সাম্প্রতিক যেইসব ফিল্ম দেখা হইল এদের বিষয়ে সামান্য। স্পয়লার না দিয়া আলোচনার চেষ্টা করা হইছে তাই কাহিনী বিশেষ পাওয়া যাবে না।
A Touch of Sin
Jia Zhangke
চীনের ক্যাপিটালিজমকে স্লোভানিয়ান চিন্তক স্ল্যাভো জিজেক বলেন, ‘ক্যাপিটালিজম উইথ এশিয়ান অথোরিটি।’ পশ্চিমা ক্যাপিটালিজমে যে স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি অল্প অল্প দেখা যায়, চীনে তাও নাই। এ টাচ অব সিন ফিল্মে আধুনিক চীনের চারটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। চারটিতেই ভায়োলেন্স আছে, যাকে বলা যায় একেবারে টরান্টিনো স্টাইলের ভায়োলেন্স। পরিচালক জিয়া জেং চীনের সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন এই ফিল্মের মাধ্যমে। ফিল্মের নির্মান এবং কাহিনীগুলো ইন্টারেস্টিং। চীনের সেন্সরবোর্ড ফিল্মটাকে আটকে দিয়েছে, সম্ভবত তার সামাজিক-রাজনৈতিক সমালোচনার জন্য।
এইটা খুবই উপভোগ্য ফিল্ম। ভালো, চমৎকার।
বাংলাদেশে সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট আইলেন। ব্যাপক টাকা ঋণ সহায়তা এবং চীনা কর্পোরেশন এই দেশে ইনভেস্ট করবে এমন শোনা যাচ্ছে। এটা হইতে পারে কারণ চীনে শ্রমের মূল্য আমাদের দেশের শ্রমের মূল্যের চাইতে অনেক বেশী। এবং চীনে শ্রমিকদের অবস্থাও তত ভালো না। যার একটা উপস্থাপন আছে এই এ টাচ অব সীন ফিল্মে।
Touch of Evil
Orson Welles
কাহিনীর শুরু মেক্সিকান-আমেরিকান এক বর্ডার শহরে। ফিল্মের শুরুতেই একটি গাড়ি বিস্ফোরন হয়। বিখ্যাত শেরিফ হানক কুইনলান সেখানে আসেন এবং মত দেন বিস্ফোরন হয়েছে ডিনামাইটের মাধ্যমে। মেক্সিকান ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অফিসার মাইক ভার্গাস ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল, সে ভিন্ন মত জানাল। এতে শেরিফ অসন্তুষ্ট হলেন। যেহেতু মেক্সিকান বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে আমেরিকার মাটিতে তাই ভার্গাসও এই কেইসে জড়িত হয়ে পড়ল। শুরু থেকেই শেরিফ কুইনলান এবং মাইক ভার্গাসের প্রতিদ্বন্ধীতা শুরু হয়ে যায়।
কুইনলান ক্যারেক্টারে অভিনয় করছেন অরসন ওয়েলস। তিনিই পরিচালক, কাহিনিও লেখছেন আরেকজনের সাথে মিলে। আমার মনে হইছে ফিল্মের প্রধান চরিত্র (ভিলেন+নায়ক) হিশাবে শেষপর্যন্ত তিনিই থাকেন। আমেরিকান ডার্ক মিস্ট্রি, ক্রাইম নয়ার ফিল্মে এইটারে একটা কাল্ট ক্লাসিক ফিল্ম বলে ধরা হয়।
Wazir
Bejoy Nambiar
একশন ধর্মী এই থ্রিলারখানা মোটামোটি। শুরুর দিকে একটা রোমান্টিক আবহ তৈরী করা হইছে এবং শেষপর্যন্ত এইটা রাখা হইছে, যা ফিল্মের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। সাসপেন্সের লগে এই ধরনের হালকা রোমান্সের ভাব না থাকা ভালো মনে হয়। ফারহান আখতার একজন এন্টি টেরোরিজম স্কোয়াডের অফিসার দানিশ আলী। তিনি ফিল্ম শুরু হইতে হইতে বিয়া করেন, তাদের সুন্দর নাচা গানা ফ্যামিলি হইয়া যায়। এক মেয়েও হয়। কিন্তু ফিল্মি জগতের নিয়ম, হ্যাপী ফ্যামিলিতে আসতে হবে দুর্যোগের অমানিষা।তাই, একদিন টেরোরিস্টদের সাথে গোলাগুলির এক পর্যায়ে দানিশ আলীর মেয়ে নিহত হইয়া যায়।
আর পন্ডিতজি হইলেন বুড়া গ্র্যান্ড মাস্টার অমিতাভ বচ্চন। তারো আছে এক প্রতিশোধ স্পৃহা। দানিশ আলীর লগে তার ফ্রেন্ডশীপ হয় দাবা খেলতে খেলতে।
ফিল্মে ওয়াজির চরিত্রে দারুণ অভিনয় করছেন নীল নিতিন মুকেশ। মূলত তার জন্যই এই ফিল্ম আমার দেখা। সেইদিন ইউটিউবে হঠাৎ এক ভিডিও দেখলাম। কোন এক ফিল্মের পুরস্কার বিতরনীর। শাহরুখ খান আর সেফ আলী, নীল নিতিন মুকেশের নাম নিয়া ফাইজলামি করছিল ফান কইরা। এতে মুকেশ প্রতিবাদ জানায় উইঠা। এমন সাধারণত দেখা যায় না উঠতি বা নয়া নায়কদের কাছে। যেহেতু শাহরুখ এরা হইল বলিউডের পাওয়ারফুল। মু্কেশের এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে। তাই তার মুভি সার্চ দিতে গিয়া ওয়াজির পাইলাম আর দেখলাম। ভালো অভিনয় করেন তিনি, দেখতেও ভালো।
ওয়াজির তথা উজির বিষয়ক একটি গল্প, এটি আরবিক উইজডম নামক বই থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছি। এই পোস্টে উজিরের কথা এলো যখন তাই যুক্ত করলাম। ফিল্মের সাথে তার সংযুক্তি নাই অবশ্য।
এক সুলতানের ছিল এক সৎ উজির। সে ত্রিশ বছর ধরে সুলতানের সেবা করে আসছে নিষ্ঠার সাথে। তার সৎ স্বভাবের জন্য কিছু লোক তার শত্রু হয়ে উঠল। তারা সুলতানের কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে লাগল।
একসময় সুলতান অভিযোগকারীদের বশে চলে গেলেন। তিনি ভাবলেন ওদের অভিযোগ সত্য। তিনি উজিরকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করলেন।
তখন প্রাণদন্ড হতো, সুলতানের হিংস্র কুকুরদের খাঁচায় দন্ডিত ব্যক্তির হাত পা বেঁধে ছেড়ে দেয়া। কুকুরেরা শরীরের অংশ খুবলে নিত।
উজিরকেও খাঁচার সামনে নেয়া হলো। তখন উজির বলল, আমার একটা শেষ অনুরোধ সুলতান। আমাকে দশ দিনের সময় দিন। আমার কিছু পাওনাদার আছেন। তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। আমার বাচ্চাদের জন্য অভিভাবক ঠিক করতে হবে। আমাকে মাত্র দশ দিন সময় দিন।
সুলতান উজিরের কথায় রাজী হলেন। তাকে দশ দিনের সময় দেয়া হল।
উজির তার বাড়িতে গিয়ে সঞ্চয়ের একশো স্বর্ণমুদ্রা নিল এবং তা দিল সুলতানের কুকুর রক্ষণাবেক্ষনকারীকে। দিয়ে বলল, এই দশ দিন কুকুরগুলিকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমাকে দিন।
কুকুরের রক্ষণাবেক্ষনকারী এতে সম্মত হল।
উজির দশদিন পরম মমতার সাথে কুকুরদের দেখাশোনা করল। দশ দিন শেষ হল। শাস্তির দিনে উজিরকে বেঁধে খাঁচায় নিক্ষেপ করা হলো সুলতানের সামনে।
কিন্তু দেখা গেল কুকুরগুলি তাকে আঘাত করছে না। বরং তার পাশে এসে লেজ নাড়ছে। এতে অবাক হয়ে সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী উজির?
উজির তখন বলল, সুলতান, ওদের আমি মাত্র দশদিন ভালোভাবে সেবা করেছি। তাই তারা আমার সাথে এমন আচরন করছে। আর আপনাকে আমি ত্রিশ বছর নিষ্ঠা ও সততার সাথে সেবা করে গেছি। আর আপনি আমার সাথে কী আচরন করছেন? আমার শত্রুদের কথায় আপনি আমাকে প্রাণদন্ড দিয়েছেন।
উজিরের কথায় সুলতান নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি উজিরকে মুক্ত করেন এবং পুরস্কৃত করলেন। আর মিথ্যা অভিযোগকারীদের শাস্তি দেন।
Elite Squad
José Padilha
ব্রাজিলের বস্তি, ড্রাগ, গ্যাং এবং স্পেশাল পুলিশ ফোর্স বিওপই এর কাহিনী। ইন্টারেস্টিংলী এইখানে ড্রাগ ট্রাফিকারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আছেন ওয়াগনার মোওরা, নারকোজ সিরিজের পাবলো এস্কোবার। বিওপিই এর অফিসার হিসেবে তার অভিনয় অসাধারন। দারুন এক অভিনেতা। ফিল্মে সব সময় একটা উত্তেজনা বিরাজ করে, ড্রাগ ট্রাফিকারদের বিরুদ্ধে এলিট ফোর্সের প্রস্তুতি, যুদ্ধ ইত্যাদি। ব্রাজিলের ড্রাগ ভায়োলেন্স নিয়ে বানানো ফিল্ম সিটি অফ গড যাদের ভালো লেগেছে, নারকোজ দেখে যাদের পাবলো এস্কোবারের অভিনয় ভালো লেগেছে, তাদের এই ফিল্মও ভালো লাগার কথা।
Kikujiro
Takeshi Kitano
তাকেশী কিতানোর সবচেয়ে বিখ্যাত ফিল্ম ইয়াকুজা মাফিয়া ড্রামা সোনাটাইন (১৯৯৩)। সেইখানে মাফিয়া বস মুরাকাওয়া চরিত্রে তার অভিনয় অসাধারন। মাফিয়া বস হিশেবে যত অভিনেতা বিভিন্ন ফিল্মে অভিনয় করেছেন তার মাঝে কিতানোর এই চরিত্র আলাদা এবং বিশেষত্বের দাবী নিয়ে অবস্থান করছে। কিতানোর এই ফিল্ম, তথা কিকুজিরো (১৯৯৯) একটি টাচি ফ্যামিলি ড্রামা। এক ছোট বালক সামার ভ্যাকেশনে তার মাকে খুঁজতে বের হয়। যে মায়ের কেবল ছবি আছে তার কাছে। তার সঙ্গী হয় মধ্যবয়স্ক, জুয়ারী কিকুজিরো। তাকেশী কিতানো কিকুজিরো চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং এই চরিত্রের অনুপ্রেরণা তিনি নিয়েছেন তার বাবার কাছ থেকে। তার পিতার নাম ছিল কিকুজিরো। জুয়ারী ছিলেন এবং পরিবার চালাতে হিমশিম খেতেন ভদ্রলোক।
Carnage
Roman Polanski
এইটা এক রুমের ভিতরে কথাবার্তামূলক ফিল্ম। এই ধরনের ফিল্ম ভালো লাগে। টুয়েলভ এংগ্রি ম্যান বা ধরেন মাইন্ডওয়াক। অথবা ডিনার উইথ আন্দ্রে। এইগুলাতে চরিত্রসংখ্যা থাকে কম। তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে গল্প দর্শকেরা বুঝতে পারেন। উত্তেজনা তৈয়ার হয়। এই ফিল্মের কাহিনী দুই পোলায় ঝগড়া করে। একজন আরেকজনরে আহত করে ফেলে। মাইর দেওয়া ছেলের মা বাপেরা যান মাইর খাওয়া ছেলের মা বাপের বাসায় বিষয়টা নিয়া কথা বলতে, একটা সমঝোতায় আসতে। তাদের কথোপকথন আস্তে আস্তে ভিন্ন রূপ নেয়। রোমান পোলানস্কির ফিল্ম একটু স্লো ভাবে শুরু হয়। কিন্তু উত্তেজনা তৈয়ার ও ধইরা রাখেন তিনি। জোডি ফস্টার ছিলেন এই ফিল্মে। অভিনয় ভালো, ডায়লগ ভালো তাই দেখতে ভালো লাগছে।
কারনেজ শব্দের অর্থ হইল বিপুল সংখ্যক মানুষরে হত্যা করা। পোলানস্কি খুব সহজে একটা জটিল বিষয়রে উপস্থাপন করতে চাইছেন, রূপকে। তলস্তয় বলছিলেন, যখন কোন অপরাধী অপরাধ করে তখন সে দুইভাবে ভাবেঃ
এক- সে কোন অপরাধ করে নাই
দুই- সে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় ছিল তাতে সে যা কাজ করছে তা করাই যায়।
এইভাবে সে একটা জাস্টিফিকেশন তৈয়ার করে। তার ভিতরের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে। এবং এই ধরনের চিন্তা তারে আরো অপরাধে যুক্ত হইতে বাঁধা দেয় না। নিজের দোষ স্বীকার না কইরা অন্য একটা ব্যক্তি বা বস্তুর উপরে দোষ দেবার যে প্রবণতা এটারে তলস্তয় এফেক্ট বলা যাইতে পারে। এই তলস্তয় এফেক্টের কারণে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারে না এবং অন্যায়, অপরাধ কইরা যাইতে থাকে। এস ক্ষেত্রে সে যদি অন্যরে দোষারূপ না কইরা ভাবত, অপরাধবোধে ভুগত তাইলে অন্তত সে পরবর্তীতে অপরাধ করতে যাইবার আগে ভাবত দুইবার।
Gaslight
George Cukor
গ্যাসলাইট একটা ইন্টারেস্টিং থ্রিলার ড্রামা। হিচককিয়ান থ্রিলার বলা যাইতে পারে একে। ফিল্মের শুরুতে একটা খুন হয়। একজন বিখ্যাত অপেরা গায়িকা খুন হন লন্ডনে তার বাড়িতে। তিনি তার বইনের মেয়ে পলারে নিয়া থাকতেন। তিনি খুন হবার পর পলা চলে যান ইতালি। সেইখানে তার সাথে পরিচয় হয় এক ভদ্রলোকের। পরিচয় পরবর্তী প্রেম। অতঃপর বিয়া। বিয়ার পর তারা দুইজনায় ফিরে আসেন লন্ডনে, সেই বাড়িতে যেইখানে খুনটা হইছিলেন। এই বাড়ি নিয়া ভয় কাজ করত পলার মনে, এইখানেই তিনি তার প্রিয় খালার মৃতদেহ দেখছিলেন। কেউ যেন তারে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে। এই বাড়িতে উঠে আসার পরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে পলার সাথে। ঘটনা আগাইয়া যাইতে থাকে। আর গুরুত্বপুর্নভাবে এর সাথে জড়িত হইয়া পড়তে থাকে গ্যাসলাইট। ভালো ফিল্ম।
শজারুর কাঁটা
শৈবাল মিত্র
শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের কাহিনী নিয়া বানানো হইছে ফিল্ম। এইখানে দেখানো হইছে ব্যোমকেশ বুড়া হইছেন। ব্যোমকেশের বন্ধু অজিতও বুড়া। ব্যোমকেশের বউ সত্যবতীও বুড়া। এইসময়ে শহরে আইল এক ভয়ানক খুনী। সে শজারুর কাঁটা দিয়া খুন কইরা বেড়াইতে লাগল। গল্পে আছে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটক, তিনকোনা এক প্রেম; কিন্তু মূল যে ব্যোমকেশ সেই যেন নাই নাই। তবে রহস্য আছে, সেটাতে ব্যোমকেশের ভূমিকা নাই বলেই মনে হয়। অতি নাটকীয়তা আছে ব্যোমকেশের কথাবার্তায়, মনে হয় এই ধরনের গোয়েন্দা ক্যরেক্টার নিয়া বাংলা যা ফিল্ম হয় তার মাঝে একমাত্র শবর দাশগুপ্তই নাটকীয়তামুক্ত।
স্লো, তবে ভালোই লাগছে দেখতে। খুনের টাইমে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখানো হইছে। মানে সেই সাইকো যখন খুন করেন রাইতে, তখন ইলেক্ট্রিক তার ইত্যাদিতে দেখা যায় রাশি রাশি কাউয়ারা বসে আছেন। এই জিনিসটা ভালো লাগছে। প্রতিবার এইরকম একটা অবাস্তব জিনিস দেখাইয়া ফিল্মের বাস্তবতার ভিতরে এক অবাস্তবতা, ধরেন পরাবাস্তবতার ইঙ্গিত যেন।
কৌশিক সেনের অভিনয় ভালো। তিনি কোন বাংলা গোয়েন্দা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করলে ভালো হবে।