ঈর্ষা লইয়া

দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল লেখছিলেন, আপনে নেপোলিয়নরে ঈর্ষা করতে পারেন। কিন্তু নেপোলিয়ন ঈর্ষা করছেন সিজাররে, সিজার করছেন আলেকজান্ডাররে, এবং আলেকজান্ডার ঈর্ষা করছেন হারকিউলিসরে, যার অস্তিত্বই ছিল না। আপনে ঈর্ষা থেকে বাঁচতে পারেন যদি যাদেরকে নিজের চাইতে ভালো বা ভাগ্যবান ভাবেন, তাদের সাথে নিজেরে তুলনা করা বাদ দিতে পারেন। আবার এই যে তাদের নিজের চাইতে ভাগ্যবান ভাবেন এই ভাবনাটা হয়ত ভুল।

রাসেল ঈর্ষা থেকে বাঁচার উপায় হিশাবে বললেন নিজেরে অন্যের সাথে তুলনা না করারে।

আবার তিনি শুরুতে বললেন, ইতিহাসের বড় ব্যক্তিরাও তাদের চাইতে বড়দের সাথে তুলনা করতেন, ও ঈর্ষায় ভুগতেন।

এই তুলনা এড়ানো সহজ কাজ না।

অনেকে তুলনা করেন বা করতে বলেন নিজের অবস্থারে সহনীয় করতে। যেমন জ্ঞানী শেখ শাদীর বিখ্যাত কবিতা আছে যার মর্মার্থ, আমার জুতা ছিল না তাই মনে দুঃখ ছিল, কিন্তু বের হইয়া দেখলাম একজনের পা নাই, তখন মনের দুঃখ রইল না।

নিজের চাইতে খারাপ অবস্থায় যারা আছে তাদের কথা ভেবে নিজের অবস্থা নিয়া হা হুতাশ না করা। স্ট্র্যাটেজি হিশাবে এটা অনেকে ব্যবহার করে থাকেন।

আমার অবশ্য এখানে প্রশ্ন আছে, যদি এইটার উপর নির্ভর করে একজনরে নিজের অবস্থায় সুখে থাকতে হয়, তাহলে সে তো খুঁজতে থাকবে তার চাইতে অসুখী অবস্থায় থাকা ব্যক্তিরে। যেমন ওই কবিতার জুতা না থাকা লোকটা রাস্তায় বেরই হবে পা নাই লোক দেখতে। এটারে আমি তাই ভালো স্ট্যাটেজি মনে করি না।

রাসেল কি রূপকে বলছেন, নাকি উক্ত ব্যক্তিরা সত্যিই তুলনা করে ঈর্ষার দুঃখ বোধ করে গেছেন?

সত্যিই। নেপোলিয়ন সিজাররে, সিজার আলেকজান্ডাররে, এবং আলেকজান্ডার হারকিউলিসরে এডমায়ার করতেন। আলেকজান্ডার তো মনে করতেন তিনি হারকিউলিসের বংশধর।

প্লুতার্ক লাইফ অব সিজারে লেখেন সিজার বলতেছেন, তুমি কি মনে করো না এইটা এক দুঃখের কথা যে আমার বয়েসে আলেকজান্ডার কত কিছু অর্জন করেছিলেন, কত মানুষের রাজা হইছিলেন, আর আমি কী করছি, আমার কোন বড় সফলতাই নাই।

সিজারের মত এত বড় বিজয়ী রাজারও মনে দুঃখ ছিল, তার চাইতে বড় রাজা আলেকজান্ডার নিয়া।

ঈর্ষা আসে সামাজিক তুলনা থেকে। সাধারণত ঈর্ষা বেশি হয়ে থাকে যাদের সাথে মিলে বয়েসে, সামাজিক স্ট্যাটাসে বা পারিবারিক কারণে, তাদের সাথে।

সমাজ বিজ্ঞানী হেল্মুত স্কয়েক লেখেন, ঈর্ষা মোটাদাগে কাজ করে সামাজিক নিকট সম্পর্কিতদের মধ্যে… প্রতিবেশীদের মধ্যে সব সময়েই ঈর্ষা দেখা যায়। ঈর্ষাগ্রস্থ লোক মনে করে তার প্রতিবেশীর পা ভাঙ্গলে, সে নিজে ভালোভাবে হাঁটতে পারবে।

একটা কৌতুক আছে এইরকম। এক লোক রাস্তা দিয়া হাঁটতেছিল। সে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পাইল, এবং ঘষা দিয়া দেখল বাইর হইছে জ্বীন। জ্বীন তারে বললো, তুমি যা বলবা তাই পাইবা কিন্তু তোমার প্রতিবেশী এর দ্বিগুণ পাবে।

