মুরাদুল ইসলাম » ফিল্ম » পাতাললোকঃ হাতিরামের মূল স্ট্রাগল কী ছিল

পাতাললোকঃ হাতিরামের মূল স্ট্রাগল কী ছিল

দ্রষ্টব্যঃ স্পয়লার আছে যেহেতু এনালাইসিস। দেখা না থাকলে এড়াইয়া যান, বা দেখার পরে পড়েন।

কালকে এমাজন প্রাইমে “কাশ্যপিয়ান” ড্রামা পাতাল লোক দেখলাম। ক্রাইম থ্রিলার ড্রামা হিসাবে এইটা একটা দেখার মত সিরিজ। এইখানে যেইরকম সোশ্যাল নানা ইস্যু নিয়া তারা কথা বলতে পারছে, এবং যেইভাবে দেখাইতে পারছে উগ্রতার রূপ, সিস্টেমিক ভায়োলেন্সের রূপ, সেই দিক থেকে আমার সুইডিশ ক্রাইম রাইটার হেনিং মেঙ্কেলের একটা কথা মনে হয়। যেইখানে মেঙ্কেল বলছিলেন, যে সংস্কৃতিরে তুইলা ধরতেছে তার একটা মনস্তাত্ত্বিক নীরিক্ষা হইয়া উঠা উচিত ফিকশনটার।

মেঙ্কেল আরেক ইন্টারভিউতে বলছিলেন, “বুদ্ধিমান লেখকেরা সবসময় এইটা বুঝেন ক্রাইমের আয়না ব্যবহার কইরা সমাজের দ্বিচারিতা, নারী পুরুষের বৈষম্য, স্বপ্ন ও বাস্তবতার তফাত, ধনী ও গরীবের ব্যবধান এইগুলা নিয়া কার্যকর ভাবে কথা বলা যায়। এবং নিজের ভেতরের দ্বিচারিতার দিকেও দেখা যায় চাইয়া। ক্রাইম ফিকশন মানুষের জীবন ও বাস্তবতারে গল্পে আনার এক অসামান্য কার্যকর উপায়। সব সময় যে মার্ডার থাকতেই হবে এইটা কথা না। আরো হালকা কোন ক্রাইম হইতে পারে। ড্রামা হইল সবসময় দ্বন্দ্ব নিয়া। মহাভারতের দিকে চাইয়া দেখেন, এইটা কি নিয়া? তাই আমি এইটা বলি, ক্রাইম ফিকশন হইল নানা জিনিস দেখানির আয়না।“”

যদিও অন্যান্য ভারতীয় কাশ্যপিয়ান ক্রাইম থ্রিলারগুলির সাথে পাতাললোকের অনেক মিল আছে, মিল আছে আদি ক্রাইম ফিকশনগুলার ন্যারেটিভ স্টাইলেও, যেমন একজন মেইন পুলিশ ক্যারেক্টার আর সাথে একজন সহকারী, তথাপি যেইভাবে গল্পটা উপস্থাপিত হইছে, যেইভাবে সামাজিক ইস্যুগুলারে তুইলা ধরছে, তা ভালো হইছে।

একটা দৃশ্যের কথা এইখানে বলি। যখন কবির এম’রে নির্যাতন করতেছিল হাতিরাম চৌধুরী, কথা আদায়ের জন্য, তখন তার খৎনা করা পুরুষাঙ্গ নিয়া একটা গালি দিয়া বসে। কাটার বাচ্চা বা এইরকম। এরপর তার প্যান্ট খুইলা চেক করে। হাতিরাম গালি দিয়াই বুঝতে পারে তার পাশে দাঁড়াইয়া আছে সহকারী আনসারি, যেও মুসলমান। ফলে এইভাবে খৎনা নিয়া রেসিস্ট গালি দেয়া ঠিক হইল না। এইজন্য হাতিরাম শরমও পায় মনে মনে।

এরপর যখন হাতিরাম চলে যায়, তখন আমরা দেখতে পাই আনসারির চউখে কবিরের জন্য সিম্প্যাথী। এইখানে ক্রিমিনাল কবিরের জন্য তার সিম্প্যাথী না। সিম্প্যাথী রেসিস্ট আক্রমনের শিকার হওয়া তার মতো মুসলমান একজনের জন্য, যেই গালির ভাগ তার গায়েও আইসা লাগছে। এই যে সিম্প্যাথী ও কানেকশন ফিল করলো আনসারি কবিরের জন্য, এইটা অন্যরা কিন্তু করে নাই, এবং এইটাই হইল ধর্ম।

সামাজিক এইসব ক্রিটিকের দিক দিয়া সমৃদ্ধ এই ড্রামাটির আলোচনা করার জায়গা রইছে যে কী দেখাইল আর কী দেখায় নাই বা তার দেখানির তীব্রতা কেমন হইল। তবে সেই আলোচনায় আমি বেশি যাব না।

