মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » ব্যবসায় যেভাবে গল্প ব্যবহার করবেন

ব্যবসায় যেভাবে গল্প ব্যবহার করবেন

 

গল্পের ভূমিকা

আমাদের গল্পই আমরা। আমাদের বিষয়ে আমরা যা বলি, এবং যেসব গল্প প্রচলিত আছে তাই আমাদের নির্মান করে অনেকাংশে। আমাদের এলাকায়, আমার ছোটবেলায় একটা বড় তেতুল গাছ ছিল। সেই তেতুল গাছ নিয়ে প্রচলিত গল্প ছিল এটি দোষী। এর মধ্যে দোষ আছে। জ্বীনেরা এই গাছে আশ্রয় নিয়েছেন। শোনা যেত গভীর রাতে এই গাছ থেকে লাগোয়া বাড়ির টিনের চালায় কারা নাকি ঢিল ছুঁড়ত, অদৃশ্য জগতের বাসিন্দারা। এই প্রচলিত গল্প, এই গাছটির উপর বিশেষত্ব আরোপ করছিল। এক ধরণের ভয়মাখানো সমীহ সে আদায় করে নিয়েছিল, তার উপর ভর করেছিল যেন অদ্ভুত এক গাম্ভির্য।

এই গাছের দোষ থাকার ব্যাপারটি যৌক্তিক দিক থেকে অসম্ভব। কিন্তু গল্প যুক্তির পথ ধরে কাজ করে না, বরং আবেগের পথে সে বেশি শক্তিশালী। ফলে, গল্পটি এখনো জনমনে গাছটিকে বিশেষ করে রেখেছে, যদিও সে গাছ এখন আর নেই। কাটা হয়েছে।

 

গল্প বলার প্রাচীনতা

কৃষিভিত্তিক সমাজের আগেও মানুষের সমাজে গল্প প্রচলিত ছিল। গল্প বলা হতো মূলত সামাজিক নিয়ম, রীতি ইত্যাদি গল্পের আকারে শিক্ষা দেবার জন্য এবং এর মাধ্যমে সহযোগীতা বাড়ানোর জন্য। হান্টার গেদারার সমাজের গল্প নিয়ে গবেষণা করে এটা পেয়েছেন কয়েকজন এনথ্রোপলজিস্ট।

কৃষিভিত্তিক সমাজ তৈরী হবার পরে গল্পের ধরণ বদলে যায়, কারণ সমাজের প্রচুর পরিবর্তন হয়। তখন গল্পে আসে গড, আলাদা মোরালিটি, নেশন স্টেইট ইত্যাদি।

হান্টার-গেদারার সমাজেও গল্প যারা বলতে তাদের অনেক সামাজিক মর্যাদা ছিল। যেমন এখন সফল লেখক বা ভিজুয়াল আর্টিস্টদের থাকে। এখনকার একজন সফল ভিজুয়াল আর্টিস্টও বেশী পার্টনার পাওয়ার সুযোগ পান।

 

গল্প যেভাবে আমাদের তৈরি করেছে

গল্প যেভাবে আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ন এবং আমাদেরকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে তা নিয়ে গল্প বলা প্রাণীটি বা স্টোরিটেলিং এনিম্যাল নামে একটি বই আছে। সে বই নিয়ে এই সাইটে আমি লিখেছিলাম, আপনি পড়তে পারেন – গল্প বলা প্রাণীটি।

 

ব্যবসায় গল্প ব্যবহার

সিএনএনের প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার তার বাপার বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনের ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন যখন তার বয়স ২০ এর কোটায় (20’s)। তার বাবা এড টার্নার ছিলেন ডিপ্রেশন পিরিয়ডের সন্তান, সেই সময়ে তার বাবা মা প্রায় সব কিছুই হারিয়ে ফেলেছিলেন। এতে এড আরো শক্তিশালী মনোভাব নিয়ে কাজে নেমে পড়েন একদিন মিলিনিয়ার হবেন, তার নিজের প্ল্যানেটেশন হবে, ইয়াচট হবে ইত্যাদি লক্ষ্য সামনে রেখে। যখন টেড তার বাবার কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন তখন তার বাবা যেসব স্বপ্ন সামনে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তার সবই অর্জন করে ফেলেছেন। টেডকে তার বাবা তখন একপাশে নিয়ে বলেছিলেন, দেখো বাবা, নিজের লক্ষ্যগুলিকে খুব বড় করো যাতে এক জীবনে তার সব অর্জন করতে না পারো। তাহলে সব সময়ই তোমার সামনে অর্জন করার মতো কিছু থেকে যাবে। আমি জীবনে ভুল করেছিলাম আমার লক্ষ্যগুলিকে খুব ছোট হিসেবে নিয়ে। এখন আমি তার সব অর্জন করে ফেলেছি এবং নতুন লক্ষ্য ঠিক করতে পারছি না।’

আপনি একটি বিজনেসের লক্ষ্য দেখতে পেলেন ছোট। আপনি তাদের হয়ে কাজ করেন। ডিসিশন মেইকারদের অনুপ্রাণিত করতে চান যাতে তারা বিশাল লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করতে থাকে। এই অবস্থায় আপনি উপরিউক্ত গল্পটি বলে কথা শুরু করতেই পারবেন। তাহলে ডিসিশন মেইকাররা আপনার কথা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেড়ে যায়।

বিজনেসে গল্প সাহায্য করতে পারে। ম্যানেজারেরা যারা ভালো লিডার হতে চান গল্প তাদের সাহায্য করতে পারে। মাইক্রোসফট, কোকাকোলা, আইবিএম বোয়িং, বেয়ার, স্যাপ ইত্যাদিসহ আরো অনেক কোম্পানিগুলি তাদের কর্মকর্তাদের গল্প বিষয়ে ট্রেইনিং দিচ্ছে।

গল্প এম্প্যাথী তৈরি করে। মানুষ হচ্ছে গল্প বলা প্রাণী। সেই হিসাবে মানুষকে নিয়ে যে ব্যবসা তাতে গল্পের গুরুত্ব থাকবে তা স্বাভাবিক। গল্প তা লেখায় হোক বা বলায়, আমাদের মস্তিষককে অধিক সচেতন করে তোলে এবং মস্তিষ্ক ঐ কন্টেন্টের প্রতি বেশি যুক্ত হয়ে পড়ে। এজন্য গল্পের মাধ্যমে মেসেজ হয় কার্যকরী।

নৃতাত্ত্বিকেরা কিছু গবেষণায় দেখেছেন, প্রাচীন কালে মানুষ বিভিন্ন ধরণের গল্প তৈরি করেছিল নৈতিকতা, নিয়ম, রীতি ইত্যাদি সম্পর্কে অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য।

ব্যবসার জন্য যে গল্প বলা হবে সেটি আবার চিরাচরিত সাহিত্য গল্পের মতো হলে হবে না। কারণ ব্যবসার গল্পে গল্পটাই মূল উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গল্পটি বলা হচ্ছে তা করা।

 

দুই ধরণের গল্প

এজন্য শন কালাহান, যিনি বিজনেস স্টোরিটেলিং কনসালটেন্ট অর্থাৎ ব্যবসায় গল্প নিয়ে কাজ করেন এবং স্টোরিজ এট ওয়ার্ক বইয়ের লেখক তিনি গল্পকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।

প্রথম ভাগের নাম দিয়েছেন স্মল এস গল্প। এই ভাগে আছে, এনেকডোটাল গল্প, উদাহরণ এবং স্মৃতিচারণ।

আর দ্বিতীয় ভাগের গল্পের নাম দিয়েছেন বিগ এস গল্প। এই ভাগে আছে লিজেন্ডস, এপিক, উপন্যাস, ফেয়ারিটেল।

ব্যবসার জন্য কোন প্রেজেন্টেশনে গল্প বলতে গেলে বিগ এস গল্পের ধরণ এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ বিগ এস গল্পে গল্পটাই মূখ্য থাকে। গল্প থাকে দীর্ঘ এবং এটি পাঠক বা শ্রোতা উপভোগ করার জন্যই শুনে থাকেন।

