ভূমিকম্পে বেরিয়ে আসে অজগর সাপ

by Gilbert Garcin
ছবিঃ  Gilbert Garcin এর।

 

“আপনি কি স্বাধীনতা কী বুঝেন?”

ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করলেন।

আমি বললাম, “বুঝব না কেন? স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের মত থাকার বা কিছু করতে পারার সুযোগ।”

ভদ্রলোক সামান্য হেসে ফেললেন। তিনি তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি হালকা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আপনার স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রাইমারী লেভেলের জ্ঞাণও নাই। কিন্তু আমি এতে অবাক হই নাই। এখনকার মানুষদের স্বাধীনতা নিয়ে জ্ঞাণ থাকবে না এটা স্বাভাবিক। খুব স্বাভাবিক। আপনারা হাজার হাজার মেকী স্বাধীনতা দেখে বড় হয়েছেন। হাজার হাজার মেকী স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। স্বাধীনতা শব্দটি আপনাদের কাছে একটি বিভ্রান্তি।”

এমনভাবে ভদ্রলোক কথাটি বললেন যে আমি অপমানিত বোধ করলাম। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু একটা বলতেও পারছিলাম না। এ এক দারুণ অস্বস্থি। আমি তার সামনে থেকে চলে যেতে চাইলাম।

বললাম, “আচ্ছা, ঠিক আছে ভাই। আমি যাই এখন। অনেক কাজ পড়ে আছে।”

ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, “আরে ভাই, যাচ্ছেন কোথায়? আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাদের মত ভদ্রলোক নই। তাই যা বলতে চাই তা একটু রূক্ষভাবে বলে ফেলি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। চলুন সামনে আরেকটু হাটা যাক। আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যাক এই বিষন্ন বাতাসে।”

আমি বললাম, “আপনি কবি নাকী?”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? আপনি নিশ্চয়ই কবিদের ভয় পান? এখনকার সময়ে প্রায় সবাই কবিদের ভয় পায়। তবে মজার কথা হল প্রকৃত কবিরা তো এখন নেই আর। অথবা থাকলেও দেখা দেন না। অপ্রকৃত কবিদের দেখেই আপনারা ভয় পান। প্রকৃত কবিদের দেখলে মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। তাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”

আমি বললাম, “তা হতে পারে। কবি কিংবা কবিতা এসব কোন ব্যাপারেই আমার কোন আগ্রহ নেই। আপনি কবি কী না জিজ্ঞেস করলাম কারণ বেশ কাব্য করে কথাটা বলেছিলেন আপনি।”

ভদ্রলোক আমাকে সাথে নিয়ে হেটে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তাই নাকী! আমার খেয়াল ছিল না কাব্য হয়ে যাচ্ছে। আমি সব সময় এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি। যেন কোনভাবে কথাতে কাব্য না আসে। কাব্যের বসত সারসের হৃদয়ে। আমার সাথে তার কী?”

ভদ্রলোকের এই কথার কোন অর্থ করতে পারলাম না আমি। তিনি কী কোন রূপকের মাধ্যমে কিছু বুঝাতে চাইছেন? আমার অস্বস্থিবোধ হল। এরকম অস্বস্থি হলে সাধারণত কারো সাথে কথাবার্তা চালানো যায় না। আর সে লোক সম্পূর্ন রূপে অপরিচিত হলে তো কথাই নেই।

আমি বিব্রত কন্ঠে বললাম, “আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায়?”

ভদ্রলোক এবার খুব মেপে উত্তর দিলেন, “এই তো সামনে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু দেখুন আমি আবার বলছি, আমাকে বাসায় যেতে হবে…”

কথাটা আমি শেষ করতে পারলাম না। ভদ্রলোক রাস্তার পাশে একটা ড্রেনের কাছে যেতে যেতে বললেন, “দাঁড়ান দাঁড়ান। আমি পেশাবটা করে নেই।”

এই কথায় আমার প্রায় চোখ কপালে উঠে গেল। কী বলব ভেবে পেলাম না। ভদ্রলোক খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্যান্টের চেন খুলে ড্রেনের মধ্যে প্রস্রাব করতে করতে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ড্রেনে টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির জলধারা পড়ার মত প্রস্রাব পড়ার শব্দ হচ্ছে। ভদ্রলোক এর মধ্যেই উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওই দেখুন একটা সারস উড়ে গেল। যে সারস উড়ে গেল সে আমার বন্ধু ছিল না।”

