নাসিম তালেব পেশাকে দুইভাবে ভাগ করেছেন। কিছু পেশা আছে যেগুলো নন-স্কেলেবল। যেমন, একজন ডেন্টিস্ট বা কনসালটেন্ট ঘন্টা হিসাবে যদি টাকা নেন, তাহলে দিনে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘন্টাই বরাদ্দ থাকে তার জন্য। ধরা যাক, ৮ ঘন্টা তিনি কাজ করেন এবং ঘন্টায় ২ হাজার করে চার্জ করেন। তাহলে তার আয় হবে নির্দিষ্ট। যত ঘন্টাই কাজ করুন না কেন তার জন্য বরাদ্দ থাকবে দৈনিক চব্বিশ ঘন্টা। একইভাবে কেউ যদি একটা রেস্টুরেন্ট খুলে, কিংবা তালেব প্রস্টিটিউটের উদাহরন দিয়েও বলেছেন; এই ধরনের পেশায় কোন এক দিনের আয় এত বেশী হবে না যে ঐ ব্যক্তির গত জীবনের আয়ের চাইতে বেশী হয়ে যাবে। এইসব পেশার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে হয় এবং সিদ্ধান্তের কোয়ালিটির চাইতে গুরুত্বপূর্ন হয়ে থাকে নিয়মিত তার পরিশ্রম।
আবার আরেক ধরনের পেশা আছে যেগুলো তালেবের মতে স্কেলেবল। এগুলোর ক্ষেত্রে হঠাৎ করে আয় মারাত্মকভাবে বেশী হবার সম্ভাবনা থাকে, এবং একই পেশার বেশীরভাগ লোকের চাইতে বহু বহু গুণ ছাড়িয়ে যায়। যেমন, জে কে রাউলিং হ্যারী পটার লিখেছেন। তিনি যখন লিখেছিলেন প্রথম, সেরকম আরো হাজারো লেখকেরা লিখেছে বা এখনো লিখছে। জে কে রাউলিং এর লেখাও অনেক পাবলিশার রিজেক্ট করে দিয়েছিলেন। দ্য নিউর্কারই দিনে প্রায় একশত পান্ডুলিপি রিজেক্ট করে, এর মধ্যে হয়ত অনেক জিনিয়াসও থাকেন; মোটকথা লেখকদের জন্য প্রকাশিত হওয়া খুব সহজ না। (বাংলাদেশের প্রকাশনী থেকে নয়। পৃথিবীর বড় প্রকাশনীদের কথা বলছি।)
কিন্তু জে কে রাউলিং সফলতা পেয়ে গেছেন হ্যারী পটারের মাধ্যমে। এখন তাকে বারবার হ্যারী পটার সিরিজের প্রত্যেকটা বই লিখতে হয় না। বইগুলো প্রিন্ট রিপ্রিন্ট হচ্ছে। তার আয়ের পরিমাণ পৃথিবী হাজারো সাধারন লেখকের চাইতে অনেক অনেক বেশী। স্ট্রাগলিং লেখকেরা যেখানে জীবন যাপন করার মত টাকা আয় করতে পারছেন না সেখানে রাউলিং ফোর্বসের ধনীদের তালিকায় উঠে গিয়েছিলেন।
একই কথা অভিনেতা-শিল্পীদের ক্ষেত্রেও। সে পেশাগুলোও স্কেলেবল।
এই ধরনের পেশা আপনার জন্য তখনই ভালো যখন আপনি সফল হবেন।
মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার মত এটা। ডিম্বানুর দিকে যখন শুক্রানুরা ছুটে যায় তখন একটাই আগে পৌছায় এবং ডিম্বানুকে নিষিক্ত করতে পারে। যা পরে মানুষ হয় এবং পুনরোৎপাদনে নিয়োজিত হয়। কিন্তু বাকী অসংখ্য শুক্রাণু নাই হয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাস থেকে। একেবারে নাই।
স্কেলেবল পেশার ক্ষেত্রেও অসফলেরা এরকম নাই হয়ে যান বেশীরভাগ ক্ষেত্রে।
লেখক, শিল্পী, স্কেলেবল পেশা, নন স্কেলেবল পেশা এক্সট্রিমিস্তান না মেডিওক্রিস্তান? Share on Xএ ব্যাপারে আরেকটু গভীরে যাওয়ার জন্য একটি থট এক্সপেরিমেন্ট তথা চিন্তা পরীক্ষার অবতাড়না করেছেন নাসিম তালেব। পরীক্ষাটা এরকম,
ধরেন একটা বিরাট বড় স্টেডিয়াম। সেখানে আপনি র্যানডমলী নিয়ে এক হাজার লোককে দাঁড় করালেন। আর পৃথিবীর সব চাইতে ওজনওয়ালা লোককে দাঁড় করালেন অন্যপাশে। এখন আপনার স্টেডিয়ামের একশো লোকের ওজনের চাইতে পৃথিবীর সবচেয়ে ওজনদার লোকটির ওজন কি বেশী হবে?
অবশ্যই না।
এক হাজার লোকের ওজনের তুলনায় তার ওজন হবে নগন্য।
অথবা একজন মানুষ বাৎসরিক ক্যালরি নিতে পারে প্রায় আট হাজারের কাছাকাছি। বছরের কোনদিনই এই আট হাজারে অর্ধাংশ ক্যালরি সে নিতে পারবে না। এমনকী আপনি যদি চান ইচ্ছে করে একদিন ক্যালরি নিয়ে আট হাজারে অর্ধাংশ বা কাছাকাছি চলে যাবেন, সম্ভব না।
এই ধরনের অবস্থার নাম তালেব দিয়েছেন মেডিওক্রিস্তান।
আবার চিন্তা করেন, স্টেডিয়ামে এক হাজার লোক র্যান্ডমলী নিয়ে দাঁড় করালেন। অন্য পাশে রাখলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোককে, ধরেন বিল গেটসকে। এখন যদি ঐ এক হাজার জনের বাৎসরিক আয়ের সাথে বিল গেটসের আয়ের তুলনা করেন তাহলে কী দাঁড়াবে ব্যাপারটা? বিল গেটসের আয় ঐ এক হাজার জনের আয়কে ছাড়িয়ে যাবে বহুগুনে।
দেখা যাবে এই এক হাজার এক জনের মধ্যে প্রায় নিরান্নব্বই দশমিক নয় ভাগ সম্পদের মালিক একজন! তিনি বিল গেটস।
একইভাবে যদি এক হাজার জন সাধারন লেখক নেন আর তার বিপরীতে জে কে রাউলিংকে রাখেন, তাহলে দেখবেন রাউলিং এর বই বিক্রির তুলনায়, এদের সবার বই বিক্রির পরিমান খুব নগন্য।
এই ধরনের অবস্থা হলো এক্সট্রিমিস্তান।
উপরে পেশার ক্ষেত্রে যেগুলোকে বলা হয়েছে নন-স্কেলেবল পেশা, যেমন কনসালটেন্ট, ডেন্টিস্ট, কোন চাকরী ইত্যাদি এগুলো মেডিওক্রিস্তানের অন্তভূর্ক্ত।
আর যেসব পেশা স্কেলেবল (ঘন্টা হিশাবে আয় নির্ভর করে না) যেমন, লেখক, শিল্পী ইত্যাদি; এরা এক্সট্রিমিস্তানের অংশ।
এক্সট্রিমিস্তান পেশার ক্ষেত্রে ভাগ্য গুরুত্বপূর্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক অনেক চিত্র পাওয়া যাবে যেখানে কোন শিল্পী তার জীবদ্দশায় ছবি বিক্রি করতে সাফল্য পান নি। ভ্যান গগ তার জীবদ্দশায় একটামাত্র ছবি বিক্রি করতে পেরেছিলেন।
অনেক লেখকের বই বিক্রি হয় নি, মানুষ এবং সমাজ তাদের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করেছে। এরকম কবিদের জন্য ফেঞ্চ শব্দ পয়েত মুদি (poetes maudit। এডগার এলান পো, আর্থার রিম্বাউদ (আর্তু র্যাবো); এদের পরবর্তীতে রীতিমত পুজা করেছে মানুষ ও সমাজ।
এমনো লেখক-চিন্তকদের পাওয়া যায় যাদের লেখা মৃত্যুর অনেক অনেক পরে এসেছে আলোচনায়। যেমন, সোরেন কীর্কেগার্ড, ফ্রাণৎস কাফকা।
এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের গ্রেট গেটসবি উপন্যাসের কথাও স্মরণ করা যায়।
[এফ স্কট ফিটজেরাল্ড এই উপন্যাসরে নিজের একটা ব্যর্থ কাজ ভাইবাই মারা গেছিলেন। তিনি এমন ভাবছিলেন মরার কালে, যে তার এই লেখা তো লোকেই ভুইলাই গেছে। তার মরার পরে এন ওয়াই টাইমস গেটসবি নিয়া লেখছিল, বইটার যা সম্ভাবনা ছিল সেই জায়গায় যাইতে পারে নাই।
এর দুই বছর পরে যুদ্ধে সৈনিকদের মাঝে বই বিলি করার জন্য একটা কাউন্সিল গঠন করা হয়। সেই কাউন্সিল যেসব বই নির্বাচন করে এর মাঝে একটা ছিল গেটসবি। ১৫৫ হাজার কপি গ্রেট গ্রেটসবি বিলি করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের মাঝে।
এর পর থেকে বই খানার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বছরে ৫০ হাজার কপি করে বিক্রি হইতে থাকে ১৯৬০ পর্যন্ত। ২০১৩ পর্যন্ত এর মোট বিক্রি ছিল প্রায় ২৫ মিলিয়ন কপি। ২০১৩ তে এর ইবুকই বিক্রি হইছে ১৮৫ হাজার কপি।
ফিটজেরাল্ড তার এই উপন্যাসের সফলতা দেইখা যাইতে পারেন নাই।]
এক্সট্রিমিস্তানের প্রকৃতিই এমন, এখানে ভাগ্য একটা বড় ফ্যাক্টর। এক্সট্রিমিস্তান হলো উইনার টেইকস অল মার্কেট। এখানে যে সফল হতে পারে সেই সমস্ত পায়। এবং এই সাফল্য হঠাৎ করে চলে আসতে পারে আবার কখনো নাও আসতে পারে। এক্সট্রিমিস্তানের অন্তর্ভূক্ত পেশা যারা বেছে নেন, তারা সবাই মনে মনে বিশ্বাস রাখেন একদিন তাদের সেই দিন আসবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশীরভাগের ক্ষেত্রে সেইদিন আসে না।
এক্সট্রিমিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পেশা নেয়া একজন লোক যে সমাজে বাস করেন সেখানে বেশীরভাগ লোকই মেডিওক্রিস্তান পেশার। তিনি হয়ত একজন বিজ্ঞানী, শিল্পী কিংবা লেখক। তিনি অনবরত হয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন একটা মাস্টারপিস লেখতে। তিনি এমন কাজ করছেন যা ধারাবাহিকভাবে কিংবা রাতারাতি কোন ফল এনে দেয় না। অন্যদিকে তারই আত্মীয়, ভাই, বন্ধুরা তাদের কাজে হাতে হাতে ফল পেয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে তিনি সমাজের চোখে, তার আত্মীয় পরিজনের চোখে ব্যর্থ হিশেবে পরিগণিত হন। যে সমাজ হাতে হাতে ফল প্রত্যাশী তার তীব্র আঘাতে তিনি জর্জরীত হন।
তবুও দীর্ঘদিন কোন ভালো ফল না পেয়েও তিনি হয়ত পরিশ্রম করে যান, এই ভেবে যে তিনি মহান কিছু করছেন। এবং একদিন আসবে সেইদিন। কিন্তু এক্সট্রিমিস্তানের নিয়মই এই, বেশীরভাগের ক্ষেত্রে সেই দিন আর আসে না।