পৃথিবীর প্রায় সব এলাকাতেই তলোয়ারের প্রচলন ছিল। বিখ্যাত যুদ্ধাস্ত্র। ছোটবেলায় কাঠের তরবারি বানাইয়া যুদ্ধ টুদ্ধ করেছি অনেক। তবে কিছু তরবারি কেন বাঁকা আর কিছু কেন সোজা, এইটা ভাবি নাই আগে।
এই ব্যাপারে আমার আগ্রহ হইল গতকাল রক মনুর একটা কথার সূত্রে, কেন ইসলামিক তলোয়ার বাঁকা হয়।
প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়েছিল চান তারার প্রভাব।
যাইহোক, এই বিষয়ে এক্ষণে যা বুঝতে পারলাম তা সংক্ষেপে বর্ননা করছি।
১। তেরা অর্থাৎ বাঁকা সোর্ড ভালো না সোজা সোর্ড ভালো এ নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। যেহেতু পশ্চিমে সোজা সোর্ডের প্রচলন ছিল বেশী তাই তাদের অনেকে মনে করে সোজা সোর্ড সেরা। আর যেহেতু মুসলিম-ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীতে তেরা সোর্ড বেশী প্রচলন ছিল, তাই তারা মনে করে তেরা সোর্ড সেরা। দুই পক্ষকে যারা “অউন” করেন বলে মনে করেন তারা নিজেদের দাবী নিয়ে তর্ক করেন।
২। আসলে ইউরোপেও তেরা সোর্ডের প্রচলন ছিল (কম হয়ত)। মুসলিম এবং ইন্ডিয়াতেও কম সোজা সোর্ডের প্রচলন ছিল। ক্লাসিক পিরিয়ডে সবাই সোজা তরবারিই ব্যবহার করতো। আব্দুল মালিকের স্বর্নমুদ্রায় তার হাতে সোজা তরবারি আছে। তবে মিশরে নিড়ানির মত একটা তরবারি ছিল। সেটা হাতল থেকে কিছু অংশ সোজা এবং তার পরে আর্কের মত গোলাকার অংশ। মনে হয় গলা কাটার জন্য এটি ব্যবহার করা হইত। রামেসিস তিন তার এক শত্রুকে এই রকম তরবারি দিয়া মারতেছেন এমন খোদাই চিত্র আছে। সেখানে তার শত্রু তার চাইতে আকারে ছোট। মনে হয় শাস্তি দেবার জন্য বা পরাজিত শত্রুরে এই ধরনের তরবারি দিয়া মারা হইত। কারণ এর আকৃতি যুদ্ধের উপযুক্ত না।
৩। তেরা সোর্ড মূলত ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করার জন্য ভালো ছিল। লম্বা ক্ষত তৈরী করার জন্য সহায়ক। ঘোড়ার পিঠে আত্ম্ররক্ষার জন্য ভালো। পক্ষান্তরে সোজা সোর্ড সরাসরি বিদ্ধ করার জন্য সহায়ক ছিল। সোজা সোর্ড বাঁকা সোর্ডের চেয়ে লম্বা তাই অপেক্ষাকৃত দূর থেকে আঘাত হানতে সক্ষম।
৪। অটোমান তুর্কী মধ্যপ্রাচ্যে আর্মিতে বাঁকা সোর্ডের প্রচলন হয়ত সোজা সোর্ডওয়ালা শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। মনে করা যেতে পারে সান জুর আর্ট অব ওয়ার তাদের পড়া ছিল। সেখানে সান জু’র বলেছেন যুদ্ধের সফলতার ধোঁকার উপর নির্ভর করে। এক সংস্কৃতির লোকেরা আরেক সংস্কৃতির লোকের সাথে যুদ্ধে নামলে খালি দক্ষতা দিয়াই যুদ্ধ হইত না। এর সাথে ভয় তৈরীর জন্য নানাবিদ পন্থাও অবলম্বন করা হতো। বাঁকা তরবারি এরকমই একটা জিনিস হয়ত।
“ইংরেজি ‘ডিসেপসন’ শব্দের অর্থ ধোঁকা, প্রতারনা অথবা ছলনা। বাইজান্টাইন রোমানদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুখের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ ইয়ারমুখ প্রান্তরে পশ্চিম দিকে মুখ করে পজিশন নিয়েছিলেন। এইটারে বলে ‘পজিশনাল এডভান্টেজ’ বা অবস্থানগত সুবিধা। এর ফলে সকাল থেকে দুপুর অবধি প্রতিপক্ষ বাইজান্টাইনদের চোখে সুর্য পড়ত, ফলে দূর থেকে তারা মুসলিম আর্মির সঠিক সংখ্যা ঠাহর করতে পারতনা। উপরন্তু খলিফা ওমর নির্দেশ দিলেন যেন প্রতিদিন সকালের দিকে মুসলিম সেনারা ছোট ছোট দলে কিন্তু ঢাক ঢোল পিটিয়ে খালিদের আর্মিতে যোগ দেয়। ফলে বাইজান্টাইনরা ভাবতে লাগল যে প্রতিদিনই মুসলিম শিবিরে না জানি কতশত নতুন সেনা যোগ দিচ্ছে। ব্যাপারটা সামান্য হলেও এর ইম্প্যাক্ট অনেক বড়, কেননা বাইজান্টাইন ভাবনা বাইজান্টাইনদেরই ক্রমশ ফ্রাস্ট্রেটেড করে তুলছিল। এই জাতীয় ট্রিক কেই বলে ডিসেপসন। আর সানজু বলেন, “সব যুদ্ধই ডিসেপসন নির্ভর।”
– আর্ট অব ওয়ার, সান জু; অনুবাদঃ ডি এইচ খান। সূত্র- সামহোয়াইন ব্লগ।
৫। দ্বিমুখি ধারযুক্ত সোর্ডও প্রচলিত ছিল, এর দ্বারা দুইদিকে কাটা যাইত। যুদ্ধে প্রথমে তীর দ্বারা এক পশলা বৃষ্টি বর্ষনের পরেই মনে হয় তরবারি হাতে নায়কেরা ছুটে যাইতেন। সেক্ষেত্রে দ্বিমুখী ব্লেডের তরবারি ভালো হবে। দুই দিকেই মারতে থাকা, অত দেখাদেখির কি আছে, এরকম মনোভাব। দ্বিমুখী তরবারি অবশ্য বাঁকা তরবারির চাইতে অনেক আগের। সব শেষের সংযোজন মনে হয় বাঁকা সোর্ড। তার আদি পিতা হিসেবে মিশরের মাথা বাঁকা তরবারিকে ধরা যায়।