মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » সহিংসতার ভূমিকাঃ গণ সহিংসতা

সহিংসতার ভূমিকাঃ গণ সহিংসতা

গণসহিংসতা

গন সহিংসতায় একদল লোক অংশ নেয় সহিংস আচরনে। এর মধ্যে কিছু ছিল একরকম প্রথাগত।
ইউরোপে বিয়ের আগে যুবকেরা শহর ও গ্রামের রাস্তায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত এবং বিভিন্ন ধরণের সহিংসতায় অংশ নিত। এসব লড়াই অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হতো অনেক সময়।
ছবিঃ হুদিব্রাস এবং স্কিমিংটন, ১৭২৫-৬৮। উইলিয়াম হগার্থ। দ্য মেট এর সৌজন্যে।
চারিবারিজ এমন একটি প্রথা প্রচলিত ছিল ইউরোপে। এর শুরু মধ্যযুগেরও আগে। সম্ভবত কোন ধরণের যাদু সংস্লিষ্ট বিষয় থেকে এর উদ্ভব। শুরুতে এটি এমন ছিল যে একদল যুবক নন বিবাহিত দম্পত্তির ঘরের পাশে গান গেয়ে উৎসবের মত করতো। কিন্তু পরবর্তীতে এটি বিয়ে এবং নৈতিকতার অভিভাবকসুলভ একটা অবস্থান নেয়।
এইসময়ে কোন ধরনের অসামাজিক ব্যবহার, যেমন বউ পেটানো, বিবাহীতদের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, শিশু নির্যাতন, নারীরা তাদের সামাজিক অবস্থানের নিচের কাউকে বিয়ে করলে, বা বউয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে কোন পুরুষ তারা দল বেঁধে মিলে শাস্তি দিত।
ইংল্যান্ডে কোন লোক বউ পেটানোতে দোষী দলে তাকে গাধার পিঠে উলটো ভাবে চড়িয়ে রাস্তায় ঘুরানো হত। তার বউ যদি অবিশ্বস্থ হত তাহলে তার মাথায় বসানো হতো দুটি শিং। এইসব শাস্তি প্রক্রিয়ার সময় গান এবং উচ্চ বাজনা বাজানো হতো।
এইসব প্রথাগত সহিংসতার বাইরে উৎসব সহিংসতাও ছিল ইউরোপে।
কিছু উৎসব প্রচলিত ছিল যেখানে সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেনী উলটে যেত উৎসবের দিন। সামাজিক ভাবে নিচু শ্রেনীর যারা তারা তাদের উপরের স্থানে থাকা লোকদের একহাত দেখে নিতে পারত ঐদিন। জুলিয়াস রাফের মতে ফ্রান্সের বরদক্সে ১৭ শতকে এরকম একশোটি উৎসব প্রচলিত ছিল এমন প্রমাণ মিলে।
খারাপ ভাষা ব্যবহার, ব্যঙ্গ করা, পবিত্র জিনিস নিয়ে মশকরা ইত্যাদি তো আর প্রতিদিন করা সম্ভব হতো না। তাই উৎসব করে একদিন এসব কাজ করা হতো।
ছবিঃ বিড়াল গণহত্যা, ১৭৫১, উইলিয়াম হগার্থ, দ্য মেট এর সৌজন্যে।
এই ধরণের উৎসব কতো সহিংস হয়ে উঠত তার একটি নিদর্শন পাওয়া যায় ১৮ শতকের প্যারিসে। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যাপূর্ন শ্রেণীদের মধ্যে এমন উৎসবের কালে ঐসময় শ্রমজীবী শ্রেণী প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরে ধরে বিড়াল মারতে শুরু করে। শুরু হয় বিরাট এক বিড়াল গণহত্যা।
তারা এই কাজ করছিল মজার জন্য। অনেকে বলে থাকেন এটি ছিল প্রতীকি সহিংসতা যেখানে শ্রমজীবীরা তাদের মালিকদের বিড়াল হত্যা করে এক ধরণের প্রতিশোধের আনন্দ পেয়েছিল।
আধুনিক যুগের শুরুর দিকে ইউরোপের রাস্তায় বিনোদনের জন্য প্রাণীদের উপর সহিংসতা এবং জনপ্রিয় উৎসবে পশুপাখিদের উপর সহিংসতা বিদ্যমান ছিল।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে থাকেন হয়ত সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতি রক্ষার্থে এরকম উৎসব সহিংসতার ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৭ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে এমন সহিংসতা বন্ধ হতে শুরু করে। কারণ যা সাধারণ ব্যঙ্গ ইত্যাদি দ্বারা শুরু হতো তা পরবর্তীতে বড় সহিংসতায় রূপ নিত প্রায়ই।
