ও পাখি! ও কবি!

পাখিদেরও আছে নাকী মন
পাখিদেরও আছে নাকী মন – ইনাম আল হক

এক

পাখিদের আমরা দেখতে পাই। কী সুন্দর আসমানে উড়ে যাচ্ছে! গাছে বসে আছে। ডাইভ দিয়ে নেমে যাচ্ছে পুকুরে। ধরে আনছে ঠোটে করে মৎসবিশেষ। পাখি ইতস্তত ওড়াওড়ি করে, আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, বাসা বাঁধে গাছের ডালে, পুরাতন বাড়ির ভেন্টিলেটরে কিংবা অন্য কোনখানে, যেখানে সচরাচর চোখ যায় না আমাদের। তাদের কারো কারো বাসার শৈল্পিক সৌন্দর্য দেখে আমরা অবাক হই। ইস্কুলে রজনীকান্ত সেনের কবিতায় পড়েছিলাম

বাবুই হাসিয়া কহে সন্দেহ কী তায়?

কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়

বাবুই এবং চড়ুইয়ের কথোপকথনের মাধ্যমে আত্মসম্মানের সাথে নিজের অল্প নিয়ে বেঁচে থাকার যে সুখ তার জয়গান গেয়েছেন কবিমশাই। বাবুই পাখিদের এই বাসা নিয়ে একটা মজার কথা পড়েছিলাম কবি জসীম উদ্ দীনের আত্মজীবনীতে। কবি বইটিতে তার গ্রামীন জীবনের এক অসাধারণ এবং মনোমুগ্ধকর বর্ননা দিয়েছেন। তার বর্ননায় গ্রামের সেইসব দৃশ্য যেন চোখে দেখা যায় এরকম অবস্থা হয়।

মজার কথাটা হল বাবুই পাখির বাসা নিয়ে। বাবুই পাখি তাদের বাসায় কিছুটা গোবর নিয়ে জমায়। অতঃপর জোনাক পোকা ধরে নিয়ে সে গোবরে আটকে রাখে। রাতে গোবরে আটকে থাকা জোনাক পোকা জ্বলতে এবং নিভতে থাকে নিজস্ব ছন্দে। বাবুই পাখির বাসা দোলতে থাকে বাতাসের মৃদু আঘাতে। কল্পনা করা যাক, এমন শত শত বাসা একটি তালগাছে ঝুলছে। বাতাসে তারা দোলছে আর ভিতরে জ্বলছে এবং নিভছে জোনাক পোকা। এক অপার্থিব সুন্দর দৃশ্যের অবতাড়না হবে নিশ্চয়ই।

সেই দৃশ্য কল্পনার পর বাস্তবে আসা যাক। বাবুই পাখি বহুগামি। একই গাছে ভিন্ন ভিন্ন বাসায় একই পুরুষ মিস্টার বাবুইয়ের ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গিনী থাকে। পাখিদের একগামিতা এবং বহুগামিতা নিয়ে দারুণ তথ্য আছে পাখিবিদ ইনাম আল হকের বইয়ে। বইটির নাম পাখিদেরও আছে নাকি মন। খুব দারুণ একটি বই। এই বছর আমার পড়া প্রথম বই।

জীবনানন্দ দাশ

বইটিতে অনেক ধরণের পাখির ছবি আছে। লেখক খুব গুছিয়ে এবং তার দারুণ গদ্যে পাখি সম্পর্কে লিখেছেন। একটার পর একটা প্রবন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে গেছে। প্রবন্ধের বিষয়গুলো বললে হয়ত বুঝতে সুবিধা হবে সবার। পাখিদের একগামিতা, বহুগামিতা বিষয়ক প্রবন্ধের কথাটা তো আগেই বলেছি। আছে পাখির পোশাক তথা বিভিন্ন সময়ে তাদের বর্নিল সাজের কথা, আছে লেসবোস দ্বীপের কবি সাফো, তার প্রেয়সী এবং এর সাথে পাতি মাছরাঙার সম্পর্কের আখ্যান। আছে বনদস্যুদের কথা, অতিথি পাখি, ইকারাস, সম্রাট অশোক এবং বিপন্ন পাখিদের গল্প।

আরেকটা বিষয় আছে এই বইতে, যা মূলত বইটিকে প্রাণ দিয়েছে। সেটা হচ্ছে কবিতা। বইয়ের গদ্যে কাব্য তার মায়া বিস্তার করে গেছে। হয়ত লেখক হৃদয় দিয়ে লিখেছেন। পাখির প্রতি তার প্রগাঢ় মমতা এবং পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবার প্রেক্ষিতে তার দুঃখ বিষাদের মত ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের অন্তরে। আমার পড়ে মনে হয়েছে পাখিদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। অন্তত কিছু লোককে সচেতন করা তো যায়ই।

জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে বার বার পাখির কথা। জীবন বাবুর কবিতায় আসা সেইসব পাখিদের বিষয়ে বলা আছে বইটিতে। আছে কবির প্রিয় বুনোহাঁস, পেঁচা, শালিখ, চিল ও কাকের বিবরণ, ছবি আর তার লেখা পাখিদের নিয়ে কবিতার লাইন-

এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাক কাচপোকা মাছরাঙা পানকৌড়ি দোয়েল চড়াই।

 

দুই

কবিদের কবিতায় পাখি আসে মাথাকাটা সেই ঘোড়ার মত। ঘোড়াটার গল্প আমি শুনেছিলাম। রোজ রাতে, যখন অন্ধকার এবং নিরবতা নিজেদের আলীঙ্গন করে এক দ্বিমুখি যাদুবাস্তবতার আনয়ন করে গ্রামে, মফস্বলে কিংবা শহরেও; তখন সেই মাথাকাটা ঘোড়াগুলি বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় সমস্ত রাস্তায়। কবিতায় পাখিদের ঘুরে বেড়ানোটা এরকম। অনেকটা দুর্বোধ্য, বেশিরভাগ যাদুময়।

শক্তির কাক কার্ণিশে বসে থাকে। অগনন হাঁসের দল তার কবিতায় পাখা দোলায়। সরোজিনী চুরি করে নিয়ে যায় শাদা রাজহাঁস। যখন ধানক্ষেতে নেমে আসে চাঁদ, ইঁদুরেরা তাকায় নক্ষত্রের পানে তখন হৃদয়পুরে উদঘাটিত হয় মুখবাঁকা ঈগলবকের ঝাঁক। তারা শনশন শব্দে পাখা ঝাপটে কোথায় যেন চলে যায়, পিছনে ফেলে রেখে বাতাস এবং ডানার সম্মিলনে উদ্ভূত অপার রহস্য। ইনাম আল হকের বইতে বুনোহাঁসের আসা যাওয়ার রহস্য নিয়ে কিছু আলোকপাত আছে। তারা কোথা থেকে আসে, যায় কোথায়, কীভাবে তাদের নিরন্তর সংগ্রামী জীবন পদে পদে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে এই বাংলায়। আছে সেসব গল্প।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

যে বাংলায় কবি জীবনানন্দ ভোরের কাক বা শঙ্খচিল, শালিকের ভেসে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, তা পাখিদের জন্য আর নিরাপদ ভূমি নয়। তিনি যদি ফিরেও আসেন, তাহলে তাকেও হয়ত কোন শিকারী ফাঁদ পেতে ধরবে। মধ্যবিত্ত কিনবে। তারপর ভেজে কিংবা ঝোল ঝোল করে রান্না হবে মাংস তার। জীবননানন্দ হয়ত এভাবেই বাঙালীর পেটে হজম হয়ে যাবেন। অথবা হয়ত ইতিমধ্যেই হয়ে গেছেন, কে জানে!

শক্তি তার কবিতায় সমস্ত দিন ইতস্তত ঘুরতে থাকা ময়ুরদের কথা বলেছেন। তারা ডালে পাতায় জড়িয়ে থাকে। বলেছেন সিংহাসন এবং তার উপর চাপ মাংস; এবং তার পায়ায় বাঁধা চারটি ঈগলপক্ষীর কথা। এনেছেন দুই চড়ুইয়ের বাসা গড়ার গল্প। খরকুটো মুখে কুড়িয়ে এনে শুরু হয় দুই চড়ুইয়ের গৃহনির্মান। কবি এরপর বলেছেন চড়ুইয়ের বাসায় ডিম ভাঙবে, ডাকাতিয়া বাতাসে ধ্বসে যাবে চড়ুইয়ের ঘর; যতই তারা খরকুটো আনুক। বাসা ভাঙার গল্প, করুণ বাস্তব গল্প ‘পাখিদেরও আছে নাকী মন’ গ্রন্থেও আছে। সুদৃশ্য লম্বা লেজ বাইরে বের করে থাকা শাবুলবুলির বাসা কিংবা বিলাইছড়িতে নলবন কাটুয়াদের হাতে শতশত পাখির বাসা ধ্বংশের কাহিনী পড়ে মন বেদনাক্রান্ত হয়ে উঠে।

 

তিন

কবি আল মাহমুদ লিখেছেন তার প্রিয় পাখি কাক নিয়ে কবিতা। কাকের কন্ঠে তিনি শুনতে পান সত্যের সুর। তার নগর জীবনের ক্লান্তিতে ক্ষয়ে আসা জীবন সতেজতার অনুপ্রেরণা প্রায় উত্তম নাগরিক কাকের কা কা ধ্বনির মধ্য থেকেই। জীবনানন্দ তার ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে স্মরণ করেছিলেন কাকের কথা। এই কৃষ্ণকায় পাখিটি বঙ্গভবনে কোন পোষাকে আসে তার এক বর্ননা আছে ইনাম আল হকের বর্ননায়।

আল মাহমুদ

আল মাহমুদের কবিতায় আরো বিভিন্ন সময় এসেছে পাখি। বিলে বুনোহাঁসের আগমনকে তিনি দেখেছেন হাওয়ার পাপড়ির মতো। ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন পাখির মত বন্য হবার। পাখিরা কেন সুন্দর গৃহ নির্মান করে তা জানতেও আগ্রহ তার। লিখেছেন,

একবার পাখিদের ভাষাটা যদি

শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর।

জানতাম পাতাদের আড়ালে তারা

খড় দিয়ে কেন গড়ে ঘর সুন্দর;

এছাড়া রবীন্দ্রনাথ কবিতায় দুর্দশার কাল বুঝাতে ডালে পাখি না বসার উপমা টেনেছেন আল মাহমুদ। দুর্দশা কিংবা খারাপ সময়ের উপযুক্ত রূপায়ন। বাংলাদেশ থেকে নানা প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাখিবিদ ইনাম আল হক জানাচ্ছেন গত ত্রিশ বছরে ত্রিশ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এদেশ থেকে। যে তিনশ প্রজাতির স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পাখি আছে তাদেরও শতাধিক প্রজাতি হারিয়ে যাবে আগামি দুই তিন দশকে।

এ এক মর্মান্তিক বিষয়। পাখি বিলুপ্তির অন্যতম কারণ কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহার, পাখি শিকার, পাখির বাসস্থান নষ্ট, বন উজার করা, আনন্দের জন্য গৃহে বন্য প্রাণী পালন, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি।

এদেশের প্রাচীন বাসিন্দা পাখিদের আমরা নিঃশেষ করে ফেলছি। বাস্তসংস্থান তথা পৃথিবীর পরিবেশের যে এক সমন্বিত স্পন্দন এর জন্য এসব পাখি দরকারী। পাখি বিলুপ্ত হলে সেই স্পন্দনে ব্যঘাত ঘটবে। ফলশ্রুতিতে আমাদের জন্য নেমে আসবে দুর্দিন। দুর্দশার কাল তথা সেই দুর্দিনে ডালে বসার মত পাখি অবশিষ্ট থাকবে না। পখিহীন গাছের ডাল সেই দুর্দশার কালের প্রতীক হয়ে থাকবে।

কবির সুমন গেয়েছেন, পৃথিবীটা পাখি গাছ মানুষ সবার। এই কথাটা যেন আমরা সবাই মনে রাখি।

পাখিদের ক্ষতি না করি। এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক সবাই, জীবনানন্দের কাচপোকা মাছরাঙা পানকৌড়ি দোয়েল চড়াইসহ সবাই থাকুক, বেচেবর্তে থাকুক।

সকল প্রাণী সুখী হোক।