স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের মাস্কুলিনিটি নয়া ভাবে প্রকাশিত হয়, এবং বাহ্যিক রূপ লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে। তারে উপাধী দেয়া হয় জাতির পিতা।
এই সময়, একটা নতুন আশাবাদ ও সম্ভাবনা নিয়ে আসে। আলোর মিছিল নামে এক বাংলা ফিল্ম আছে, ওইখানে রাজ্জাক, আনোয়ার হুসেন এসব চরিত্রের মধ্যে তার স্ফুরণ দেখবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রপার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় তলে তলে আসল মাসকুলিনিটি ডিফাইনড হয় এইভাবে, যিনি এই নতুন সময়ে সুবিধা ব্যবহার করে নিজে ক্ষমতাবান ও ধনী হতে পারবেন তিনিই পুরুষ। এর উদাহরণ দেখবেন আলোর মিছিল ফিল্মের অভিনেতা খলিলের চরিত্রের মধ্যে। অনেক মানুষ এই সময়ে তার পথ অবলম্বন করে সমাজে বিত্তশালী হয়েছেন। এরাই পরে সমাজে দাম পাইছেন, আধুনিক বাংলাদেশে ধনী হইছেন, যদিও ফিল্মে অন্যভাবে দেখানো হইছে।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ওই সময়ে ‘সন্তানেরা’ যেহেতু সক্রিয় হতে থাকেন আলাদা ভাবে, তাই ফ্রয়েডিয়ান ক্রাইসিস উপস্থিত হয়। পিতার হত্যা জরুরী হয়ে পড়ে পুত্রদের মাসকুলিনিটির মীমাংসায়। পিতারে তারা হত্যা করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুটা খেয়াল করেন। একই সাথে এটাতে আনন্দ ও বিষাদের টোন আছে। এমনকি তার হত্যাকারীরা, যেমন কর্নেল রশীদ স্বাক্ষাতকারে বলেন, হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, ইত্যাদি, অর্থাৎ, তাদের গিল্ট টের পাওয়া যায়। কারণ সিম্বলিক হইলেও হত্যাটা হইছে পিতার।
তখন পিতৃহীন অবস্থায় স্বাভাবিক ক্যাওস উপস্থিত হয়।
এই ক্যাওস শেষ হইলে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি অন্য এক মাসকুলিনিটি আনতে চান তার সক্রিয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের যে দুই বাহ্যিক মাসকুলিন রূপ, তার মধ্যেও স্পষ্ট পার্থক্য আছে। প্রথমজন সামন্তীয় লিডারদের মত, দ্বিতীয়জন সানগ্লাস পড়া ড্যাশিং, সৎ, বাস্তবিক সমাধান খুঁজেন, কিন্তু মারাত্মক উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যেমন মুজিবও তার স্টাইলে তার জায়গায় ছিলেন ক্ষমতার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমাদের সমাজের চির পরিচিত পিতা ও পুত্রের মডেল।
ফ্রয়েড যেভাবে বলেছিলেন, মোজেসের ধর্ম পরিবর্তিত হইছিল পুত্র যিশুর ধর্মে, ঐখানে পিতা মোজেস যার তীব্র বিরোধী ছিলেন সেইসব প্যাগান জিনিসপাতির আত্মীকরন হইছে, একইভাবে জিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু জিনিশ আসছে যার তীব্র বিরোধী ছিলো শেখ মুজিবের রাজনীতি। এটা এক স্বাভাবিক পরিণতি, পুত্রের ধর্মরে পিতার ধর্ম থেকে আলাদা হইতে হয়।
এরশাদ পুত্রের ধর্ম জারি রাখেন, তিনি এই ধর্মেরই বাহক। তিনি কোন তৃতীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নাই সিন্থেসিস ঘটাইয়া। এর কারণ, পুত্রের ধর্ম বিকশিত হবার আগেই জিয়া মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
এই দুই শাসকের, বিশেষত এরশাদের আমলে সরকারী আমলারা শক্তিশালী হইতে থাকেন।
এইদিকে এরশাদের পতনের পর, পিতার ধর্ম শেখ হাসিনার মাধ্যমে ও পুত্রের ধর্ম খালেদা জিয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকে।
কিন্তু এই রাজনৈতিক বাস্তবতা দেশের মসকুলিনিটিরে ডিফাইন করতে পারে নাই।
আলোর মিছিলের খলিলেরাই মাস্কুলিনিটি ডিফাইন করছে, সমাজে সাকসেসফুল হিশাবে পরিচিত হইছেন। এরা এক পর্যায়ে বড় বড় ব্যবসায়ী হইছেন। এক সময় এইরকম ক্ষমতাবান হবার উপায় ছিল ছাত্র রাজনীতি করা, ও সেইখান থেকে পাওয়া ক্ষমতা কাজে লাগাইয়া সম্পদ বানানো। তখন ছাত্র রাজনীতির সংঘাত ছিল সাধারণ ঘটনা। নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের ছাত্র নেতারা কেন ভালো নেতা হইতে পারলেন না, বরং ওই পাওয়ার কাজে লাগাইয়া ব্যবসা বা অন্যান্য সুবিধার দিকে গেলেন? কারণ মাস্কুলিনিটি তখন টাকায়, ব্যবসায়।
কিন্তু গত পনের বছরের মধ্যে দেশের কাছে মাসকুলিনিটির সংজ্ঞা ঝুঁকছিল, বিসিএস পাশ করে চাকরি করতে হবে, এইদিকে। কারণ এইখানে ক্ষমতা ও সম্পদ আছে। লীগের আমলে যেহেতু গণতন্ত্র ছিল না তাই ক্ষমতার “কী(key)” পিপল আছিল আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এরা অর্থনৈতিক সুবিধা পাইছেন। সিভিল সার্ভিসের লোকেরা হয়ে যান রাজনীতিবিদদের থেকে শক্তিশালী।
২০২৪ এর গণ আন্দোলনে যে ডিফ্রেন্ট ঘটনাটা ঘটলো, যে বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনতারে সাথে নিয়া ছাত্রছাত্রীরা স্বৈরাচার হটাইল, ওইখানেও দেখবেন, মূলে ছিল বিসিএসের কোটা। ওইটা ট্রিগার করছে ঘটনারে।
এখন যদি গণতন্ত্র আসে দেশে, আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যায় ক্ষমতা ও সম্পদ তৈরির সুযোগ কমে, তাহলে এইদিকে মাস্কুলিনিটি ঝুঁকে থাকবে না। আমাদের সমাজ কীভাবে সফল পুরুষ বা মাসকুলিনিটিরে এখন ডিফাইন করে, তা দেখার বিষয়।
যদি দেখা যায় যেই সম্ভাবনা নিয়ে আসছিল এই নতুন বাংলাদেশ, তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, করাপশন থাকে, দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতি করতে থাকে, নতুন দল ক্ষমতায় আইসা আওয়ামীলীগের মত টাকা পাচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করতে থাকে, তাহলে, সম্ভাবনাময় তরুণ ছাত্র নেতারা হারিয়ে যাবেন বলেই মনে হয়। বেশিরভাগেই ব্যবসায়ী হবেন, বিভিন্ন যোগাযোগ কাজে লাগাইয়া টাকা কামাবেন, অনেকে বিদেশে চলে যাবেন।