মানদা দেবী ও রমেশদা’র চাপান-উতোর

এইখানে দুইটা বই একত্রে আছে। প্রথম বইয়ের লেখক মানদা দেবী, বইয়ের নাম শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত। বইখানা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। এর কয়েকবছর পরে প্রকাশিত হয় রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা রমেশদা’র আত্মকথা। শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত নাম থেকে যেমনে বুঝা যায় এইটা যিনি লেখছেন তিনি ছিলেন পতিতা, সেইরকম রমেশদা’র আত্মকথা নাম থেকে বুঝার উপায় নাই রমেশচন্দ্র একজন বিশিষ্ট লম্পট, পতিত এবং দালাল।

প্রথম বইখানাতে মানদা দেবী তার পতিতা হইবার কাহিনী বিধৃত করেছেন। শিক্ষিত এবং সম্পদশালী পরিবারের কন্যা ছিলেন তিনি। তার খুব অল্প বয়সে মা মারা যান। এরপরে বাপের পর্যাপ্ত নজরদারীর অভাবেই তিনি কুপথে গিয়াছেন এমন অভিযোগ তার। তারে কুপথে নিয়া যাবার ব্যাপারে যেসব জিনিসরে তিনি দোষ দিয়াছেন তার মধ্যে উপন্যাস ইত্যাদিও আছে। এগুলি হালকা রসের এবং বাস্তব জীবনচিত্র দেখায় না বলে তার অভিযোগ।

এইখানে কিঞ্চিত একটা লাভ স্টোরি আছেও বলা যাইতে পারে। মানদা দেবী তার বাপের দুসম্পর্কের ভাই রমেশচন্দ্রের হাত ধরে ঘরের বাহির হন। তার লেখা থেকে মনে হয় প্রেমের টান এতে ছিল। তারা নানাবিদ স্থানে ঘুরেন। অতঃপর তিনি সমাজ হইতে পতিত হন।

মানদা দেবী ও রমেশদা

মানদা দেবী তার পতিতা জীবনের কাহিনীও উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি নিজেরে পর্যাপ্ত দোষ দিতে তিনি ছাড়েন নাই। এর সাথে সাথে সমাজ ও সমাজস্থ ভালো এবং সম্ভ্রান্ত লোকেরাও কীভাবে সমাজরে নষ্ট করতেছে (তার হিশাবে) সেটা তিনি বর্ননা করেছেন। তার লেখার হাত দেখিয়া এটা বুঝতে পারা যায় তিনি সেসময়ের লেখকদের বই পুস্তক পড়িতেন।

রবীন্দ্রনাথেরও কিঞ্চিত সমালোচনা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। ঐ নারীদের নিয়া থিয়েটারী করা, নাচা গানা ইত্যাদির।

পতিতা জীবনের কাহিনীতে যাইয়া এক পর্যায়ে তিনি একটি ইন্টারেস্টিং কথা বলিয়াছেন যা এখন মনে পড়িতেছে। পতিতাদের ঘরে যেসব লোক যান তাদের পতিতাদের ভাষায় তখন বলা হইত বাবু। এইরকম যেসব বাবুরা নিয়মিত আসিতেন কোন এক পতিতার ঘরে, তার সাথে ওই বাবুর একটা সম্পর্ক তৈয়ার হইয়া যাইত। সেরকমই এক অবিবাহীত বাবু আসিতেন মানদা দেবীর ঘরে। কিন্তু একসময় তিনি আসা ত্যাগ করেন। সেকথা লিখিতে যাইয়া মানদা দেবী বলিয়াছেন, তিনি তার পতিতা জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখিয়াছেন অবিবাহীত পুরুষদের বেশীদিন ধইরা রাখা যায় না, এরা স্থির থাকে না, এনাদের চিত্ত চঞ্চল প্রকৃতির হইয়া থাকে। পক্ষান্তরে যারা ঘরে নিজের বউরে ভালোবাসে তারা বেশ্যারেও ভালোবাসে।

এরপরে রমেশদা’র আত্মকথায় যাওয়া যাক। মানদা দেবীর আত্মকথায় বলা হইয়াছে বা উপস্থাপন করা হইছে তাকে এক প্রথম শ্রেণীর লম্পট হিসেবে। রমেশ’দা তার আত্মকথায় তাহা আরো বিস্তৃত করিয়াছেন। তিনি অস্বীকার না করিয়া তার লাম্পট্যের আরো নানাবিদ কীর্তি বর্ননা করিয়াছেন। কিন্তু মানদা দেবী যে অভিযোগ করিয়াছেন তার সম্পর্কে, সেগুলো খন্ডনের অল্প চেষ্টাও করিয়াছেন।

সমাজের নানাবিদ ব্যক্তিবর্গ বিষয়ে তিনি সমালোচনা করার চেষ্টা নিয়েছেন তীক্ষ্ণ ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ এবং জোড়াসাঁকো ফ্যামিলিরে এক হাত দেখে নিয়াছেন। রমেশ’দার স্মৃতিকথায় দেখিতে পাওয়া যায় তিনি রবীন্দ্রনাথের একটা গান গাইয়া তার এক আকাঙ্খিত রমনীকে আহবান করিতে গিয়া তীব্র অপমানিত হইয়াছিলেন। এইটা পড়িয়া মনে পইড়া যায় যে, রবীন্দ্রনাথের একটা গানরে (কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।) দ্বিজু বাবু বলিয়াছিলেন লাম্পট্যগীতি।

এই দুই বইতে উল্লিখিত দুই ব্যক্তিবর্গের জীবন কাহিনীর সাথে সাথে তৎকালীন সমাজের এক চিত্র পাওয়া যায়। স্বদেশী আন্দোলন এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদারতার পরিচয় সম্পর্কে এনারা বর্ননা করিয়াছেন। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও একটা পরিচয় তাই মিলে। ইনসাইটফুল এই বইটি থাকুক আপনার পাঠ্যতালিকায়।