আমাদের সমাজে ভালো ইন্সটিটিউশন গড়ে উঠে না কেন?

মানুষের স্বভাব হইল রুল মানা। যেকোন রুল দেখলে সে এর উপর কোন ঐশ্বরিক বা ব্যাখ্যার অতীত কিছু আরোপ করে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে প্রায়শই। আবার মানুষেরই স্বভাব সহিংসতা

রুল মানাটা খুব দরকারী একটা রাজনৈতিক জনসমাজ বা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য। মানুষের রুল মানার প্রবণতা থাকলেই সে ইন্সটিটিউশনগুলি মানবে ও তৈরি করবে। ইন্সটিটিউশন মূলত বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা নেয় বা কিছু রুল মানায়।

আমাদের দেশে যে নৈরাজ্য আমরা দেখি কারণ আমাদের ভালো ইন্সটিটিউশন হয় নাই। রুল হয় নাই, রুল ও ইন্সটিটিউশন বাইরের দেশ থেকে কপি করা হইছে, কিন্তু মানুষের এগুলি মানার ও বুঝার যে এভল্যুশন হবার কথা, তা হয় নাই।

ইউরোপে এটা হইছে। ফলে আমরা বর্তমানে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ইউরোপেই দেখি। এর কারণের একটা হচ্ছে, ইউরোপের লোকেরা রুল মানে। কেন তারা রুল মানে?

রুল মানা প্রবণতারে বুঝতে হলে, আরেকটু আগের সমাজ, তথা ট্রাইবাল সমাজে হান্দাইতে হবে। ট্রাইবাল বা গোষ্ঠীগত সমাজে মানুষ গোষ্ঠীরে মানে। গোষ্টী কী? তার আত্মীয় স্বজন পরিজন এদের নিয়ে একটা দল, যেখানে তারা নিজেদের মধ্যেই নিয়ম কানুন মেনে চলে, নিজেদের মধ্যে বিয়াশাদী করে ও নিজেদের স্বার্থ আগে দেখে।

সমাজ যদি গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে আবদ্ধ থাকে তাহলে কোন কেন্দ্রীয় রাজার কাছে নিজেদের স্বাধীনতা পুরা বিলাইয়া দিবে না। রাজা ক্ষমতায় গেলেও এদের সমঝে চলতে হত।

ইউরোপ যখন খ্রিস্টান হইল, বা ক্যাথলিক চার্চ যখন পাওয়ারফুল হইল, তখন তারা ধর্মীয় কিছু নিয়মের মাধ্যমে এইসব গোষ্ঠীবদ্ধটা ভেঙ্গে দেয়। গোষ্ঠী ভেঙ্গে দিতেই তারা এটা করছিল বা নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে করছিল, নাকি ধর্মীয় নিয়মের বাস্তবায়নে করছিল, তা বিষয় না তেমন এই আলোচনায়। বিষয় হল, এর ফলে গোষ্ঠীগুলি দূর্বল হয়ে যায়।

নিয়মগুলি ছিল নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ, আত্মীয়দের বিধবাদের বিবাহ, সন্তান দত্তক নেয়া, এবং বিবাহ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টানিটিতে যাবার কয়েক জেনারেশনের মধ্যে ট্রাইবগুলি দূর্বল হয়ে পড়ে এই নিয়মসমূহের ফলাফল হিসেবে।

এতে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গ্রো করে। গোষ্টী যেহেতু নাই সে তো একাই। সে একদিক দিয়ে কিছু স্বাধীনতা পাইল। এবং পরবর্তীতে এর উপর যখন কেন্দ্রীয় রাজা বা সরকার তৈরি হইল, মানুষ ইন্সটিটিউশনের কাছে নিজের স্বাধীনতা দিতে কোন আপত্তি করে নাই। অর্থাৎ নিয়ম মানতে তাদের আপত্তি থাকলো না।

অর্থাৎ, তাদের এই নিয়ম মানা প্রবণতায়, ভালো ইন্সটিটিউশন তৈরি, সর্বোপরি গণতন্ত্রে ক্যাথলিক চার্চের শক্ত ভূমিকা আছে।

এটা ইন্সটিটিউশনের রুল মানা প্রবণতারে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু কীভাবে কেন্দ্রীয় সরকার এতো পাওয়ারফুল হইল যে তারে সবাই মানবে, এটা ভিন্ন বিষয়। মোটাদাগে একটা সমাজের কথা ভাবুন, যেখানে মূল রাজা আছেন। সেইখানে আবার পাওয়ারফুল অনেক এলিট আছেন, যারা ধরা যাক জমিদার, লর্ড, নাইট ইত্যাদি। রাজারে এইসব এলিটদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন্দ্রীয় সর্বময় পাওয়ার প্রতিষ্ঠা করতে, যেটা আধুনিক রাষ্ট্রের মূল কথা।

আবার অন্যদিকে, যদি এলিটেরা একেবারে উইক হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে রাজা একেবারে সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবেন, তার জন্য কোন চেক এন্ড ব্যালেন্সের জায়গা থাকবে না। ভালো গভর্নমেন্ট ওই সমাজে তৈরির জন্য, এমন এক অবস্থা হতে হবে যেখানে এলিটেরা উইক হবে যাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা মানে, সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থাকে, আবার সরকারও এলিটদের স্বীকার করবে কারণ তারা এইরকম পাওয়ারফুল থাকবে যে সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।

যেসব সমাজ এমন ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় যেতে পারছে, তারাই ভালো ইন্সটিটিউশন বানাইছে। এবং এই অবস্থায় যাওয়া অবশ্যই কেন্দ্রীয় পাওয়ার এবং ওই সোশ্যাল গ্রুপের নিরন্তর ক্ষমতা দ্বন্দ্বের পরেই একসময় হইছে।

এখন আবার আগের কথায় চলে যাই , গোষ্টী সমাজ যেখানে পাওয়ারফুল থাকবে সেখানে বন্ডিং আত্মীয়তার। মানুষ নিজেদের গোষ্টীর বাইরে বিশ্বাস করে না। যেখানে লার্জ স্কেলে বিশ্বাস ও আস্থা কাজ করবে না, অর্থাৎ সামাজিক পূঁজি [পুটনামের, বর্দিউর নয়] কম থাকবে মানুষে মানুষে। মানুষ বৃহত্তর সমাজটারে দেখবে জিরো সাম গেইম হিশাবে, আবার নিজেরা গোষ্টীগত ভাবে এক থাকায় তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক হবে না, ও কোন ইন্সটিটিউশনের কাছে নিজেদের স্বাধীনতা দিতে চাইবে না। রুল মানতে চাইবে না।

প্রয়াত আকবর আলী খান ভিলেম ভ্যান শ্যান্ডেলের রিসার্চের উপর ভর করে বলেছিলেন, এই অঞ্চলের মানুষেরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক এইজন্য সামাজিক পূঁজি কম। কারণ হিশাবে দেখিয়েছিলেন গ্রামের গঠন। বন্যায় গ্রাম ডুবে যায়, এইজন্য গ্রামগুলি ছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে একেক গ্রামের আলাদা আলাদা ইকোনমি ছিল। ইত্যাদি।

এগুলি ঠিক আছে, কিন্তু রোগ চিহ্নিত করায় ঝামেলা করেছেন আকবর আলী খান, উলটা হয়ে গেছে। এটা গোষ্টী বদ্ধ মানসিকতার জন্য, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের জন্য নয়। একক গ্রাম গোষ্টীবদ্ধতারেই শক্তিশালী করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে যেতে ট্রাইবাল সমাজ ভাঙতে হত। এই সামাজিক ফেব্রিক ভাঙ্গার মত কোন শক্তি এ অঞ্চলের সমাজে আসে নি।

তদুপরি এখানে ছিল হিন্দু ধর্মের জাতপ্রথার প্রভাবে, যেখানে মূল চার বর্ণের বাইরেও বিভিন্ন পেশাকেন্দ্রিক, যেমন চামার মুচি তাঁতি জেলে ইত্যাদি নানা জাতিতে বিভক্ত ছিল সমাজ। এবং পরে ইসলাম ধর্ম আসলেও সেটি আশরাফ আতরাফে বিভক্ত হয়, লোকায়ত সূফী প্রভাবে ছিল, বা সবচাইতে বড় ক্যাথলিক চার্চের মত কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কখনোই ইসলাম ধর্মের ছিলনা এতদঞ্চলে। আর থাকলেও চার্চের মত ওই চার রুল আরোপ করত না কারণ ঐগুলা ইসলামে বিধিবদ্ধ।