মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » রাজনীতি, প্রতীক ও রিচুয়াল  

রাজনীতি, প্রতীক ও রিচুয়াল  

সিরিয়ায় একবার উচ্চপদস্থ এক অফিসার সেনাবাহিনী ভিজিটে গেছেন। তিনি গিয়ে সেনাদের বললেন, তোমরা কাল রাতে কে কী স্বপ্ন দেখেছ বলো?

একজন সেনা এগিয়ে এসে বললেন, আমি দেখলাম আকাশে আমাদের মহান নেতার ছবি, আমরা সবাই আগুনের সিঁড়ি পার হয়ে সেই ছবিতে চুমো খাচ্ছি।

দ্বিতীয় সেনা এগিয়ে এসে বললেন, আমি দেখলাম আমাদের মহান নেতা সূর্য হাত দিয়ে ধরে, চিপে খেয়ে ফেললেন। সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর তার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল, আলো ছড়িয়ে পড়ল তার সুন্দর মুখশ্রী থেকে চারিদিকে, দুনিয়া আলো ফিরে পেল।

এইভাবে একের পর এক সেনা তাদের স্বপ্নের কথা বলে গেলেন।

এরপর একসময় একজন সৈনিক আসলেন। তিনি ভিজিটিং অফিসারকে স্যালুট দিয়ে বললেন, আমি দেখলাম আমার মা প্রস্টিটিউট হয়ে আপনার বিছানায় শুয়ে আছেন।

এই ঘটনার পর ১৯৮৯ সালের ওই বসন্তে, এই প্রতিভাবান ও বেশ ভালো ক্ষমতায়  থাকা অফিসারকে ধুম মাইর দেয়া ও প্রেসিডেন্টশিয়াল গার্ড থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সিরিয়ায় আসাদরে ডিভাইন এবং প্রায় সর্বশক্তিমান হিশাবে উপস্থাপন করা হত।যেকোন দিনে তাকে হয়ত ঘোষণা করা হচ্ছে দেশের সবচে বড় ফার্মাসিস্ট, শিক্ষক, আইনজ্ঞ, ডাক্তার, বা ফরেন পলিসি বিষয়ে তিনি সব কিছু জানেন। তিনি পিতা, লেবাননের রক্ষাকর্তা, চিরদিনের নেতা, নাইট, আধুনিক সালাহ উদ দীন ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত। ইয়াংদের নিয়মিত ভাবে র‍্যালিসহ বিভিন্ন রিচুয়ালে অংশ নিতে হত, কবি লেখকদের নিয়মিত নেয়া হত বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ স্লোগান ও প্রেসিডেন্টের পক্ষে বক্তব্য তৈরি জন্য, প্রফেশনাল সিন্ডিকেট সাংবাদিকদের, ডাক্তারদের, আইনজ্ঞদের ইত্যাদি, সব ছিল প্রেসিডেন্টের পক্ষে কাজ করার জন্য। সেই অবস্থায় উক্ত ঘটনা।

এইখানে, যে অফিসার বললেন, আমার মা প্রস্টিটিউট ও আপনার বিছানায়, উনি রূপক একটা কথা বলছেন। মা দিয়ে হয়ত তিনি বুঝাইছেন তার দেশ সিরিয়া।

ইন্টারেস্টিং বিষয়, তিনি কিন্তু রিচুয়ালে অংশ নিছেন।

মুজিববর্ষের শপথ অনুষ্ঠানের রিচুয়াল থেকে ব মিসিং হওয়াকে একই ধরণের ঘটনা মনে হল। ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা রিচুয়ালে অংশ নিছেন, কিন্তু ব নাই করে দিছেন। রূপকে সেই ব মিসিং দ্বারা বুঝায়, বাংলাদেশ মিসিং, বিজয় মিসিং। কার দ্বারা মিসিং? বঙ্গবন্ধুর নামের আগ্রাসন দ্বারা মিসিং। যেন এই আওয়ামী রেজিমে উপস্থাপিত মুজিবের ব খেয়ে ফেলতেছে বাংলাদেশ ও বিজয়ের ব।

এদের শাস্তি হবে।

বাইরে থেকে বলার উপায় নাই তারা ওই অফিসারের মত উদ্দেশ্য নিয়ে করছে কি না। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে।

মুজিব বর্ষ
মুজিব বর্ষ

২১ জানুয়ারি ২০২১ সালে জাতীয় সংসদে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সংসদে দাঁড়িয়ে গাজিপুর-৩ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন একটা গল্প বলেন। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ও পদ্মাসেতুকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। পদ্মাসেতু প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়। 

একপর্যায়ে পদ্মাসেতু বলে, আমার প্রেরণার উৎস শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনা।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে স্তুতি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান শেখ হাসিনার ফিগারকে আদর্শ ফিগার হিশাবে উপস্থাপন করা পর্যন্তও গিয়েছেন। অর্থাৎ, সেক্সুয়াল ইমেজারিতেও শেখ হাসিনার স্তুতি পৌঁছেছে। 

কিন্তু সেতুর কথা বলাটা বেশি গুরুত্বের দাবী রাখে। কারণ আমরা জানি যে, সেতু কথা বলতে পারে না। 

সাংসদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন নি তিনি কবিতা বলছেন। তিনি সরাসরি তার অভিজ্ঞতা, সেতুর সাথে কথোপকথন উল্লেখ করেছেন। 

মানুষের স্তুতি থেকে এখন জড় প্রাণহীন বস্তুও যে স্তুতিতে অংশ নিয়েছে বা তাদের নেয়ানো হয়েছে, এটা এক এক্সট্রিম অবস্থা। 

কল্পণা করেন, আরও সাংসদ ও নেতারা যদি সামনে বলেন, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, চেয়ার টেবিল ইত্যাদি স্থাপনা ও নানাবিদ বস্তু প্রধান নেত্রীর স্তুতি করছে, তখন কী করা যাবে? 

যেই জায়গাটা আছে জড় বস্তুর কথা বলার বা কথা না বলার, স্তুতির আগ্রাসন সেইখানে চলে যাওয়া মানে ওই জড় বস্তুর আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি হয়ে যাওয়া, এবং এই জড় বস্তুদের নিয়ে মানুষের কল্পণাকে দখল করে নেয়া। 

ধরেন একটা গাছ আছে। যে কেউ এটা নিয়ে কল্পণা করতে পারে, কবিতা লেখতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যদি এই গাছ প্রধানমন্ত্রীরই স্তুতি করছে এমন বক্তব্য দেন, বিশেষত সংসদে দাঁড়িয়ে দেন, এটা একটা ট্রুথ নির্মান হয়, যা অন্য সকল মানুষের গাছ নিয়ে সব কল্পনার জায়গায় হস্তক্ষেপ। রিলিজিয়নে, যেমন বলা আছে প্রতিটা গাছ বিরিক্ষ লতা, প্রতিটা বস্তু আল্লার নাম জপে, এই সত্য আরোপ আল্লার সর্বময় ক্ষমতার প্রকাশে। এইরকম কোন রাজনৈতিক নেতার স্তুতিকারকেরা করতে চাইলে, ভয়ংকর। কারণ তিনি আল্লা না, ডিভাইন ক্ষমতা তার নাই। 

সংসদে এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবী করা উচিত ছিল। অথবা সাংসদকে বলতে হবে, তিনি এটা কল্পণা করেছেন বা কবিতা লিখেছেন। 

2 thoughts on “রাজনীতি, প্রতীক ও রিচুয়াল  ”

  1. মুরাদুল ভাই আপনার সাথে আমার অনেক অনেক কথোপকথন হয়। যদিও সেগুলো সরাসরি হয় না। আপনার লেখা আমি খুব মন দিয়ে ও যত্ন সহকারে পড়ি। পড়তে পড়তেই চলে আলাপ আলোচনা। কথাটা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উপায় না থাকায় comment box মারফৎ জানালাম। আপনার লেখার আমি একজন গুণমুগ্ধ পাঠক ও প্রচারক। আমার প্রিয়জনদের আপনার লেখা পড়তে বলি। আপনার লেখার পড়ে আমি খুবই উপকৃত।

    আপনার এই লেখাটাও আপনার অন্যান্য লেখার মতোই ভাবায়।
    তবে, প্রতীক এবং রিচুয়াল এই দুটো শব্দ সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করলে বিষয়টা বোঝা আরও সহজ ও সম্পূর্ন হতো। কারণ, আমাদের জীবনে প্রতীক ও রিচুয়াল এই দুটো জিনিসের গভীর প্রভাব আছে। আমার মনে হয় আমাদের বোধবুদ্ধির একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে শুধু প্রতীক আছে। যেমন, চীনের নাম শুনলে আমাদের কিন্তু চীনের পতাকা আর চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখানে পতাকা আর রাষ্ট্রপতি চীনের প্রতীক মাত্র। চীন মানে শুধু ওই পতাকা বা শি জিনপিং এর চেয়ে অনেক বেশি কিছুই। কিন্তু আমরা চীনকে বুঝি ওই প্রতীক দিয়েই।
    ঠিক একই ভাবে, আমাদের অনেক বোঝাপড়া কিন্তু এইরকম ভাবেই প্রতীক নির্ভর।
    যদিও লেখাটার লক্ষ্য হয়তো মাননীয় সংসদের কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখা। এবং ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লেখাটি তার উদ্যেশ্যে সফল ।

    আপনার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং