আমাদের তল্লাটে প্রথম যেদিন বান্দর দেখা যায় সেইদিন ছিল কাঠফাটা রৌদ্রের দিন। আমরা সেদিন ভাবতেছিলাম এত গরম পড়ে কেন? কেউ কেউ ভাবতেছিল এই গরমে সৌদি আরবের কী অবস্থা, আর কেউ কেউ নিজেদের জীবনের লগে মাছের জীবনের তুলনা কইরা ভাবতেছিল মাছ হইয়া জন্ম নেয়া বড় ভালো ছিল।
আমরা ঘামতে ঘামতে একে অন্যের দিকে তাকাইয়া গল্প করতেছিলাম। আমাদের মাথার উপরে ছিল এক বিশাল আসমান। সেই আসমানের রঙ তখন নীল এবং তাতে স্থির হইয়া দাড়াইয়া আছে কিছু সাদা মেঘখন্ড। আমাদের গল্পের বেশিরভাগ জুইড়া ছিল গরম, ঘাম এবং জাগতিক বিভিন্ন দীর্ঘশ্বাস, তাই আমরা যখন হতাশ হইয়া পড়তেছিলাম খুব বেশি, তখন আমরা আসমানের দিকে তাকাইতেছিলাম। সেই আসমানের রঙ বা মেঘ আমাদের মনে কোন অনুভূতির সৃষ্টি করল না, আমরা কেবল আসমানের গনগনে চুলার মত উত্তপ্ত সূর্যরে শত্রু ভাইবা তার দিকে পরাজিত সৈনিকের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাইতেছিলাম। আমাদের ঘামের মধ্য দিয়া লবন এবং পানি বাইর হইয়া যাইতেছে এমন কথা বললেন আমাদের এলাকার একমাত্র ডাক্তার ডাঃ মোবারক আলী, এম বি বি এস। তিনিও আমাদের লগে আইসা খাড়াইছিলেন। কারন ঘরের মধ্যে প্রচন্ড গরম।
আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলল, ডাক্তার সাব, গরমে বাইর হইতেছে, আমরা কী করুম?
ডাঃ মোবারক আলী , এম বি বি এস তখন তার ডাক্তারি সুরে আমাদের বললেন, লবন পানি বের হইয়া গেলে পানিশূন্যতা দেখা দিবে। গরমে আমাদের হিট স্ট্রোকও হইতে পারে। তিনি আমাদের বললেন, স্যালাইন খাইতে।
আমাদের মধ্য থিকা একজন উইঠা কইল, স্যার আমগো ত ডায়রিয়া হয় নাই।
ডায়রিয়ার কথায় এলাকার প্রধান গলিতে উপস্থিত লোকেরা, মানে আমরা সবাই হো হো কইরা হাইসা উঠি। আমরা কেন হাইসা উঠি এর কোন ব্যাখ্যা নাই। ডাক্তার সাবও হাসেন আমগো লগে।
তিনি তার দুই হাত নাইড়া আমাদের বুঝাইয়া দেন, পানিশূন্যতা কী জিনিশ।
তার বর্ননা মুগ্ধ হইয়া শুনতে শুনতে আমরা অবাক হইয়া যাই এইটা চিন্তা করে যে দুনিয়ার কত কিছু আমরা জানি না। আমাদের মনে হইতে থাকে ডাক্তার না থাকলে আমরা সবাই হিট স্ট্রোক বা পানিশূন্যতায় মারা যাইতাম। ডাক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমাদের মন ভারী হইয়া উঠে এবং এর জন্য আমরা দুশ্চিন্তা অনুভব করি। কারন প্রকৃতিগভাবে আমরা অকৃতজ্ঞ জীব বিশেষ।
ডাক্তার স্যালাইন বানানির পদ্বতি আমগো সামনে তুইলা ধরলেন। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ছেলে মোফাজ্জ্বল চট কইরা স্যালাইন বানানির প্রক্রিয়া ধইরা ফেলে এবং ধরামাত্রই স্যালাইন তৈরী করতে দৌড় দেয় তার বাড়িতে।
আমরা এতে ভীত হইয়া পড়ি। আমাদের ধারনা হয় যে হয়ত মোফাজ্জ্বল একা একাই স্যালাইন বানাইয়া খাইয়া ফেলবে এবং সে একাই এই গরমে পানিশূন্যতা আর হিট স্ট্রোক থিকা বাইচা যাবে। আর আমরা স্যালাইনের অভাবে গরমের আধিক্যে মইরা যাব।
আমরা মরতে চাই না। আমরা বাঁচতে চাই। তাই আমরা সবাই মিলে মোফাজ্জ্বলের বাড়ির দিকে হাটা দিলাম এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তার বাড়িতে পৌছে গেলাম।
আমাদের হাঁকডাকে মোফাজ্জ্বল বের হইয়া আইসা বলল, আপনেরা?
আমরা কইলাম, দেখো মোফাজ্জ্বল, তুমি ভালো পোলা। আমরাও ভালো লোক। আমরা একই এলাকায় হাজার বছর ধইরা আছি। আছি না কও?
মোফাজ্জ্বল মাথা নাইড়া বলল, জ্বি। আছি।
আমরা কইলাম, মোফাজ্জ্বল এখন গরম পড়ছে। গরম বাড়তেই আছে। আমাদের মধ্যে ভয় ঢুইকা গেছে এই গরম বাড়তেই থাকব। দুনিয়া হাবিয়া দোজখে পরিণত হইবার প্রাথমিক স্টেজে আছে। এই ব্যাপারে তোমার কী মত?
মোফাজ্জ্বল চোখ বড় বড় কইরা বলল, আপনাদের মতই আমার মত।
আমরা মোফাজ্জ্বলের কথায় খুশি হইলাম। আমরা তারে বললাম, মোফাজ্জ্বল, ডাক্তারের স্যালাইন বানানির পদ্বতি আমরা বুঝি নাই। আমাদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। এত জটিল জিনিস বুঝার ক্ষমতা। তুমি আমগো এলাকার গর্ব। তুমি বুঝতে পারছো। এখন আমাদের স্যালাইন খাওয়াও।
মোফাজ্জ্বল এই কথা শুইনা যেন আৎকে উঠল। সে লাফ দিয়া দুই হাত পিছনে সইরা গিয়া কইল, এইডা কী কন? এত লোকরে আমি স্যালাইন খাওয়ামু ক্যাম্নে?
আমরা মোফাজ্জ্বলরে বললাম, ক্যাম্নে খাওয়াইবা কী! বানাইয়া খাওয়াইবা।
মোফাজ্জ্বল হতাশ হইয়া তাকায়। সে বলে তার কাছে এত লোকের জন্য লবন, গুড় ও পানি নাই। আমরা কইলাম এইটা কোন সমস্যাই না। আমরা সবাই চান্দা তুইলা হাজার হাজার টাকা জড়ো করলাম। মজিদ মিয়ার দোকান থিকা অনেক অনেক গুড় ও লবণ কিইনা আনা হইল।
তারপর বড় বড় ডেগ আইনা তাতে টিউবওয়েল চাইপা বিশুদ্ধ পানি ভরা হইল। অতঃপর ক্যালকুলেটরে হিশাব কইরা কইরা আমাদের এলাকার সবচেয়ে মেধাবী পোলা মোফাজ্জ্বল ডেগ গুলাতে লবন আর গুড় দিতে লাগল। তারপর বড় বড় চামচ দিয়া কয়েকজন মিইলা একেকটা ডেগে নাড়তে শুরু করল। মোফাজ্জ্বল বলতেছিল, খিয়াল রাখবেন লবন গুড় যেন ভালো কইরা মিশে।
মোফাজ্জ্বলের বাড়ির উঠান অনেক অনেক ডেগে পূর্ণ হইয়া উঠল। সব ডেগে স্যালাইন। আসমানে উত্তপ্ত সূর্য। আমরা যখন মোফাজ্জ্বলের উঠানে স্যালাইন রেডি করতেছিলাম তখন উপরে তাকাইয়া মাঝে মাঝে সূর্যরে দেখতেছিলাম। এইবার আমাদের দৃষ্টি ছিল প্রবল শত্রুর প্রতি মহা মারণাস্ত্র প্রস্তুত করতে থাকা যোদ্ধার মত।
এত এত পানির ডেগ জড়ো হইছিল যে সব গুলাতে লবন গুড় ঢালতে আর নাড়তে নাড়তে আসরের আযান পইড়া গেল। জহীরুদ্দিন গলা খাকারি দিয়া কইলেন, চলেন মুসল্লীরা, ভালোকাজের আগে নামায পইড়া আসি।
আমরা কইলাম ঠিক আছে। আমরা সবে মিইলা মসজিদের দিকে গেলাম। অন্য ধর্মের যারা ছিল, যেমন নরেশ, হরিচরন চৌধুরী এরা মোফাজ্জ্বলের ঘরে বইসা ফ্যানের বাতাস খাইতে লাগলেন।
আমরা নামায পইড়া আইলাম। তখন আমরা মনে মনে সুখী ছিলাম। কারণ পানিশূন্যতা কিংবা হিটস্ট্রোক আমাদের কিছু করতে পারবে না।
আমরা হাটতে হাটতে মোফাজ্জ্বলের বাড়ির সামনে আসলাম। আইসাই আমরা অবাক হইয়া গেলাম। হাজার হাজার বান্দর আমাদের ডেগ গুলাতে মুখ দিয়া স্যালাইন খাইতেছে। কেউ কেউ লাফাইয়া পড়তেছে পানিতে। আমরা টের পাইলাম কারা যেন আমাদের ভিতরটারে ছুরি দিয়া কাইটা ফেলতেছে। আমরা লাঠিসোটা নিয়া বান্দর তাড়াইতে গেলাম। কিন্তু তারা ছিল সংখ্যায় প্রচুর। তারা এক বিরাট দল হইয়া আমাদের সামনে আইসা দাড়াইল। তাদের সংখ্যাধিক্য দেইখা আমরা আগাইতে সাহস পাইলাম না। আর আমাদের চোখের সামনে আমাদের তৈরী লবন গুড়ের স্যালাইন একেবারের শেষ ফোটা পর্যন্ত খাইয়া বান্দরেরা “ক্যাচ ক্যাচ” করতে করতে লাফাইয়া লাফাইয়া চাইরদিকে গাছ বিরিক্ষিতে ছড়াইয়া পড়ল। সেই দিন থিকা আমাদের তল্লাটে বানরেরা আমাদের সাথে বসবাস করে আসতেছে।