রে। স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক খালি এই আঙুল দিয়াই লেখেন। আর কোন আঙুল ব্যবহার না কইরা। আমি মূলত এই আঙুল আর বাম হাতের বুড়ি আঙুল, এই দুইজনকে ব্যবহার করি।