মুরাদুল ইসলাম » গল্প » এদোগাওয়া রানপোর গল্প “মানসিক পরীক্ষা”

এদোগাওয়া রানপোর গল্প “মানসিক পরীক্ষা”

ফুকিয়া হয়ত জীবনে অনেক দূর যেতে পারত যদি সে তার অসাধারন বুদ্ধিবৃত্তি ভালো কাজে লাগাত। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী যুবক ফুকিয়া, টোকিওর ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকদের নিত্য গর্বিত করে চলেছিল। যে কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারত এক দারুণ সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যারিয়ারের দিকে না গিয়ে সে সহসা নিজেকে শেষ করে দিল একটি খুনের মাধ্যমে!

কেন বা কোন রহস্যময় কারণে এই প্রতিভাবান তরুণটি এমন হিংস্র কাজ করেছিল, সে সম্পর্কে নানা অনুমান সেই জঘন্য অপরাধ সংঘটনের আজ এতদিন পরেও চালু আছে। কেউ কেউ এখনো মনে করে খুনের সেই চিরাচরিত কারণটি অর্থাৎ টাকাই এই খুনের পিছনের কারণ। এই ধারণাটি অনেকাংশে বিশ্বাসযোগ্য। তরুণ ফুকিয়া তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত এবং আর্থিক অনটন তার ছিল। এছাড়া, তার মত প্রতিভাবান যুবককে টাকার জন্য কাজ করতে গিয়ে অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, এই বোধ তাকে হয়ত গভীরভাবে আঘাত করেছিল। এজন্য সে হয়ত ভেবেছিল এই অপরাধই তার ঐ অবস্থা থেকে বেরোনোর একমাত্র পথ। কিন্তু এইসব কারণ কি তার সেই অদ্ভুত জঘন্য হিংস্র অপরাধকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম? অন্যরা অবশ্য আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তত্ত্ব দিয়েছেন ফুকিয়া আসলে আজন্ম অপরাধী। সে আসলে খুন করার জন্যই খুন করেছে, অন্য কোন কারণ এর সাথে জড়িত নয়। কারন যাই হোক, এটা স্বীকার করার কোন  উপায় নেই অন্যসব অতি বুদ্ধিমান অপরাধীদের মত ফুকিয়াও নিখুঁত অপরাধ করতে গিয়েছিল।

ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর প্রথম দিন থেকেই ফুকিয়া ছিল চঞ্চল এবং অস্থির। যেন কোন এক অশুভ শক্তি তার চিন্তার জগত গ্রাস করে নিচ্ছিল, তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিচ্ছিল সেই ভয়ংকর খুনে নকশা পূর্ন করার কাজে। প্রতিদিন ক্লাস করার সময়, বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে আড্ডায়, এবং ব্যয় নির্বাহের জন্য করতে থাকা সাধারণ কাজগুলির সময়ে সে হতবুদ্ধি হয়ে থাকত এটা ভাবতে ভাবতে যে কী তাকে এত সন্ত্রস্ত করে তুলছে।  এবং একদিন সে তার এক ক্লাসমেট সাইতো’র সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠে এবং তার মাথায় ছায়া ছায়া ভাবে থাকা সেই নকশাটি আকার নিতে শুরু করে সেদিন থেকেই।

সাইতো ফুকিয়ার মতই একজন ছাত্র। ফুকিয়ার মত টাকা পয়সা নিয়ে তারও সমস্যা। এক বছর ধরে সে একটা বাড়িতে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকছে। বাড়ির মালিক একজন ষাট বছর বয়েসী বুড়ো মহিলা। মহিলার স্বামী ছিলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। স্বামী মারা যাবার পরে তিনি স্বচ্ছল অবস্থাতেই আছেন কিন্তু স্বভাবে ভদ্রমহিলা ছিলেন বদমেজাজী ও দারুণ অর্থলোভী। তার কিছু বাড়ি থেকে নিয়মিত মাসোহারা বাড়ি ভাড়া পেতেন তিনি। কিন্তু এরপরও সুদে টাকা খাটাতেন। এর মাধ্যমে তিনি অনেক টাকা বাড়তি যোগ করে ফেলেন তার সম্পত্তিতে। মহিলার ছিলেন নিঃসন্তান, স্বামী মারা যাবার প্রথমদিকে টাকাই তার স্বান্তনার কাজ করেছিল। সাইতোকে ভাড়াটে হিসেবে রাখার পিছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরাপত্তা। যেসব লোক সুদে টাকা খাটায় এরা বাড়িতে অনেক টাকা রাখে। ভদ্রমহিলাও রাখতেন। তাই বাড়িতে একজন বিশ্বাসী পুরুষ লোক থাকা নিরাপত্তার জন্য দরকারী।

ফুকিয়া সাইতোর কাছে এসব শোনার পর পরই বৃদ্ধার টাকার প্রতি তার লোভ জাগ্রত হল। কয়েকবার সাইতোর সাথে বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে যাবার পরে সে নিজেকে বার বার বলতে লাগল, “এত টাকা দিয়ে বৃদ্ধ মহিলা কী করবে? এই মহিলা আর কয়দিনই বা বাঁচবে? আর আমি এখনো যুবক। আমার সামনে পড়ে আছে ভবিষ্যত।”

তার চিন্তা এই জায়গাতেই বার বার ঘোরপাক খেতে লাগল। এক পর্যায়ে সে একটি উপসংহারে চলে এল। বৃদ্ধার টাকা তার চাই। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরই ডালপালা মেলে ভয়ংকর এক পরিকল্পনায় রূপ নিল। প্রথমেই ফুকিয়া ভেবে নিল প্রতিটি সফল পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে – দক্ষ এবং নিরেট প্রস্তুতি।

একদিন কথায় কথায় সাইতো এমন একটি কথা বলে ফেলল যা ফুকিয়ার মাথা প্রায় ঘুরিয়ে দিল। এই তথ্যের জন্যই সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল মনে মনে।

সাইতো হাস্যোচ্ছ্বলে, বন্ধুর মাথায় বড় হতে থাকা ভয়ংকর পরিকল্পনাটি সম্পর্কে না জেনেই বলল, “আমার বাড়িওয়ালী মহিলা তার টাকা নিয়ে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। প্রতিমাসে টাকা লুকিয়ে রাখার নতুন জায়গা বের করে। আজ দূর্ঘটনাক্রমে আমি তার সাম্প্রতিক টাকা লুকানোর জায়গার খোঁজ পেলাম। সেই এই ক্ষেত্রে একেবারেই অসাধারন। ধারণা করতে পারো কোথায় টাকাটা রাখা হয়েছে?”

একজন দক্ষ অভিনেতার মত নিজের ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রেখে, হালকা হাই তুলে এবং অনাগ্রহী ভঙ্গিতে ফুকিয়া বলল, “আমি কোন অনুমানও করতে পারব না।”

সাইতো তার এই অভিনয়ের ফাঁদে ধরা দিল। ফুকিয়ার অনাগ্রহে সে কিছুটা হতাশ হয়েই বলল, “তাহলে শুনো, সাধারণ কেউ টাকা লুকিয়ে রাখতে চাইলে কোন গোপন গহ্ববরে বা দেয়ালের মধ্যে গর্ত করে রাখে। কিন্তু আমার প্রিয় বাড়িওয়ালী তার লুকানোর কাজে অনেক বেশী মৌলিক। গেস্ট রুমের তাঁকে একটি বামন পাইন গাছ আছে, তা তোমার মনে আছে কি? সেই জায়গাটাই হচ্ছে বৃদ্ধ মহিলার টাকা লুকানোর নতুন জায়গা। সেই পাত্রের ভিতরে মাটির নিচে। তোমার কি মনে হয় না ভদ্রমহিলা অতিরিক্ত চালাক? কোন চোর এই জায়গায় টাকা আছে ভাবতেই পারবে না।”

দিন যেতে লাগল এবং সাইতোকে দেখে মনে হল সে এই কথাবার্তার কথা ভুলেই গেছে, কিন্তু ফুকিয়া ভুলে নি। সাইতোর কথাগুলির প্রতিটি শব্দ সে মনযোগের সাথে শুনেছে এবং এরপরই সে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছে বুড়ো মহিলার টাকা হস্তগত করতে হবে। কিন্তু এর আগে কিছু জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে। এর মধ্যে একটি হল কীভাবে এমন অবস্থা তৈরী করা যায় যাতে সামান্যতম সন্দেহও যেন তার দিকে না আসে। আরো যেসব জিনিস, যেমন বিবেকে দংশন বা অনুশোচনা তা তাকে তেমন ভাবিত করল না। দস্তয়ভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশম্যান্টে রাশকোনিকভের কথাবার্তা, বিদেহী আত্মার ভয়ে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি আজগুবি চিন্তাভাবনা। সে মনে করে শেষ পর্যন্ত সব কিছু নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে। নেপোলিয়ন যে প্রচুর মানুষ হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন তাই বলে কি তিনি গনহত্যাকারী বলে গন্য হবেন? অবশ্যই না। তিনি যাই করে থাকুন না কেন, এখন প্রশংসিত সেনানায়ক যিনি সম্রাট হয়েছিলেন।

কাজটি করার জন্য ফুকিয়াকে শান্তভাবে সুযোগের অপেক্ষা করতে হল। যেহেতু সে প্রায়ই সাইতোর সাথে দেখা করতে ওই বাড়িতে যেত তাই বাড়িটির সামগ্রিক গঠন সম্পর্কে তার ধারণা ছিল। আরো কয়েকবার গিয়ে সে বাকী সব খুঁটিনাটি যা তার দরকার সব জেনে নিল। উদাহরনস্বরূপ, সে জানল বুড়ো মহিলা ঘর থেকে খুব কমই বের হন। এটা ছিল হতাশাজনক আবিষ্কার। বুড়ো মহিলা দিনের পর দিন তার বাড়ির একটা অংশে নিঃশব্দেই থাকতেন। যদি কোন কারণে তাকে বাইরে যেতেই হত তাহলে তিনি তার কাজের মেয়েটিকে পাহাড়ায় রেখে যেতেন। কাজের মেয়েটি সাধারণ এক গ্রাম্য মেয়ে। ফুকিয়া বুঝতে পারল এই পরিস্থিতিতে তার অপরাধ কর্মটি করা খুব সহজ হবে না। যদি এতে সফল হতে হয়, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ চতুরতার ব্যবহার করতে হবে।

পুরো এক মাস ধরে ফুকিয়া বিভিন্ন ধরনের উপায় বের করল টাকা হাতিয়ে নেবার এবং সব ক’টিতেই সে নানা ফাঁক দেখতে পেয়ে সে বাতিল করে দিল। শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারল এর একটাই সমাধান আছেঃ বুড়ো মহিলাটিকে তার খুন করতে হবে। সে নিজেকে এই বলে যুক্তি দিল মহিলার যত টাকা আছে, এর জন্য খুন করা অযৌক্তিক হবে না। এবং সে এটাও নিজেকে মনে করাল ইতিহাসের সব বিখ্যাত ডাকাতরাই তাদের শিকারকে সব সময় খুন করে এসেছে, কারণ মৃতরা কথা বলতে পারে না। শিকার খুন করার অর্থ স্বাক্ষী না রাখা।

