অনুগল্পঃ মেয়েটির বাবা

এই এলাকায় আসার পর এদের সাথেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। বাবা এবং মেয়ে। মেয়েটার বয়স তিন বা চার হবে। বাবা প্রায় আমার বয়েসী। পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ। খুব অভিজাত পরিবার। আলিসান বাড়ি। কি একটা পারিবারিক ঝামেলার কারণে বাড়ির গৃহকর্ত্রী অর্থাৎ মেয়েটির মা এবং লোকটির স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। লোকটি আমাকে কখনো কারণটি বলে নি। আমিও কখনো জিজ্ঞেস করি নি। কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিশেষত সে যদি না প্রকাশ করতে চায় তাহলে আমার কোন আগ্রহ নেই। এমনিতে আমার নিজের জীবনই বেশ জটিলতাপূর্ণ।

আমি ওদের ওখানে যেতাম মাঝে মাঝে। লোকটি শিল্প, সাহিত্য, দর্শনের সমঝদার। এরকম লোক সচরাচর পাওয়া যায় না। নীৎসে, কান্ট, হেগেল, শ্লেগেল নিয়ে প্রায়ই আমাদের আলোচনা হত। মেয়েটিও ছিল খুব মিষ্টি। সে তার ছোট পুতুলটি নিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকত বেশিরভাগ সময়।

সেদিন সকালে হতদন্ত হয়ে লোকটি এল আমার কাছে। আমি তখন বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এসে বিষন্ন মুখে বলল, ভাই, বড় ঝামেলায় পড়ে গেছি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ঝামেলা?

লোকটি বলল, আমার মেয়েটা কাঁদছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কি হয়েছে?

লোকটি বলল, না মানে…ওর পুতুলটা আমি কেটে ফেলেছিলাম। তাই কাঁদছে।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, পুতুল কাটলেন কেন? আচ্ছা, নতুন আরেকটা কিনে নিয়ে বাসায় চলে যান।

লোকটি বলল, কিন্তু নতুনটা তো আমার মেয়েরটা হবে না। ওটাতো অন্য আরেকটা হবে।

আমি বিরক্তমুখে বললাম, তাহলে কি করতে চান?

লোকটি বলল, আপনি একটু চলুন না। আমার মেয়েটি

আপনাকে বেশ পছন্দ করে। আপনাকে দেখলে কান্না থামাবে।

আমি বিরক্ত হলেও লোকটির সাথে চললাম তার বাড়িতে। গিয়ে দেখি বসার কক্ষের মেঝেতে পুতুল পড়ে আছে। তার পাশে পড়ে আছে লোকটির মেয়ে। মাথা কাটা অবস্থায়। কার্পেট রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম হল।
লোকটার মুখভঙ্গির কোন পরিবর্তন হল না। সে আগের মতই বলল, দেখছেন, আমার মেয়েটা কাঁদছে।

আমি পুলিশে খবর দেই। লোকটিকে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায় তখন তার মুখে ছিল “হতবিহ্বল” দৃষ্টি। যেন সে বুঝতে পারছে না কেন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

যাবার সময় লোকটি পুলিশের গাড়ি থেকে আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেছিল, ভাই, আমার মেয়েটাকে একটু দেখে রাখবেন।