লোক বলল, তাইলে মাইরা আমারে আধমরা করে দাও।

এইখানে, সামাজিক নিকট সম্পর্কিত বলতে প্রতিবেশী খালি না, আপনি যার অবস্থানে নিজেরে ভাবতে পারেন। যেমন একজন লেখক ঈর্ষা করবে লেখকরে, ডাক্তার আরেক ডাক্তাররে, গায়ক আরেক গায়করে। গায়ক কোন এক এক্সপার্ট মুচিরে ঈর্ষা করবে না, মুচিরে ঈর্ষা করবে আরেক মুচি।

ঈর্ষা মানুষরে যে পেইন দেয় তা তো খারাপ। চার্লি মাঙ্গার বলছিলেন এইটা এক গর্দভী পাপ কারণ এতে কোন মজা নাই। তাহলে, প্রশ্ন আসে, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই ঈর্ষা কেন মানুষদের মধ্যে আসলো? খালি পেইন দিতে তো আসবে না।

ঈর্ষা মানুষরে সিগন্যাল দেয় সমাজে তার স্ট্যাটাস কমে যাচ্ছে। অমুকের স্ট্যাটাস, মান সম্মান বেশি হয়ে যাচ্ছে, এখন তার নিজের মান সম্মান বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। এই মেসেজ দেয় তারে।

ফলে একটা সেলফ ইম্প্রুভমেন্টের ফাংশন আছে ঈর্ষার।

ধরা যাক, কেউ এইটা কাজে লাগাইল, এবং ঘুমাইয়া না থাইকা কাজ করতে উঠলো, কারণ তার কলিগ বা বন্ধু ভালো করে ফেলছে। বিবর্তনের লজিকে, ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষায় এখানে ঈর্ষার একটা ভালো দিক দেখা যায়।

কিন্তু যখন ঈর্ষার পেইনটা তীব্র হয়, সে এর ফলে কিছুই করতে পারে না, এবং ওই ব্যক্তিরে আক্রমণ করে, ক্ষতি করতে চায়, নেগেটিভিটিতে আক্রান্ত হয়, এটা হইল কু প্রভাব, ঈর্ষা বলতে সাধারণত আমরা এই প্রভাবরেই বেশি বুঝে থাকি।

জুলিয়াস সিজারের এক বন্ধুর ছিল নাম ক্যাসিয়াস।

একবার সিজার নদীতে ডুবে মারা যাচ্ছিলেন। ক্যাসিয়াস তারে বাঁচান।

এইজন্য ক্যাসিয়াস নিজেরে সিজারের চাইতে সেরা মনে করতেন। সিজার বড় রাজা হয়ে যাবার পরেও সে সিজাররে তার চাইতে ছোট মনে করতেন।

সিজার যত সফল হইতে লাগলেন তার ঈর্ষা তত বাড়তে লাগল।

শেষে যখন সিজার হত্যার ষড়যন্ত্র হয়, এর শুরুটা করেছিলেন এই ক্যাসিয়াস। সে সবাইরে জড়ো করে, একত্রিত করতে উদ্যোগ নেন সিজাররে হত্যার জন্য। কারণ তিনি সিজারের সফলতাকে ঈর্ষা করতেন।

এই সিজারই আবার আলেকজান্ডারকে ঈর্ষা করতেন।

সিজারের ঈর্ষায় আলেকজান্ডারের কিছু হয় নাই, বা হয়ত সিজার এই তুলনার মাধ্যমে নিজেরে বেটার করার চেষ্টা করে গেছেন কিন্তু ক্যাসিয়াসের ঈর্ষায় সিজার হত্যা সংঘটিত হয়। এবং শুরু হয় ১৩ বছরের সিরিজ গৃহযুদ্ধ।

দান্তে তার ইনফার্নোতে সবচাইতে নিম্ন স্তরের দোজখে রাখছেন এই ক্যাসিয়াস, তার সাথের ব্রুটাস, এবং আরেক কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক জুডাস এস্কারিয়টরে।

কিছু কিছু হান্টার গেদারার সমাজে ঈর্ষা দূর করতে তারা সামাজিক স্ট্যাটাসটারেই দূর করতে নানা উপায় বের করেছিল।

যেমন, তারা কোন এক ভালো শিকারিকেই সব শিকার করতে দিত না। অন্য আরেকজনরে তীর ছুঁড়তে সুযোগ দিত যাতে সে পশুটা শিকার করতে পারে। কারণ একজন প্রতিদিন শিকার করলে তার মধ্যে এই ধারণা জন্মাতে পারে সে অন্য সবার চাইতে ভালো। কেউ শিকার করে নিয়ে আসলে তারা এই মাংসকে খুব বড় কিছু হিশাবে দেখত না, বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। যাতে তার ভেতরে অহংকার না জন্মে।

ভালো শিকারিরা হয়ত দুয়েকজন বেশী স্ত্রী রাখার সুযোগ পেত কিন্তু কোন দ্রব্যাদি বেশি পেত না যা দেখিয়ে সে নিজেরে অন্যদের চাইতে বেশী মর্যাদার দাবী করতে পারে।

তার গর্ব নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যদের ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ, এই দুইয়ের জন্যই ছিল এই পদ্বতি।

এই চর্চা টিকে থাকে নাই জটিল সমাজ তৈরি হতে থাকলে।

আধুনিক সমাজে এই অবস্থা নাই। এখানে ঈর্ষার নিয়ন্ত্রণ কঠিন।

একনোমিস্ট ও দার্শনিক এডাম স্মিথ এক উপায় বলেন।

“যে লোকের হঠাত কোন বড় সাফল্য চলে আসে সে লক্ষ করবে অন্যদের সাথে তার আনন্দ ভাগাভাগি করা কঠিন হয়ে উঠেছে। সে তার সফলতা ও সৌভাগ্যের গল্প বলা বন্ধ করে দিবে। সে বিনয়ী হতে চেষ্টা করবে, হয়ত ঠিকভাবে পারবে না। কিন্তু তার অন্ততপক্ষে চেষ্টা করা উচিত।”

মানুষের ঈর্ষা থেকে বাঁচতে এডাম স্মিথ বলেন, নিজের সফলতার গল্প না বলতে আর বিনয়ী হতে, যাতে মানুষ টের না পায়। এইজন্য দেখা যায় সমাজে সাকসেসফুল লোকেরা একেকজন বাইরে থেকে বিনয়ের ছোটখাট অবতার।

তারা নিজেদের সাকসেসকে ছোট করে দেখান ও দূর্ভাগ্যকে বড় করে দেখান।

যখন তারা এইরকম বিনয়ী থাকেন অন্তত বাইরে, তখন মানুষেরা একরকম তাদের মেনে নেয়।

হিউম্যান ন্যাচারের ডার্ক সাইড বিষয়ে অকপট দার্শনিক আর্থার সোপেনহাওয়ার একটা পরীক্ষার পথ বাতলে দেন আমাদের, কে আমাদের ঈর্ষা করে তা ধরে ফেলার জন্য।

তিনি বলেন, কেউ তোমারে ঈর্ষা করে কি না বুঝতে তার সামনে তোমার এক ভালো খবর শেয়ার করো। এরপর লক্ষ করবা তার গলার স্বর, মুখের ভঙ্গির কী পরিবর্তন হয়।

আবার, তার সাথে নিজের কোন দূর্ভাগ্যের খবর শেয়ার করবা। তখন খেয়াল করবা তার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠে কি না।

অন্যের দূর্ভাগ্যে যে আনন্দ হয় মানুষের তা বাস্তব, এবং এর জর্মন নাম হইল Schadenfreude, ইংরাজি উচ্চারণ শাডেনফ্রয়ডা।।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব মরাল আপত্তিগুলা ট্রেন্ডিং হয়, যেমন অমুক কেন তার বউরে ডিভোর্স দিছে তার বিচার চাই ইত্যাদি এরকম অনেক কিছু, এগুলার মূলে কোন নৈতিকতা থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, থাকে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঈর্ষা ও শাডেনফ্রয়ডা।।

ঈর্ষা পরিবেশ নির্ভরও, তাই কোন কোন সমাজে এটি বেশি থাকে। যেমন, ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক আমেরিকান সমাজে সফলদের সফলতায় খুশি হওয়া এবং ঈর্ষা চেপে রাখার নিয়ম আছে। কে হতে চায় মিলিওনিয়ার শোতে লাইফলাইন নিতে অংশগ্রহণকারীরা যখন দর্শকদের জিজ্ঞাসা করতে পারে, দেখা গেছে আমেরিকায় ৯০% মানুষই সঠিক উত্তর দেয়। কিন্তু রাশিয়ায় মানুষ লাইফলাইন নিতে চায় না কারণ ওইখানে মানুষের ভুল উত্তর দিয়ে ক্ষতি করার প্রবণতা আছে।

