তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন বড় সাহিত্যিক। তার আত্মজীবনী ‘আমার সাহিত্য জীবন’ – এতে তিনি তার সাহিত্য জীবনের নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। বিভিন্ন কারণে তারাশঙ্করের আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ন বলে বিবেচীত হতে পারে। যেকোন ফিল্ডে কাজ করতে হলে সেই ফিল্ডের বড় কাজ, আইডিয়া এবং ব্যাক্তিদের সম্পর্কে জানতে হয়। সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। লেখকদের জন্য তাই অন্য লেখকদের আত্মজীবনী পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ন।
‘আমার সাহিত্য জীবন পড়া’ থেকে একটি বিষয় এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। এর পরে অন্য দু’টি আইডিয়া যুক্ত আছে, তা যথাক্রমে অন্ট্রিপ্রেনিউর ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট পল গ্রাহাম এবং ট্রেডার, দার্শনিক, স্ট্যাটিস্টিশিয়ান নাসিম তালেবে হতে প্রাপ্ত। এবং এই তিন বিষয় যুক্ত করে সমন্বিতভাবে একটি ফলাফলে যাওয়া হয়েছে- যাকে আমি বলেছি প্রত্যাখান ডিল করার কৌশল। এখানে লেখালেখির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কিন্তু অন্য যেকোন ক্ষেত্রে তা কাজে আসবে বলে মনে হয়।
প্রত্যাখ্যান
লেখক হতে গেলে আপনি ধরে নিতে পারেন যে অবশ্যই আপনার লেখা প্রত্যাখাত হবে অনেক জায়গা থেকে। এর কিছু হতে পারে অ-ন্যায্য, কিছু অন্যান্য কারণে। অ-নায্য বলতে বুঝানো হচ্ছে আপনি নতুন লিখছেন তাই সম্পাদকেরা আপনার লেখা পড়বেনই না এমন। আর অন্যান্য কারণ বলতে বুঝানো হচ্ছে সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গী, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তার বুঝ এবং পছন্দ ইত্যাদি। এইসব ফ্যাক্টর কাজ করে কোন পত্রিকায় বা সাহিত্য পত্রিকায় লেখা ছাপার ক্ষেত্রে।
তারাশঙ্করের ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছিল। তিনি তার সাহিত্য জীবনের প্রথমভাগকে বলেছেন অবহেলার কাল, অবজ্ঞার যুগ।
গ্রামে প্রথম কবিতা ছাপিয়ে পূজায় বিলি করেছিলেন ছোটবেলায়। তখন একজন এমন কটু মন্তব্য করেছিলেন যে সে সম্পর্কে তারাশঙ্কর লিখেন-
সাহিত্যজীবনের শুরুতে তারাশঙ্কর এক বিখ্যাত পত্রিকায় গল্প পাঠিয়েছেন। কয়েকদিন পরে উত্তর এল লেখাটি বিবেচনাধীন আছে। আরো কয়েকদিন পরে তিনি ডাকযোগে জানতে চাইলেন লেখার কী অবস্থা ফিরতি রিপ্লাই কার্ডসহ। উত্তর এলো বিবেচনাধীন আছে। এভাবে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে অপেক্ষা করে তিনি দশবার জানতে চান। দশবারই একই উত্তর আসে। তারপর আটমাস পরে একবার কলকাতায় গেলে তিনি ঐ পত্রিকার অফিসে গিয়ে জানতে চান তার লেখাটির কী অবস্থা। পত্রিকার লোকজনেরা বলেন, লেখা এখনো খুলে দেখা-ই হয় নি!
বিচার দুই ধরনের হয়ে থাকে
পল গ্রাহামের কাছ থেকে দুই ধরনের বিচারের কথাটা জানতে পারি। জাজমেন্ট হয় দুই ধরনের। এক– যখন আপনি স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার খাতা দেখার সময় স্যার আপনার পুরা বছরের শিক্ষার কর্মফল বিচার করেন এবং বিচার করেন ক্লাসে আপনার উপস্থিতি, সক্রিয়তা ইত্যাদি। এই ধরনের বিচারের সাথে ছোটকাল থেকেই আমরা পরিচিত হই। ফলে আমাদের মনে হয় সব ধরনের বিচারই বুঝি এরকম। আসলে তা নয়। আরেক ধরনের বিচার আছে, যখন আপনি কোথাও চাকরীর ইন্টারভিউয়ে যান, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন বা ধরেন কোথাও লেখা পাঠান। ঐ জায়গায় যিনি বিচারক থাকেন তিনি আপনার স্কুলের শিক্ষকের মত না। স্কুলের শিক্ষকের একটা দায় ছিল আপনার কাজের সুষ্ট বিচারের যাতে আপনার উন্নতি হয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় পদ্বতির বিচারে যারা বিচারক তাদের কাছে আপনার উন্নতি বিবেচ্য নয়, এ ব্যাপারে কোন দায় তাদের নেই। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে আপনাকে পছন্দ করে গ্রহন করতে পারেন বা বাদ দিতে পারেন। এ ধরনের বিচার বিচারকের চাহিদার উপরে নির্ভর করে; আপনার ট্যালেন্ট, পরিশ্রম এসব হয়ত খতিয়ে দেখেন না তিনি। এখানে সে বিচার করতে বসেছে আপনাকে দিয়ে বা আপনার কাজ দিয়ে তার চাহিদা কতটুকু পূরণ হবে।
যদি কোন প্রকাশকের সাহিত্য রুচির সাথে আপনার লেখা মিলে, যদি সে মনে করে ঐ বই ছাঁপিয়ে সে লাভ করতে পারবে; তাহলে সে আপনার বই প্রকাশ করতে পারে। আপনি অসাধারণ মানের কোন বই লিখলেন কিন্তু যে প্রকাশককে দিলেন তার সাহিত্য রুচির সাথে মিলল না, তার মনে হলো এতে লাভ হবে না অথবা কোন কারণে ব্যক্তি হিসাবে আপনার বুদ্ধিভিত্তিক অবস্থান সে পছন্দ করল না, তখন সে আপনার পান্ডুলিপি রিজেক্ট করতে পারে। এতে আপনার মন খারাপ করার কিছুই নেই, কারণ এটা স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার বিচারের মত বিচার নয়, এটা দ্বিতীয় ধরনের বিচার।
এসব ক্ষেত্রে প্রত্যাখাত হলে তা স্বাভাবিকভাবে নেয়াই যৌক্তিক। বিচার বা জাজমেন্ট বিষয়ক মাত্র এক ধরনের ধারণা আমাদের মাথায় থাকে তাই আমরা দ্বিতীয় ধরনের বিচারকে ধরতে পারি না এবং এতে আমাদের কেউ প্রত্যাখ্যান করলে বেশী দুঃখ পাই।
এন্টিফ্রাজাইলিটি
নাসিম তালেব চার খন্ডে অনিশ্চয়তা নিয়ে যে দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেছেন এর চতুর্থ বই হচ্ছে এন্টিফ্র্যাজাইল। ফ্র্যাজাইল শব্দের শব্দের প্রচলিত বিপরীত শব্দ রোবাস্ট, যার অর্থ ধরেন শক্ত। কিন্তু তালেব এখানে আপত্তি করেছেন। তিনি বলেছেন ফ্র্যাজাইলের বিপরীত শব্দ রোবাস্ট হলে নেগেটিভ (-) এর বিপরীত শব্দ নিউট্রাল (+-) হতে হয়। কিন্তু নেগেটিভ এর বিপরীত নিউট্রাল নয়, পজেটিভ (+)। এই যুক্তিতে তালেব বলেন, ফ্র্যাজাইলের বিপরীত এন্টিফ্র্যাজাইল।
ধরা যাক একটি বাকসের মধ্যে রাখা কাচের টুকরা। তা পাকা মেঝেতে ফেলে দিলে ভেঙ্গে যাবে। এটি একটি ফ্র্যাজাইল বস্তু।
এন্টিফ্র্যাজাইল হবে এমন বস্তু যা ফেলে দিলে কেবল যে ভাঙবে না এমন নয়, প্রতিবার ভাঙার চেষ্টা করা হলে সে আরো বেশী অভঙ্গুরতা অর্জন করে নিবে। অর্থাৎ প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সে শক্তি আহরন করে নিয়ে আরো শক্ত হয়ে উঠবে। এই বস্তুই ফ্র্যাজাইলের প্রকৃত বিপরীত বস্তু, এন্টিফ্র্যাজাইল।
ধরুন একজন লেখক। তিনি খুব কষ্ট করে খুব ভালো মানের একটি কবিতা লিখেছেন। এরপর তিনি তা এক বিখ্যাত সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন বড় এক সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদকের কাছে এই নতুন লেখক পরিচিত ছিলেন না। তিনি তার লেখাটি পড়লেন না। যেমনটা উপরে তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে হয়েছিল। আরো হাজার হাজার লেখকের জীবনেও হয়েছে। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এটি।
সম্পাদক পড়লেন না তা তাই লেখাটি ছাপাও হলো না। আরো দুয়েকবার চেষ্টা করলেন কবি কবিতা পাঠিয়ে। কিন্তু একই ব্যাপার ঘটল। কবি ভাবলেন তার কবিতা কিছুই হয় নি। হতাশ হয়ে একসময় রাগে দুঃখে ক্ষোভে সেই কবি কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন।
এই কবিটি হলেন ফ্র্যাজাইল।
আবার চিন্তা করা যাক আরেক কবির কথা। তিনি তার ভালো কবিতা পাঠালেন বিখ্যাত সম্পাদকের দরবারে। তার দুই ধরনের বিচার সম্পর্কে ধারনা ছিল। ফলে তিনি পত্রিকাতে দেবার আগেই ধরে নিয়েছিলেন সম্পাদক নাও ছাপাতে পারে, এমনকী নাও দেখতে পারে। ফলে যখন পত্রিকায় প্রকাশ হলো না তখন তার তেমন দুঃখ হলো না। তিনি অন্যান্য পত্রিকাতেও পাঠাতে লাগলেন। না ছাপা হলেও তিনি হতাশ হলেন না। কারণ তিনি জানতেন ওরা তার মানের বিচার করছে, তাদের চাহিদা দেখছে।
এভাবে একসময় তার কবিতা প্রকাশিত হলো। এই কবিটি হলেন এন্টিফ্র্যাজাইল। প্রতিবার রিজেক্ট তাকে শক্ত ও পরিণত করে তুলেছে। তিনি কষ্টও পান নি তেমন কারণ মানব চরিত্র ও পরিবেশ সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল।
“অমলকান্তি”, “কলকাতার যিশু” বা “উলঙ্গ রাজা”র কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা স্বাক্ষাৎকার দেখেছিলাম ভারতীয় টিভি চ্যানেল দূরদর্শনে। সেখানে তিনি বলেছিলেন প্রথম যখন কবিতা লিখতেন তখন প্রায় সব পত্রিকাতে লেখা পাঠাতেন। ফিরতি কার্ড দিয়ে। মজা করেই বলেছিলেন, অনেক সম্পাদক লেখাটা ফেরতও পাঠান নি। হয়ত ঐ ফেরত কার্ড দিয়ে তার প্রেমিকাকে চিঠি লিখেছিলেন।
নীরেন্দ্রনাথ দুই ধরনের জাজমেন্ট যে আছে তা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ভেঙ্গে যান নি, বরং এন্টিফ্র্যাজাইল হয়ে উঠেছেন।
শুধু কবি বা লেখক না একজন উদ্যোক্তাকেও হয়ত এমন কাজ করতে হবে যেখানে বার বার প্রত্যাখাত হবার সম্ভাবনা আছে। তাতে থেমে গেলে তিনি ফ্র্যাজাইল। কিন্তু তিনি যদি মনে মনে তৈরী হয়ে যান, আমি অনেক প্রত্যাখাত হবো, আমাকে নিয়ে লোকে হয়ত মজা করবে কিন্তু আমি এন্টিফ্র্যাজাইল, এ থেকে শক্তি অর্জন করে আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাব; তাহলে তাকে আটকানো অসম্ভব।