বাঙালী কেমন বিদ্রোহী?

ইতিহাসে আমরা পড়েছি বাংলাকে ডাকা হতো বিদ্রোহ নগরী। কারণ এখান থেকে প্রায়ই বিদ্রোহ হতো। ফলে একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এ অঞ্চলের মানুষেরা বীরত্বকামী, পরিশ্রমী, সাহসী ও স্বেচ্ছাচারী স্বাধীন।

বিদ্রোহী বলতে ঋণাত্মক ভাবে স্বেচ্ছাচারী উছৃঙ্খলতাও বুঝায়। মোগল বা দিল্লী দরবারের ইতিহাসে এই অর্থেই বাংলাকে বিদ্রোহ নগরী বলা হতো, ধনাত্মক কোন অর্থে নয়।

কিন্তু ইতিহাসের এই বয়ান স্বত্তেও আমরা এতদঞ্চলের লোকদের চরিত্র দেখি অলস প্রকৃতির। তেমন সাহসী বা বীরাকাঙ্খীও নয়। বরং ইতিহাসে বা বর্তমানেও দেখা যায় এরা রাজ্যানুগত। তাহলে, এখানে বিষয়টা কী? কেন এইসব নিরীহ টাইপের লোকের গায়ে বিদ্রোহী বা উচ্ছৃঙ্খল তকমা জুটেছিল?

বাদশা জাহাঙ্গীর বাংলার শেষ বিদ্রোহী পাঠানরাজ ওসমানকে আত্মসমর্পন করার জন্য আদেশ দিয়ে পত্র পাঠিয়েছিলেন। ওসমান তখন যে জবাব দেন তার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার বিদ্রোহের কারণ।

ওসমান বলেন, জনাব, আপনি বিশাল ভারতের অধীশ্বর, আর আমি ভারতের এক কোণে পড়ে আছি। আমার স্বাধীনতা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। জঙ্গলের পাখিটিও স্বাধীন থাকতে চায়।

ওসমান এখানে জঙ্গলের পাখির সাথে তুলনা দিয়ে নিজের স্বাধীন থাকার ইচ্ছাকে স্বভাবজাত বুঝিয়েছেন। রাজ্য দখল করার বা সাম্রাজ্যবাদী কোন আকাঙ্খা নেই এই স্বাধীনতার, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন।

আর্যরা যখন এগিয়ে আসলো, তখন তারা পূর্বদিকে এসে বঙ্গদেশেই তাদের অভিযান শেষ করে।

এর পিছনে দায়ী বাংলার ভৌগলিক কারণ। মুজতবা আলী যাকে বলেছেন “নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস”। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আরাকান, দক্ষিণে সমুদ্র।

ভারতের পশ্চিম প্রান্তে যুগে যুগে আক্রমণ করেছে তুর্কী, পাঠান, শক, হুনেরা। তাদের চাপ পড়েছে পাঞ্জাবের উপর, পাঞ্জাব থেকে উত্তর প্রদেশ এবং এভাবে একসময় বাংলায়। কিন্তু বাংলা আর কোনদিকে চাপ দিতে পারে না। তার পালাবার পথও নেই।

যুদ্ধের একটি প্রাচীন নিয়ম সান জু বলেছিলেন, পালাবার পথ না রেখে শত্রুকে আক্রমণ করতে নেই। বিড়ালকেও পালাবার পথ না রেখে আক্রমন করলে বিড়াল আত্মরক্ষার্থে আক্রমণকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বাংলার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে। জয়ী জাতী এসে তাদের উপর নির্যাতন করেছে, দাস হিসেবে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখনই তারা আত্মরক্ষার্থে বিদ্রোহ করেছে। একই জিনিস একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ঘটেছিল। শোষিত ও আক্রান্ত হলেই বাঙালী, দেয়ালে পিঠ ঠেকার পরেই বিদ্রোহ করে।

ফলে, বাঙালীর বিদ্রোহ বীরত্ব ও সাহস ইত্যাদি থেকে যতটা, তার চাইতে বেশী আত্মরক্ষার্থে। জঙ্গলের পাখিটির মতো।

উভয় বাঙলাঃ হুজ্জৎ-ই-বাঙ্গল” প্রবন্ধে পন্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী ইতিহাসের বিচারে বাঙালীর বিদ্রোহের এই কারণ ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যা বাঙালীর বিদ্রোহ বুঝার জন্য গুরুত্বপূর্ন মনে হলো আমার কাছে। বিভিন্ন রাজার বিদ্রোহের আরেক কারণ ছিল দেশের ভেতরের ভূ-প্রকৃতির আনুকূল্য। জঙ্গল, টিলা, পাহাড়, নদী ইত্যাদি দ্বারা বেষ্টিত দূর্গম এলাকা বিদ্রোহের অনুকূল।