মানুষের প্রতি নাকী বিশ্বাস হারানো পাপ। কিন্তু বিশ্বাস রাখাটাও বিপদজনক। কারণ যার প্রতি বিশ্বাস রাখা হচ্ছে সে তার ব্যাপারে কতটা সৎ কিংবা আদৌ সৎ কিনা সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার বক্তব্যের সাথে তার কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের জায়গা আছে কি না অথবা তার স্মৃতি তার সাথে প্রতারণাও করতে পারে, সেই ক্ষেত্রে সে সৎ হলেও ভুল একটা গল্প বলবে।
ব্যাপারটা জটিল এবং শেষ পর্যন্ত মানবজাতির উপর বা কোন ব্যক্তির বক্তব্যের উপর বিশ্বাস একটি ভঙ্গুর অবস্থায় পৌছে যায়।
আকিরা কুরোসাওয়া তার অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেনঃ
“মানুষেরা তাদের নিজেদের সম্পর্কে সৎ হইতে পারে না। তারা নিজেদের সম্পর্কে বলার সময় কিছুটা না সাজাইয়া পারে না।”
১৯৫০ সালের জাপানি ফিল্ম রাশোমনের মূল কথা বা সারমর্ম হিসেবে এটাই বলা যায়। এই উক্তিরই প্রতিফলন দেখা যায় রাশোমনে।
রাশোমনের মাধ্যমেই জাপানি সিনেমা পশ্চিমের সাথে পরিচিত হয়। যে স্টুডিওতে এটা নির্মান হয়েছিল তারা ক্রেডিট হিসেবে নিজেদের নাম ফিল্মে রাখে নাই। কারণ তারা দেখে মনে করেছিল এই ফিল্মের কোন মাথা মুন্ডু নাই। কিন্তু এই ফিল্মেই প্রথম ফ্ল্যাশব্যাক বা অতীতচারন এমনভাবে দেখানো হয়েছে যাতে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং একজন ভিক্টিম (আত্মা) একই ঘটনা চার ভিন্নভাবে ব্যক্ত করে। এটা ছিল ফিল্ম জগতে অভিনব এবং অবশ্যই অসাধারন।
ইতালির ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রাশোমন গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জিতে নেয়। ২৪ তম একাডেমি এওয়ার্ডে পায় মোস্ট আউটস্ট্যান্ডিং ফরেন ল্যাংগুয়েজ ফিল্মের মর্যাদা।
ফিল্ম শুরু হয় এইভাবে যে, একটা খুব মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু আর একজন লোক বসেছিলেন একটি ভাঙ্গা সিটি গেটের নিচে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।
ধরে নিলাম এই ভাঙা সিটি গেট পৃথিবীতে বিশ্বাসহীনতা এবং বাইরের তুমুল বৃষ্টি এই বিশ্বাসহীনতার ফলে পৃথিবীর অস্থিরতা প্রতীক।
বৃষ্টির মধ্যে আরেকটি লোক উঠে আসে সেই ভাঙা গেটের নিচে। তার সাথে সেই ঘটে যাওয়া মারাত্মক ঘটনাটি নিয়ে কথা বলেন ভিক্ষু এবং সেই প্রথম লোক।
প্রথম লোক বনে গিয়েছিল কাঠ কাটতে। গিয়ে সে হঠাৎ দেখতে পায় একটি হ্যাট পড়ে আছে। কিছু দূরে সে দেখতে পায় একজন মৃত লোক।
এর পরে কোর্টে তাকে স্বাক্ষী দেয়ার জন্য ডাকা হয়। কারণ যে লোকটা মারা গেছে তার খুনী একজন ডাকাত ধরা পড়েছে।
ভিক্ষুও যান স্বাক্ষী দিতে কোর্টে। কারণ তিনি যে লোকটি মারা গেছে তাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছিলেন। লোকটির ঘোড়ার উপরে ছিল তার স্ত্রী। নিচে অস্ত্রসহ লোকটি হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঘোড়াটিকে। লোকটি ছিল একজন সামুরাই।
ভিক্ষু এবং প্রথম লোকটি তাদের স্বাক্ষী দেবার পর ঘটনার শুরু হয় মূলত।
ধৃত ডাকাত একভাবে বলে ঘটনাটি। যে লোক মারা গেছে তার স্ত্রী এসে বলে অন্যভাবে।
এই দুই ঘটনা ভিক্ষু এবং প্রথম লোক কারোরই বিশ্বাস হয় না। তাই তারা যান একজন শামানের কাছে। শামান মানে হল যারা বাদ্য বাজিয়ে, বিভিন্ন তন্ত্র মন্ত্রের সাহায্যে মৃত আত্মার সাথে কথা বলতে পারে। এর সাহায্যে তারা সেই মৃত লোকের আত্মাকে আনেন। মৃত লোকের আত্মা এসে বলে ঘটনাটি অন্যভাবে।
এতেও সন্দেহ প্রকাশ করে সেই প্রথম লোক।
একই ঘটনা তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলার ফলে ঘটনাটি জটিল হয়ে পড়ে। তখন গল্পের বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে লোকটি মারা গেল কেন এবং কীভাবে?
ডাকাত বলে সে খুন করেছে।
লোকটির স্ত্রী বলে সে খুন করেছেন তার স্বামীকে।
লোকটির মৃত আত্মা শামানের উপর ভর করে বলে সে নিজে আত্মহত্যা করেছে।
ভাঙা গেটের নিচে বসে ভিক্ষু এবং প্রথম লোকটি বৃষ্টির মধ্যে উঠে আসা নতুন লোকটিকে এসব কাহিনী বলছিলেন। তখন আবার প্রথম লোকটি একই ঘটনা নিয়ে আরেক রকম কাহিনী বলে। সে জানায় এই কাহিনী সে কোর্টে বলেনি কারণ সে চায় নি নিজে মামলায় জড়িয়ে পড়ুক।
এরই মাঝে ভাঙ্গা গেটের ভেতর থেকে কেঁদে উঠে একটি শিশু। দ্বিতীয় লোকটি দৌড়ে যায়। এবং শিশুটিকে জড়ানো মূল্যবান জিনিসপত্র হাতড়ে নেয়।
প্রথম লোকটি এই অমানিকতা দেখে বাঁধা দিতে যায়।
তখন বেরিয়ে আসে আরেক কাহিনী।
একই ঘটনা বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে বা স্ববিরোধীভাবে যখন ব্যক্ত করেন তখন যে অবস্থার উদয় হয় তার নাম দেয়া হয়েছে “রাশোমন এফেক্ট”। এই ফিল্ম থেকেই নেয়া হয়েছে নাম।
সর্বকালের সেরা একটি ফিল্মের মর্যাদা পাওয়া্রাশোমন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক ধরে রাখতে সক্ষম। ঘটনার বিস্তারের সাথে সাথে আগ্রহ জন্মে প্রকৃত পক্ষে সেখানে কী ঘটেছিল তা জানার জন্য। অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়ও ফিল্মের ঘটনা এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জাপানি চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া ফিল্ম ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবে খ্যাত। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি নির্মান করেছেন ৩০টির মত ফিল্ম। পেয়েছেন সম্মানসূচক একাডেমী এওয়ার্ড। এশিয়ান উইক এবং সিএনএন তাকে বলেছিল শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে “এশিয়ান অব দ্য সেঞ্চুরী।”
এই পরিচালক অনেক বিখ্যাত চিত্র পরিচালকের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার ভক্তদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপ্পোলা, স্টিভেন স্পিলভার্গ, মার্টিন স্করসেস, জর্জ লুকাস, জন মিলিয়াস, রবার্ট এল্টম্যান এর মত লোকেরা। খ্যাতনামা সুইডিশ পরিচালক ইংমার বার্গম্যান তার তার ভার্জিন স্প্রিং ফিল্মকে বলেছেন কুরুসাওয়ার দূর্বল অনুকরণ।
কপ্পোলা বলেছিলেন, “একটি ব্যাপার তাকে আলাদা করে। তিনি একটি বা দুটি মাস্টারপিস বানান নি। বানিয়েছেন আট টি মাস্টারপিস।”
মার্টিন স্করসেস (স্করসেজি) বলেছিলেন, “সহজভাবেই বলি- আকিরা কুরোসাওয়া আমার মাস্টার, এবং পৃথিবীর আরো অনেক নির্মাতার।”
স্পিলবার্গ বলেছিলেন, “তার কাছ থেকে যতটুকু শিখেছি পৃথিবীর আর কোন নির্মাতার কাছ থেকে তত শিখি নি।”
কুরোসাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। তিনি ১৯৫২ সালে কলকাতাতে প্রথম দেখেন রশোমন। তিনি লিখেছেন,
“আমার উপর এই ফিল্মের প্রভাব ছিল রোমাঞ্চকর। আমি পর পর তিনদিন ফিল্মটা দেখি এবং প্রতিবারই অবাক হয়ে ভেবেছিলাম আর কোথাও কী এরকম আরেকটি ফিল্ম আছে যা ফিল্মের প্রতি ক্ষেত্রে নির্মাতার নিয়ন্ত্রণের দৃঢ় এবং উজ্জ্বল দৃষ্ঠান্ত বহন করে।
রাশোমনের মূল প্লট Ryūnosuke Akutagawa এর ১৯২২ সালে প্রকাশিত গল্প ইন এ গ্রুভ থেকে নেয়া। রাশোমন এফেক্ট এর ব্যবহার আছী বলিউডের তলোয়ার ফিল্মে।