চিত্রশিল্পী
বের হয়েছিলাম কোন একটা কাজে। তখন রোদের দিন। রোদের এক ধরনের গন্ধ নাকে আসছে। হয়ত রোদের গন্ধ না। রাস্তার গন্ধ, মানুষের গন্ধ সব মিলেমিশে তৈরী হয়েছে। আমার কাছে মনে হল রোদেরই গন্ধ। গন্ধটা ঠিক কি রকম বোঝাতে পারব না। অস্পস্ট রঙের মত।
আমি আস্তে আস্তে হাটছিলাম। আমার একটু সামনে একটি রিকশা এসে থামল। রিকশার পিছনে কিছু ছবি আঁকা। স্বস্তা ধরনের রঙ ব্যবহার করে আঁকা ছবি। কিন্ত মনে হচ্ছে জীবন্ত। আমি ছবি গুলোর প্রতি আকৃষ্ট হলাম।
বিভিন্ন ছবি, রঙ ইত্যাদি নিয়ে ছোট একটি রিসার্চ করছি। সে কারনে অথবা অন্য কোন কারনে ছবিগুলো টানল আমাকে খুব।
রিকশাওয়ালাকে গিয়ে ছবি বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কে একেছে জিজ্ঞেশ করায় সে শিল্পির নাম বলল। আমার লোকটাকে দেখার আগ্রহ হল। রিকশাওয়ালার কাছ থেকে ঠিকানা নিলাম।
খুব বেশি দূরে না শিল্পীর বাসা। এখান থেকে কাছেই। পায়ে হাটা পথে দশ মিনিট। তাই হেটে ই রওনা দিলাম। দুটা গলি পেরিয়ে একটু ভিতরে ঢোকে বামদিকের এক বাসার নাম্বার মিলিয়ে দেখলাম রিকশাওয়ালার দেয়া নাম্বারের সাথে মিলে গেল।
একটা ঝুপড়ির মত ঘর। ঘর দেখে হতাশ হলাম। এখানে কোন বড় মাপের লোকের প্রত্যাশা করা বৃথা। পাশের ড্রে্ন থেকে ভকভক করে দূর্গন্ধ আসছে। দম আটকে আসে এরকম দূর্গন্ধ।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম দরজা খোলা। একজন লোক খালি গায়ে উবু হয়ে ছবি আঁকছেন। তিনি পা ছড়িয়ে বসেছেন। তার লুঙি ও হাটুর উপরে চলে এসেছে।
ইনিই বোধহয় শিল্পী। ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পান খাচ্ছেন। মাথায় ঝাঁকড়া কাচাপাকা চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
সমস্ত ঘরজুড়ে আঁকার জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো।
আমি দরজায় দাঁড়াতেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভিতরে এসে বসেন। দরজায় দাঁড়ালে লাইট আসে না।
আমি একটু ভিতরে গিয়ে তার ছবি আঁকা দেখতে দেখতে বললাম, আমি আপনার ছবি দেখে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনি চমৎকার আকেঁন। আপনার নাম কি?
তিনি বললেন, আমার নাম তোরাব আলী।
আপনি কি শুধু আকাঁ আঁকি ই করেন?
-জি জনাব। আঁকাআঁকি করি। কাটাকুটি খেলি। দুনিয়া কাটাকুটি খেলার জায়গা। হে হে হে।
তোরাব আলীর হাতে তুলি ছিল। তিনি রঙে চুবিয়ে তা দিয়ে সামনের কাগজে একটা ক্রসের মত দিলেন। প্রথম টান দেয়ার সময় বললেন কাটা দ্বিতীয় টানের সময় কুটি। তিনি বোধহয় কাটাকুটি জিনিশটা পরিস্কার করলেন আমার কাছে।
আমি সপ্রশংস চোখে বললাম, আপনার আঁকা ছবিগুলো অসাধারন। আমি রিকশার পিছনে একটা দেখেছি। আসলেই অসাধারন। আমি পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ছবি দেখেছি। আপনার গুলো আসলেই ব্যতিক্রম।
তোরাব আলী আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মুখের বা দিকে ডান হাতের আঙুল দিয়ে টেলে মুখ পাশ থেকে সুপারির গুড়াগুলো সরাতে সরাতে বললেন, আমি হইতেছি শিল্পী। দ্য ক্রিয়েটর। অন্য যাদের আপনেরা শিল্পী বলেন ওরা নকলবাজ। অন্যের সৃষ্টি নকল করে।
আমি খানিকটা কৌতুকবোধ করলাম তার বলার ভঙ্গি দেখে। যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। তাকে জিজ্ঞেশ করলাম, মানে কি? আপনি কি বলতে চান পৃথিবীর বড় শিল্পীরা শিল্পী না?
তোরাব আলী আগের মতই বললেন, যারা অন্যের সৃষ্টি নকল করে হেরা শিল্পী না। তারা হইল গিয়া মুখস্ত করা ছাত্রের মত। আমার আঁকা গুলা দেখেন। কোন নকল নাই। সব আমার সৃষ্টি। আমি কারো সৃষ্টির ছবি আঁকি না।
আমি তোরাব আলীর ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। ছবিগুলোর সাথে পৃথিবীর কোন প্রানী বা মানুষের কোন মিল নেই। সম্পূর্ন অদ্ভূত ধরনের আঁকা ছবিগুলো। প্রত্যেকটাই মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত। এরকম জীবন্ত আর কোন ছবি কখনো মনে হয় নি।
তোরাব আলী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র সুরে হে হে করে হেসে উঠলেন। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি লোকটা হাসে অদ্ভুত ভাবে। হে হে করে টেনে টেনে।
তোরাব আলী হাসা বন্ধ করে বললেন, আপনি ভাবতেছেন ছবিগুলা ক্যান জীবন্ত লাগতেছে? ঠিক না?