সমাজের এলিটরা এ ধরণের উৎসব থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে শুরু করে। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় চার্চই নৈতিক কারণ দেখিয়ে এমন উৎসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আর ১৮ শতকের শেষের দিকে অথরিটি জনসমাগমের জায়গা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দেয়। ১৯ শতকের মধ্যে সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন শিল্প বিপ্লবের সূচনা করে। ইত্যাদি কারণে এমন উৎসব করা জনতা সহিংসতা কমে আসে।
গণসহিংসতা মধ্যে আরো পড়ে দাঙ্গা, বিদ্রোহ ও বিপ্লব।
দাঙ্গা বলা হয় সাধারণত যে সহিংসতা স্থানীয় লোকদের মধ্যে, এবং যার স্থায়ীত্ব খুব বেশী হয় না। দাঙ্গায় যুক্ত লোকের সংখ্যা কয়েক ডজন থেকে কয়েক হাজারো হতে পারে।
বিদ্রোহ আরেকটু বড় পরিসরের দাঙ্গা যেখানে তাদের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, নেতা নেত্রি থাকে এবং আরো অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
আর বিপ্লবের থাকে একটি জাতীয়তাবাদী চেহারা, যেখানে তারা বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা বা স্টেইট ফেলে দিতে চায়।
এই তিন জায়গাতেই মবের সহিংসতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু ইতিহাসবিদ মবের সহিংসতার খারাপ দিকটা দেখাতে চান আর কিছু ইতিহাসবিদ বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্বের সাপেক্ষে মব সহিংসতার ন্যায্যতাও দিতে চান। মব সহিংসতা কেমন ভাবে দেখা হচ্ছে তা অনেকটা নির্ভর করে ইতিহাসবিদের রাজনৈতিক চিন্তা কোনদিকে তার ওপর।
মব সহিংসতার সাথে গণহত্যা ও লুটতরাজের কথাও আসে। গণহত্যায় একদল লোক আরেকদল লোককে হত্যা করে। সাধারণত যাদের হত্যা করা হয় তারা তাকে অস্ত্রহীন। এদের হত্যা করার উদ্দেশ্য হতে পারে রাজনৈতিক, জাতিগত, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয়।
ছবিঃ চিওজের গণহত্যা, ইউজেন দেলাক্রয়েক্স, ১৮২৪
এই গণহত্যা সরাসরি রাষ্ট্রের নির্দেশে হতে পারে আবার এমনো হতে পারে যে রাষ্ট্রের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে মব কাজটি করেছে। যারা হত্যা করছে তাদের মধ্যে আক্রান্তদের চাইতে নিজেরা সুপিরিয়র এমন এটা বোধ থাকে।
এই গণহত্যাকে অনেক সময় ঠান্ডা মাথায় এবং উত্তেজনার বশে এই দুইভাগে ভাগ করে দেখা হয়। উত্তেজনার বশে গণহত্যা হয় যুদ্ধে বা বন্দিদের যখন সেনারা হত্যা করে। আবার ঠান্ডা মাথায় হত্যা হয় হিসাব নিকাশ করে, যেমন, সেনারা গর্ত খুড়ে এর সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে যে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশী মানুষদের উপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা ছিল এরকম।
কখনো গণহত্যা চালানো হয় কোন ভূখন্ড থেকে যাতে মানুষ পালিয়ে সরে যায় এজন্য। এমন গণহত্যা হয়েছিল ১৯৪৭-৪৮ সালে ফিলিস্তিনের যুদ্ধে ইহুদি ও ইজরাইলি সৈন্যদের দ্বারা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং