রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) জীবন এবং সাহিত্যভাবনার অনেক গুরুত্বপূর্ন অংশ পাওয়া যায় তার আত্মজীবনী “জীবনস্মৃতি”তে। একজন সাধারণ পাঠকের কাছে বইটি গুরুত্বপূর্ন এ কারণে যে এখানে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা বিষয় সম্পর্কে জানা যায়। আর একজন লেখকের কাছে বইটি আরো বেশী গুরুত্বপূর্ন কারণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তাকে বাংলা সাহিত্যের যেকোন লেখকের বুঝাপড়াকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
এই লেখায় রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য সম্পর্কে ভাবনা, কাঁচা বয়সের সমালোচনা এবং তরুণ লেখকের প্রকাশিত হবার আকাঙ্খা এই তিন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাসাহিত্যে প্রথম শিশুদের জন্য যেসব বই লেখা শুরু হয় সেগুলো ছিল নীতিকথা ভিত্তিক। গল্পের ছলে জ্ঞাণ বিতরনই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য সেগুলোতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই ধারার শিশুসাহিত্য রচয়ীতা। কবি ও সাংবাদিক শোয়েব সর্বনাম ‘জ্ঞান নয়, আনন্দই হোক মুখ্য’ নামে একটি লেখা লিখেন ইত্তেফাক পত্রিকায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলা শিশুসাহিত্যে জ্ঞাণনির্ভরতা বাদ দিয়ে নিখাঁদ আনন্দ নির্ভর শিশুসাহিত্যের সূচনা হয় রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়দের হাত ধরে। তার লেখাটি এখান থেকে পড়া যেতে পারে।
রবিন্দ্রনাথ শিশুসাহিত্যকে একেবারেই সহজ করে দেবার পক্ষপাতি ছিলেন না। তার মতে,
“আমার বাল্যকালে বাংলাসাহিত্যের কলেবর কৃশ ছিল। বোধ করি তখন পাঠ্য অপাঠ্য বাংলা বই যে-কটা ছিল সমস্তই আমি শেষ করিয়াছিলাম। তখন ছেলেদের এবং বড়োদের বইয়ের মধ্যে বিশেষ একটা পার্থক্য ঘটে নাই। আমাদের পক্ষে তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় নাই। এখনকার দিনে শিশুদের জন্য সাহিত্যরসে প্রভূত পরিমাণে জল মিশাইয়া যে-সকল ছেলে-ভুলানো বই লেখা হয় তাহাতে শিশুদিগকে নিতান্তই শিশু বলিয়া মনে করা হয়। তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা হয় না। ছেলেরা যে বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম– যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত। সংসারটাও ছেলেদের উপর ঠিক তেমনি করিয়া কাজ করে। ইহার যতটুকু তাহারা বোঝে ততটুকু তাহারা পায়, যাহা বোঝে না তাহাও তাহাদিগকে সামনের দিকে ঠেলে।”
শিশুসাহিত্যে দুর্বোধ্যতারও দরকার আছে। শিশুদের জন্য শুধু ছেলেভুলানো ঘুমপাড়ানি কাহিনী নির্ভর গল্প কবিতা লেখার চাইতে, সামান্য কঠিন বাস্তবতাও মেশানো যেতে পারে। এই হলো রবীন্দ্রনাথের কথা।
এছাড়া এভাবেও ভাবা যেতে পারে, শিশুদের জন্যও যেরকম বই তাদের ভাবাতে পারে সেরকম বই দরকার।
ষোল বছর বয়সে তার বড়দাদার সম্পাদিত ভারতীতে লেখা প্রকাশ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিটি তরুণ লেখকদের জন্য উপকারী হতে পারে। জীবনস্মৃতির ভারতী প্রবন্ধ হতে,
“যে-বয়সে ভারতীতে লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম সে-বয়সের লেখা প্রকাশযোগ্য হইতেই পারে না। বালককালে লেখা ছাপাইবার বালাই অনেক– বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থার জন্য অনুতাপ সঞ্চয় করিবার এমন উপায় আর নাই। কিন্তু তাহার একটা সুবিধা আছে; ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখিবার প্রবল মোহ অল্পবয়সের উপর দিয়া কাটিয়া যায়। আমার লেখা কে পড়িল, কে কী বলিল, ইহা লইয়া অস্থির হইয়া উঠা– লেখার কোন্খানটাতে দুটো ছাপার ভুল হইয়াছে, ইহাই লইয়া কণ্টকবিদ্ধ হইতে থাকা– এই-সমস্ত লেখাপ্রকাশের ব্যাধিগুলা বাল্যবয়সে সারিয়া দিয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থচিত্তে লিখিবার অবকাশ পাওয়া যায়। নিজের ছাপা লেখাটাকে সকলের কাছে নাচাইয়া বেড়াইবার মুগ্ধ অবস্থা হইতে যতশীঘ্র নিষ্কৃতি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।”
এই প্রবন্ধে আরেকটি উপলব্ধি আছে রবীন্দ্রনাথের যা তরুণ লেখক কাম সমালোচকেরা পড়তে পারেন।
“এই সময়টাতেই বড়দাদাকে সম্পাদক করিয়া জ্যোতিদাদা ভারতী পত্রিকা বাহির করিবার সংকল্প করিলেন। এই আর-একটা আমাদের পরম উত্তেজনার বিষয় হইল। আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু আমি ভারতীর সম্পাদকচক্রের বাহিরে ছিলাম না। ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস– কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ভারতীতে প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম।”