এরপর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর প্রস্রাব শেষ করে রাস্তায় উঠে এসে প্যান্টের চেন ঠিক করতে করতে বললেন, “স্বাধীনতা হচ্ছে এমন জিনিস যা সব সময় চর্চা করতে হয়। যা দেখতে খুব ছোট ছোট ব্যাপার মনে হয় সেগুলোতেও পরিপূর্ণরূপে স্বাধীন হতে হয়। তাহলেই কেবল স্বাধীনতা অনুভব করা সম্ভব। তা না হলে স্বাধীনতা অনুভব হবে অন্ধের হাতিকে অনুভবের মত। মিডিয়ার প্রচারনা আর পল্যুটেড পলিটিশিয়ান-ভন্ড ইন্টেলেকচুয়ালদের দেয়া সংজ্ঞার ভিত্তিতে তখন আপনি সংজ্ঞায়িত করবেন স্বাধীনতাকে। যত্র তত্র যেখানে ইচ্ছা মুত্র ত্যাগ হল স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক বড় পদক্ষেপ। এর মধ্যে আপনি প্রভূত স্বাধীনতা অনুভব করতে পারবেন। কি, করে দেখবেন নাকী?”

ভদ্রলোক খুব উৎসাহী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তার কথাবার্তায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এরকম একটা লোকের সাথে আমি এই দূর্যোগের সন্ধ্যায়, আধো অন্ধকারে হেটে যাচ্ছি। তাও কোথায় যাচ্ছি তা জানি না।

তবে এবার আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের মধ্যে কিছু একটা ঠিক নেই। তার সাথে কথা বলার কোন মানে হয় না। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বললাম, “আমাকে এবার যেতেই হবে। আমি চললাম।”

ভদ্রলোক সাথে সাথেই প্রশ্ন করলেন, “কোথায় চললেন?”

আমি বললাম, “কেন? বাসায়।”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “সে বাসা কী আর আছে।”

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে? বাসা থাকবে না কেন? আমি যখন বের হই তখনো তো দেখেছি আছে।”

ভদ্রলোক বললেন, “তা তো দেখেছেনই। কিন্তু ঐ যে আপনাদের নলেজ কম। তাই কোন ব্যাপারই বুঝতে পারেন না। ভূমিকম্পে আফটার শক বলে একটা ব্যাপার আছে। প্রথম আঘাতের পরে হালকা আরো কিছু আঘাত আসে। আপনারা যখন অজগরটার ভয়ে পাগলের মত বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর থেকে আর সারা শহরময় পিপীলিকার মত ছোটাছোটি করে বেড়াচ্ছিলেন তখন আরো বারকয়েক কেঁপে উঠেছে ধরনী। তার খবর কী রেখেছেন আপনারা?”

আমি ভয় পাওয়া কন্ঠে বললাম, “কী বলছেন এসব? ওখানে আমার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে?”

ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত দিয়ে স্বান্তনা দেয়ার মত স্বরে বললেন, “ওদের কথা ভাববেন না। যখন খবর এল ভূমিকম্পে প্রধান চিড়িয়াখানা ভেঙ্গে বৃহৎ অজগর সর্পটি বেরিয়ে গেছে তখন অন্য সবার মত আপনার দারা পুত্র পরিবারও বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সুতরাং, যখন পুনরায় ভূমিকম্প মৃদু আঘাত হানে তখন আপনার পরিবার বাসায় ছিল না। তারাও আপনার মত অজগর সাপটির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল শহরময়। সবার মনে তখন একই ভয়, একই চিন্তা। কখন অজগর সাপটির সাথে তাদের দেখা হয়ে যায়।”

আমি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু সাপটি কি ধরা পড়েছে?”

ভদ্রলোক বললেন, “সে আমি কী করে বলি। আমিও তো আপনাদের মতই এ শহরের বাসিন্দা। যারা সবাই নিজের অন্তরে একেকটা অজগর সর্প পুষে রাখেন। আর আরেকটি অজগরের ভয়ে হন গৃহছাড়া।”

আমি বললাম, “আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। এই সময়ে আমি ভেতর থেকে সম্পূর্ন ভেঙ্গে গেছি। এই কিছুদিন আগেও আমার ছেলে মেয়ে স্ত্রী নিয়ে দারুণ পরিবার ছিল। আমার ঘর ছিল, চাকরী ছিল। কিন্তু আজ এক দিনের ব্যবধানে সবকিছু পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। একটিমাত্র ভূমিকম্প এবং একটি অজগর সাপের চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। আমার মনের অবস্থা কত খারাপ আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। আমার মনে এখনো গভীর কুয়ার তলদেশে জমাট অন্ধকারের মত ভয় ঘাপটি মেরে বসে আছে। এ অবস্থায় এবং এই আধো অন্ধকারময় পরিবেশে আপনার রূপকধর্মী কথার অর্থ বুঝা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

ভদ্রলোক আমার দীর্ঘ কথায় সামান্য হাসলেন। এই অবস্থাতেও একটা লোক কীভাবে হাসতে পারে আমি জানি না।

তিনি বললেন, “আপনার ভয় দূর হয়ে যাবে। দেখছেন না চারিদিকে কোন শব্দ নেই। শহর নিরব হয়ে গেছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? এই প্রশ্ন আগেও আমার মাথায় এসেছে। চারিদিকে কোন শব্দ নেই কেন? এত লোক কোথায় গেল?”

ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, “আমি আসলে সেই কথা বলতেই আপনার কাছে এসেছিলাম। সারা শহর আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছি সে ইতিহাস বলার জন্য। কিন্তু কাউকে পাই নি। শেষ পর্যন্ত আপনাকে পেলাম রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বসে আছেন একজন পরাজিত মানুষের মত। তাই আপনার সাথে কথা বলা শুরু করি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে বলুন? কোথায় সব মানুষ?”

ভদ্রলোক বললেন, “এই তো এসে গেছি। সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে বামদিকে মোড় নিয়ে সোজা গলিতে ঢুকে পড়লেই হবে।”

বুঝতে না পেরে বললাম, “মানে?”

ভদ্রলোক বললেন, “মানে হল ওদিকটাতেই যেতে হবে। গলিটার শেষ মাথায় গিয়ে আপনাকে বুঝিয়ে বলা যাবে। তা না হলে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না। দেখুন সারসেরা আমাকে বিশ্বাস করে না। আমি তাদের দিকে তাকালেই তারা উড়ে যায়। আমি এক মিনিটের জন্যও কোন বসা সারস দেখি নি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্নতা। এই বড় অপূর্নতা নিয়ে আমি বেঁচে আছি। আমার হৃদয়জোড়ে এই না পাওয়ার বেদনা গভীর কিছু হাহাকারের জন্ম দিয়ে চলে প্রতি মুহুর্তে।”

ভদ্রলোকের চোখ ছলছল করে উঠল। আর আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই তুচ্ছ কারণে কারো চোখে পানি আসতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

ভদ্রলোক চোখের পানি আটকাতে অন্যদিকে তাকিতে শান্তভাবে বললেন, “চলুন।”

তারপর সোজা হাটতে লাগলেন। আমিও তার সাথে সাথে চললাম। সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম। তখন অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে। চারিদিকে কোন শব্দ নেই। পশুপাখি, জনমানব নেই। বামদিকে মোড় নিয়ে ভদ্রলোক সোজা গলিতে ঢুকে পড়লেন। আমিও ঢুকলাম তার পিছু পিছু। গলিটা ছিল বেশ ছোট। পাশাপাশি তিনজন লোক হাটতে পারবে এমন।

গলি ধরে যেতে যেতে একসময় ভদ্রলোক থামলেন। আমিও থামলাম তার পিছনে।

তিনি পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী আর বলবো। নিজের চোখেই দেখে নিন।”

আমি এগিয়ে গিয়ে গলির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম। শত শত মানুষ। একেকটা খাঁচা একেকজনের জন্য। তারা খাঁচার ভেতরে নিঃশব্দে বসে আছে।

ভদ্রলোক বললেন, “এইসব খাঁচা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। আপনি কী একটাতে ঢুকে পড়বেন নাকী একা এই মৃত নগরে একলা নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকবেন?”

আমি স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।