ঈর্ষা মানুষের প্রাকৃতিক ব্যাপার। কিন্তু এটি কীরকম শক্তিশালী ভাবে মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হবে তা নির্ভর করে ওই সমাজের সামাজিক নর্মগুলার উপরে।

যে সমাজ ঈর্ষারে নিয়ন্ত্রণ করার নর্ম তৈরি করেছে, তারা সামগ্রিকভাবে মিলে মিশে কাজ করতে পারে ও উন্নত হয়।

অন্যদিকে যারা ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা দূর্নীতি ও সিনিসিজমে, অন্যের প্রতি অবিশ্বাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পারস্পারিক আস্থা ও বিশ্বাস, তথা সোশ্যাল সাইন্টিস্ট রবার্ট পুটনামের সোশ্যাল ক্যাপিটাল একটা দেশের উন্নতির পথে বড় ফ্যাক্টর।

শাডেনফ্রয়ডা হলো, অন্যের দুঃখে আনন্দ পাওয়া, আবার পরশ্রীকাতরতা হচ্ছে, অন্যের সফলতায় দুঃখিত হওয়া। দুইটাই মূল থেকে ঈর্ষা থেকে আসে, দুইটা ধরণ। সামগ্রিক সমাজ বিবেচনায় সমাজে এগুলার একটা ভালো দিক আছে বলে আমার ধারণা।

এই দুইটা বা এর মূলে থাকা ঈর্ষা জাগ্রত হয় যখন ব্যক্তি অনুভব করতে থাকে সামাজিক ভাবে তারই কাছাকাছি কোন লোক বেশী ক্ষমতাবান হয়ে যাচ্ছে। অর্থ সম্পদ বিদ্যা বুদ্ধি সফলতা দিন শেষে সবগুলাই পাওয়ার বাড়ায়। তখন ঈর্ষার অনুভবে, সে হয়ত ওই ব্যক্তিরে গালি দিলো, নিন্দা করলো, বলল, ওই লোক চোরাকারবারি, বা অন্য কোন ক্রিয়েটিভ ভাবে প্রকাশ করলো। এই বলার মাধ্যমে সে একটা শান্তি পায়। ওই ব্যক্তির সাফল্য তার মনে যে অশান্তি তৈরি করছিল এটা ব্যালেন্স করে এই নিন্দা। এইভাবে কয়েকজন অসফল ও ক্ষমতাহীন মিলে যখন তারা ওই ব্যক্তির নিন্দা করে তখন তাদের মধ্যে একটা সাময়িক ভ্রাতৃত্ব বোধও আসে। এই মেকানিজম না থাকলে এই মানুষগুলা ঈর্ষার নেগেটিভ পাওয়াররে কন্ট্রোল করতে পারত না।

একইভাবে, ধরা যাক একজন লোক নিজে অসফল, সে সফল হইতে পারবে না, এইজন্য এমনিতে তার দুঃখ আছে। সে যখন অন্যের দুঃখ দেখে একটা আনন্দের ফিল পায়, এটা তার নিজের দুঃখ ভুলতে সাহায্য করে। শেখ শাদী যেভাবে বলছিলেন ওই উদারভাবে না, বরং ঠিক উলটাভাবে। আমি এক কেজি দুঃখে আছি, হালায় তো পাঁচ কেজি দুঃখে পড়ছে, হাহা, এটাই আমার আনন্দ।

অনেকে এখানে বলতে পারেন, এটা তো সমাধান না, তাদের জন্য তো এটা ভালো না। হ্যাঁ, ঠিক, কিন্তু সবাই সব কিছু বুঝবে না। কমন সেন্স, আপনে যখন ক্ষমতাহীন, তখন আপনার কাজ করতে হবে ওইসব দিকে যেগুলা আপনারে ক্ষমতাহীন করে রাখছে, ওইগুলা ইম্প্রুভ করতে হবে। হয়ত স্কিল বাড়ানো, হয়ত বেশী পরিশ্রম করা ইত্যাদি, নানা কিছু, কিন্তু প্রথমে আসে রিয়েলাইজেশন। নিজের অবস্থাটা বুঝতে পারা। কম্ফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসা, এবং কাজ করা, পরিশ্রম করা। এই পথটা প্রাথমিক ভাবে অনেক কঠিন, সবাই এইটা করতে রাজী হবে না। যারা করতে রাজী হবে না, তাদের ক্ষমতাহীনতার ফিল, যেইটা গভীরে নিরাপত্তাহীনতার ফিল, এটা দূর করতে একটা মেকানিজম তো লাগবে, সেটাই এই ঈর্ষা।

ফন্ট বড় করুন-+=