অধিকার বিষয়ক অবস্থানে বেহুলা বা রূপবানের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন আধুনিক নারীরা অথবা তাদের দিকে তাকাইয়া বুঝা যাইতে পারে আমাদের এখানে সংগ্রামী নারীদের স্বরূপ। লোক গল্পের এই দুই চরিত্রের ব্যাক্তিত্ব দেখেন, কি শক্ত! রূপবানের পালায় বারো বছর বয়সী রূপবানের সাথে বিয়ে হয় বারোদিনের রহীম বাদশার। তা না হলে রহীম বাদশা মরে যাবে এমন অভিশাপ ছিল মুনির।
রূপবানকে তার পিচ্চি জামাই সমেত বনবাসে যাইতে হয়। এবং এরপর নানা বিপদ সে অতিক্রম করে। জামাই রহীমকে লালন পালন করে, শাসনে রাখে। মানুষের মতো মানুষ বানাইতে চায়। তাই সে নিজের পরিচয় দেয় না প্রথমে। কিন্তু তার মানে এই না যে সে স্ত্রীর অধিকার ছাইড়া দিছে। রহীম বাদশাকে সায়েদ বাদশার মেয়ে প্রেমে পতিত করলে রূপবান তেজস্বী রূপে অবতীর্ন হয় এবং জামাইকে অন্য রমনীর হাত থেকে রক্ষা করে।
এই পালায় দৈব বিষয় নাই, খালি মুনির ঐ অভিশাপ ছাড়া।
বেহুলা-লখিন্দরের গল্পে মনসা দেবীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন লখিন্দরের বাপ। তাই প্রতিশোধ হিসেবে মনসা লখিন্দরের বিয়ার প্রথম রাতে দংশন করার ঘোষনা দেন। বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিয়া হয় তখন বেহুলার বয়স এগারো বছর। মনসার অভিশাপের কথা তার জানা ছিল তাই পয়লা রাতে সে সতর্ক থাকে এবং লখিন্দরকে নিবৃত্ত রাখে প্রেমলীলা হতে, সাবধানতার জন্য।
মানে নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। লখিন্দরকে দংশন করে মনসা তার ঝাল মেটান।
পরে লখিন্দরকে ভেলায় ভাসাইয়া দেয়া হয়। সবার বাঁধা উপেক্ষা করে বেহুলা জামাইয়ের সাথে ভাসতে থাকে। এবং এক সময় যায় ইন্দ্রের সভায়। গিয়া নাচে ইন্দ্রকে মুগ্ধ করে এবং জামাইকে জীবিত করে নিয়ে আসে এই মহান বাংলায়।
গ্রীক পুরাণের অর্ফিয়ুস-ইউরিডিসির লাভ স্টোরিতেও দেখা যায় অর্ফিয়ুসের বউ ইউরিডিসিকে সাপ দংশন করে। শ্রেষ্ট সঙ্গীত শিল্পী অর্ফিয়ুস এরপর একসময় পাতালে যায় স্ত্রীকে জীবিত করতে। পাতাল বা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের রাজা হেইডিস এবং তার বউ পারসোফেনিকে অর্ফিয়ুস নিজের গানে মুগ্ধ করে। তারা তার বউকে জীবিত করতে সম্মত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা ভুলের কারণে অর্ফিয়ুস তার বউকে জীবিত করতে পারে না। চিরতরে ইউরিডিসিকে হারিয়ে ফেলে।
গ্রীক পোলা অর্ফিয়ুস যা করতে পারে না, বেহুলা নারী হইয়া তা কইরা দেখাইছে। এইখানে তার বিশাল কৃতিত্ব আছে। রূপবানের মতো সেও নিয়ন্ত্রণে গেছে সব কিছুর, প্রেমও আছে তাদের দুইজনার মধ্যে।
সাধারণ নারীত্বের যে কল্পনা, নিয়ন্ত্রিত হবে খালি, এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের রূপবান ও বেহুলা। এই দুই গল্প একসময় জনপ্রিয়তম ছিল বাংলার জনপদে জনপদে।
তবে এক দৃষ্টিতে কেউ কেউ বলতে পারেন তাদের অতিরিক্ত পতি ভক্তি আছে। এভাবে দেখা ঠিক হবে না, কারণ তাদের ভক্তি যদি থেকেও থাকে তা তাদের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সে প্রেম তাদের উপর অত চাপাইয়া দেয়া না। যদিও বারোদিনের রহিম বাদশাকে বিয়া করতে রূপবানের উপর একাব্বর বাদশা চাপ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে রূপবান জামাইকে লালন পালন করেছে, সাথে থেকেছে নিজের প্রেমের টানেই।
বেহুলা ও রূপবান সংগ্রামী নারীদের গল্প বলে। প্রেমখানা বাদ দিলে এই সংগ্রাম হয়ত দেখতে পাবেন চারপাশেই। এক বাচ্চা দুই বাচ্চা রেখে জামাই ফেলে গেছে এমন নারীরা আছেন যারা অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করে বা গার্মেন্টসে কাজ করে সন্তান লালন পালন করছেন। সায়েদ বাদশার মতো লোকদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাইয়া (বা বাঁচাইতে না পাইরাও) এই নিরাপত্তাহীন সমাজে তারা জীবন সংগ্রামে লিপ্ত আছেন। এগুলো ঐ ধরনের সংগ্রামই।
বেহুলা ও রূপবানের চরিত্র তাই এখনো বর্তমান আছে বাস্তবে, আরো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। কারণ গল্পের ক্ষেত্রে দর্শক বা শ্রোতাদের হৃদয় না ভেঙ্গে দেয়ার জন্য কিছু নৈতিক বা স্বান্তনামূলক জিনিসের অবতাড়না করা হয়। বাস্তবের দুনিয়ার গল্পকারের কাছে ওইসব পাত্তা পায় না।
স্বান্তনামুলক জিনিস বলতে কি বুঝাইলাম তার একটা উদাহরন দেই। পুরানা শুক্রবারের বাংলা ফিল্মে দেখা যাইত কোন কোন ক্ষেত্রে নায়ক বা নায়িকা মারা যান শেষ দৃশ্যে। তখন দেখানো হয় শাদা কাপড় পড়া তার লগের নায়ক বা নায়িকা, যিনি আগেই মারা গেছেন, তিনি দুই হাত বাড়াইয়া আছেন। মরার পরে দুইজন শাদা পোষাক পড়া নায়ক নায়িকার কোলাকোলিও দেখানো হইত। মানে দর্শকদের বুঝানো হইত পরকালে গেছেন তারা, গিয়া একজনের সাথে আরেকজন মিলিত হইছেন, ফলে আপনারা বেশী দুঃখ পাইয়েন না।
ট্র্যাজেডিকে কম-ট্র্যাজিক বা আনন্দময় বানানোর এক দারুণ ব্যবস্থা।