সতর্কভাবে সর্বোচ্চ নিরাপদে কীভাবে কাজটি করা যায় তার পরিকল্পনা করতে লাগল ফুকিয়া। এতে সময় লাগল। নির্দোষ সাইতোর কাছ থেকে ফুকিয়াও এও অবগত হল না টাকা লুকানোর জায়গা পরিবর্তিত হয় নি। সব কিছু একেবারে নিখুঁত ভাবে, এমনকী একেবারে তুচ্ছ জিনিসও নিখুঁতভাবে সে করতে পারবে, এমন মনে হতে লাগল ফুকিয়ার।

সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিত ভাবে একদিন ফুকিয়ার সামনে সেই সুযোগটি চলে এল যার জন্য সে অপেক্ষায় ছিল। সাইতো ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে পুরোদিন বাইরে থাকবে। কাজের মেয়েটি একটি সংবাদের প্রেক্ষিতে বাইরে যাবে এবং সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে না। কাকতালীয়ভাবে এর দুই দিন আগে ফুকিয়া একটু যাচাই করে দেখেছিল মহিলার টাকা ঐ লুকানো জায়গাতে আছে কী না। সাইতোর সাথে দেখা করতে গিয়ে সে ভদ্রমহিলার রুমে গিয়েছিল তার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। তখন কথাবার্তার এক পর্যায়ে সে মহিলার গোপন টাকাগুলির কথা তুলে খুব সতর্কভাবে এবং মহিলার চোখ কোন দিকে যায় তা লক্ষ করে। মনস্তত্ত্বের একজন প্রতভাবান ছাত্র ফুকিয়া, যখন দেখল লুকানো টাকার কথা উঠতেই মহিলার চোখ খুবই অল্প সময়ের জন্য সেই বামন পাইন গাছের দিকে গেল তখন সে বুঝে নিল জিনিস জায়গামতই আছে।

খুনের দিনে ফুকিয়া তার ভার্সিটির পোশাকটিই পরল, ক্যাপ এবং কালো ছাত্রদের আলখেল্লাটি সহ। হাতে গ্লাভস পরে নিল যাতে আঙুলের ছাঁপ না থাকে। অনেকদিন আগে থেকেই সে ছদ্মবেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, কারণ সে মনে করে ছদ্মবেশমূলক পোশাক তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে। তার দৃঢ় বিশ্বাস অপরাধ যত সহজ ও সাধারনভাবে সংঘটিত হবে, অপরাধীকে বের করা হবে তত কঠিন। সে তার পকেটে নিল লম্বা কিন্তু সাধারণ বড় একটি ছুরি এবং নতুন মানিব্যাগ। এই জিনিসগুলি সাধারণ একটি ছোট দোকান থেকে সে কিনেছে। যখন কিনেছে তখন দোকানে আরো অনেক ক্রেতা ছিল এবং কেনার সময় সে কোনরূপ দামদর করতে যায় নি। তাই তার এই বিশ্বাস আছে যে কেউ তার কথা মনে রাখবে না।

নিজের চিন্তায় মগ্ন ফুকিয়া আস্তে আস্তে হেটে অপরাধ সংঘটনের স্থানটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সে যখন বাড়িটির কাছে চলে আসছিল তখন দশম বারের মত নিজেকে মনে করিয়ে দিল বাড়িতে প্রবেশের সময় কারো চোখে পড়া যাবে না। কিন্তু বাড়িতে পৌছার আগে যদি দূর্ঘটনাক্রমে কোন পরিচিত ব্যক্তির সাথে দেখা হয়ে যায়? এটা খুব একটা মারাত্মক কিছু হবে না, পরিচিতকে বুঝানো যেতে পারে সে হাটতে বেরিয়েছে। এরকম সে প্রায়ই বেরোয়।

পনের মিনিট পর সে বৃদ্ধ মহিলার বাড়ির সামনে পৌছল। যদিও পরিচিত কারো সাথে তার দেখা হয় নি, তবুও সে বুঝতে পারছিল ভয়ে ও উত্তেজনায় যেন তার দম ফুরিয়ে আসছে। এটা তার কাছে এক জঘন্য অনুভূতি। প্রশান্ত এবং ভদ্র অপরাধের একজন রাজপুত্র হিসেবে নিজের যে ছবি সে তার মানসপটে সব সময় রেখে এসেছে এর পরিবর্তে তার নিজেকে মনে হতে লাগল একজন সাধারণ চোর বা ছিঁচকে চোরের মত।

নিজের স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ফুকিয়া চুপিসারে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল। যখন কাউকে দেখা গেল না তখন কারো চোখে এখনো পড়ে নি আশ্বস্ত হয়ে সে তার মনযোগ বাড়ির দিকে ন্যস্ত করল। বাড়িটি আরো দু’টি বাড়ির মাঝখানে স্যান্ডউইচের মত। দুই সারি গাছ দুইদিকে ঐ দুই বাড়ি থেকে এই বাড়িটিকে আলাদা করে রেখেছে। গাছের সারি গাঢ় প্রাকৃতিক দেয়ালের কাজ করছে। বাড়ির সামনে বিপরীত দিকে কংক্রিটের দেয়াল, এর ভিতরে বিত্তশালীদের জন্য সম্পূর্ন আলাদা একটি ব্লক।

আস্তে এবং শব্দহীনভাবে, গেইটের সাথে যুক্ত ঘন্টা হাত দিয়ে ধরে, ফুকিয়া গেইটের খুলল। ঘন্টা হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল যাতে খোলার সময় শব্দ না হয়। বাড়ির প্রাঙ্গনে ঢোকার পর সে শান্তভাবে হেটে চলে গেল দরজার কাছে এবং আস্তে করে ডাক দিল।

কলিং বেলের শব্দের সাথে মিলিয়েই সে বলল, “শুভ সকাল।” তার গলার স্বর তার নিজের মনের হল না।

তার প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এল। বুড়ো মহিলা দরজার কাছে এলেন, তার পরনের কিমোনো এক ধরনের খচমচ শব্দ সাথে নিয়ে এল।

তিনি কিছুটা নিচু হয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “শুভ সকাল মিস্টার ফুকিয়া। কিন্তু আপনার বন্ধু সাইতো তো বাসায় নেই।”

ফুকিয়া তাড়াতাড়ি বলল, “আমি আসলে আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছি, যদিও তা সাইতো বিষয়েই।”

মহিলা বললেন, “তাহলে ভেতরে আসুন।”

ফুকিয়া তার জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করার পর ভদ্রমহিলা তাকে বসার রুমে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “আমার কাজের মেয়েটি আজ বাসায় নেই। তাই আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। এক মিনিটের বেশী লাগবে না।”

তিনি উঠলেন এবং অন্য কক্ষে যাওয়ার জন্য ফিরলেন।

এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল ফুকিয়া। ভদ্রমহিলা যখন দরজা খোলার জন্য কিছুটা নিচু হয়েছিলেন তখনই পিছন থেকে ফুকিয়া তাকে ঘুষি মারল। এবং তার গ্লাভস পরা দুই হাত দিয়ে মহিলার গলা চেপে ধরল। কয়েক মিনিট মহিলা ছটফট করলেন এবং তার এক আঙ্গুল পাশে রাখা ভাঁজ করা পর্দাটিকে সামান্য ছিঁড়ে ফেলল।

মহিলা অসাড় হয়ে যাবার পর ফুকিয়া সতর্কভাবে পর্দাটিকে নিরীক্ষণ করে দেখল। পর্দাটি দু’ভাঁজের এবং এর উপরে স্বর্নালী আঁশে আঁকা আছে সামন্ততান্ত্রিক সময়ের সুন্দরী কোমাচি’র ছবি। মহিলা মৃত্যু কালের যন্ত্রনায় যে আঁচড় কেটেছেন তা গিয়ে পড়েছে একেবারে কোমাচি’র মুখের উপরে।

ফুকিয়া শীঘ্রই আবার তার প্রশান্ত ও স্থির অবস্থায় চলে গেল। এই পর্দা কিছু বুঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। সে তাই এটাকে ছেড়ে নিয়ে তাঁকের দিকে গেল যেখানে রয়েছে বামন পাইন গাছ। সে টব থেকে গাছটি তুলে ফেলল এবং যেরকমটা আশা করেছিল সেরকমই দেখতে পেল; ওয়েল পেপারে মোড়া বান্ডিল।

সে তাড়াতাড়ি ওয়েল পেপার খুলে ফেলল এবং ভিতরে টাকা দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেমে এল ফুকিয়ার।

সময় নষ্ট করল না ফুকিয়া। সে অর্ধেক টাকা নিয়ে তার নতুন মানিব্যাগে রাখল। বাকী অর্ধেক আগের মত ওয়েলপেপারে মুড়ে পরিপাটি করে রেখে দিল আগের মতই। তার মতে এটাই তার সবচেয়ে দক্ষ পদক্ষেপ। এখানে কত টাকা ছিল তা বৃদ্ধ মহিলা ছাড়া আর কেউ জানত না। অর্ধেক সরালেও কারো বুঝার উপায় নেই টাকা সরানো হয়েছে। তাই টাকা যে চুরি গেছে তা পুলিশ ভাবতেও পারবে না।

ফুকিয়ার এর পরের পদক্ষেপ ছিল বুড়ো মহিলার হৃতপিন্ডে লম্বা ছুরিটে বিদ্ধ করে দেয়া। এটা করার পর ছুরি বের করে সে মহিলার পরনের কিমোনোতে মুছে সে নিজের পকেটে পুরে নিল ছুরিটা। এই অদ্ভুত কাজটি সে করেছে যাতে কোনভাবে মহিলার বেঁচে যাবার সুযোগ যেন না থাকে, যেমনটা অপরাধ সংস্লিষ্ট উপন্যাসে ফুকিয়া প্রায়ই পড়ে এসেছে। সে প্রথমে মহিলাকে ছুরি দিয়ে খুন করে নি কারন তাতে রক্তের ছিটা তার পোশাকে লাগার সম্ভাবনা ছিল।

ফুকিয়া গাছটি পাত্রে রেখে এমনভাবে মাটি চাপা দিল যে দেখে বুঝার উপায় নেই এটা নাড়াচাড়া করা হয়েছে। সে পিছনে সন্দেহজনক কিছুই রাখল না। এরপর সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে একবার নিঃশব্দে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল। জুতার ফিতা বাঁধার সময় তার মনে হল পায়ের ছাঁপ দেখে কি কেউ কিছু বুঝতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝতে পারল এর কোন সম্ভাবনা নেই, ঘরে প্রবেশের রাস্তা সিমেন্টের আস্তরনে আচ্ছাদিত। পায়ের ছাপ পড়বে না। বাগানে আসার পর তার আরো নিরাপদ বোধ হল। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, ভূমি শক্ত এবং শুকনো। এখন একমাত্র কাজই বাকী তার, সোজা সামনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

তার হৃতপিন্ড উন্মত্তভাবে লাফাচ্ছিল। এখন সামান্য ভুলেই মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সে সামান্য পদ শব্দের জন্যও তার কানকে খাড়া করে রাখল। কিন্তু দূর থেকে কেবল তার কানে ভেসে আসল জাপানী বীণার সঙ্গীত। ঘাড় খাড়া করে ফুকিয়া সোজা হেটে গিয়ে গেইট খুলল এবং সোজা হেটে বেরিয়ে গেল।

ভদ্রমহিলার বাসার পাঁচ কিংবা ছয় ব্লক পরে জাপানি শিন্তো ধর্মের একটি মঠ ছিল, চারিদিকে উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ফুকিয়া সে দেয়ালের ফাক দিয়ে পাশের খালে বড় ছুরিটি এবং তার রক্তমাখা গ্রাভসদ্বয় ফেলে দিল এবং অলসভাবে হাটতে হাটতে চলে গেল একটি ছোট পার্কে, যেখানে সে প্রায়ই হাটতে যেত। সে বেঞ্চিতে বসে স্বাভাবিক ভাবে দেখতে লাগল দোলনায় কয়েকটি শিশু খেলা করছে।

কিছু সময় এখানে কাটানোর পর ফুকিয়া হাই তুলে উঠে দাঁড়াল, আরমোড়া ভেঙ্গে শরীরটাকে সোজা করে হেটে হেটে চলে গেল পাশের থানায়। নির্দোষ একটা চাহনি দিয়ে সে ডেস্কে বসা সার্জেন্টের সাথে কথা বলল।

তার মানিব্যাগ দেখিয়ে সে বলল, “ অফিসার, আমি এই মানিব্যাগটি রাস্তায় পেলাম। এটা টাকায় ভর্তি, তাই আমি ভাবলাম থানায় দিয়ে যাই।”

পুলিশের লোকটি মানিব্যাগ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল এরপর সাধারণ কিছু প্রশ্ন করল। ফুকিয়া স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে গেল, কোথায় সে পেয়েছে, কখন ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, যে তার এই তথ্যগুলি ছিল বানানো। কেবল একটি তথ্যই বানানো ছিল না। সেটা হল তার নাম এবং ঠিকানা।

কয়েকটি ফর্ম পূরণের পর সার্জেন্ট তাঁকে একটি রিসিপ্ট দিয়ে দিল। ফুকিয়া তা পকেটে ঢুকিয়ে অল্পক্ষনের জন্য একবার ভাবল কাজটা কী সে ঠিক করেছে। যেকোন দিক থেকে দেখতে গেলে এটাই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা। কেউ জানে না বৃদ্ধ মহিলার টাকা অর্ধেক চুরি গেছে। এবং এটাও নিশ্চিত কেউ এই মানিব্যাগের টাকা দাবী করতে আসবে না। জাপানি আইন অনুসারে কেউ টাকা কুড়িয়ে পেলে এক বছরের মধ্যে যদি দাবীদার না পাওয়া যায় তাহলে ঐ টাকা যিনি পেয়েছেন তাকে দিয়ে দেয়া হয়। এক বছর অবশ্যই লম্বা সময়, কিন্তু তাতে কি? এটা ব্যাংকে রাখা টাকার মতই, ফুকিয়া এর প্রাপ্তির ব্যাপারে পুরো নিশ্চিত থাকতে পারে।

 

পক্ষান্তরে টাকা যদি সে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখত তাহলে তা খরচ করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় তার থাকতে হত। তখন দিনের প্রতি মুহুর্তেই তাকে থাকতে হত প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যে। কিন্তু যেভাবে সে এই সন্দেহের দূরতম সম্ভাবনাও দূর করে দিল তাতে বৃদ্ধ মহিলা ব্যাংক নোটগুলির সিরিয়াল যদি রেখে থাকত, তবুও ধরা পড়ার সুযোগ থাকত না।

থানা থেকে হেটে বাসায় ফেরার সময়ে সে উল্লসিত মনে ভাবতে লাগল কী অসাধারন নিপুনভাবেই না কাজটা সে করেছে। ‘বিশুদ্ধ প্রতিভার স্বাক্ষর’ মৃদু হেসে সে নিজেই বলে উঠল। “আর পুলিশের জন্য কী নির্মম পরিহাস! একজন চোর তার লুঠের মাল তাদের কাছে রেখে আসল! এই অবস্থায় কীভাবে কেউ একজন আমাকে সন্দেহ করবে? কেন, এমনকী মহান বুদ্ধও সত্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন না!”

এর পরের দিন প্রশান্তির ঘুম দিয়ে সকালে উঠল ফুকিয়া। বোর্ডিংহাউজের পরিচারিকা খবরের কাগজ রেখে গিয়েছিল। ফুকিয়া তা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে শুরু করল এবং একটি খবর দেখে তার সদ্য ঘুম থেকে উঠা চোখ পুরোপুরি প্রশস্ত হয়ে উঠল। খবরটির প্রথম অংশে আছে বৃদ্ধ মহিলার মৃতদেহ আবিষ্কার হবার খবর। এতে ফুকিয়ার অবাক হবার কোন কারনই ছিল না। কিন্তু রিপোর্টের শেষের দিকে উল্লেখ আছে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে তার বন্ধু সাইতোকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার সাথে পাওয়া গেছে অনেক টাকা।

ফুকিয়া ভাবল, আসলে এই ঘটনাও আতংকিত হবার মত কিছু না। এটা তার নিরাপত্তার জন্য এক দিক দিয়ে ভালোই হল। সাইতোর একজন নিকঠ বন্ধু হিসেবে থানায় সাইতো সম্পর্কে খোঁজ নেয়া দরকার মনে করল ফুকিয়া।

ফুকিয়া খুব তাড়াতাড়ি পোশাক পরে পত্রিকায় উল্লিখিত থানায় চলে গেল। দেখা গেল এটি সেই থানা যেখানে সে মানিব্যাগ ফেরত দিয়ে এসেছিল। এটা জানতে পেরে ফুকিয়া তার ভাগ্যকে অভিশাপই দিল এবং তার মনে হল কেন আমি টাকা নিয়ে অন্য কোন থানায় যাই নি? তবে, এখন তা আর পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই।

অত্যন্ত দক্ষভাবে সে তার বন্ধুর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার উদ্বেগের কথা জানাল। সে জিজ্ঞেস করল সাইতোর সাথে দেখা করার অনুমতি সে পাবে কি না। পুলিশ অফিসার ভদ্রভাবে জানালেন তা সম্ভব নয়। এরপর ফুকিয়া জানতে চাইল কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে তার বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু পুলিশ কোন কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানাল।

অবশ্য ফুকিয়া এ নিয়ে তেমন কিছু মনে করল না। ওরা না বললেও সে সহজেই কল্পনা করে নিতে পারল যে আসলে কী হয়েছিল। সেদিন নিশ্চয়ই সাইতো কাজের মেয়ে ফেরার আগেই বাসায় ফিরে এসেছিল। ততক্ষণে ফুকিয়া বৃদ্ধ মহিলাকে খুন করে চলে গেছে। সাইতো হয়ত প্রথমে ভেবেছিল ডাকাতি হয়েছে। তাই সে বামন পাইন গাছের নিচে পরীক্ষা করে দেখল টাকা আছে কি না। কিন্তু সে দেখতে পেল ওয়েলপেপারে মোড়া টাকাগুলি ঠিকই আছে। আর এরপর কী হয়েছিল তাও ফুকিয়া সহজে কল্পনা করে নিতে পারে।

সন্দেহাতীতভাবে, সাইতো’র ওই টাকার প্রতি লোভ জাগ্রত হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যদিও এটা করা ছিল তার বোকামি। সে ভাবল সবাই ভাববে বৃদ্ধ মহিলাকে খুন করে খুনি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এই ভেবে সে সমস্ত টাকা নিজের পকেটস্থ করে ফেলল। এরপর সে কী করেছে? তাও সহজে বুঝা যায়। সে তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে মৃতদেহ পাওয়া যাবার বিষয়টি জানিয়েছে। কিন্তু ঐসময়ও টাকা তার সাথে ছিল। সে ভাবে নি প্রথম সন্দেহের তীরটি তার দিকেই আসবে এবং তাকেই প্রথম খানাতল্লাস করা হবে। কী চূড়ান্ত গর্দভ!

ফুকিয়া আরো ভাবতে লাগল, সাইতো নিশ্চয়ই বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। সেইসব চেষ্টা, তার কোন বিবৃতি কি ফুকিয়াকে বিপদে ফেলতে পারে? সাইতো যদি বলতে থাকে আসলে এই টাকাগুলি তার তাহলে ঠিক আছে। টাকার পরিমাণ অনেক। একজন ছাত্রের কাছে এত টাকা কীভাবে আসবে এই প্রশ্ন অতি অবশ্যই উঠবে। তাই সাইতো’র বক্তব্য মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তখন সাইতো’র কাছে আর একটি মাত্র পথ থাকতে, নির্জলা সত্যটাই বলা। এক্ষেত্রে ঝানু উকিলের জেরার মুখে সে বলে ফেলতে পারে বৃদ্ধ মহিলার টাকা রাখার জায়গার কথা সে ফুকিয়াকেও বলেছিল।

ফুকিয়া স্পষ্ট শুনতে পেল সাইতো বলছে, “এই অপরাধ সংঘটিত হবার মাত্র দুইদিন আগেও আমার বন্ধু ফুকিয়া ঐ রুমে বসে বৃদ্ধ মহিলার সাথে তার লুকানো টাকা নিয়ে কথা বলেছে, এবং সে জানত টাকাগুলি কোথায় লুকানো আছে। তাহলে সে কি এই অপরাধ করতে পারে না? এই কোর্টে উপস্থিত ভদ্রমহোদয়েরা, আপনাদের জ্ঞাতার্থে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার বন্ধু ফুকিয়া তার অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় ছিল তা সবার জানা কথা।”

নিজের এইসব স্বগতোক্তিতে ফুকিয়া অসস্থি অনুভব করছিল কিন্তু শীঘ্রই তার আশাবাদী মন সাময়িক আতংক কাটিয়ে উঠল। পূর্ন আবেগহীন চেহারায় সে থানা থেকে ফিরে এল বোর্ডিংহাউজে। নাস্তা করতে বসার সাথে সাথেই তার পুরনো সাহসের অহমিকা ফিরে এল। খেতে খেতে সে কাজের মহিলাটিকে বলছিল এই খুনের কিছু বিষয় সম্পর্কে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কিছু সময় পরেই ফুকিয়া বুঝতে পারল খুনের সন্দেহভাজন হিসেবে সাইতো’র গ্রেফতার হওয়াটাই ক্লাসের এবং ক্যাম্পাসের প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

এই উত্তেজনাকর কেইসের দায়িত্ব যার উপর পড়েছিল তিনি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি কাসামোরি। যিনি তার আইনি কাজকর্মের জন্যই কেবল বিখ্যাত নন, ব্যক্তিগত কিছু অর্জন বিশেষ করে, মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার জন্যও পরিচিত। যখন তিনি এমন কোন কেইসের সামনে এসে পড়েন যা সাধারণ তদন্তের নিয়মে সমাধান করা যাচ্ছে না তখন তিনি তার মনস্তত্ত্ববিদ্যার জ্ঞান সেখানে ব্যবহার করে অসাধারনভাবে মীমাংসায় পৌছে যান। কাসামোরি’র মত একজন বিখ্যাত মানুষের হাতে যখন বৃদ্ধ মহিলার খুনের কেইসটি পড়ল, তখন সাধারণ লোকেরা রায় নিশ্চতই হয়ে গেল এই খুনের রহস্যের জট খুলতে যাচ্ছে।

কাসামোরিও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। শুরুতে দেখতে যত কঠিনই মনে হোক না কেন, তিনি এর মীমাংসা করে ছাড়বেন। তিনি প্রথমে বৃদ্ধ মহিলার সাথে যুক্ত সব কিছু তদন্তের আয়তায় নিয়ে এলেন। কেইস আলাদতে উঠার আগেই সব দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে উঠবে। কিন্তু তদন্ত শুরু করে তিনি বুঝতে পারলেন, তদন্ত যত এগুচ্ছে কেইস তত জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। বাইরে থেকে পুলিশেরা বার বার বলছে আর কেউ নয় সাইতোই খুনি। কাসামোরিও পুলিশের তত্ত্বের পেছনের যুক্তি মেনে নেন। বৃদ্ধ মহিলার সাথে যক্ত সব লোককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কাউকেই তেমন সন্দেহ করার অবকাশ নেই, একমাত্র তার এই ছাত্র ভাড়াটে, দূর্ভাগা সাইতো ছাড়া।

বৃদ্ধ মহিলার কাছ থেকে যারা টাকা ধার নিত, তার অন্য সব ভাড়াটে, এমনকী বৃদ্ধ মহিলার সামান্য পরিচিতদের সাথে ফুকিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

সাইতো’র ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় ছিল যা তার মারাত্মক ক্ষতি করে যাচ্ছিল। সে ছিল প্রকৃতিগত ভাবেই খুব ভীত প্রকৃতির মানুষ। আদালতের পরিবেশে সে মারাত্মক ভাবে আতংকিত হয়ে পড়ল। কথা তার মুখে আটকে যাচ্ছিল, হাত পা কাঁপছিল। একজন অপরাধী ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য যেন তার মধ্যে ফুটে উঠছিল এইসব আচরনে। এছাড়া অতিরিক্ত ভীতিকর উত্তেজনায় সে তার পূর্বে বলা বিষয় ভুলে গিয়ে পরস্পরবিরোধী এবং একেক সময় একেক কথা বলে নিজেকে আরো বিপন্ন করে তুলল। এছাড়া আরেকটি কারণে তার মানসিক অবস্থা উন্মাদ দশার প্রায় কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিল। সেটা সত্যিই সে ভদ্রমহিলার অর্ধেক টাকা চুরি করেছিল, যেমনটা ফুকিয়া ভেবেছিল ঐরকমই।

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি সাইতোর বিরুদ্ধে সব প্রমানাদি জড় করলেন। সাইতোর জন্য তার করুনা বোধ হতে লাগল। কিন্তু কাসামোরি’র মনে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। তিনি নিজেকে বার বার প্রশ্ন করতে লাগলেন, “এই ভীতু প্রজাতির উজবুক কী এমন নিখুঁত এবং হিংস্র খুন করতে পারে?” তিনি সাইতো যে অপরাধী এতে সন্দেহ পোষন করতে লাগলেন। যেসব প্রমান আছে তাতে সরাসরি সাইতোকে অপরাধী প্রমান করা যায় না এবং এখনো সাইতো খুন করার কথা স্বীকার করে নি।

এক মাস চলে গেল।এই সময়ে প্রাথমিক রহস্যভেদও সম্ভব হল না। তদন্তের অগ্রগতির শম্বুক গতি তিনি মারাত্মকভাবে বিব্রত হয়ে উঠলেন।

কেইসের কাগজপত্র প্রায় শতবারের মত ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন কর্মকর্তাদের এজন্য ঝাড়িও দিলেন একদিন। “এভাবে চলতে থাকলে এই কেসের মীমাংসায় পৌছাতে হাজার বছর লাগবে।”

কাসামোরি রাগান্বিত ভাবেই অন্য একটি ডেস্কে গিয়ে কিছু কাগজ তুলে নিলেন। যে থানার অধীন এলাকায় বৃদ্ধ মহিলা খুন হন ঐ থানার ক্যাপ্টেন মামলার বিষয়বস্তু নিয়ম মাফিক লিখে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্যহীনভাবেই তিনি কাগজগুলির উপরে চোখ বুলাচ্ছিলেন। এক সময় আকস্মিকভাবে তার চোখে পড়ল পচানব্বই হাজার ইয়েন সমেত একটি মানিব্যাগ পাওয়া যেদিন মহিলা খুন হন ঐদিনই। মহিলার বাড়ির কাছে একটা জায়গায়। ঐ মানিব্যাগ খুঁজে পায় এবং থানায় পৌছে দেয় ফুকিয়া নামক একজন ছাত্র। এবং সে প্রধান সন্দেহভাজন সাইতো’র অন্তরঙ্গ বন্ধু! কোন কারণে- হয় কোন কোন গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে ব্যস্ত থাকার জন্য পুলিশের ক্যাপ্টেন এই রিপোর্ট আগে পাঠান নি।

পুরো রিপোর্টটি পড়ার পর কাসামোরি’র চোখ অদ্ভুত দ্যোতিতে চকচক করে উঠল। এক মাসের মত তিনি অন্ধকারে হাতরে মরছিলেন। এই তথ্য সেই অন্ধকারের মাঝে ক্ষীন এক আলোক রেখা। এই তথ্য কি কেইসের জন্য গুরুত্বপূর্ন? কাসামোরি দেরী না করে তা খতিয়ে দেখতে মনস্থ করলেন।

ফুকিয়াকে সাথে সাথে ডাকা হল এবং ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি তাঁকে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এক ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে কাসামোরি’র মনে হল এতে কোন লাভই হচ্ছে না। ফুকিয়াকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল আগের জিজ্ঞাসাবাদে সে কেন এই মানিব্যাগ প্রাপ্তি এবং তা থানায় জমা দেবার বিষয়টি উল্লেখ করে নি, এর উত্তরে ফুকিয়া বলল তার মনে হয় নি এটা বলার কোন প্রয়োজন আছে। কারণ বৃদ্ধ মহিলার টাকা তো চুরি হয় নি। ফলে এই ঘটনাকে তার বিচ্ছিন্নই মনে হয়েছে।

সরাসরিভাবে ফুকিয়ার দেয়া এই উত্তর কাসামোরির কাছে যুক্তিযুক্তই মনে হল। বৃদ্ধ মহিলার টাকা সাইতো’র কাছে পাওয়া গেছে। তাহলে কে ভাববে ঐ কুড়িয়ে পাওয়া টাকা বৃদ্ধ মহিলার?

যাইহোক, কাসামোরি ধাঁধায় পড়ে গেলেন। প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার হল যে লোক তারই অন্তরঙ্গ বন্ধু খুন হয়ে যাওয়া জায়গার অল্প দূরে সেইদিনই প্রচুর টাকা কুড়িয়ে পেল এবং তা থানায় দিয়ে এল, এ কী কেবলই কাকতালীয় ঘটনা? সাইতো আদালতে একথাও বলেছে তার বন্ধু ফুকিয়া বৃদ্ধ মহিলার লুকানো টাকার কথা জানত। সুতরাং এই টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার ভিতরে কোন রহস্য আছে। এখানে অবশ্যই আছে প্রখর গোয়েন্দার জন্য যোগ্য এক জটিল ধাঁধা।

রাগান্বিত ভাবে এই কেইসের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে কাসামোরির একবার মনে হল বৃদ্ধ মহিলাটি ব্যাংক নোটগুলির সিরিয়াল নাম্বার যদি লিখে রাখত তাহলে সহজেই বের করা যেত ফুকিয়ার জমা দেয়া টাকা গুলি মহিলার ওখান থেকে চুরি হওয়া টাকা কি না।

নিজেকে তিনি বার বার বলতে লাগলেন, “একটা মাত্র সূত্রও যদি পেতাম আমি।”

এর পরের কিছুদিন কাসামোরি অপরাধ সংঘটনের স্থানে বার বার গেলেন। বৃদ্ধ মহিলার আত্মীয়দের সাথে কথা বললেন। কিন্তু তাতে কোন লাভই হল না। তিনি মানতে বাধ্য হলেন তিনি যেন একটি দেয়াল ঠেলছেন, কোন সূত্রও মিলছে না।

ফুকিয়ার এই টাকা ভর্তি মানিব্যাগ পাওয়াকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে মনে করেন তা হল, এই মানিব্যাগের টাকা বৃদ্ধ মহিলারই টাকা। ফুকিয়া বৃদ্ধাকে খুন করেছে সেই অর্ধেক টাকা মানিব্যাগে নিয়ে এসেছে, বাকী অর্ধেক রেখে এসেছে জায়গামত। এবং মানিব্যাগ টাকা রাস্তায় পাওয়া গেছে বলে অভিনয় করেছে। কিন্তু এইরকম অবিশ্বাস্য জিনিস কী আসলেই সম্ভব? মানিব্যাগটি খুব যত্নসহকারে, মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে পরীক্ষা করে হয়েছে, সামান্যতম সূত্রের জন্য। কিন্তু পাওয়া যায় নি। এছাড়া ফুকিয়ার বক্তব্যও বিবেচনায় নিতে হবে। সে বলেছে যেদিন খুন হয় ঐদিন সে বৃদ্ধ মহিলার বাড়ির সামনে দিয়ে হেটে গিয়েছে। যে লোক খুন করেছে সে কি এমন সহজ স্বাভাবিক ভাবে এরকম বিপদজনক কথা বলতে পারে? এবং তারপর আসে সেই ছোরা বা অস্ত্রটির কথা যার মাধ্যমে বৃদ্ধ মহিলাকে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। সারা বাড়ি এবং বাড়ির আশপাশের বৃহত্তর পরিসরে খোঁজেও সেই বস্তুটি পাওয়া যায় নি।

চূড়ান্ত প্রমাণ না পাওয়ার কারণে পুলিশের সাইতোকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা যৌক্তিকই মনে করেন কাসামোরি। কিন্তু এরপরও ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি কাসামোরির যুক্তি দিলেন, সাইতো দোষী হলে ফুকিয়াও দোষী। আড়াই মাসের তদন্তের পরে এটাই বের হল যে সম্ভাব্য সন্দেহভাজন দুইজন। কিন্তু এদের কাউকে অভিযুক্ত করার মত কোন সূত্রও বের হল না।

এই কানাগলিতে পৌছার পরে কাসামোরির কাছে আরেকটি পদ্বতি ছিল এই কেইসের রহস্য উদঘাটনের।  সন্দেহভাজন দুইজনকে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার ভেতর নিয়ে যেতে হবে। এই পদ্বতি পূর্বে কাজ করেছে।

 

খুনের দুই তিন দিন পরে ফুকিয়াকে যখন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন সে জানতে পারে সুপরিচিত শখের মনস্তত্ত্ববিদ, ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি কাসামোরি এই কেইসের দায়িত্বে আছেন। এই ব্যাপারটি তাকে আতংকিত করে তুলে। ডিস্ট্রিক্ট এটর্নীর নাম শুনেই এবং বিশেষত দ্বিতীয়বার তিনি নিজে ডাকিয়ে নিয়ে যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তখন শান্ত এবং পরিপূর্নভাবে প্রস্তুত ফুকিয়া ভীত হয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছি কাসামোরি হয়ত কোন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করবেন। তখন কী হবে? সে কি ঐসব পরীক্ষার মাঝে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে?