ব্যবসার জন্য বলা গল্প এমন হলে হবে না। এমন হলে দেখা যাবে যে ব্যবসা উদ্দেশ্যে গল্পটি বলা হচ্ছে তা সাধিত হবে না বরং গল্পের ফাঁদে পড়ে গল্পটি শ্রোতাদের বিনোদিত করার দিকে যাবে, আর পাঠকেরা মূল পয়েন্টগুলি মিস করে গিয়ে গল্প উপভোগ করবেন।

 

বিজনেস গল্পে ৬ টি জিনিস

ব্যবসার গল্প কীভাবে বলতে হয় এ নিয়ে ছয়টি জিনিস ব্যবহার করার কথা বলে স্টোরি ল্যাব। এগুলি হলোঃ

১। গল্পটি যে গল্প তা বলবেন না। কারণ যারা এখানে শুনতে এসেছেন তারা গল্প শুনতে আসেন নি। আগ্রহ তৈরি করার জন্য প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে পারেন। যেমন ব্যবসায় গল্পের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক গল্প আপনি শ্রোতাদের বলতে চান। এখানে শুরুতে এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলেন, আপনি কি জানেন যে কোকাকোলা বা মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানি তাদের কর্মকর্তারা গল্প বলা শেখার ট্রেইনিং দিচ্ছে?

২। আগে এরকম ছিল, এখন এরকম, এবং কীভাবে আমরা সমাধান করলাম- এই ফর্মূলায় গল্প বলুন। আমরা একে বলতে পারি সাসপেন্স ফর্মূলা।

এই মাত্র এক বছর আগে রফিক সাহেবের গরুর খামারটির অবস্থা ছিল খুবই বাজে। তার ৪৯ টি গরু থেকে দৈনিক দুধ হতো মাত্র বিশ লিটার। গরুরা দুধ দিত না, যদিও পর্যাপ্ত খাদ্য রফিক সাহেব দিচ্ছিলেন।

আর এখন আমরা কাজ শুরু করার পর রফিক সাহেবের খামারের ৪৯ টি গরু দৈনিক দুধ দিচ্ছে ৩০৯ লিটার। এ থেকে দৈনিক রফিক সাহেবের আয় হচ্ছে তেতাল্লিশ হাজার টাকা।

কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হলো? আমাদের কনসালটেন্সি ফার্ম প্রথমে রফিক সাহেবের ফার্মটি পরীক্ষা করে। আমরা দেখতে পাই তার গরুগুলি সব পাচ্ছে কিন্তু বিনোদন পাচ্ছে না। সুতরাং, আমরা তার গরুগুলিকে সাম্প্রতিক কালে বের হওয়া বাংলা আধুনিক গানগুলি শুনাতে থাকি। এতেই…

এই গল্পে প্রথম দিকে বলা হয়েছে আগের খারাপ অবস্থা। পরে বলা হয়েছে বর্তমানে সমস্যা সমাধানের পর ভালো অবস্থা। তখন শ্রোতাদের মধ্যে জানার ইচ্ছা তৈরি হবে কীভাবে এটি হলো। শেষধাপে এসে বলা হলো কীভাবে এটি তারা করেছেন।

৩। হাস্যরসাত্মক কথাবার্তা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনি যখন হাস্যরসাত্মক হবার অতি চেষ্টা করবেন তখন বিরক্তিকর হয়ে উঠবেন। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থেকে হাস্যরস বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করতে হবে।

৪। ম্যানেজার বা লিডার হিসেবে যখন আপনি গল্প বলবেন তখন ‘আমি এখানে কীভাবে এলাম’ ফর্মূলা ব্যবহার করতে পারেন। আপনি বলতে পারেন আপনি কীভাবে এখানে বা এই পর্যায়ে। এই ক্ষেত্রে নিজের ব্যর্থতার কথাগুলিও আনুন।

