ফ্রেইলটিঃ আধ্যাত্মিকতার সমস্যা?

ফ্রেইলটি ২০০২ সালের একটি আমেরিকান থ্রিলার ফিল্ম। এর গল্প বেশ ইন্টারেস্টিং। একজন বাবা তার দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। তাদের বেশ সুখী পরিবার। এরমাঝে একরাতে বাবা স্বপ্নে দেখেন ঈশ্বরের পক্ষ থেকে এঞ্জেলরা এসে তাকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন। তাকে মনোনীত করা হয়েছে মানুষরূপী কিছু ডেমন ধ্বংশ করার জন্য।

দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলের এতে বিশ্বাস হয় না। সে মনে করে তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। তার মধ্যে ঈশ্বরে অবিশ্বাস তথা বিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ছোট ছেলে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝেই ঈশ্বরের নির্দেশে তাদের ডেমন হত্যা চলে।

আধ্যাত্মিকতার সমস্যা নিয়ে স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেকের একটা বক্তব্য আছে ইউটিউবে। দ্য এবিস অব স্পিরিচুয়ালিটি নামে। সেখানে তিনি স্পিরিচুয়ায়িটি কীভাবে একজন ভালো লোকের দ্বারা খারাপ কাজ করাতে পারে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। নাৎসীদের বস হেইনরিখ হিমলার ভাবল তার সেনাদের দ্বারা এত হত্যা, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মানুষ মারা ইত্যাদি কীভাবে করানো যায় যাতে তারা নিজেরা দানবে পরিণত না হয়। এইজন্য সে সাহায্য নেয় ভগবত গীতার। গীতার কাহিনীতে এক সময় অর্জুনের মধ্যে দ্বিধার উদ্ভভ হয় যে তিনি এত এত লোকের মরনের কারণ হবে যে যুদ্ধ তা করবেন কি না। তখন গড কৃষ্ণ তাকে বুঝিয়ে দেন এই জাগতিক সবকিছু নশ্বরতা সম্পর্কে। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়। এই কাহিনীর যুদ্ধে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব ছিল, যা হিমলারকে সহায়তা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ হত্যায়।

frailty

 

আধ্যাত্মিকতার এই সমস্যা মারাত্মক। ফ্রেইলটি ফিল্মের প্রধান চরিত্র যে বাবা, মিস্টার মিকস, তাকে খারাপ মানুষ বলা যাবে না তার দিক থেকে দেখলে। সন্তানের প্রতি তার মমতা আছে। সে মানুষ খুন করে না। তার মতে সে ঈশ্বরের নির্দেশে ডেমন ধ্বংশ করে।

ডেনিশ ফিলোসফার সোরেন কীর্কেগার্ড আব্রাহামিক রিলিজিয়নের অনেক কাহিনীকে তার লেখায় মেটাফোর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো আব্রাহামের নিজের পুত্র আইজাককে ঈশ্বরের নির্দেশে উৎসর্গ করতে যাবার ঘটনা। ফ্রেইলটি ফিল্মে এই ঘটনারও উল্লেখ আছে। মিস্ট্রার মিকসকে তার ঈশ্বরও বলেন তার বড় ছেলে ফিন একজন ডেমন, তাকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু এখানে মিকস পুত্রস্নেহের কাছে পরাজিত হন এবং পুত্রকে হত্যা না করে তাকে সংশোধন করতে চান। এখানে তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব খুব বেশি প্রাধায় পায় নি যেমন পেয়েছিল নোয়াহ-তে। নোয়াহতে এই টেনশনটাই গুরুত্বপূর্ন ছিল, নোয়াহ’র নাতনীদের প্রতি মমতা একদিকে, অন্য দিকে ঈশ্বরের নির্দেশ।

যাইহোক, মিস্টার মিকসের কাছে ঈশ্বর হতে আসা নির্দেশের ব্যাপারে কিন্তু একটি প্রশ্ন রয়ে যায়, এই নির্দেশ আসলে ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে না শয়তানের কাছ থেকে এসেছে তা কীভাবে বুঝা যাবে?

এর একটা উত্তর হতে পারে, ঈশ্বর দয়ালু। তিনি চাইবেন না কেউ তার পুত্রকে উৎসর্গ করুক। অল্ড টেস্টামেন্টের আব্রাহামকেও ঈশ্বর তার পুত্র আইজাককে উৎসর্গ করতে দেন নি।

ফ্রেইলটিতে তাই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না মিস্টার মিকসের কাছে ঈশ্বরেরই নির্দেশ এসেছে। কিন্তু তবুও তার দিক থেকে সে কীভাবে দেখছে তা না বুঝে কিছুই বলা যায় না। স্বাভাবিক নৈতিকতার দিক থেকে মিস্টার মিকসের এই হত্যাযজ্ঞ কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এরকম কাল্ট পৃথিবীতে অনেক আছে এবং এর অনেকগুলোই তাদের কর্মকান্ডের জন্য কুখ্যাত। এর একটি আত্মহত্যাপ্রবণ সিক্রেট কাল্ট অর্ডার অব দি সোলার টেম্পল নিয়ে লিখেছিলেন ব্লগার ইমন জুবায়ের। বাংলাদেশেও এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। যা নিয়ে  নাসিমা সেলিমের একটি গবেষণা প্রবন্ধ আছে। ২০০৭ সালে বাবা আদম নামে এক ব্যাক্তির পরিবারের নয়জন সদস্য একসাথে অদ্ভুতভাবে আত্মহত্যা করেছিল। বাবা আদম এক নতুন অদ্ভুত ধর্ম তৈরী করেছিল যা তার পরিবারের সদস্যরা মানত। তাদের একসাথে আত্মহত্যা তখনকার সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছিল। আমার গ্যাডফ্লাই বইয়ের এক উপকাহিনীতে এর ছায়া আছে। ফ্রেইলটি ফিল্মের ঘটনার সাথে বাবা আদমের ঘটনার বেশ সাদৃশ্য বিদ্যমান।

ফ্রেইলটিতে ভিকটিমরা সবাই যার যার ক্ষেত্রে অপরাধী। তাদের সেই অপরাধের শাস্তিদাতার ভূমিকায় অবতীর্ন হওয়া মিস্টার মিকস ও তার ছেলেরা যে কথিত ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করছেন, তাকে পুরা ভাওতা বা মানসিক সমস্যা বলে ফিল্মে উড়িয়ে দেয়া হয় নি।

জটিলতা ধরে রাখা হয়েছে। খোলাসা করে দেয়া হয় নি মিকস পরিবারের বিশ্বাসের সত্যতা বা অসত্যতা সম্পর্কে।

বাইরে থেকে বা সহজভাবে দেখলে একে ধর্মের ক্রিটিক বলে মনে হবে। কিন্তু আমার মনে হয় এখানে ধর্মের ক্রিটিক করা হয় নি। বিশ্বাসের একটা রূপ তুলে ধরা হয়েছে শুধু। ক্রিটিক হত যদি মিস্টার মিকসকে একজন মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো হত। ফিল্মে তা করা হয় নি।

এখানে মিস্টার মিকস এবং তার ছেলেদের দৃষ্টিকোন থেকে তাদের বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দেখানো হয়েছে। এবং এর ভয়াবহতাও। যুক্তি দিয়ে সরাসরি এই ধরনের বিষয় কেন ডিল করা যাবে না তারও উপস্থাপনের প্রয়াস বলা যায় ফিল্মটাকে।