আমি তোরাব আলীর কথায় ভয় পেলাম কিছুটা। কেন জানি গায়ের রোম কাটা দিয়ে উঠল। মনে হল তার চোখদুটি হচ্ছে জ্বলন্ত দুটি গোলক। যা আমার ভিতর পর্যন্ত পড়ে নিচ্ছে অনায়াসে। ভয়ে ভয়ে ইতস্তত করে বললাম, হ্যা। তবে আপনি জানলেন কী করে?
তোরাব আলী হেসে বললেন, ভয় পাইয়েন না। আমার ছবি যে দেখে সেই এমনে ভাবে।তাই বললাম। আপনি যা ভাবতেছেন তাই। ছবিগুলো আসলেই জীবন্ত।
আতঁকে উঠে বললাম, জীবন্ত মানে?
তোরাব আলী নির্বিকার ভাবে পান চিবুতে চিবুতে বললেন, জীবন্ত মানে জেতা। জিন্দা।
এ কী করে সম্ভব?
তোরাব আলী আগের মতই বলেন, সব ই সম্ভব। আমি নিজে সৃষ্টি করি। তাই আমি জীবন দিতে পারি। আমি নকল করি না।
ঘরময় ছড়ানো কয়েকটা ছবির দিকে চোখ গেল। দেখলাম সত্যি ই জীবন্ত ছবিগুলো। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায় আস্তে আস্তে নড়ছে যেন।আর সব ছবি ই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর। ব্যাপারটা আগে আমার নজরে আসে নি এতটা প্রকটভাবে।
তোরাব আলী আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পৃথিবীর একজন সার্থক শিল্পস্রষ্টা কিন্তু আমার কথা কেউ জানল না। আফসোস!
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম, আমি আপনার কথা প্রচার করব। ব্লগে ফেসবুকে পত্রিকায় দিব। তাহলে নিশ্চয়ই জানবে সবাই। এত ক্ষমতাধর শিল্পী আমাদের দেশে আছেন তা সবার জানা দরকার। আপনাকে নিয়ে এবং আপনার সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা হবে।
তোরাব আলী আমার দিকে আগের মতই হতাশ চোখে তাকালেন। তিনি এখনো পান চিবুচ্ছেন। চিবুতে চিবুতে ই বললেন, আমার এই গুণের কথা জেনে কেউ এখান থেকে যাইতে পারে নাই। এইটা হইল কথা। নির্মম কথা। তয় সত্য। নির্মম কথাগুলো সত্য হইলেই ভয়ংকর।
আমার মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত ভয়ে গেল। গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল। তোরাব আলীকে আবারো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেশ করলাম, কেন? এখান থেকে যেতে কি অসুবিধা?
তোরাব আলী আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রঙে ডুবানো তুলিটা হাতে নিলেন। সামনের কাগজে ক্রস টেনে বললেন, দুনিয়া কাটাকুটির খেলা ভাই সাহেব। আমি সৃষ্টি করে কাটা দিচ্ছি। কেউ আমাকে গোপন রেখে তার কুটি দিচ্ছেন। এইতো কাটাকুটিরে ভাই। এইটাই জীবন। তবে আপনে ভাগ্যবান । একজন সার্থক চিত্রশিল্পী দেখলেন। দুনিয়াতে সবাই সার্থক চিত্রশিল্পী দেখে যেতে পারে না।এখন বিদায়। অনেক দিন নতুন কোন ছবি আঁকি না। আজ আঁকব।
তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। এরপর থেকে আমি আর আমাকে আলাদাভাবে অনুভব করতে পারছি না। তবে আমি নিশ্চিত আমি বেঁচে আছি। আমার সামনেই আছে তোরাব আলীর আঁকা কয়েকটা বিকটদর্শন ছবি। মাঝে মাঝে তোরাব আলীকেও দেখি। তোরাব আলীর কাছে আমার মত একজন দুজন লোককেও আসতে দেখি সপ্তাহে কিংবা মাসে। আমি আমার কানকে অনুভব করতে পারছি না, কিছু শুনতেও পারছি না। তবে তোরাব আলী কাগজে তুলির কাটাকুটি দাগ দিয়ে যখন হে হে করে হাসে তখন তার পান খাওয়া দাঁত বের করা দেখেই আমি বুঝতে পারি তার হাসি। এ ও বুঝতে পারি আমি ঝুলে আছি তোরাব আলীর রুমের বা দিকের দেয়ালের কোন অংশে।
———————————————————————————————————
গল্পটি প্রথম প্রকাশ করি সামুতে ২১ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৩৭। এরপর তা আমার প্রথম বইয়েও যুক্ত হয়। সত্যজিৎ রায়ের একটা গল্প আছে গগন চৌধুরীর স্টুডিও। সত্যজিৎ এর শঙ্কু সিরিজেও মনে হয় এরকম একটি গল্প আছে। গল্পটি সানডে সাসপেন্সে শুনি কিছুদিন আগে। আজ এই গল্পটি এখানে পোস্ট করার কারণ হল অহল্যা নামে এরকম একটি শর্ট ফিলিম দেখলাম।