৫। ২+২ ফর্মূলা ব্যবহার করুন। এটি পিক্সারের এন্ড্রু স্ট্যানটন তার লেড লেকচারে বলেছিলেন। আপনার শ্রোতারা ২+২ কতো তা শুনতে চায় না, বরং তারা এটি নিজ থেকে বের করে নিতে চায়। অর্থাৎ, এই ফর্মূলা হলো, সব ব্যাখ্যা করতে যাবেন না। আপনার শ্রোতাদের নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে নেবার সুযোগ দিন। আপনি তাদের ব্রাশ, রঙ, ক্যানভাস তুলে দিবেন কিন্তু ছবি এঁকে দিবেন না। ছবি আঁকার কাজটা তাদের উপর ছেঁড়ে দিন।

৬। মেটাফোর-রূপক ইত্যাদি ব্যবহার করুন।

মেটাফোর-রূপক ব্যবহার করে গল্প বা কথা বলার উদাহরণ হিসেবে বেশ আগে দেয়া আমার একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস উল্লেখ করছি। এখানে লং টার্ম লক্ষ্য নিয়ে কাজের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে।

কয়েনে টস দিলে শাপলা না মানুষ উঠবে এই সমস্যা খালি বর্তমানের সাপেক্ষে বিচার করলে ভয়াবহ। কারণ তা অনিশ্চিত।

কিন্তু লং টার্মে সহজ। প্রচুর প্রচুর টস করা হলে অর্ধেক উঠবে শাপলা, অর্ধেক মানুষ।

যারা লং টার্ম চিন্তা করেন, তারা শুরুতে দেখা যাবে হয়ত শাপলা ধরে বসে আছেন। আর নড়ছেন না। কারণ তিনি জানেন টস প্রচুর হবে এবং দুইটাই অর্ধেক অর্ধেক উঠবে। যেকোন একটা ধরে তাই বসে থাকা বেটার। প্রথম দিকে তারে হারতেও দেখা যেতে পারে, এবং তিনি এক বোকা হিসেবে পরিচিত হবেন অন্যদের কাছে।

অন্যদিকে স্বল্পমেয়াদী ও বর্তমান ভিত্তিক চিন্তা করারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলবে, নিত্য নতুন কৌশল বের করতে চাইবে প্রতি টস জেতার। তারা হয়ত জিতবেও। এবং স্বল্পমেয়াদে হয়ত সাকসেসফুল হয়ে কিভাবে সফল হওয়া যায় এর মোটিভেশনাল বক্তৃতাও দিবে।

অবশেষে, লং রানে লং টার্ম চিন্তা করারাই এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু বাস্তব দুনিয়া ঘটমান বর্তমান, তাই এখানে শেষ দৃশ্য আসা না পর্যন্ত কে নায়ক কে ভিলেন তা বুঝা সহজ না।

 

 

কোম্পানি কালচার নির্মান করে গল্প

প্রতিটা কোম্পানির একটা কালচার থাকে এবং এই কালচারকে তারা খুবই গুরুত্ব দেয়। কোম্পানির ওয়েবসাইটগুলিতে দেখা যায় তাদের কালচারের মূলনীতি নিয়ে এক পেইজ বা কয়েক পেইজ লেখা আছে। স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওরের ৫০০ কোম্পানির ওয়েবসাইট বিশ্লেষণ করে এক গবেষণায় দেখা গেছে কোম্পানিগুলি যেসব ভ্যালুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় তাদের কোম্পানি কালচারের জন্য তার মধ্যে ইনোভেশন সবচাইতে এগিয়ে আছে, ৮৫%। এরপর ইন্ট্রিগ্রিটি বা সততা এবং রেসপেক্ট বা সম্মান, ৭০%।

পরে তাদের অর্থনৈতিক সফলতার সাথে এইসব ভ্যালুর কী মিল আছে তা দেখা হলো। কিন্তু তেমন কোন মিল পাওয়া গেল না। কেবল দেখা গেল যারা কেবল ওয়েবসাইটে ভ্যালু ঝুলিয়ে রাখে নি, নিজেরা সেই ভ্যালুগুলি কোম্পানিতে অনুসরন করেছে তাদের অর্থনৈতিক সফলতার হার বেশি।

নিউজিল্যান্ডের মারস নিউজিল্যান্ডের একটি অন্যতম সফল ফুড এবং রিটেইল বিজনেস। তারা ৫ টি মূল নীতি অনুসরন করে নিজেদের কোম্পানি কালচারের জন্য। তার মধ্যে একটি হলো রেস্পন্সিবিলিটি বা দায়িত্বজ্ঞান। এই নিয়ে মারস নিউজিল্যান্ডে যে গল্পটি প্রচলিত তা হলো এমন,

রুরাল অষ্ট্রেলিয়ান শহর উডুংগাতে মারস নিউজিল্যান্ডের এক ফ্যাক্টরিতে একটি প্রেজেন্টেশনে ছিলেন কোম্পানির চেয়ারম্যান জন মারস। প্রেজেন্টেশন চলছিল, হঠাৎ একটি ফ্লুরোসেন্ট বাতি ঝামেলা শুরু করলো, জ্বলে আর নিভে। কোন কথা না বলে চেয়ারম্যান জন মারস উঠে বাইরে গেলেন, একটি মই নিয়ে প্রবেশ করলেন। মই বেয়ে উঠে বাতিটি খুললেন। এরপর আবার মইটি বাইরে রেখে আসলেন। অতঃপর আবার প্রেজেন্টেশনটি দেখতে বসলেন।

প্রেসিডেন্ট এই কাজটি করেছেন, দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এই গল্পটি ছড়িয়ে পড়েছে কোম্পানিতে, এবং কোম্পানি কালচারের কোর ভ্যালুর একটি রেস্পন্সিবিলিটির সরাসরি চর্চার দৃষ্টান্ত স্বয়ং চেয়ারম্যান দেখিয়ে দিলেন এখানে।

এরকম এ কোম্পানি তাদের কালচারের কোর ভ্যালুগুলি চর্চা করে, এ সম্পর্কিত গল্প প্রচলিত থাকে তাদেরই কালচার উন্নত হয় এবং এরা ভালো করতে থাকে।

 

 

গভীর সম্মান দেখানো কী?

এমিল জাটোপেক একজন চেক লং ডিস্ট্যান্স রানার। লং ডিস্ট্যান্স রানিং এ তিনি একজন সর্বকালের মহানায়ক। ৫০০০ মিটার, ১০০০০ মিটার এবং ম্যারাথন তিনি ১৯৫২ সালের হেলসিংকি অলিম্পিকে জিতেছিলেন যা এখন পর্যন্ত একটি বিশ্বরেকর্ড। আরো মজার ব্যাপার হলো, এই ম্যারাথনে জীবনে প্রথমবারের মত অংশ নেবার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন একেবারে শেষ সময়ে, কয়েক মিনিট আগে।

অষ্ট্রেলিয়ান একজন বিখ্যাত লং ডিস্ট্যান্স রানার রন ক্লার্ক। তিনি এমিলের অনেক রেকর্ড ভেঙ্গেছিলেন। মেক্সিকো শহরে এক দৌড়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ট্র্যাকেই প্রায় মারা যেতে বসেছিলেন। দু’টি বিশ্বরেকর্ড থাকলেও তিনি কিছু দূর্ভাগ্যের কারণে অলিম্পিক জিততে পারেন নি। এই রানার এমিলকে সম্মান করতেন। তিনি ১৯৬৮ একবার চেক গিয়েছিলেন এমিলকে দেখতে গিয়েছিলেন। এমিলও রন ক্লার্কের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখতেন ও সম্মান করতেন। তারা দুজন বন্ধু হয়ে যান।

ফেরার পথে এমিল রনকে একটি উপহার দেন বাক্সে। বলেন, এটা বন্ধি হিসেবে তোমাকে দিচ্ছি না, দিচ্ছি কারণ তুমি এটা তোমার প্রাপ্য তাই। এটি বাড়িতে গিয়ে খুলবে।

রন বুঝতে পারলেন না এতে কী আছে। একসময় কৌতুহলের বশে খুলেই ফেললেন।

তিনি দেখতে পেলেন ভিতরে আছে এমিলের ১০০০০ মিটার অলিম্পিক স্বর্ণপদক।

রন ক্লার্ক সেখানে বসে, খোলা বাক্স হাতে তিনি, কাঁদছিলেন।

মানুষের সম্মান দেখানোর এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন এমিল জাটোপেক, গ্রেট রানার।

গভীর সম্মান কী বুঝাতে কোন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চাইতে এই গল্পটি কি অধিক শক্তিশালী নয়?

 

যে কারণে স্ট্র্যাটেজিক স্টোরি

কোন ঘটনা ইমেজ আকারে মনে রাখা হলো মনে রাখার একটি প্রাচীনতম টেকনিক। প্রাচীন গ্রীক-রোমান ওরাটরেরা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই। তারা মনে রাখতেন ইমেজ আকারে।

আমরাও কোন ঘটনাকে ইমেজের সাথে যুক্ত করতে পারলে তা বেশি মনে রাখতে পারি। কোন বর্ননা আমাদেরকে কোন ইমেজ দেখাতে না পারলে, কোন কিছু অনুভব করাতে না পারলে তা মনে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।

সংস্থাসমূহে কাজ করা ৯৫% লোক তাদের স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে জানে না বা স্ট্র্যাটেজি বুঝে না; এটি কাপলান এবং নর্টনের গবেষণায় দেখা গেছে। ২০১১ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় ৪৫০ টি কোম্পানির ৮০% ই মনে করে তাদের লোকেরা তাদের স্ট্র্যাটেজি বুঝে না।

এই দুরাবস্থা বা সমস্যা কাটিয়ে উঠার একটা উপায় হলো স্ট্র্যাটেজিকে স্ট্র্যাটেজিক গল্পে রূপান্তর করা। যখন স্ট্র্যাটেজিকে গল্পরূপ দেয়া হবে তখন তা হবে একটি জড়বস্তুকে প্রাণ দেবার মতো বিষয়।

 

কোন অর্গানাইজেশনের স্টোরি লাইন কেমন হবে

সাধারণত কোন বড় মিডিয়ার ফিল্ম বা ডকুমেন্টারি ইত্যাদি সেকশনের দায়িত্বে যিনি থাকেন তার কাছে একই ঘটনার নান স্টোরি উপস্থিত থাকে। কিন্তু তিনি এর সবক’টি উপস্থাপন করেন না। একটি নির্বাচন করেন, তুলনামূলক বেশি সত্য যেটি। এর জন্য তিনি তার টিমের সাথে আলোচনা করেন।

একই ব্যাপার অর্জানাইজেশনের গল্পের ক্ষেত্রে। এখানেও নানা গল্পের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সব গল্প বলা যাবে না। সব গল্প কাজ করবে না। কোন স্টোরি লাইন দেয়া হবে এর জন্যও পরিকল্পনা দরকার।

এছাড়া জোর করে আরোপিত গল্প দেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে এটি গল্প বলেই মনে হবে, এবং শ্রোতারা তা গ্রহণ করবে না। বিশেষত কোম্পানির গল্প তার লিডারদের আচরন থেকে তৈরি হয়। তারা কী বলেন, কীভাবে বলেন, কীভাবে কাজ করেন ইত্যাদি থেকে গল্প তৈরি হয়। জটিল অবস্থায় এবং বিশৃঙ্খল অবস্থাতেই গল্প বেশি তৈরি হয়।

একজন লিডার হিসেবে আপনার কোম্পানি সম্পর্কে কী গল্প হচ্ছে তা আপনাকে জানতে হবে। তবেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার কোম্পানিটির চরিত্র কী এবং কী কী আপডেট করা দরকার। সেই অনুসারে আপনি তখন গল্প তৈরির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারেন।

রোমান দাস পাবলিয়াস সাইরাসের নীতিবাক্যের বইতে একটা বানী ছিল, সৈন্যদের নির্ভর করে সেনাপতির প্রজ্ঞার উপরে। কোন সেনাপতি যদি মূর্খ ও ভীরু হন তাহলে তিনি শক্তিশালী সৈন্যদল নিয়েও বিজয়ী হতে পারবেন না।

কোন কোম্পানির ক্ষেত্রে তার সেনাপতি হচ্ছেন লিডারেরা। লিডারদের তাই প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হয় এবং যেইসব কোর ভ্যালু তিনি তার কোম্পানি কালচারে প্রতিষ্ঠা করতে চান তা নিজে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়।

আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় সবচেয়ে প্রশংসিত ইউনিয়ন জেনারেল ছিলেন ইউলেসিস এস গ্র্যান্ট। তিনি আমেরিকার ১৮ তম প্রেসিডেন্টও ছিলেন। সিভিল ওয়ার যখন চলছিল তখন একবার স্টিম জাহাজ থেকে সেনারা যখন আনলোড করছিল জিনিসপত্র তখন সেটি বিস্ফোরন হয়। সবাই চারদিকে ভয়ে দৌড়াদোড়ি শুরু করে, মাটিতে শুয়ে পড়ে, আর এদিকে বৃষ্টির মতো অনেকের দেহ ছিটকেও পড়ছিল। শুধুমাত্র ইউলেসিস এস গ্র্যান্ট দৌড়ে গেলেন বিস্ফোরন স্থলে।

এটাকে বলে বাস্তব খারাপ পরিস্থিতিতে নার্ভ কন্ট্রোলের ক্ষমতা। ইউলেসিস এস গ্র্যান্ট সেনাপতি হিসেবে এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্থাপন করেন। এটা তাকে নিয়ে প্রচলিত গল্পদের একটি হয়।

সুতরাং, তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সেনাদের মধ্যেও একইরকম দৃঢ়তা ও স্থিতধিতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।

 

 

স্ট্যাটেজিক গল্প বলায় কার্যকারণ দরকার

স্ট্র্যাটেজিক গল্পে কোন একটা ঘটনা ঘটলে তা কেন ঘটলো তা বলা দরকারি। তখন গল্পটি গল্প হয়ে উঠে এবং শ্রোতাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।

যেমন, আপনি একটি কয়েন হাতের মুঠোতে নিলেন। আরেক হাত দিয়ে ইশারা করলেন এই হাতের দিকে। আর পরে হাত খুলে দেখালেন কয়েনটি নেই। এতে ঘটনা ঘটলো কিন্তু সাধারণ হলো বিষয়টা, কেন ঘটল তার পেছনের কারণ পাবেন না শ্রোতারা বা দর্শকেরা।

কিন্তু একই ঘটনায় আপনি এক হাতে কয়েন নিলেন মুঠোতে। এরপর এক হাতে একটি মোমবাতি জ্বালালেন। জ্বলন্ত মোমবাতি কয়েন ধরা হাতের নিচে ধরণের। মুখ দিয়ে আপনি অভিনয় করলেন ভেতরে কয়েনটি গলে যাচ্ছে আর আপনি ব্যথা পাচ্ছেন। এরপর হঠাৎ হাত খুলে দেখালেন কয়েনটি নেই।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কয়েনটি নাই হবার পেছনে একটি কারণ দেখানো হলো। মোমবাতির তাপে সেটি গলে গেছে। একটি গল্প তৈরি হলো। আপনার মুখের অভিনয়ে আবেগও যুক্ত হলো। সুতরাং, এই গল্প হবে বেশি কার্যকরী। বেশি মনে থাকবে মানুষের।

উদাহরণ হিসেবে যা বলা হলো, এটা অবশ্যই একটি ট্রিক। কয়েন তো আসলে অদৃশ্য হয় নি, আপনি কোথাও সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটে যেমন কয়েনের প্রথম ক্ষেত্রে ঘটেছিল। অনেক সিদ্ধান্ত আপনি লিডার হিসেবে নিলেন, কিন্তু তার পেছনে কী কারণ আছে তা আপনি যদি আপনার কর্মচারীদের না বলেন, তাহলে তারা সিদ্ধান্তটি ঠিকমতো বুঝতে পারবে না। এর সাথে ঠিকমতো এনগেইজ বা যুক্ত হতে পারবে না। এইজন্যই তো দরকার পড়ে স্ট্র্যাটেজিক গল্প বলার।

 

জেফ বেজোসের ছয় পেইজের মেমো

আমাজনের ফাউন্ডার ২০০৪ সাল থেকে তাদের কর্পোরেট মিটিং এ পাওয়ারপয়েন্ট বাদ দিয়ে ছয় পেইজের বর্ননাকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছেন। তার কথায়,

