বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক যুক্তিবাদী বিচারে আমরা মানুষের জীবনের ও জগতের ঘটনাগুলিরে অংকের সমীকরণের মত দেখতে চাই। অংকে অযৌক্তিকতা নেই, এক যোগ এক দুই। কিন্তু লাইফে এই বিচার ভিন্ন।
দেখা যায় কোন ব্যক্তি হঠাৎ একদিন জুয়া খেলে অনেক টাকা জিতে ফেলেছে। এরপর সে আবার এবং বারবার জুয়া খেলতে গেছে জিতার জন্য। কিন্তু ঐ ঘটনার মত আর সে জিতে নাই। এরকম অনেক হয়। অতীতের ঘটনা একইরকমভাবে পুনরাবৃত্তি হয় না। সব পরিবেশ, পরিস্থিতি এক করে রাখলেও সমীকরণ মিলে না ঠিক অতীতের মত।
দেখা যায়, একজন ব্যবসায়ী তার এক বন্ধুর লগে ব্যবসা করে ব্যাপক লাভ করেছেন। পরবর্তীতে এই সাফল্যের সূত্রধরে তিনি আরো উদ্যোগ নিলেন বন্ধুর সাথে। কিন্তু ঐগুলা আগের মত আর হইল না।
প্রতিটা সাকসেসেই কিছু জিনিস থাকে এক্সিডেন্টাল, যাকে লাক বা ভাগ্য (সম্ভাব্যতা) বলতে পারেন। এই এক্সিডেন্টাল জিনিসগুলা সফলতা বিচারের সময় দেখা হয় না। কিন্তু পরবর্তীতে কেবল এইগুলা না থাকার কারণে পরবর্তী প্রচেষ্টা সফল নাও হইতে পারে। এজন্যই সাফল্যের গল্পগুলা বিভ্রান্তিকর।
সাফল্যে এক্সিডেন্টাল বা অনিশ্চিত জিনিসের ভুমিকা দেখা যেতে পারে ইংরাজদের বাংলা দখলের ক্ষেত্রে।
১৬৯০ সালে জোব চার্নক জাহাজে সৈন্য নিয়ে কলকাতার সুতানুটি গ্রামে আসেন। কলকাতায় আসার বা এখানে থাকার ইচ্ছা ইংরাজদের ছিল না। তারা চাইছিল চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে মোগল সেনাপতির হাতে মাইর খাইয়া তারা গেল সুতানুটি গ্রামে।
তারা যা চাইছিল তা করতে পারে নাই। কিন্তু কলকাতা থেকে তারা বাংলা দখন এবং সারা ভারত বর্ষই দখল করে নিল এবং শাসন করল দুইশ বছর। যে মোগল সম্রাটেরা তাদের ব্যবসা করার অনুমতি দিছিলেন এদেরই উত্তরপুরুষ বাহাদুর শাহ জাফররে শেষে বন্দী করে রাখল মিয়ানমারে। মরার পরে গোপনে তার কবর দিল সাধারণ কয়েদীর মতোই।
ইংরাজরা যখন কলকাতাকে কেন্দ্র করে বেশ ঝাঁকিয়ে বসল তখন তাদের কিছু সমস্যা দেখা দিল। তারা তখন আশেপাশের জমিদারদের বিদ্রোহ ইত্যাদি থেকে বাঁচতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে।
ইংরাজ কোম্পানি ঠিক করল তারা তাদের সমস্যা নিয়া দেখা করবে মোগল সম্রাটের লগে। সম্রাট তখন ফররুখশিয়র, অরাংজেবের নাতি। কোম্পানির লোকজন নানারকম উপহারাদি নিয়ে গেল দিল্লীতে। কিন্তু গিয়া তারা শোনল ফররুখশিয়রের বিয়া। তিনি রাজপুত এক রাজার মেয়েরে বিয়া করতেছেন। বিয়া না হওয়া পর্যন্ত আলাপ হবে না। ইংরাজরা বিয়ার অপেক্ষায় বইসা রইল।
এরপরে হঠাৎ ফররুখশিয়র অসুস্থ হইয়া পড়লেন। ডাক্তার, বদ্যি, হাকিম, কবিরাজ কেউ তার রোগ ভালো করতে পারে না। অতঃপর খোঁজ পড়ল ইংরাজদের দলে থাকা ডাক্তার হ্যামিল্টনের। হ্যামিল্টন সাহেব গিয়া রোগী দেখলেন। এবং সম্রাট ফররুখশিয়র, হ্যামিল্টন সাহেবের ওষুধে ভালো হইয়া উঠলেন।
খুশি হইয়া সম্রাট ফররুখশিয়র ইংরাজদের কলকাতার কাছে চব্বিশটা গ্রামের জমিদারী উপহার দিয়া দিলেন। এইটাই হইল চব্বিশ পরগনা।
দেখেন কীরকম অনিশ্চিত বা এক্সিডেন্টাল জিনিস এখানে কাজ করেছে। তারা গেছিল তাদের অসুবিধা পেশ করতে। কিন্তু সম্রাটের বিয়া দেইখা বইয়া রইল, কখন বিয়া শেষ হয় এবং তারা তাদের আর্জি পেশ করতে পারে এইজন্য। এর মাঝে সম্রাটের অসুস্থ, হ্যামিল্টনের চিকিৎসা ইত্যাদি আইসা সমীকরণ বদলাইয়া দিল।
কিন্তু এরপরেও কাহিনী আছে। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খান মারা যাবার পরে তার নাতি কুড়ি বছরের সিরাজ ক্ষমতায় আসেন। তার সাথে ইংরাজদের সমস্যা শুরু হয়। তিনি একসময় জানতে পারেন ইংরাজ এবং ফ্রেঞ্চরা দুর্গ বানাইতেছে। তিনি দুই পক্ষরেই কাজ বন্ধ করার জন্য এবং কেন বানাইতেছে এর কারণ দর্শানোর জন্য চিঠি মাইরা দেন।
ফ্রেঞ্চরা চিঠির উত্তরে জানাইল, তারা অল্প মেরামত করছে।
ইংরাজরা উত্তর দিল, বিশৃঙ্খলার মধ্যে ব্যবসা চালাইয়া যাইতে তাদের শক্তি বৃদ্ধি জরুরী।
সিরাজ ইংরাজদের উত্তরে খুশি হইলেন না। তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক এক অভিযান চালাইলেন। অতর্কিত আক্রমণ করলেন তিনি। দুর্গ ঘেরাও কইরা বেদম মাইর দেয়া হইল ইংরাজদিগকে। ইংরাজ ১৪৬ জন বন্দিকে একখানা ঘরে বন্দি কইরা রাখা হইছিল এবং সকালে খুইলা দেখা যায় ২৩ জন মাত্র জীবিত আছে, এইরকম একটা কাহিনী প্রচারিত হয়। এইটাকেই অন্ধকূপ হত্যা বলা হয়। এর পক্ষে বিপক্ষে কথা আছে। বিতর্কিত এই ঘটনা ছাড়াও এইটা বলা যায় এই যুদ্ধে ইংরাজদের ব্যাপক ক্ষতি হইছিল। অনেক ইংরাজ দুর্গের পশ্চিম দরজা দিয়া হুগলি নদীতে নৌকা করে পালায়।
তারা হুগলির কাছে ফলতা গ্রামে গিয়া বাস করতে শুরু করে। তাদের সাহায্যের জন্য মাদ্রাজ হইতে পাঠান হয় রবার্ট ক্লাইভ, একজন নৌ সেনাপতি, যুদ্ধ জাহাজ ও সৈন্য।
এরা আইসা আবার কলকাতা দখল করল। নবাব সিরাজ আবার আইলেন এদের হটাইতে। নবাব আইসা এক জায়গায় তাবু করলেন। ক্লাইভ রাইতে যুদ্ধ করা পছন্দ করতেন। তিনি ঠিক করলেন রাইতে নবাবের তাবুতে আক্রমন করবেন। তিনি সেইমত সৈন্য নিয়া রাইতে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু ভুল করে তার সৈন্যরা তাবুর পাশের ক্ষেতে নেমে গেল। হইচই শুনে নবাবের সৈন্যরা জাইগা উঠল। ক্লাইভের সৈন্যরা সামলে নিয়ে কামান ছুঁড়তে শুরু করছিল অবশ্য, কিন্তু ততক্ষণে নবাবের সৈন্যরাও তৈরী হইয়া গেছে। ফলে নিরাশ হইয়া ক্লাইভরে ভাগতে হইল।
এরপরে ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের পথে আগায়। সিরাজরে হটাইতে চাইছিলেন আরো অনেকে। যেমন প্রভাবশালী জগৎশেঠ পরিবার। তারা ষড়যন্ত্রে যোগ দিল। মীরজাফররে পরবর্তী নবাব বানাইতে মত দিল ইংরাজরা। বুড়া আফিংখোর মীরজাফর দিয়া তাদের কাজে সুবিধা হইব ভাইবাই তারে নবাব বানাইতে চাইল তারা।
এইদিকে মীরজাফর দুই পক্ষেই ছিল, ফলে তারে নবাবও সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন, আবার ক্লাইভও তারে সন্দেহ করতেন।
পলাশীর যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবাবের লগে পঞ্চাশ হাজারের বেশী সৈন্য, পঞ্চাশটার বেশী কামান। ইংরাজরা সেই তুলনায় অনেক কম।
যুদ্ধ শুরু হইয়া গেল। তখনো মীরজাফর কোন দলে ক্লাইভ বুঝতে পারলেন না। তিনি তারে চিঠি দিয়া জানাইলেন, আমারা যা করা সম্ভব করছি। আপনি আমাদের লগে আসেন। নতুবা আমরা নবারের লগে মিটমাট কইরা নিব।
আর এইদিকে নবাব তার কোন সেনাপতিরেই যেন বিশ্বাস করতে পারতেছিলেন না।
নবাবের সৈন্যরা তুমুল গোলাবর্ষন করতে লাগল। ইংরাজরা তখন এর ঠিক জবাব দিতে পারতেছিল না। এর মাঝে বিকালে আইল তুমুল বৃষ্টি। গোলা বন্ধ হইল কিছু। ক্লাইভ আগা মাথা পানিতে ভিইজা একটা ইংরাজ শিবিরের ওইখানে একটা পাকা বাড়িতে কাপড় ছাইড়া ঘুমাইয়া রইলেন। সৈন্যদের নির্দেশ দিয়া গেলেন, এইরকম চলতে থাক, রাইতে ফাইট হবে।
এর মাঝে আহত হইলে নবাবের সেনাপতি মীর মদন। এবং তার মৃত্যু হইল। যুদ্ধ পরিস্থিতি বদলে গেল। মীর জাফর নবাবরে যুদ্ধ বন্ধ রাখতে বললেন।
নবাব তাতে এক পর্যায়ে রাজী হইলেন।
মোহনলাল চাইতেছিলেন না যুদ্ধ বন্ধ হোক। তাও নবাবের আদেশ মানতে হইল।
আর এইদিকে মীর জাফর গোপনে রবার্ট ক্লাইভরে খবর দিলেন নবাবের সৈন্যরা আইজ আর যুদ্ধ করবে না।
ক্লাইভ ঘুম থেকে উইঠা চোখ কচলে দেখলেন তার সেনাপতি কিলপ্যাট্রিক নবাবের সৈন্যরে তাড়াইয়া নিয়া যাচ্ছে।
ক্লাইভও ইয়াহু বইলা যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়লেন।
ছত্রভঙ্গ নবাব সৈন্যরা পালাইতে লাগল। নবাব পালাইলেন। পালানোর কালে তারে ধরাইয়া দিল এক লোক। নাম তার দানশা ফকির।
এইভাবেই ইংরাজ কোম্পানি তথা ইংরাজদের বাংলা দখলের শুরু।
এই যে পুরা ঘটনা ইতিহাসের, এতে শিক্ষা কী? শিক্ষা হচ্ছে দুনিয়া অদ্ভুত। তার ঘটনাবলি প্রেডিক্ট করা যায় না। নানা ফ্যাক্টর এইখানে কাজ করে। এক আর একে দুই হয় না এখানে। তাই এটা হলো দুনিয়ার জটিল সমীকরণ।