এই বিপদ সম্ভাবনার ভয় ফুকিয়ার মধ্যে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে সে ক্লাসে যেতে অস্বস্থি বোধ করছিল। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ক্লাসে গেল না। রুমে বসে বসে ভাবতে লাগল মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করা হলে কীভাবে তা সে উতরে যেতে পারে। অবশ্যই কাসামোরি কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করবেন তা আগে থেকে বুঝার উপায় নেই। যত ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা ফুকিয়া মনে করতে পারল, তার সবগুলি নিয়েই সে ভাবল, কীভাবে এগুলিকে বোকা বানিয়ে সে বেঁচে যেতে পারে। যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করা হয় মিথ্যা তথ্য উদঘাটন করার জন্য, তাই ফুকিয়ার প্রথম চিন্তা ছিল এই ধরনের পরীক্ষায় মিথ্যা তথ্য দেয়া অসম্ভব।

ফুকিয়া জানত একধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় লাই ডিটেক্টর ডিভাইস ব্যবহার করা হয় শারিরিক প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। এছাড়াও সে জানত আরেক ধরনের সহজ পদ্বতি আছে যাতে সন্দেহভাজনকে এক ধরনের প্রশ্ন করা হয় এবং তার উত্তর দেয়ার সময়ের উপর ভিত্তি করে অপরাধী সনাক্ত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা ভাবতে ভাবতে ফুকিয়া আরো চিন্তিত হয়ে পড়ল। ধরা যাক তাকে হঠাৎ করে সরাসরি প্রশ্ন করা হল, “আপনি কি বৃদ্ধ মহিলাকে খুন করেছেন?” ফুকিয়া এই আত্মবিশ্বাস অনুভব করল যে এর উত্তরে সে শান্তভাবে পালটা প্রশ্ন করতে পারবে, “কী প্রমাণের উপর ভিত্তি করে আপনি এই ধরনের অযৌক্তিক অভিযোগ করছেন?” কিন্তু যদি লাই ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই বস্তু কি তার সেই সময়ের মানসিক অবস্থা রেকর্ড করে ফেলবে না? কোন মানুষের পক্ষে তার এই ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নয় কি?

ফুকিয়া নিজেই নিজেকে নানা ধরনের কাল্পনিক প্রশ্ন করে দেখল। অদ্ভুতভাবে, প্রশ্নগুলি যতই অপ্রত্যাশিত হোক না কেন, সে নিজে যেহেতু নিজেকে করছে, তাই তার কোন রকম দুশ্চিন্তাই হল। সে ভাবতে পারল না এই ধরনের প্রশ্ন তার মধ্যে কোন শারিরিক প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে সক্ষম। আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারল যদি সে ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে নিখুঁত যন্ত্রের মুখেও সে নিরাপদ থাকতে পারবে।

যখন ফুকিয়া নিজের উপর এইসব নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল তখন এক পর্যায়ে এসে সে নিশ্চিত হয়ে গেল ঠিক মত প্রস্তুতি নিতে পারলে এবং বার বার অনুশীলনের মাধ্যমে এসব মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব। সে নিশ্চিত হল একজন মানুষকে একই প্রশ্ন যদি বার বার করা হয় তখন সেই প্রশ্নের জন্য তার প্রতিক্রিয়া অনেক কমে যাবে। এই চিন্তায় এসে ফুকিয়া সিদ্ধান্তে আসল মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাকে ফাঁকি দেবার সবচেয়ে সেরা উপায় হল প্রশ্নগুলির সাথে পরিচিত হওয়া। তার যুক্তি ছিল, প্রশ্নগুলি তার উপর এখন আর প্রভাব ফেলছে না কারণ সে বার বার নিজেকে এই প্রশ্নগুলি করেছে। উত্তর দেবার আগেই তার প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই জানা। ফলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ উৎপন্ন হচ্ছে না।

ফুকিয়া মনযোগের সাথে একটি বড় অভিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়তে লাগল এবং বের করতে লাগল কোন শব্দ গুলি প্রশ্নাকারে তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হতে পারে। পুরো এক সপ্তাহ এভাবে সে কাজ করে গেল। তার স্নায়ুকে সম্ভাব্য যেকোন ধরনের প্রশ্নগুলির জন্য তৈরী করে তুলল। যখন সে মনে করল এই দিক থেকে তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে তখন অন্য দিকে গেল। এটি হচ্ছে শব্দ-সম্পর্ক পরীক্ষা। মনরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীদের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকেন।

 

ফুকিয়া এই পরীক্ষাটা যেরকম বুঝে তা হল, এই ধরনের পরীক্ষায় একটা শব্দ ছুঁড়ে দেয়া হয় রোগী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিটির দিকে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিটিকে ঐ শব্দ শোনে তার মাথায় প্রথম যে শব্দ আসে তা বলতে হয়। তারপর পরীক্ষক আরো কিছু শব্দ বলে যাবেন যেগুলির সাথে মূল ঘটনার কোন সম্পর্কই নেই, যেওন পর্দা, কালি, অন্ধকার, ডেস্ক ইত্যাদি। এই পরীক্ষার মূল গুরুত্ব হচ্ছে পরীক্ষক যে শব্দ বলেন এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তি এর প্রতিক্রিয়ায় যে শব্দ উত্তর দেন, তাদের মধ্যে মানসিক মিল থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ পরীক্ষক বললেন “পর্দা” এর উত্তরে ব্যক্তিটি বলতে পারে “জানালা” “কাগজ” বা “দরজা”। এবং পরীক্ষার মধ্যে “ছুরি” “টাকা” বা “মানিব্যাগ” ইত্যাদি শব্দ ঢুকিয়ে দেয়া হয় দোষী ব্যক্তির অপরাধের সাথে সংযুক্তি পরীক্ষা করার জন্য।

ফুকিয়ার ক্ষেত্রে, যদি সে সাধারণ অপ্রস্তুত থাকত তাহলে “বামন গাছ” এর উত্তরে বলে ফেলত “টাকা”। এর মাধ্যমে অবচেতনে সে স্বীকার করে বামন গাছের নিচে টাকা ছিল তা সে জানত। আবার সে যদি প্রস্তুত তাকে আগেভাগে তাহলে উত্তর দিত নির্দোষ শব্দে যেমন “মাটির পাত্র”। এতে তার কোন বিপদের আশংকা থাকত না।

ফুকিয়া জানত এই ধরনের শব্দ পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্ন এবং উত্তরের মধ্যেকার সময় রেকর্ড করা হয়। যদি দোষী ব্যক্তি “পর্দা” শব্দের উত্তরে “দরজা” বলতে নেয় এক সেকেন্ড সময় আর “বামন গাছ” শব্দের অর্থ “মাটির পাত্র” বলতে সময় নেয় তিন সেকেন্ড, তাহলে তা সন্দেহের উদ্রেক করবে। সে নিশ্চয়ই তার মাথায় প্রথম যে শব্দটি এসেছে তা বলে নি, নতুন শব্দ বলেছে এবং এজন্যই বেশী সময় লেগেছে। এই ধরনের বেশী সময় লাগানো অবশ্যই সন্দেহ তৈরী করবে।

ফুকিয়া ঠিক করল শব্দ পরীক্ষায় তাকে নেয়া হলে সে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেবে। এটাই নিরাপদ। আরো ঠিক করল, যদি তাকে “বামন গাছ” শব্দ ছুঁড়ে দেয়া হয় তাহলে সে “পাইন” কিংবা “টাকা” উত্তর দেবে। কারণ পুলিশ জানবে সে যদি দোষী নাও হত, এই শব্দগুলির সাথে সে ভালোরকম থাকত। এবং তার জন্য এই উত্তর দেয়াই স্বাভাবিক।

একটা জিনিস কেবল ফুকিয়াকে ভাবিয়ে তুলল। তা হচ্ছে উত্তর প্রদানের সময়। কিন্তু তার এই বিশ্বাস ছিল ঠিক ঠাক প্রস্তুতি ও অনুশীলন করতে থাকলে উত্তর দেবার সময়ও ঠিক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল “বামন গাছ” বা এরকম শব্দ বলা হলে এক মুহুর্ত দ্বিধা না করে সাথে সাথেই উত্তর দিতে হবে “পাইন” বা “টাকা”।

কিছুদিন ফুকিয়া কঠোর অনুশীলন করল। একসময় তার আত্মবিশ্বাস জন্মাল সবচেয়ে কঠিন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাও সে উৎরে যাবে নিমিষে। এবং সে এটা ভেবেও আশ্বস্ত হল সাইতো যেহেতু নির্দোষ, সেও অনেক ভীত হয়ে পড়বে এই ধরনের প্রশ্নের সামনে। যত ফুকিয়া এইসব সম্ভাবনার কথা ভাবতে লাগল ততই তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যেতে লাগল। এই সময়ে সে শীষ দিয়ে গান গাওয়ার মত স্বাচ্ছন্দ্যকর অবস্থায় পৌছে গেল এবং আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে লাগল ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি কাসামোরি’র ডাকের জন্য।

 

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি দু’জন সন্দেহভাজনের উপর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার পরের দিন। কাসামোরি তার পড়ার কক্ষে ব্যস্তভাবে পরীক্ষার ফলাফলগুলি দেখছেন। এই সময়ে হঠাৎ তার কাজের লোক এসে বলল একজন লোক এসেছেন তার সাথে দেখা করতে।

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি আক্ষরিক ভাবেই একরাশ কাগজের মধ্যে ডুবে ছিলেন এবং কারো সাথে দেখা করার মত মানসিক অবস্থা তার ছিল না। তিনি ব্যস্তভাবে বিরক্তির সাথে বললেন, “উনি যেই হোন না কেন, দয়া করে তাকে বলো আমি ব্যস্ত আছি। এখন দেখা করতে পারব না।”

“শুভ বিকেল, মিস্টার ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী,” কাজের লোকের সচকিত চাহনি উপক্ষা করে আনন্দিত স্বরে বলে উঠলেন একজন লোক। “বলবেন আপনি এত ব্যস্ত যে আপনার প্রিয় পুরনো বন্ধু আকেচিকে দেখার সময় নেই।”

কাসামোরি নাকের উপর থেকে চশমাটা সরিয়ে ভালোভাবে থাকালেন। সাথে সাথেই তার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তিনি উত্তর দিলেন, “আরে! ডক্টর আকেচি! আমি জানতাম না আপনি। আমাকে ক্ষমা করুন। আসুন আসুন, আসলে সত্যি বলতে কি আপনি প্রত্যাশা করছিলাম আপনি যেন একবার এখানে আসেন।”

কাসামোরি তার কাজের লোকটিকে যেতে বললেন এবং অতিথিকে বসালেন। ডক্টর আকেচি, একজন অসাধারন গোয়েন্দা। জটিল সব রহস্য সমাধানের জন্য সম্পূর্ন নতুন এবং অতীব ধারালো সব পদ্বতি তিনি প্রয়োগ করেন। ডক্টর কিগোরো আকেচি সেই একমাত্র মানুষ যার সাথে কথা বলার জন্য ট্রেন ধরতে যাবার সময়ও দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেন ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী। এর আগে কয়েকটি কেইস যেগুলিকে বলা হয়েছিল রহস্য উদঘাটন অসম্ভব, সেগুলি সমাধানের জন্য কাসামোরি আকেচির সাহায্য নিয়েছিলেন। কোনবারই ডক্টর আকেচি তাকে হতাশ করেন নি। এবং এর মাধ্যমে তিনি জাপানের অন্যতম অসাধারন গোয়েন্দায় পরিণত হয়েছেন।

একটি সিগারেট ধরিয়ে ডক্টর আকেচি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নীর টেবিলের উপর রাখা স্তূপাকার কাগজের দিকে উদ্দেশ্যপূর্নভাবে তাকালেন।

তিনি বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি খুব ব্যস্ত। এটা কি সাম্প্রতিক খুন হওয়া সেই বৃদ্ধ মহিলার কেইস?”

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বললেন, “হ্যাঁ। খোলাখোলিভাবে বলতে গেলে আমি আমার ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছি।”

শুকনো হাসির সাথে ডক্টর আকেচি বললেন, “হতাশাবাদ আপনাকে মানায় না মিস্টার ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী, এখন আমাকে দু’জন সন্দেহভাজনকে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা যে দিলেন তার ফলাফলগুলি।”

কাসামোরি তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, “মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা আপনি কীভাবে জানলেন?”

ডক্টর আকেচি বললেন, “আপনার একজন সহকারীর কাছ থেকে। আমিও এই কেইসের ব্যাপারে গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। এজন্যই তো আপনার এখানে এলাম। মনে হল আপনার এখানে আসা দরকার এবং আমার বিনীত সাহায্যের প্রস্তাব করা যায়।”

কাসামোরি কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, “এটা আপনার মহানুভবতা।”

এরপর দ্রুতই তিনি তার জটিল পরীক্ষাগুলির ফলাফল নিয়ে আলোচনায় গেলেন।

তিনি বললেন, “ফলাফলগুলি আপাত দৃষ্টিতে স্পষ্ট, তা আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটা জিনিস আমাকে হতবুদ্ধি করে রেখেছে। কাল দুইজন সন্দেহভাজনকে আমি দুটি পরীক্ষা দেই। একটি লাই ডিটেক্টর দিয়ে, আরেকটি শব্দ-সম্পর্ক পরীক্ষা। ফুকিয়ার ক্ষেত্রে তার নাড়ির স্পন্দন সব সময়ই ছিল সন্দেহের উর্ধ্বে। কিন্তু তখন শব্দ-সম্পর্কের ফলাফল, ফুকিয়ার এবং সাইতোরটা আমি একসাথে মেলালাম তখন দেখতে পেলাম তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সত্যি বলতে কি এমন ফলাফল আমার ভাবনার অতীত, এর ব্যাখ্যা আমি কী দেব বুঝতেই পারছি না। আপনি প্রশ্নোত্তরগুলি দেখুন, দু’জন সাসপেক্টের একই শব্দের উত্তর দেবার সময়ের পার্থক্যটা দেখুন।”

কাসামোরি ডক্টর আকেচির হাতে শব্দ-সম্পর্ক পরীক্ষার নিচের ফলাফলটি তুলে দেনঃ

শব্দ ফুকিয়া সাইতো
উত্তর সময় লেগেছে উত্তর সময় লেগেছে
মাথা চুল ০.৯ সেকেন্ড লেজ ১.২ সেকেন্ড
সবুজ ঘাস ০.৭ সেকেন্ড ঘাস ১.১ সেকেন্ড
পানি গরম পানি ০.৯ সেকেন্ড মাছ ১.৩ সেকেন্ড
গান গানগুলি ১.১ সেকেন্ড গেইশা ১.৫ সেকেন্ড
লম্বা খাটো ১ সেকেন্ড দড়ি ১.২ সেকেন্ড
হত্যা* ছুরি ০.৮ সেকেন্ড  অপরাধ ৩.১ সেকেন্ড
নৌকা নদী ০.৯ সেকেন্ড  পানি ২.২ সেকেন্ড
জানালা দরজা ০.৮ সেকেন্ড গ্লাস ১.৫ সেকেন্ড
খাবার বীফস্টিক ১ সেকেন্ড মাছ ১.৩ সেকেন্ড
টাকা* ব্যাংক নোট ০.৭ সেকেন্ড ব্যাংক ৩.৫ সেকেন্ড
ঠান্ডা পানি ১.১ সেকেন্ড শীত ৩.২ সেকেন্ড
অসুখ ঠান্ডা ১.৬ সেকেন্ড যক্ষা ২.৩ সেকেন্ড
সূচ সুতা ১ সেকেন্ড সুতা ১.২ সেকেন্ড
পাইন* বামন গাছ ০.৮ সেকেন্ড  গাছ ২.৩ সেকেন্ট
পাহাড়  উঁচু ০.৯ সেকেন্ড নদী ১.৪ সেকেন্ড
রক্ত* প্রবাহ  ১ সেকেন্ড লাল ৩.৯ সেকেন্ড
নতুন পুরাতন ০.৮ সেকেন্ড  পোশাক ৩ সেকেন্ড
ঘৃণা মাকড়শা ১.২ সেকেন্ড  অসুস্থতা ১.৫ সেকেন্ড
বামন গাছ* পাইন ০.৬ সেকেন্ড ফুল ৬.২ সেকেন্ড
পাখি উড়ছে ০.৯ সেকেন্ড হলুদ ৩.৬ সেকেন্ড
বই গ্রন্থাগার ১ সেকেন্ড  উপন্যাস ১.৩ সেকেন্ড
ওয়েল পেপার* লুকানো ১ সেকেন্ড পার্সেল ৪ সেকেন্ড
বন্ধু সাইতো ১.১ সেকেন্ড ফুকিয়া ১.৮ সেকেন্ড
বাক্স কাঠ ১ সেকেন্ড পুতুল ১.২ সেকেন্ড
অপরাধ* খুন ০.৭ সেকেন্ড পুলিশ ৩.৭ সেকেন্ড
মহিলা প্রেমিকা ১ সেকেন্ড বোন ১.৩ সেকেন্ড
চিত্রকলা পর্দা ০.৯ সেকেন্ড প্রাকৃতিক দৃশ্য ১.৩ সেকেন্ড
চুরি* টাকা ০.৭ সেকেন্ড গলার হার ৪.১ সেকেন্ড
দ্রষ্টব্যঃ স্টার চিহ্নিত শব্দগুলি অপরাধের সাথে সরাসরি যুক্ত।

ডক্টর আকেচি কাগজটি পরীক্ষা করে দেখার পর ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বললেন, “দেখতেই পাচ্ছেন সব কিছু পরিস্কারভাবেই আছে। সাইতো অবশ্যই ইচ্ছা শব্দ গোপন করেছে, যে শব্দ তার মাথায় এসেছে তা না বলে ভিন্ন শব্দ তৈরী করে বলেছে। ‘বামন গাছ’ শব্দটির উত্তরে সে যে সময় নিল তাতে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় টাকা কিংবা ‘পাইন’ বা ‘টাকা’ শব্দ তার মাথায় এসেছিল, তাই সময় নিয়ে চিন্তা করে সে অন্য শব্দ বলেছে। অন্যদিকে ফুকিয়া কিন্তু ‘বামন গাছ’ শব্দের উত্তরে ‘পাইন’ বলেছে। ‘ওয়েল পেপার’ এর উত্তরে ‘লুকানো’ বলেছে। ‘অপরাধ’ এর উত্তরে বলেছে ‘খুন’। একেবারে স্বাভাবিক স্বরে, কোন ধরনের দ্বিধা ছাড়াই সে বলেছে। অপরাধী হলে সে অবশ্যই এই শব্দগুলি এড়িয়ে যেত। তাই এই পরীক্ষা ফলাফল থেকে তা বুঝা যায়, তাতে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখতেই হয়। আর অন্যদিকে, যখন সাইতোকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করতে হয়, এই পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেন, আমার মন সায় দেয় না।”

ডক্টর আকেচি নিঃশব্দে কোন প্রকার বাঁধা প্রদান না করে ডিস্ট্রিক্ট এটর্নীর কথা শুনলেন। ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি তার কথা শেষ করার পর ডক্টর আকেচির চোখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল এবং তিনি বলতে শুরু করলেন।

ডক্টর আকেচি বলতে লাগলেন, “আপনি কি কখনো মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার সীমাবদ্বতা সম্পর্কে ভেবেছেন? ম্যুয়েনস্টারবার্গ মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার পক্ষে ছিলেন এবং তার সমালোচনা করে ডি কুইরস বলেছিলেন, যদিও এই পদ্বতি তৈরী করা হয়েছে ট্রায়ালের  নির্যাতন এর মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের বিকল্প হিসেবে তথাপি এটি নির্দোষ ব্যক্তির উপর এক ধরনের নির্যাতন হিসেবে কাজ করে। এবং এর ফলে প্রকৃত দোষী ছাড়া পেয়ে যায়। ম্যুয়েনস্টারবার্গ তার নিজের বইয়েই লিখেছেন, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা কার্যকরী কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তি, বস্তু, বা জায়গাকে চিনে কি না তা জানার জন্য, অন্য ক্ষেত্রে তা খুব ভয়ংকর হতে পারে। আমি বুঝতে পারছি কাসামোরি, আপনাকে এসব বলা নিশ্চিতরূপে বাহুল্যতা, কিন্তু আমি আসলে এই গুরুত্বপূর্ন দিকটিতে আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাচ্ছি।”

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি হালকা বিরক্তি মেশানো কন্ঠে জানালেন তিনি এসব সম্পর্কে সচেতন আছেন।

ডক্টর আকেচি বললেন, “তাহলে ঠিক আছে। এখন চলুন আমরা কেইসটিকে একটু অন্যভাবে দেখি। ধরা যাক, একজন নিরপরাধ, প্রচন্ড রকমের ভীত প্রকৃতির মানুষ কোন খুনের ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন। তাকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে ঐ পরিস্থিতিতে জানে যে যেভাবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এখানে সে জীবন মৃত্যুর মাঝে দোল খাচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে যদি কোন শক্ত মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় নিয়ে ফেলা হয় তবে সে কি তার স্থিরতা ধরে রাখতে পারবে? তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবেই প্রচন্ড আলোড়িত থাকবে এবং ঐ অবস্থায় নির্দোষ ব্যক্তিই কি দোষী বলে সাব্যস্ত হবে না, যেমনটা বলেছিলেন ডি কুইরস?”

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বিরক্তমাখা কন্ঠে বললেন, “ধারণা করছি আপনি সাইতোর কথা বলছেন।”

ডক্টর আকেচি উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। আমার যুক্তি মতে সে খুনের ব্যাপারে সম্পূর্ন নিরদোষ, যদিও অবশ্যই টাকা সে চুরি করে থাকতে পারে, এই সম্ভাবনা রয়ে যায়। এবং এরপর আসে বড় প্রশ্ন, বৃদ্ধ মহিলাকে খুন করল কে?”

কাসামোরি এই জায়গায় আকস্মিক বাঁধা দিয়ে অস্থিরভাবে বললেন, “ডক্টর আকেচি, আমাকে সাসপেন্সে রাখবেন না। আপনি কি নির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্তে এসেছেন কে সত্যিকার খুনি?”

ডক্টর আকেচি সহাস্যে বললেন, “হ্যাঁ, আমি মনে করে এসেছি। আপনার দুই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার ফলাফল বিচার করে যা বুঝলাম, আমার বিশ্বাস ফুকিয়াই খুনটা করেছে। যদিও এ ব্যাপারে এখনো আমি পুরো নিশ্চিত কথা আপনাকে বলতে পারছি না। আমরা কি তাকে এখানে আনতে পারি? আমি যদি তাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি তাহলে আমার মনে হয় আমি এই গুরুত্বপূর্ন কেইসের সমাধানে পৌছুতে পারব।”

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বললেন, “কিন্তু প্রমান কি? আপনি কীভাবে প্রমান সংগ্রহ করবেন?”

আকেচি দার্শনিকভাবে বললেন, “দোষী ব্যক্তিকে যথেষ্ট দড়ি সরবরাহ করুন, তাতেই সে ঝুলে যাবার মত যথেষ্ট প্রমান নিজ থেকেই হাজির করবে।”

ডক্টর আকেচি তার পরিকল্পণার কথা সবিস্তারে বললেন কাসামোরিকে। পরিকল্পণা শোনার পর কাসামোরি তার কাজের লোককে হাততালি দিয়ে ডাকলেন। ডেস্ক থেকে কাগজ কলম নিয়ে ফুকিয়ার উদ্দেশ্যে একটি চিরকোট লিখলেনঃ

“আপনার বন্ধু সাইতো অপরাধী হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। আমি আপনার সাথে কিছু ব্যাপারে কথা বলতে চাই। অতিসত্ত্বর আপনাকে আমার বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করছি।”

তিনি চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন এবং কাজের লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দিলেন ফুকিয়ার উদ্দেশ্যে।

ফুকিয়া যখন চিরকোট পেল তখন সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেছে। এই চিঠি যে একটি ফাঁদ তা সে জানত না, চিঠি পেয়ে সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এমনকী রাতের খাবারের ব্যাপারে চিন্তা না করে সে তাড়াতাড়ি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির বাসার দিকে ছুটল।

ফুকিয়া কাসামোরির পড়ার কক্ষে প্রবেশ করতেই কাসামোরি তাকে উষ্ণ ভাবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বসতে বললেন।

কাসামোরি বললেন, “আপনাকে আমি এতদিন সন্দেহ করে এসেছি এর জন্য আমার আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত মিস্টার ফুকিয়া। এখন আমি জানি আপনি নির্দোষ। তাই আমি ভাবলাম আপনি হয়ত শুনে খুশি হবেন কীভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসলাম।”

ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি সবার জন্য জলখাবার আনার নির্দেশ দিলেন তার কাজের লোককে এবং এরপর উৎসাহের সাথে ফুকিয়ার সাথে ডক্টর আকেচির পরিচয় করিয়ে দিলেন। অবশ্য এক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন নাম ব্যবহার করলেন।

তিনি চোখের পাতা না ফেলে ডক্টর আকেচিকে নির্দেশ করে বললেন, “ইনি মিস্টার ইয়ামামোটো। একজন উকিল। বৃদ্ধ মহিলার উত্তরাধিকারীরা তার সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য এনাকে নিয়োগ দিয়েছেন।”

চা এবং পিঠা দ্বারা জলখাবারের পর তারা নানা অগুরুত্বপূর্ন বিষয়ে আলাপ চালিয়ে গেলেন। ফুকিয়ে খুব স্বাধীনভাবে কথা বলছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই আসরের সবচেয়ে বাকপটু বক্তায় পরিণত হল সে। হঠাৎ একসময় সে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকাল এবং আকস্মিক ভাবে উঠে দাঁড়াল।

মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি বুঝতে পারি নি এত সময় চলে গেছে। আপনারা অনুমতি দিলে এবার আমি যেতে চাই।”

শুকনো গলায় ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বললেন, “অবশ্যই, অবশ্যই।”

হঠাৎ করে ডক্টর আকেচি ফুকিয়াকে বলে উঠলেন, “দয়া করে আর এক মুহুর্ত থাকুন। আপনি যাবার আগে একটি মামুলি প্রশ্ন করার আছে আমার। আপনার কি মনে আছে বুড়ো মহিলা যে ঘরে খুন হন সেই ঘরে স্বর্নালী রঙের কাজকরা দ্বিভাজি একটি পর্দা ছিল?” এটা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর জন্য তুচ্ছ এক আইনি ঝামেলা গজিয়ে উঠেছে। আসলে এই বস্তুটি বুড়ো মহিলার ছিল না। ঋণের জন্য বন্ধক হিসেবে এটি মহিলা রেখেছিলেন। এখন মূল মালিক এসে বলছে সে ক্ষতিপূরণ চায়। কিন্তু আমার ক্লায়েন্ট তা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তাদের কথা হল এই পর্দা আগে থেকেই এমন ছিল। এটা অবশ্যই তুচ্ছ বিষয় কিন্তু আপনি যদি মনে করতে পারেন তাহলে আমার জন্য খুবই উপকার হয়। আমি যে কারণে আপনাকে জিজ্ঞেস করছি তা হল আমি জানি আপনি প্রায়ই ঐ বাসায় যেতেন। ফলে এই পর্দাটি হয়ত আপনি দেখে থাকবেন। সাইতোকেও এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। কিন্তু তার যা মানসিক অবস্থা, এর মধ্যে তার কথা গ্রাহ্যের মধ্যে নেয়া যায় না আসলে। আমি বুড়ো মহিলার কাজের মেয়ের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে চলে গেছে গ্রামে। আমি এখনো তাকে চিঠি লেখার সময় পাই নি।”

যদিও ডক্টর আকেচি স্বাভাবিক কথাবার্তার ভঙ্গিতে কথাটি বলেছিলেন তবুও ফুকিয়া তার হৃতপিন্ডের লাফানো অনুভব করল প্রশ্ন শুনে। কিন্তু তাড়াতাড়ি সে নিজেকে সামলে নিল। সে নিজেকে বলল, “আমি কেন ভয় পাব? কেইস তো ইতিমধ্যেই শেষ।” তারপর সে নিজেকে জিজ্ঞেস করল কী উত্তর দেয়া যায়। একটি সংক্ষিপ্ত বিরতির পর সে ঠিক করল স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে যাবে, যেরকম এতক্ষন বলে এসেছে।

সে বলতে শুরু করল, “ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি যেমন জানেন, আমি একবারই আসলে ঐ কক্ষে গিয়েছিলাম। তা খুনের দুইদিন আগে।  আমার যতদূর মনে পড়ে তাতে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি ঐ পর্দা ছিল ওখানে এবং যখন আমি দেখেছি তখন ওটাতে কোন ক্ষত ছিল না।”

ডক্টর আকেচি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত? ক্ষতিগ্রস্ত বলতে আমি বুঝাচ্ছি ওতে আঁকা কোমাচির ছবিতে একটি আঁচরের দাগ।”

ফুকিয়া জোরের সাথে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা আমি চিনেছি। আমি নিশ্চিত। ওই সুন্দর কোমাচির ছবিতে বা অন্য কোথাও কোন আঁচরের দাগ ছিল না। অন্য কোন ধরনের ক্ষতচিহ্ন থাকলেও আমার চোখে পড়ত।”

ডক্টর আকেচি বললেন, “বেশ, আপনি কি একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করে এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে আপনার কোন অসুবিধা আছে কি? আসলে ঐ পর্দার মালিক তার দাবীর ব্যাপারে এতই জেদী যে আমাকে তা ভালোরকম সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।”

ফুকিয়া সহযোগীতামূলক কন্ঠে বলল, “অবশ্যই না। আপনি যখনই বলবেন তখনই আমি এই হলফনামা স্বাক্ষর করে দিতে পারি।”

ডক্টর আকেচি হাসির সাথে ফুকিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার মাথা চুলকাতে লাগলেন। যখন তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন তখন এমন মাথা চুলকান, এটা তার স্বভাব। তিনি বলতে লাগলেন, “এখন, আমার মনে হয় আপনি স্বীকার করবেন আপনি এই পর্দা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, কারন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় আমি লক্ষ করেছি আপনি “চিত্রকলা’র উত্তরে “পর্দা”র কথা বলেছেন। আপনি জানেন, ছাত্রদের বোর্ডিংহাউজে পর্দা একটি দূর্লভ বস্তু।”

ফুকিয়া ডক্টর আকেচির নতুন গলার স্বর শুনে চমকে উঠল। সে ভেবে পেল না লোকটি কী অর্থ করতে চায়।

তার সাথে উকিল বলে যে লোকটির পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে আবার সে বলে উঠল, “যাই হোক, এছাড়া আরেকটি জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষন করে। গতকালের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় আট টি বিপদজনক শব্দ ছিল যা এই খুনের সাথে জড়িত। হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি কোন সন্দেহ তৈরী না করেই এগুলির যথাযথ উত্তর দিয়েছেন। তবে আমার মতে, তা একটু বেশী যথাযথই হয়ে গেছে। আপনাকে আমি সেই আটটি শব্দ এবং তার উত্তরের রেকর্ড দেখার অনুরোধ করছি।”

ডক্টর আকেচি প্রশ্নোত্তরে তালিকা তুলে ধরে বললেন, “আপনি গুরুত্বপূর্ন শব্দাবলি উত্তর দেবার সময় খুবই কম সময় নিয়েছেন অগুরুত্বপূর্ন শব্দগুলির চাইতে। উদাহরনস্বরূপ, “বামন গাছ” শব্দের উত্তরে “পাইন” বলতে আপনি সময় নিয়েছেন মাত্র শূন্য দশমিক ছয় সেকেন্ড। তা বুঝায় অসাধারন নির্দোষতা। কিন্তু শূন্য দশমিক এক শূন্য সেকেন্ড সময় আপনি নিয়েছেন “সবুজ” শব্দটির জন্য, যা ছিল তালিকার আটাশটি শব্দের মধ্যে উত্তর দেয়ার জন্য সবচেয়ে সহজ শব্দ।”

ডক্টর আকেচির উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ফুকিয়া আসলে বুঝতে পারছিল না এই কথাবার্তা যাচ্ছে কোনদিকে। সে কাঁপুনির সাথে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, এই বাচাল উকিল কী বলতে চায়। তাকে তাড়াতাড়ি তা বুঝতে হবে, হতে পারে এটা কোন ফাঁদ।

ডক্টর আকেচি কঠিনভাবে বলে যেতে লাগলেন, “বামন গাছ” “ওয়েলপেপার” “অপরাধ” অথবা খুনের সাথে যুক্ত ঐ আট শব্দাবলীর উত্তর দেয়া “মাথা” বা “সবুজ” শব্দের মত এত সহজ নয়।  কিন্তু আপনি কঠিন শব্দগুলির উত্তর দিয়েছেন কম সময়ে আর সহজগুলির ক্ষেত্রে বেশী সময় নিয়েছেন। এর অর্থ কী? এটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কিন্তু এখন আমাকে অনুমান করতে দিন আপনার মাথায় কী ছিল। এটা সত্যিই আপনার জন্য চিত্তাকর্ষক হতে পারে। অবশ্যই, আমার ভুল হয়ে থাকলে, বিনীতভাবে আমি আপনার ক্ষমা চাই।”

ফুকিয়া অনুভব করল তার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত কথাবার্তা তার স্নায়ুকে ইতিমধ্যেই বশ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু সে বাঁধা দেবার আগেই ডক্টর আকেচি আবার কথা বলা শুরু করলেন।

ফুকিয়াকে তিনি বলতে লাগলেন, “আপনি নিশ্চিতভাবে জানতেন মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাগুলির বিপদ সম্পর্কে। তাই আমার ধারণা আপনি এই পরীক্ষাগুলির জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। উদাহরস্বরূপ, খুনের সাথে যুক্ত শব্দাবলী উত্তরে আপনি কী বলবেন তা সতর্কভাবে আপনি ঠিক করে নিয়েছিলেন। যাতে পরীক্ষাস্থলে হুবহু তা বলে যেতে পারেন। আমাকে ভুল বুঝবেন না, মিস্টার ফুকিয়া। আপনি যে পদ্বতি অনুসরন করেছেন তার সমালোচনা করছি না আমি। আমি শুধু বলতে চাই কখনো কখনো মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা খুবই বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। এতে দোষীরা ছাড়া পেয়ে যায় আর নির্দোষেরা দোষী বলে সাব্যস্ত হয়।”

ডক্টর আকেচি কিছুক্ষণের জন্য থামলেন তারপর আবার বলতে লাগলেন,

“মিস্টার ফুকিয়া, আপনি বেশী চালাকির সাথে আপনার প্রস্তুতি নিয়েই বড় ভুলটা করে ফেলেছেন। পরীক্ষার সময় আপনি খুবই দ্রুত উত্তর দিয়েছেন। এটা স্বাভাবিকই ছিল, কারণ আপনি ভেবেছিলেন ধীরে উত্তর দিলে আপনাকে সন্দেহ করা হবে। কিন্তু আপনি তা বেশী করে ফেলেছেন!”

ফুকিয়ার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখ ক্রূর তৃপ্তির সাথে দেখতে দেখতে ডক্টর আকেচি অল্প থামলেন। তারপর আবার বলা শুরু করলেন,

“আমি এখন পরীক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ন জায়গায় আসি। আপনি কেন “টাকা” “লুকানো” কিংবা “খুন” ইত্যাদি বিপদজনক উত্তর দিলেন যেগুলি আপনাকে অপরাধী করতে পারে? এগুলি আপনি ইচ্ছে করেই বলেছেন নিজেকে সরল প্রমাণ করতে। আমি ঠিক বলছি কি না, ফুকিয়া? আমার যুক্তি কি ঠিক নয়?”

ফুকিয়া আবেগশূন্য দৃষ্টিতে ডক্টর আকেচির দিকে তাকিয়ে রইল। সে চাইছিল ডক্টর আকেচির অভিযুক্ত করতে থাকা ঠান্ডা দৃষ্টির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে কিন্তু কেন যেন সে চোখ সরাতে পারছিল না। কাসামোরির মনে হল ফুকিয়া যেন এক সম্মোহনের জালে আটকা পড়েছে এবং সে ভয় ছাড়া আর কোন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না।

ডক্টর আকেচি বলতে থাকলেন, “প্রশ্নোত্তরে আপনার এই নির্দোষতা আমার কাছে সত্য মনে হয় নি। তাই আমি স্বর্নালী কারুকাজের পর্দাটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করার চিন্তাটি করি। আমি যা আশা করেছিলাম আপনি সেই উত্তরই দিয়েছেন।”

ডক্টর আকেচি হঠাৎ ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি, এখন আমি আপনাকে একটি সহজ প্রশ্ন করতে চাই। পর্দাটি বৃদ্ধ মহিলার কক্ষে কবে আনা হয়?”

কাসামোরি উত্তর দিলেন, “খুনের আগের দিন। অর্থাৎ গত মাসের চার তারিখে।”

ডক্টর আকেচি বললেন, “খুনের আগের দিন, তাই তো? তাহলে তো অদ্ভুত ব্যাপার, মিস্টার ফুকিয়া যে এইমাত্র বললেন তিনি খুনের দুই দিন আগে ঐ কক্ষে পর্দাটি দেখেছেন। তা ছিল গত মাসের তিন তারিখ। বৃদ্ধ মহিলার খুন হয়ে যাওয়া কক্ষেই তিনি দেখেছেন!”

দেখাই যাচ্ছে, দুই পরস্পরবিরোধী কথা, অর্থাৎ আপনাদের একজন ভুল করছেন!”

 

ধূর্ত একটি বাঁকা হাসি দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি বললেন, “মিস্টার ফুকিয়াই সম্ভবত ভুলটা করেছেন। গত মাসের চার তারিখ বিকেলের আগ পর্যন্ত পর্দাটি তার মূল মালিকের বাড়িতেই ছিল। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই!”

ডক্টর আকেচি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুকিরা মুখের অবস্থা লক্ষ করলেন। কান্না শুরুর আগ মুহুর্তে ছোট মেয়ের মুখ যেমন হয়, তার মুখের অভিব্যক্তিও সেরকম হয়েছে।

ডক্টর আকেচি হঠাৎ অভিযোগের তীর সরাসরি নিঃক্ষেপ করলেন ফুকিয়ার দিকে এবং কঠোরভাবে বললেন, “যা আপনার দেখার কথা না তা কেন আপনি বললেন দেখেছেন? এটা আপনার জন্য খারাপই হল যে সেই ধ্রুপদী চিত্রকলা আপনি মনে রেখেছেন এবং এর মাধ্যমে আপনি নিজেকে ডুবালেন। সত্য বলার উত্তেজনায় আপনি একেবারে খুঁটিনাটিও বর্ননা করেছেন। তাই নয় কি, মিস্টার ফুকিয়া? দুই দিন আগে আপনি যখন ঐ কক্ষে গিয়েছিলেন তখন কি দেখতে পান নি ওখানে সেই পর্দাটি ছিল না? আসলে ওসবের প্রতি তখন লক্ষ দেবার সময়ই আপনার ছিল না। কারণ এগুলি আপনার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। যদি থাকত তাহলে অবশ্যই সেদিন আপনি তা ভালো করে লক্ষ করতেন, সেই রুম আরো প্রাচীন চিত্রকর্ম ও পুরাতন জিনিসে পূর্ন ছিল। তাই এটা অনুমান করা স্বাভাবিক যে ঐ পর্দাটাও হয়ত ওখানে ছিল। আমার প্রশ্নটি আপনাকে বিভ্রান্ত করেছে। তাই আপনি সেই সরলীকরন ধারনায় পৌছে গেছেন দুই দিন আগেও পর্দাটি ওখানে ছিল। এখন, যদি আপনি কোন সাধারণ অপরাধী হতেন তাহলে অবশ্যই এমন কথা বলতেন না। ঐ ঘর সংস্লিষ্ট যেকোন জিনিসের ব্যাপারেই বলতেন আপনি কিছু জানেন না। কিন্তু প্রথম থেকেই আমি লক্ষ করে দেখেছি আপনি একজন প্রখর বুদ্ধিমান লোক, তাই আমি জানতাম সরাসরি বিপদজনক কোন প্রসঙ্গ না আসা পর্যন্ত আপনি খোলাখোলি কথা বলে যাবেন। আমি আপনার চাল ধরতে পেরে পালটা চাল দিয়েছি।”

ডক্টর আকেচি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। কৌতুকপূর্নভাবে তিনি বিধ্বস্ত ফুকিয়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “খুবই খারাপ, আপনি এখন আমার মত এক সাধারন উকিলের ফাঁদে আটকা পড়ে গ্যালেন।”

আর কথা বলে কোন লাভ নেই বুঝতে পেরে ফুকিয়া নিশ্চুপ রইল। সে চালাক লোক, বুঝতে পারছিল যে ভুল সে করেছে তা শুধরানোর জন্য যাই বলবে তা তাকে সর্বনাশের আরো গভীরে নিয়ে ফেলবে।

লম্বা সময় চুপ থাকার পর ডক্টর আকেচি আবার বললেন, “আপনি কি কাগজে কলম চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, ফুকিয়া? পুলিশের একজন স্টেনোগ্রাফার আমাদের সব কথা রেকর্ড করছেন পাশের কক্ষে বসে।”

তিনি পাশের রুমে কেউ একজনকে ডাক দিলেন। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে এক তাড়া কাগজ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন একজন যুবক স্টেনোগ্রাফার।

ডক্টর আকেচি তাকে অনুরোধ করলেন, “দয়া করে আপনি পড়ে যান।”

স্টেনোগ্রাফার তার রেকর্ডকৃত কথোপকথন পড়ে গেলেন।

ডক্টর আকেচি বললেন, “এখন মিস্টার ফুকিয়া, আমি খুশি হব যদি আপনি ঐ কাগজে স্বাক্ষর করেন এবং আপনার আঙ্গুলের ছাপ দেন। অবশ্যই তাতে আপনার কোন আপত্তি থাকার কথা না, কারণ আপনি নিজেই বলেছেন পর্দার ব্যাপারটি নিয়ে যেকোন সময় হলফনামা স্বাক্ষর করে দিতে আপনি প্রস্তুত।”

ফুকিয়া কাগজে স্বাক্ষর করল এবং তার আঙ্গুলের ছাঁপ দিল। এর কিছুক্ষণ পরে ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির নির্দেশ মত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে কয়েকজন গোয়েন্দা এসে অপরাধীকে ধরে নিয়ে গেল।

খেলা শেষ, ডক্টর আকেচি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ম্যুয়েনস্টারবার্গ যা বলেছিলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার প্রকৃত গুরুত্ব হচ্ছে জানতে পারা অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন ব্যক্তি, বস্তু বা স্থান সম্পর্কে জানে কি না তা জানতে পারা। ফুকিয়ার ক্ষেত্রে সব কিছু নির্ভর করেছে ঐ পর্দার উপরে। এটা ছাড়া অন্য মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা তার ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বপূর্ন ফলাফল বয়ে আনতে পারত না। এমন বুদ্ধিমান বজ্জাত সে, যে ঐসব পরীক্ষার প্রশ্নকে পরাজিত করার জন্য সদা প্রস্তুত ছিল তার মস্তিষ্ক।”

চেয়ার থেকে উঠে ডক্টর আকেচি মাথায় তার হ্যাট পড়লেন, যেন দীর্ঘ লেকচার দেয়ার পর অধ্যাপক ক্লাস ছাড়ছেন। এরপর একটু থামলেন তার শেষ কথা বলার জন্য।

হাসির সাথে তিনি বললেন, “আরো একটি জিনিস আমি যোগ করতে চাই। মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার জন্য আসলে অদ্ভুত যন্ত্রপাতি, তালিকা, বা শব্দ খেলার প্রয়োজন নেই। সেই আঠারো শতকের স্বর্নালী সময়ের বিখ্যাত বিচারক ওওকা আবিষ্কার করেছিলে, মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদে ফেলে অপরাধী ধরা খুব কঠিন কিছু না, তিনি সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে প্রায়ই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করতেন। কিন্তু অবশ্যই আপনাকে সঠিক প্রশ্নগুলিই করতে হবে। যাই হোক, শুভ রাত্রি মিস্টার ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী। আর জলখাবারের জন্য ধন্যবাদ।”


২০২০ সালের একুশে বইমেলায় আমার গল্পের বই এখানে জাদু শেখানো হয়। স্টল ৭১৮, বৈভব।

1 thought on “এদোগাওয়া রানপোর গল্প “মানসিক পরীক্ষা””

  1. কোনো কোনো গল্প থাকে যা গল্প করার মত হয়না কেবলি অনুভব করার মত হয়। খুব দারুণ খুব। অনেক ধন্যবাদ পড়ার সুযোগ করে দেবার।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং