তারসেম সিং এর দ্য ফলঃ ফ্যান্টাসী এবং বাস্তবতার সুন্দর গল্প

২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইন্ডিয়ান-আমেরিকান পরিচালক তারসেম সিং এর দ্য ফল মুভিটি নিয়ে এই পোস্ট। এই মুভি নিয়ে লেখার কারণ হল এরকম মুভি সচরাচর দেখা যায় না। এডভেঞ্চার-ফ্যান্টাসী ঘরনার ফিল্ম এবং একটি টাচিং স্টোরি। মুভিটির ফ্যান্টাস্টিক্যাল চিত্রায়ন এতই অসাধারন যে এর জন্যই ফ্যান্টাসী প্রিয়রা একে পছন্দ করবেন।

thefall_pangonglake

তারসেম সিং এর নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এবং বিশটিরও বেশী দেশে ফুটেজ শুটায়িত। পুরো ফিল্ম নির্মান করতে লেগেছে চার বছর।

ছবির কাহিনী হল একটি ছয় বছর বয়েসী মেয়ে আলেকজান্দ্রিয়া হাত ভাঙা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় ছিল হাসপাতালে। সেই হাসপাতালে এল পা ভাঙা নিয়ে একজন মুভি স্টান্ট ম্যান রয়। রয়ের সাথে জমে উঠল আলেকজান্দ্রিয়ার বন্ধুত্ব।

হতাশ রয় এবং কৌতুহলী শিশু আলেকজান্দ্রিয়া। আলেকজান্দ্রিয়া একটি গল্প বলতে বললে রয় একসময় তার গল্প শুরু করে। পিওর ফ্যান্টাসী গল্প। যদিও এটা তার জীবনের কাহিনীই কিছুটা। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। সেই গল্পে আছে পাগড়ি মাথার ইন্ডিয়ান, একজন কালো দাস যোদ্ধা, ইতালিয়ান এক বোমাবিদ এবং এক মুখোশধারী দস্যু। তাদের সাথে আছেন চার্লস ডারউইন এবং তার পোষা বানর ওয়ালেস।

তারা সবাই গভর্নর ওডিয়াসের উপর প্রতিশোধ নিতে চান। কারণ দুষ্ট গভর্নর ওডিয়াস তাদের সবার সাথেই করেছে ভয়ংকর অপরাধ। এই পাঁচ নায়ক মিলিতভাবে প্রতিশোধ নিতে চলেন ওডিয়াসের খোঁজে। তারা দ্বীপ থেকে সমুদ্র পাড়ি দেন হাতির পিঠে চড়ে। তাদের সাথে দেখা হয় এক অদ্ভুত মিস্টিকের।

রয় গল্প বলে যায়। আলেকজান্দ্রিয়া কল্পনা করে নেয়। আলেকজান্দ্রিয়ার কাল্পনিক চোখ দিয়েই দর্শক দৃশ্যগুলো দেখতে থাকেন। দেখতে দেখতে মুখোশধারী দস্যু বদলে হয়ে যায় রয়।

the-fall-12

এখন কথা হল, বিধ্বস্ত ও বিষন্ন স্টান্ট ম্যান রয় কেন এই গল্প বলে যাচ্ছে তার ছোট বন্ধুর কাছে? একেবারেই কারণ ছাড়া নয়। রয়ের গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে আরেক লোকের সাথে। যেই লোকের জন্য স্টান্ট হিসেবে কাজ করছিল সে অর্থাৎ সেই নায়কের সাথে। সুতরাং, দুঃখে রয়ের মধ্যে চলে আসে আত্মহত্যা প্রবণতা। সে আলেকজান্দ্রিয়াকে দিয়ে মরফিন ট্যাবলেট চুরি করাতে চায়।

আলেকজান্দ্রিয়া কিছুদিন ধরে হাসপাতালে আছে। সবার সাথেই তার ভালো সম্পর্ক। ট্যাবলেট কোথায় জানা থাকে তা তার জানা ছিল। সে রয়ের প্রস্তাবে সম্মত হয়।

সাথে সাথে পাঁচ হিরো নিয়ে রয়ের গল্পও এগিয়ে যায়। সেই গল্পে একসময় যোগ হয় আলেকজান্দ্রিয়া।

ফিল্মটিতে প্রথমদিকে রয়কে সব সময় বেডে শুইয়ে রেখেছিলেন পরিচালক। যাতে ছয় বছর বয়েসী অভিনেত্রী ভাবে সে সত্যিই হাটতে পারে না এবং তার চোখে সত্যিকারভাবে ফুটে উঠতে পারে হাটতে না পারা রয়ের জন্য মমতা। ছোট অভিনেত্রীর কথোপকথনের বেশিরভাগ ছিল আনস্ক্রিপ্টেড এবং রয়ের সাথে তার অনেক কথোপকথন শ্যুট করা হয়েছিল লুকিয়ে। যাতে স্বাভাবিক কথোপকথনে কোন বাঁধা না আসে।

দ্য ফল

অসাধারনের ভিজুয়ালাইজেশনের সাথে রয়ের দুঃখবোধ,হতাশা এবং আত্মহত্যাপ্রবণতার সাথে কৌতুহলী আলেকজান্দ্রিয়ার ফ্যান্টাসির জগত এবং বাস্তবের প্রতি বিস্ময়ানুভূতি – এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। এটাই মূলত ফিল্মের প্রধান দ্বন্দ্ব। এর সাথে রয়ের বেঁচে থাকা ও আলেকজান্দ্রিয়ার প্রতি মমতা, আলেকজান্দ্রিয়া নিষ্কলুশ শিশুসূলভ অভিব্যক্তি ফিল্মটাকে পূর্নতা দিয়েছে।

তার সাথে ছিল তারসেম সিংয়ের ক্রিয়েটিভ ডিরেকশনের কাজ। বলাবাহুল্য, তিনি দীর্ঘদিন ধরে, নিজস্ব খরচে বলা যায় মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরী করেছেন দ্য ফল। শুধুমাত্র এজন্যই তাকে দেখার লিস্টে রাখা যায়। কারণ কেউ যখন এরকম কমিটমেন্ট নিয়ে কোন কাজ করে, তা একেবারে ফেলে দেবার মত খারাপ হয় না কখনই।

তারসেম সিং
তারসেম সিং

 

পরিচালক তারসেম সিং এর জন্ম ইন্ডিয়ায়। তিন বছর বয়সেই পরিবারের সাথে চলে যান ইরানে। তারসেম বলেনঃ

ভারতে গাইড টু ফিল্ম স্কুল ইন আমেরিকা নামে একটা বই দেখেছিলাম এবং এটা দেখে আমি ধাক্কার মত খাই। এটা আমার জীবন পরিবর্তন করে দেয়। কারণ আমি ভাবলাম, কলেজে তুমি এমন কিছু শিখতে গেলে তা তোমার বাবা পছন্দ করেন এবং তুমি ঘৃণা কর। আমি বাবাকে বললাম, আমি ফিল্ম নিয়ে পড়তে চাই। তিনি বললেন, কখনোই সম্ভব না। আমি নিজে নিজেই লস এঞ্জেলসে যাওয়ার পথ করে নিলাম। একটা ফিল্ম বানিয়ে আর্ট সেন্টার কলেজ অফ ডিজাইনে স্কলারশিপ বাগিয়ে নিয়েছিলাম। বাবা ভাবলেন আমি হার্ভার্ডে যাচ্ছি। আমি তাকে ফোন করে বললাম, আমি ফিল্ম নিয়ে পড়তে চাই। তিনি বললেন, আমার কাছে তোর আর অস্তিত্ব নাই।