“সাধারণ কর্পোরেট মিটিং এভাবে শুরু হয় যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড উপস্থাপন করবে। আমাদের মতে এতে আপনি কিছু বুলেট পয়েন্ট পান এবং খুবই কম তথ্য জানতে পারেন। এটা উপস্থাপকের জন্য আরামদায়ক হলেও শ্রোতাদের জন্য খারাপ। তাই এর পরিবর্তে আমরা আমাদের মিটিং গুলি ছয় পেইজের মেমো ভিত্তিক করে তুলি। সাধারণ পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড হলে সেখানে একজিকিউটিভেরা বিরক্ত করে। কিন্তু মেমো হলে দুই নাম্বার পেইজে কারো মনে কোন প্রশ্ন উদয় হলে এর উত্তর হয়ত সে পাবে চার নম্বর পেইজে।”

 

গল্প চিহ্নিত করা

গল্প কনসালটেন্ট শন কালাহানকে (বা তার ফার্মকে) বিভিন্ন কোম্পানি হায়ার করে তাদের কোম্পানির ভিতরের গল্প চিহ্নিত করার জন্য, এবং সে বিষয়ে পরামর্শ দেবার জন্য। ভদ্রলোক এসব করতে গিয়ে কিছু প্রশ্ন বের করেছেন, যার মাধ্যমে বিজনেস লিডারেরা নিজেদের গল্প সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন তাদের কর্মচারীদের কাছে। এই প্রশ্নগুলি ছোট একটি পিডিএফ ইবুক আকারে তারা ছেড়েছেন, সেখান থেকে প্রথম অংশের প্রশ্নগুলি আমি এখানে বাংলায় দিলাম যাতে ভিতরের কন্টেন্ট কী আছে এ ব্যাপারে আপনারা ভালো ধারণা করতে পারেন।

লিডার নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে এই প্রশ্নগুলির সাহায্য নিয়ে নিজের গল্পটি বের করতে পারেন।

আপনি আজ যা তা হতে আপনার জীবনের কোন তিনটি ঘটনা বেশি প্রভাব ফেলেছে, তৈরি করেছে আজকের আপনাকে। এগুলির মধ্যে একটি বেছে নিন, ও তা বর্ননা করুন।

আপনার পাওয়া সবচাইতে সেরা উপদেশটি কি? কে দিয়েছিলেন এবং পরিস্থিতিটি কী ছিল?

পেছন ফিরে চিন্তা করে, আপনার জীবনের কিছু সবচাইতে আনন্দময় দিনের কথা ভাবুন। এর একটি বর্ননা করুন, এবং কেন এটি এত বিশেষ ছিল আপনার জন্য।

আপনি এখন যা করছেন তা কীভাবে করা শুরু করলেন।

সবচাইতে কঠিন যেসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আপনার তার মধ্য থেকে একটি বর্ননা করুন। এর ফলাফল কী হয়েছিল।

 

গল্প নিরীক্ষা কেন্দ্র

স্টোরি ল্যাব বা শন কালাহানের এনেকডোটের আদলে একটি গল্প নিরীক্ষা কেন্দ্র করার ইচ্ছা আমার, যেখানে বিভিন্ন ধরণের স্মল এস গল্প বা বিজনেসে ব্যবহার করার মতো গল্প নিয়ে নিরীক্ষা করা হবে। কারণ গল্পের, বিশেষত মৌখিক গল্পের একটা সাংস্কৃতিক দিক থাকে। ফলে আমাদের এখানে বিজনেস গল্পগুলির প্যাটার্ন হয়ত অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম হতে পারে। এই প্রজেক্টে আপনি গল্প দিয়ে, বা স্মল এস গল্প বিষয়ে আপনার চিন্তা শেয়ার করে অংশ নিতে পারেন।

অংশ নেবার জন্য, তিনটি স্মল এস গল্প দিয়ে আপনি আমাকে ইমেইল করুন – [email protected]

সুবিধার জন্য বলছি আবার, স্মল এস গল্প হলো এনেকডোটাল গল্প, উদাহরণ এবং স্মৃতিচারণ।

1 thought on “ব্যবসায় যেভাবে গল্প ব্যবহার করবেন”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং