জাল্লো শব্দের অর্থ হলুদ। এক ধরনের ইতালিয়ান ফিল্ম এবং সাহিত্য ধারা। পোস্ট ফ্যাসিস্ট ইতালিতে পেপারব্যাকে কিছু মার্ডার মিস্ট্রি বই বের হত যেগুলোর কভার ছিল হলুদ। সেখান থেকেই জাল্লোর আগমন।
এই হলুদ কভারের বইগুলো সাধারণত ইংলিশ বিভিন্ন মার্ডার মিস্ট্রির অনুবাদ ইত্যাদি ছিল। আগাথা ক্রিস্টি, র্যামন্ড চ্যান্ডলার (সম্পর্কিত তথ্যঃ হারুকী মুরাকামি চ্যান্ডলারের বড় ভক্ত। চ্যান্ডলারের দ্য বিগ স্লীপ নিয়ে মুভিতে মূল গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হামফ্রে বোগার্ট।), এডগার ওয়ালেস এদের বইগুলোর অনুবাদই ছিল প্রথমে হলুদ কভারে। ১৯২৯ সালের দিকে এসব বই প্রকাশ করা শুরু করেছিল ইতালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনী মোনাডরি। এগুলো প্রকাশিত হত পেপারপব্যাকে এবং দাম ছিল কম। সুতরাং, তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এরপর আরো বিভিন্ন প্রকাশনী মৌলিক এরকম বই প্রকাশ করতে থাকে। গড়ে উঠে জাল্লো বা হলুদ সাহিত্য ধারা। তখন জাল্লো অর্থই হয়ে যায় মার্ডার মিস্ট্রি জাতীয় থ্রিলার।
এরপর এগুলোর শুরু হল ফিল্মায়ন।
ইতালিয়ান দর্শকদের কাছে যেকোন ধরনের মার্ডার মিস্ট্রি জাতীয় থ্রিলারই জাল্লো। কিন্তু বাইরের দর্শকদের কাছে ইতালিয়ান ধাঁচের মার্ডার মিস্ট্রি গুলোকেই বলা হয় জাল্লো।
এই জাল্লো ফিল্মের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমনঃ
১। গথিক ডার্ক হরর
২। সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলারের উপাদান
৩। ভায়োলেন্ট, ডার্ক থিম
৪। হিচককীয়ান টেনশন, সাসপেন্স
প্রথম জাল্লো ফিল্ম হিসেবে ধরা হয় দ্য গার্ল হু নিউ টু মাচ (১৯৬৪)কে। এটা পরিচালনা করেছিলেন মারিও বাভা। এই ফিল্মকে পুরোপুরি জাল্লো বলা না হলেও বলা হয় জাল্লোর কিছু উপাদান এর মধ্যে আছে। এছাড়া মারিও বাভার ব্ল্যাড এন্ড ব্ল্যাক লেইস একটি ভালো জাল্লো ফিল্ম হিসেবে পরিচিত।
এই হলুদ ফিল্ম ধারার ক্ষেত্রে আরেকজন বড় পরিচালক হলেন ডারিও আরজেন্টো। তিনি অনেক জাল্লো ফিল্ম নির্মান করেছেন। তাকে বলা হয় ইতালিয়ান হিচকক। বলা যায় জাল্লো ফিল্ম আধুনিকতার স্তরে যায় তার হাত ধরেই। ডারিও আর্জেন্টোকে পরে অনেক জাল্লো ফিল্ম পরিচালক অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন এবং তার ব্যবহার করা আধুনিক উপাদানগুলো ব্যবহার করেছেন।
তার ফোর ফ্লাইজ উইথ গ্রে ভেলভেটে (১৯৭১) দেখা যায় একজন ড্রামারকে ফলো করে একটা অদ্ভুত লোক। ড্রামার মানে মিউজিক্যাল ব্যান্ডে ড্রাম বাজায়। ড্রামারের মনে সন্দেহ হয়। অদ্ভুত লোকটা কেন ফলো করছে তাকে? ড্রামার লোকটার পিছু নেয়। তাদের ধ্বস্তাধ্বস্তি হয় এবং এক পর্যায়ে যে লোকটি অনুসরন করছিল সে মারা যায় ড্রামারের হাতের চাকুর আঘাতে। ঘটনাটি ঘটে একটা গ্যালারিতে। দেখা যায় পুতুলের মুখোশ পড়া এক লোক ছবি তুলে নেয় পুরো ঘটনার। মূল চরিত্র অর্থাৎ ড্রামারও তা দেখতে পায়।
তারপর সেই পুতুলের মুখোশধারী আমাদের ড্রামার ভদ্রলোককে ব্ল্যাকমেল করতে থাকে।
এটাই ছিল আমার দেখা প্রথম জাল্লো। মোটামোটি ভালো লেগেছে। তবে টুইস্টটা খারাপ ছিল না।
দ্বিতীয় দেখা জাল্লো ছিল ডারিও আরজেন্টোর দ্য বার্ড উইথ ক্রিস্টাল প্লুমেজ (১৯৭০)। এটা পরিচালকের প্রথম ছবি হলেও এই ছবিটি আগেরটা থেকে বেশি ভালো লেগেছে। এই ফিল্মের মাধ্যমে জাল্লো ফিল্ম একটা আধুনিক স্তরে প্রবেশ করে। এই ফিল্মে ক্রাইমগুলো যথেষ্ট ভায়োলেন্ট ছিল। ফিল্মটিতে দেখা যায় নায়ক ভদ্রলোক একজন আমেরিকান। তিনি একজন লেখক। তার মডেল গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বাস করেন ইতালির রোমে।
তিনি আমেরিকায় ফিরবেন কয়েকদিন পর। এরমাঝে রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে দেখলেন এক অদ্ভুত ঘটনা। এক ভদ্রমহিলা আর এক ভদ্রলোক ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। কাচে ঘেরা একটা গ্যালারির ভেতরে। তিনি অনেক দূরে ছিলেন। রাস্তার অন্যপাশে। তাই ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি দেখতে না পেলে আমাদের তথা নিরীহ দর্শকদেরও দেখার উপায় নেই। শুধু দেখা গেল ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে কালো কোট এবং হ্যাট পড়া লোকটা ভদ্রমহিলার পেটে হালকা ছুরি মেরে পালাল।
নায়ক ছুটলেন গ্যালারির দিকে। গিয়ে দেখলেন ভেতরে যাবার উপায় নেই। কাচ দিয়ে ঘেরা। মহিলা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।
নায়কের উছিলায় পুলিশ আসল তাড়াতাড়ি। মহিলাকে নেয়া হল হাসপাতালে। কিন্তু পুলিশ লেখক নায়ককে নিয়ে গেল থানায়। হালকা জিজ্ঞাসাবাদের পর তার পাসপোর্ট রেখে দিল। কারণ শহরে একইভাবে অনেক খুন হচ্ছে কিছুদিন ধরে। সব ক্ষেত্রেই সুন্দরী ভদ্রমহিলারা। এবং খুনগুলো একেবারে ভয়ংকর প্রজাতির।
প্রথনে পুলিশ তাকে হয়ত সামান্য সন্দেহ করেছিল। তিনি হয়েছিলেন সামান্য বিরক্ত। কিন্তু তারপর পুলিশের সন্দেহ তার উপর থেকে চলে যায়। নায়ক এই রহস্য উদঘাটনে লেগে যান। তাকে রহস্য সমাধানের নেশায় পেয়ে বসে।
এইভাবেই কাহিনী এগিয়ে যায়। কাহিনীতে বড় ধরনের টুইস্ট বিদ্যমান। জাল্লো হিসেবে ক্লাসিক।
ডারিও আরজেন্টোর ডিপ রেড আদর্শ জাল্লো হিসেবে সমাদৃত। এখানে নায়ক থাকেন একজন জাজ পিয়ানিস্ট এবং মিউজিক শিক্ষক। একজন সাইকিককে খুন করে যায় কালো পোষাক পরিহিত এক অদ্ভুত ব্যক্তি। তিনি ঘটনাক্রমে ভায়োলেন্ট ক্রাইম দেখে ফেলেন। এবং এর রহস্য উদঘাটনে লেগে যান। জাল্লোতে খুনিদের পোষাকগুলো থাকে কালো, হাতে গ্ল্যাভস, হ্যাট ইত্যাদি। আরজেন্টোর ফিল্মে দেখা যায় নায়কেরা সরাসরি গোয়েন্দা না। অন্য পেশার লোক যে রহস্য সমাধানে লেগে যায়। এইজন্য সাসপেন্স বেশি তৈরী করতে পারেন লেখক এবং পরিচালক। কারণ এই রহস্য উদঘাটনকারীরা ভুল করেন এবং সেটাই স্বাভাবিক।
ডিপ রেড ফিল্মে ভায়োলেন্স এগুলো সময় নিয়ে দেখানো হয়েছে। খুব ভালো টুইস্ট আছে। মিউজিকের ব্যবহার করা হয়েছে অনেক। ফিল্মের ডায়লগগুলোও খারাপ না। যেমন একটা ডায়লগ ভালো লেগেছে, নায়ককে তার মাতাল পিয়ানিস্ট বন্ধু বলে,
“You know what Marc? The difference between you and me is purely political. You see, we both play rather well. But I am the proletarian of the pianoforte. While you are the bourgeois. You play for the sake of art and you enjoy it. I play for living. It’s not the same thing. ”
আরেকটা মুভির কথা বলা যায়। ফরবিডেন ফটো অফ এ লেডি এভাব সাসপিশন। এর পরিচালকের নাম লুসিয়ানো এরকোলি। এটাও জাল্লো হিসেবে ভালো এবং এতেও ভালো টুইস্ট বিদ্যমান। জাল্লোর আরেকটি উপাদান সেক্সুয়ালিটি এই ফিল্মে আছে বেশ ভালোভাবে।