আমার দেখার পয়েন্ট থাকবে কিছু সাইকোএনালিটিক পয়েন্ট।

এই গল্পে আমরা যত সব নারী ক্যারেক্টার দেখি, তাদের কারো মধ্যেই কংক্রিট কোন ক্যারেক্টার দেখি না। অর্থাৎ, গল্পের নারীরা যার মত হইতে চায়, এমন কোন নারী চরিত্র নাই। যেমন ডলি মেহরা, ফ্র্যাজাইল ও সাইকোলজিক্যালি অসুস্থ চরিত্র। রেনু চাউদারি সাধারণ এক গৃহীনি। সারা ম্যাথিউজ, উচ্চাকাঙ্খী। চান্দা মুখার্জী মোরালি প্রবলেমেটিক, ইত্যাদি। এইসব চরিত্রগুলা এত ফ্লুইড যে, কোন কংক্রিট ক্যারেক্টার বাইর করা যাবে না, যেইটা আমাদের জ্যাক লাঁকার বিখ্যাত উক্তি দি ওম্যান ডাজ নট একজিস্টের কথা স্মরণ করায়। অর্থাৎ, ওম্যানের আইডিয়াল ক্যারেক্টার নাই। একইসাথে সে ডলি মেহরা, যে মাতৃরূপী ফেমিনিনিটি নিয়া কুত্তার কাছে, আবার চান্দা মুখার্জী হইয়া সে সেক্সুয়াল অবজেক্ট হিসাবে উপস্থাপিত। আবার সারা ম্যাথিউজ প্রথমদিকে সঞ্জীব মেহরারে সেক্সুয়ালি সিডিউসই করে আর পরের দিকে রিজিড হইয়া যায় তার অবস্থানে।

পক্ষান্তরে, মেইল ক্যারেক্টারগুলির যে তাড়ণা আমরা লক্ষ করি, এইটা হইল মাসকুলিনিটির। সেইটা তোপ সিং এর লাইফের গল্পেই দেখেন, বিশাল ত্যাগীর বা হাতিরাম চাউদারির। মূলত, হাতিরামের যেই স্ট্রাগল, এই স্ট্রাগলটা হইল এই মাসকুলিনিটিরই স্ট্রাগল।

এই জিনিস বুঝতে হইলে আমাদের যাইতে হবে হাতিরাম ও তার বাপের সম্পর্কে। যেই ছোট দৃশ্য একবার দেখায়। বাপের সাথে হাতিরামের যেই কমপ্লিকেটেড সম্পর্ক ছিল, সেইটা হাতিরামের পোলার সাথেও হাতিরামের হইতে থাকে। একই পুনরাবৃত্তি।

সন্তানদের জন্মের আগ থেকেই বাপেরা মাপেরা তার নাম ঠিক কইরা রাখেন, তার প্রতি নানা এক্সপেক্টেশন তৈরি করছেন। এছাড়া ভাষা, কালচার ও বাপ মায়ের প্রভাব এবং চাওয়া এইগুলা মিলাইয়া শিশুর যে কাল্পনিক আইডেন্টিফিকেশন তৈরি করে, ঐ সিম্বলিকই তার লাইফরে নির্মাণ করতে থাকে।

হাতিরামের প্রতি তার বাপের যে ভিউ ছিল ওইটাই হাতিরামের আইডেন্টিটি নির্ধারণ করছিল।

একবার দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল এক ড্রয়ারে তার বাপের একটা ডায়রি পাইছিলেন। ঐ ডায়রিতে লেখা ছিল তার বাপ মায়ের প্রেমকালীন সময়ের কিছু কথাবার্তা। দেইখা রাসেল তো পুরাই তব্দা খাইয়া গেলেন, এইটা যে পুরাই তার নিজের প্রেমকালীন চিন্তার মতোই।

অর্থাৎ, বাপের প্রফেসী ‘সিম্বলিক’ নির্মান কইরা পোলারে ড্রাইভ করতে থাকে ওইদিকে।

রাসেলের বাপের ডায়রি পাওয়া যে বোধের উদয় কইরা দিছিল, হাতিরামের ক্ষেত্রে এইটা অনেক পরে হইছে। যদিও আপনারা শুইনা থাকবেন বার বার, তার বউ রেনু চাউদারি তারে বলছে, পুরা বাপের মতো আচরণ করতেছ তুমি!

হাতিরাম চাউদারি একবার বইলা উঠে, আমি অর্ধেক জিন্দেগী বাপের চোউখে চুতিয়া হইয়া কাটাইছি, বাকী অর্ধেক পোলার চউখে চুতিয়া হইয়া কাটামু না।

এইটাই হইল হাতিরামের মিশন স্টেইটমেন্ট।

সিম্বলিক নির্মাণ থেকে একটা আইডিয়ালরে লক্ষ কইরা তার যাত্রা, মাসকুলিনিটির দিকে। মাসকুলিনিটির নির্মান সব সময় একটা আইডিয়াল ইমেজের সাথে কানেক্টেড।

যেইটা জন ওয়েইনরে ধরা যায়, আমেরিকান কালচারে।

জন ওয়েইন

এবং যেইটার এক্সট্রিম ভার্সন আমরা দেখি ভিশাল ত্যাগীর মধ্যে। সবচাইতে এক্সট্রিম মাসকুলিনিটির ফোর্স হইল এইখানে মাস্টারজি বা ধনুলিয়া। ইভেন ভিশাল ত্যাগীর মাস্কুলিনিটিও তার সামনে ক্যাস্ট্রেটেড হইয়া যায়, আনুগত্যের চিহ্ন হিশাবে আঙ্গুল কাইটা দেয়াটাই ছিল ঐ ক্যাস্ট্রেশন। ক্যাস্ট্রেটেড হওয়ার পরে ভিশালের মাসকুলিনিটি ছিল মাস্টারজির মাসকুলিনিটির ছায়ামাত্র। এবং এই কারণেই মাস্টারজি মরার খবর ত্যাগি সইতে পারে নাই, ও তা জানার পরেই সুইসাইড করে।

হাতিরামের মাস্কুলিনিটির দিকে যাত্রায়, তার আত্ম-মুক্তির যুদ্ধে প্রভাব হিসেবে সাবকনশাস মডেল ইমেজ ছিল ভিশাল ত্যাগী।

সাংবাদিক সঞ্জীব মেহরারে সে গিয়া যখন যুধিষ্টিরের কুত্তার গল্প বলে, আর ফিইরা আসে, তখন হাতিরামের মাইর খাওয়া বিপর্যস্ত চেহারা থাকলেও এর আগেই সে মাসকুলিনিটি অর্জন কইরা ফেলছে, যেইটা ঐ দৃশ্যে মিলে। যাওয়ার আগে সে মেহরারে বলে, প্রথম যখন দেখা হইছিল মেহরা, ভাবছিলাম আপনে কতো বড়ো মানুষ আর আমি কতো ছোট…এই যে তার  স্বীকারোক্তি বা ঘোষণা, এইটা হইল সামাজিক ফেইক মাসকুলিনিটিরে (এইখানে মেহরা, টিভি সাংবাদিক) ডিনাই করাটারে প্রকাশ্য কইরা তোলা।

লাস্টের দিকের কোর্টের উঠানে ভিশালের মুখামুখি হইয়া যখন দাঁড়ায় হাতিরাম, দুইজনই হাতে পিস্তল নিয়া পরস্পরের দিকে তাক কইরা, এইটা একটা দারুণ দৃশ্য। আমরা বুঝতে পারি যে, এরা পরস্পর শত্রু না।

পাতাললোক

হাতিরাম যেইটা হয়, যেই মাসকুলিনিটি তার মধ্যে দেখা যায়, সে যে তার বাপের কাল্পনিক নির্মাণ থেকে বের হইয়া যায়, এতে ভিশাল ত্যাগীরই প্রভাব।

এবং এর আগে আগে আমরা ত্যাগীর শিশুকালের দৃশ্য দেখি, যেইখানে ব্রাহ্মণ বলতেছে সে কী হবে বা কেমন হবে তার লাইফ, এইটাই হইল সিম্বলিক নির্মাণ, যেইটার শুরু হয় বাচ্চা জন্ম নেবার আগে থেকে মা বাপের ঐ বাচ্চা নিয়া কল্পণা ও আলোচনার মাধ্যমে।

এবং ত্যাগি নিজেরে মাইরা ফেললে দৃশ্যপট হইতে এক্সট্রিম মাসকুলিনিটির বিনাশ হয়। কেবল থাকে আইডিয়াল মাসকুলিনিটির কাছাকাছি থাকা হাতিরাম চাউদারি।

হাতিরামের এই নতুন আইডেন্টিটি নির্মানই ছিল তার স্ট্রাগল। আমরা দেখি পরে তার ছেলের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো হয়।

এবং আইসক্রিম যে সে ছুইড়া দেয় কুত্তার দিকে, এইটা হইল ঐ এক্সট্রিম মাসকুলিনিটির প্রতি তার কিছুটা শ্রদ্ধামূলক ভঙ্গি, যদিও এর বিপদ সম্পর্কে সে অবগত।

1 thought on “পাতাললোকঃ হাতিরামের মূল স্ট্রাগল কী ছিল”

  1. অনেক অনেক ভালো অ্যানালাইসিস,ভাই।আমিও আজকে পাতাল লোক দেখলাম।আর আপনার লেখা পড়ে প্রীত হইলাম।শুভকামনা ও ভালোবাসা র‌ইলো।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং