বিড়ালের দিন

ছবিঃ পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর ৪৪/এ ভাগিরথী লেন এর চন্দন চৌধুরী।
ছবিঃ পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর ৪৪/এ ভাগিরথী লেন এর চন্দন চৌধুরী।

 

বিড়ালের দিন

 

সাইফুদ্দিন মৌলানা যখন আসমানের দিকে তাকাইয়া ভাবতেছিলেন সাদা মেঘ উইড়া যাইতেছে কোথায় ঠিক তখন তার ঘরের মধ্যে একটা সাদা বিড়াল প্রবেশ করল। গল্পের শুরু এখান থেকে। এর আগের সাইফুদ্দিন মৌলানার জীবন একেবারেই সাদামাটা ছিল হয়ত, তাই তা গল্পের মধ্যে বিশেষ আসবে না।

সাইফুদ্দিন মৌলানা আসমান থিকা চোখ ফিরাইয়া জমিনে তাকাইলেন। তিনি বইসা আছেন বেতের চেয়ারে। তার প্রকান্ড বাড়ির ভিতরে এক নাদুশ নুদুশ বিড়াল। সাইফুদ্দিনের মনে হইল আসমানের ঐ সাদা মেঘের এক অংশ পইড়া গিয়া বিড়ালে পরিণত হইয়া তার বাড়িতে আইসা পড়ছে। বিড়াল হাইটা হাইটা তার কাছে আসল। এত সাবলিল ভাবে হাটা যে দেখলে মনে হয় সে তার নিজের বাড়িতে হাটতেছে। সাইফুদ্দিন খুশি হইলেন। তিনি সযত্নে বিড়ালটারে ঠাই দিলেন তার বাড়িতে।

প্রতিদিন বিড়ালের কাজ কর্মে তিনি অভিভূত হইতে লাগলেন। এবং বাড়তে থাকল তার বিড়ালাসক্তি।

একদিন প্রভাতবেলায় তিনি আবার কিশোর সূর্যযুক্ত আকাশের দিকে তাকাইয়া ছিলেন। সেইদিনও সাদা মেঘ ভাসতেছিল আসমানে। সাইফুদ্দিনের মনে হইল এমনি একদিন সাদা মেঘ দেখার পর তিনি তার বাড়িতে আবিষ্কার করছিলেন বিড়ালটারে। সাদা মেঘ, নীল আকাশ এবং সূর্যের প্রতি নিজেরে কৃতজ্ঞ মনে হইল তার। তার মনের একটা অংশ বার বার প্রত্যাশা করছিল যে আইজও হয়ত দেখা যাবে আরেকটা বিড়াল।
সাইফুদ্দিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। প্রতিদিন যত সময় বারান্দায় বেতের চেয়ারে বইসা থাকেন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় তিনি বইসা রইলেন। কিন্তু নতুন কোন বিড়াল আসল না। তার পুরানা বিড়ালটাই তার পায়ের চারপাশে ঘুইরা ঘুইরা খেলতে লাগল। সাইফুদ্দিন মৌলানা বিড়ালের ক্রিড়ায় মুগ্ধ হইলেন।

সেদিন সন্ধ্যা বেলায় তার কাজের লোক মুখ বেজার করে আইসা জানাল, হুজুর , আরেকটা বিড়াল আইছে। এরে কি জাগা দিব না দূর কইরা দিব?

সাইফুদ্দিন মৌলানা বিড়ালের কথায় যুগপৎ আনন্দিত এবং অবাক হইলেন। কাজের লোকরে বললেন বিড়ালের যেন কোন অযত্ন না হয়। বিড়াল দূর করে দেয়ার কথা যেন মুখে না আনে আর।

তিনি নতুন বিড়ালরে দেখলেন গিয়া। এটাও সাদা। তবে সাদার মাঝে কালো কালো দাগ বিশেষ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সেদিন রাতে প্রগাঢ় আনন্দ নিয়া ঘুমাইতে গেলেন সাইফুদ্দিন মৌলানা।

পরদিন থেকে তার বিড়ালপ্রীতি আরো বাইড়া গেল। তিনি কাজের লোকরে বললেন, দুইটা বিড়ালে খারাপ দেখায়। আরো দশ বিশ জোড়া সংগ্রহ কর।

কাজের লোক প্রতিবাদ জানাইতে চায়, কিন্তু হুজুর এত বিড়াল পালমু কেমনে?

মৌলানা বলেন, টেকা দিমু, পালবা। নতুন লোক রাখবা।

কয়েকদিনের মধ্যেই সাইফুদ্দিন মৌলানার বাড়িতে মোট বিড়াল হল একুশ জোড়া। এগুলো দেখাশোনার জন্য মানুষ তিন জন।

মৌলানা প্রতিদিন বেতের চেয়ার নিয়ে বিড়ালগুলোর মাঝখানে বইসা থাকতেন। বিড়ালেরা মনের আনন্দে নিজেদের মত করে ঘুরে বেড়াইত।

সারাদিন বিড়ালের সাথে কাটাইয়া মৌলানা রাতেও বিড়ালের স্বপ্ন দেখতেন। দেখতেন বিড়ালেরা তার সাথে কথা কয়। হাজার হাজার বিড়াল তারে মাঝখানে রাইখা ঘুরতেছে। এরকম একটা স্বপ্ন দেইখা মৌলানার ঘুম ভাইঙ্গা গেল একদিন। তার শরীর দিয়া ঘাম বের হইতে লাগত। তার ভিতরে পাপবোধ হইতে লাগল। তার মনে হইতে লাগল এই বিড়ালগুলারে জায়গা দিয়া তিনি কোনভাবে পাপ কইরা ফেলতেছেন। কিন্তু বিড়ালগুলোরে কোথাও দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। তার মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি বিড়ালদের মায়ায় আটকা পড়ছেন। মায়া হইল বাইর থিকা দেখলে তুচ্ছ জিনিস। কিন্তু সেই বাইর থিকা দেখা তুচ্ছ জিনিসের ভিতরে ঢুইকা গেলে তার থিকা বের হওয়ার কোন উপায় থাকে না। তখন সমস্ত পৃথিবীর শক্তির চেয়ে এরে শক্তিশালী মনে হয়।

দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধাদ্বন্ধে রাইত কাটল সাইফুদ্দিন মৌলানার। পরদিন সকালে তিনি তার বেতের চেয়ারে বইয়া চা খাইতেছিলেন। তার সামনে পিছনে নিজেদের ইচ্ছামত হাটাহাটি করতেছে, রোদ পোহাইতেছে বিড়ালেরা এমন সময় তার কাজের লোক আইসা দাঁড়াইল সামনে।

মৌলানা তার দিকে তাকাইয়া বললেন, কিছু কইবি নাকী?

কাজের লোক জবাব দেয়, জি হুজুর।

তাইলে ক? কিছু কইতে আইয়া খাড়াইয়া রছ কেন?

কাজের লোক ইতস্তত কইরা কয়, হুজুর, একটা কথা…বিড়াল বাইড়া যাইতেছে…।

বাইড়া যাইতেছে মানে কি?

মানে হুজুর আগে ছিল বিশ জোড়া আর এক একুশ জোড়া। কিন্তু ডেলি এক জোড়া কইরা বাড়তেছে। এখন পয়ত্রিশ জোড়া…

বাড়ে ক্যামনে? বাচ্চা দেয় নি?

জি না হুজুর। সকালে একজোড়া কইরা বাইরে পাওয়া যায়। প্রথমে  বুঝা যায় নাই। খাওয়ানোর টাইমে ঝামেলা অয়।

সাইফুদ্দিন মৌলানার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বিড়াল বাড়ে ক্যাম্নে! কিন্তু তিনি কাজের লোকরে বললেন, খাবার বেশি কইরা কিনবা। বাড়তে থাকুক।

সেইদিন পুরা সময় এই চিন্তা তারে আচ্ছন্ন কইরা রাখল। তিনি কাজের লোকদের নিয়া গিয়া বিড়াল গুইনা দেখলেন আসলেই পয়ত্রিশ জোড়া।
তারপরদিন তিনি সকালে উঠলেন। উইঠা নতুন আগত বিড়াল জোড়ারে দেখলেন। সেদিন হইল ছত্রিশ জোড়া।

এইরকম সাইফুদ্দিন মৌলানার বাড়িতে বিড়াল বাড়তেই থাকল। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। কাজের লোকেরা বলল, হুজুর বিড়াল কুফা। সবগুলারে ফালাই দিয়া আসি।

কিন্তু মৌলানা না কইরা দিলেন। বিড়াল ফেলে দেয়াকে তিনি ভিতর থেকে সায় দিতে পারলেন না। যদিও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এটাই একমাত্র এই বিড়াল যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উপায়। সব বুঝেও মৌলানা বিড়ালগুলারে রাখার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। মাঝে মাঝে মানুষ যুক্তির বাইরে গিয়া সিদ্ধান্ত নেয়।

সাইফুদ্দিন মৌলানার বাড়িতে বিড়ালের সংখ্যা একশো, দুইশ, তিনশো, চাইরশো ছাড়াইয়া একেবারে চাইরহাজারে পৌছায়া গেল। প্রতিদিন এক জোড়া না, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সংখ্যায় বিড়াল বাড়তে থাকল। হাজার হাজার বিড়াল মৌলানার বাড়িতে ঘাঁটি তৈরী করল।
এই সংখ্যায় ক্রমেই লাখের দিকে যেতে থাকল।

প্রতিবেশিরা অতীষ্ট হইয়া মেয়রের কাছে নালিশ জানাইল। মেয়রের লোকজন আইসা এত এত বিড়াল দেইখা হতভম্ব হইয়া গেল। নগরের হর্তাকর্তারা এত এত বিড়ালের কি পরিমাণ উপদ্রব হইতে পারে সেই চিন্তা কইরা আতংকে অস্থির হইলেন। তারা সাইফুদ্দিন মৌলানার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা কইরাও ব্যর্থ হইলেন। কারন মৌলানা এখন পুরা দিন হাজার হাজার বিড়াল বেষ্টিত হয়ে দিনাতিপাত করেন। তার কাজের লোকেরাও কেউ বাইরে আসে না।

সমস্ত ঘরে, ছাদে, সামনের উঠানের মত বিশাল জায়গায় হাজার হাজার বিড়াল। গাছে বিড়াল, পিছনের বাগানে বিড়াল। দেখলে মনে হয় তিল ধারনের জায়গা নেই কোথাও। এই অসংখ্য বিড়ালেরা খাবার পায় কোথা থেকে ভাইবা লোকে চিন্তিত হইল।

সাইফুদ্দিন মৌলানা ও তার কাজের লোকদের জীবনের ব্যাপারেও অনেকে আশংকা করেছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের দেখা যাইত উঠানে বা ছাদে বিড়ালদের সাথে। সুতরাং বোঝা গেল তারা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন।

নগরপিতা এবং নগরের গণ্যমান্য লোকজন ঠিক করলেন একটা বিহিত করতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না। তাদের আলোচনায় ঠিক হইল তারা পুলিশ দিয়া আক্রমন করবেন সাইফুদ্দিন মৌলানার বাড়িটাতে। তবে এতে সহস্র বিড়ালের নগরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই জন্যে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন।

যদি তারা আক্রমন কইরা বসেন তাহলে কি হবে বলা যায় না। বিড়ালেরা খুব সুবিধার প্রানী না। সাইফুদ্দিন মৌলানা প্রায়ই ভাবেন এখন, বিড়ালেরা মানুষের অন্তরে বিড়ালের মত পা ফেলে নিঃশব্দে চলাচল করে। যার গতায়ত অন্তরে তোমার সে যে শক্তিমান হে মানব।