কস্টলি সিগন্যাল
এল এস ডি খাওয়া ছেলেদের ছবি দেখে নাকি অনেকে ক্র্যাশ খাইতেছেন, এটা নিয়া অনেকে ট্রল করতেছেন। আমি ক্র্যাশ খাওয়া বা এ সংশ্লিষ্ট মন্তব্য দেখি নাই। তবে ট্রল দেখে ধরে নিলাম আসলেই অনেকে ক্র্যাশ খাইছেন ও সেই অনুভূতির কথা ফেসবুকে শেয়ার করছেন।
এভলুশনারি থিওরির একটা হাইপোথিসিস হইল হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল, যেইখানে ধারণা করা হয় বিভিন্ন প্রাণীরা “কস্টলি সিগন্যাল” দিয়া বিপরীত লিঙ্গরে আকর্ষন করে। কস্টলি সিগন্যাল, যেইটা করতে গিয়া প্রাণীটার ক্ষতি বা কষ্ট হয়, কিন্তু এইটা করেও যে সে টিকে আছে সেটা তার জিনের স্বক্ষমতার সিগন্যাল হিসাবে কাজ করে। এর বিখ্যাত উদাহরণ, পুরুষ ময়ূরের বিশাল লেজ।
জ্যারেড ডায়মন্ড থার্ড শিম্পাঞ্জিতে এই হাইপোথিসিসের উপর ভর করেই মানুষের নিশা করার (এডিকশন) এক ব্যাখ্যা দিছিলেন, যে এইটা একটা “কস্টলি” সিগন্যাল হিসাবে কাজ করে। যেমন এলএসডি খাওয়া পোলারা হাসতেছেন, এইখানে সিগন্যাল হইল সে এলএসডি নিয়াও টিকে আছে, বিপরীত লিঙ্গের কাছে আকর্ষক।
মানুষের বিপদজনক কাজ করা, যেমন রাফ ড্রাইভ করা, বা উচ্চতা থেকে লাফাইয়া পড়া বা রাফ আচরণ, মারামারি এগুলাও কস্টলি সিগন্যাল হিসাবে কাজ করে।
ধরেন, এক ইয়াং পোলা রাফ বাইক চালান।
এতে এক ইয়াং মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন। কারণ এই রাফ বাইক চালানো তার স্বক্ষমতার সিগন্যাল, যার ধারা সেই জঙ্গলের সমাজ থেকে চলে আসছে। জঙ্গলের সমাজে পুরুষেরা ফাইট বা শিকার করে নিজেদের স্বক্ষমতার সিগন্যাল দিত, এবং এর উপর ভিত্তি করেই মেয়েরা তাদের সাথে মিলে বাচ্চা উৎপাদনে রাজী হইতেন।
দিনশেষে জিনিশটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ বাচ্চার জন্য। যাতে সে ভালো জিন পায় ও প্রতিকূল দুনিয়ায় বেঁচে থাকে, ও প্রজন্মান্তরে নিয়া যায় জিনরে।
আবার উপরোক্ত ক্ষেত্রে, ওই ইয়াং পোলার মা ক্ষিপ্ত হইতে পারেন। পোলারে নিষেধ করতে পারেন বা করেন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। কারণ এইখানে তার পুত্রধন হইল তার জিন, যে মইরা যদি যায় ফুটানি দেখাইতে গিয়া, তাহলে কে আগাইয়া নিবে তার জেনেটিক এজেন্ডা।
এই ব্যাখ্যাই একমাত্র ব্যাখ্যা না, বা আল্টিমেট ট্রুথ না এই বিষয়ে। মানুষ কেন কী আচরণ করে তা জটিল। কিন্তু “সিগন্যালিং” একটা কাজের মডেল চিন্তার ক্ষেত্রে।
মার্কেট ফর লেমনস
অর্থনীতিবিদ জর্জ একারলফের একটি পেপার যা ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়।
লেমন বলা হয় ইউজড কার মার্কেটের এমন কারকে যা কেনার পর দেখা যায় সমস্যা আছে।
ইউজড কার মার্কেটে বিক্রেতা জানে তার পণ্য কেমন। পুরা না জানলেও তার ধারণা থাকে। অন্যদিকে ক্রেতার কাছে এই তথ্য থাকে না।
এই তথ্যের অসাম্যতা একটি বাজে অবস্থা তৈরি করে।
ধরা যাক একজন বিক্রেতা বাজে ইউজড কার বিক্রি করে। আরেকজন ভালো ইউজড কার বিক্রি করে।
যে বাজে কার বিক্রি করে সে কম দামে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু যে ভালো ইউজড কার বিক্রি করে সে ওই দামে বিক্রি করতে পারবে না।
ক্রেতা এই দুই দামের মাঝামাঝি দামে কিনতে চাইবে। এক্ষেত্রে প্রথমে মনে হতে পারে ক্রেতার লাভ।
কিন্তু এখানে প্রকৃতপক্ষে, বাজে ইউজড কারের বিক্রেতা ন্যায্য দামের চাইতে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পায়। তার লাভ বেশি হয়।
অন্যদিকে, ভালো ইউজড কারের বিক্রেতার জন্য এটি ক্ষতিকর।
এই অবস্থা যখন চলতে থাকে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ইউজড কার মার্কেটে ভালো কার থাকে না। যা থাকে তা হলো লেমনস।
অনেক ক্রেতা যখন লেমনস কিনে নেয়, এবং দেখে যে বাজে কার তারা কিনেছে, তখন ইউজড কার মার্কেট থেকে তারা বেশি দামে কার কিনতে ভয় পায়। ফলে ভালো ইউজড কার তাদের ন্যায্য দাম আর পায় না, এবং একসময় মার্কেট থেকে চলে যায়।
যেসব ক্ষেত্রে তথ্যের অসাম্যতা আছে, যেমন ইনস্যুরেন্স বিজনেস, শিক্ষা বিজনেস, ইনভেস্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই লেমনস সমস্যা হতে পারে।
এখন আপনি যদি একটি ব্র্যান্ড নিউ কার কিনেন, এবং কোন কারণে সাথে সাথে ইউজড কার ডিলারের কাছে বিক্রি করতে চান, তাহলে যে দামে কিনেছেন ঐ দামে বিক্রি করতে পারবেন না। এর পেছনের ব্যাখ্যা হিসেবে একারলফের লেমনের ব্যাখ্যাটা খাটে। ডিলার মনে করবে আপনার কারে কোন ত্রুটি আছে, হয়ত এটা লেমন। বা সে এটা জানে যে ইউজড কারের ক্রেতার মধ্যে এই ভয় থাকবে। ফলে অবশ্যই আপনাকে তার কাছে কম দামে বিক্রি করতে হবে।
কয়েকজন ইকোনমিস্ট (রিচার্ড ব্লান্ডেল, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং তার সহ গবেষকেরা) দেখেছিলেন বাস্তব মার্কেটে এটা কীভাবে কাজ করে।
ডেনমার্কের ইউজড কার মার্কেটের ডেটা নিয়ে সে রিসার্চে দেখা যায়, এক বছর পরে কার বিক্রি করতে হলে ডেপ্রেসিয়েশনের বাইরে অতিরিক্ত ১৫% লসে বিক্রি করতে হয়। দ্বিতীয় বছর হলে ৮%। তিন বছর পরে ২/৩% এবং এভাবে সময়ের সাথে সাথে কমে। অনেকদিনের ব্যবহৃত কারের ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত লস বা লেমন পেনাল্টি দিতে হয় না, কারণ ডিলার মনে করে না এতে গোপন কোন ঝামেলা আছে। যেহেতু অনেক দিনের পুরনো কার, তাই এর সমস্যাগুলি যা তা তো দেখাই যাচ্ছে।
তারা আরো দেখেন যে, কখনো কখনো ভালো ইউজড কারও বিক্রি হয়। কারণ বিক্রেতার হয়ত টাকার খুব দরকার তাই কম দামেই বিক্রি করে দেয়।
সমাধান হিসেবে ওয়ারেন্টির কথা আসে। ওয়ারেন্টির মাধ্যমে এই তথ্যের অসাম্যতা যুক্ত জায়গায় ভালো ইউজড কারের বিক্রেতাও বিজনেস করতে পারবে। এছাড়া, ১৯৭০ সালের চাইতে সময় এখন অনেক আলাদা ইন্টারনেটের বিস্তার, ও সামাজিক মাধ্যমের কারণে। ফলে, মানুষের কাছে অন্য ক্রেতার রিভিউ এর কারণে, বা অনেক সময় কার বিক্রয়কারী অনলাইন প্রতিষ্ঠানের কারণে তথ্যের অসাম্যতার সমস্যা অনেক কমেছে। কারণ, একটি কার বিক্রেতা অনলাইন কোম্পানি নির্দিষ্ট কিছু কোয়ালিটি চেক করেই কার তাদের সাইটে রাখবে।
জর্জ একারলফ ২০০১ সালে এই পেপারের জন্য নোবেল স্মৃতি পুরষ্কার পান।
এতো সহজ একটা আইডিয়ার জন্য একজন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন, কিভাবে সম্ভব, এমন মনে হতে পারে কারো। এই পেপার যখন লেখেন একারলফ তখন তিনি কেবল পিএইচডি করেছেন, এসিসটেন্ট প্রফেসর। তিনটি প্রধান জার্নাল এটিকে রিজেক্ট করে, এর মধ্যে একটি জানায় এই আইডিয়া একেবারে সাধারণ।
তথ্য অসাম্যতা, বা তথ্য ইকোনমিতে একারলফের এই চিন্তা ছিল অর্থনীতির জন্য নতুন ও বৈল্পবিক। এটি অর্থনীতির অনেক মডেলের (যা ধরে নেয় তথ্য পারফেক্ট) সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেয়।
মাইকেল স্পেন্স জব মার্কেট সিগনালিং নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেপার প্রকাশ করেন, এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে দ্য কেইস এগেইন্সট এডুকেশন নামে বই লিখেন অর্থনীতিবিদ ব্রায়ান কাপলান। যেখানে ল্যাবর ইকোনমিতে বলা হয় শিক্ষার মাধ্যমে নানা স্কিল আয়ত্ত্ব করে হিউম্যান ক্যাপিটালের উত্তরণ হয়, সেখানে সিগনালিং থিওরির ভাষ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি আসলে কিছু জিনিশের সিগনাল হিসেবে কাজ করে চাকরিদাতাদের কাছে। এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে রিটার্ন তা এই সিগনালিং এর উপর ভিত্তি করে।
“Caplan argues that the primary function of education is not to enhance students’ skills but to certify their intelligence, conscientiousness, and conformity—attributes that are valued by employers. He ultimately estimates that approximately 80% of individuals’ return to education is the result of signaling, with the remainder due to human capital accumulation.”
ফলে ল্যাবর ইকোনমিতে যে ধারণা করা হয় শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উন্নতি হয়, সে ধারণা ধাক্কা খায়।
২০০৭ সালে ওয়াশিংটন রাজ্য জব মার্কেটকে ফেয়ার করতে আইন পাশ করে এখন থেকে চাকরিদাতারা চাকরিপ্রার্থীর ক্রেডিট স্কোর দেখতে পারবে না। দৃশ্যত এটি একটি ভালো আইন।
পরে আরো ১০ রাজ্য এটিকে অনুসরণ করে। এর সমর্থকেরা উদযাপন করেন বিষয়টা, কারণ ক্রেডিট স্কোর কম থাকে সাধরণত দরিদ্র, কালো বা ইয়াংদের। এখানে বৈষম্য কমবে এমন ধারণা ছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষকেরা এই আইনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান, এই আইনের ফলে দরিদ্র ও কালোরা আরো বেশি চাকরি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
এটা কেন হল, এর ব্যাখ্যায় একারলফের মডেলের চিন্তা দরকারি।
ক্রেডিট স্কোর ছিল একটা সিগনাল। যার ক্রেডিট স্কোর ভালো সে সময়মত ঋণ পরিশোধ করে, তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ইত্যাদি। এবং এটি ফেইক করা সহজ না। এই ক্রেডিট স্কোরে যখন চাকরিদাতাদের এক্সেস থাকল না তখন তারা অন্যান্য সিগনালে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করল। যেমন শিক্ষা ডিগ্রী, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
যেহেতু এগুলি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে কম, ফলে তারা আরও বৈষম্যের শিকার হল, আইনের ফলে কোন উপকার পেল না।
সিগনালিং অনেক অর্থনৈতিক আচরণের ব্যাখ্যা দেয়।
যেমন কোন কোম্পানি ডিভিডেন্ড না দিয়ে সেই টাকা ইনভেস্ট করলে এতে কোম্পানির লাভ হত এবং লং রানে স্টক ইনভেস্টরদের লাভ হত। এটা না করে ডিভিডেন্ড দিতে পারে ও দিয়ে থাকে নিজেদের স্বক্ষমতার বা স্ট্রেংথের সিগনাল হিসেবে।
এয়ারলাইন্সের উদ্দেশ্য বিজনেস ক্লাসের টিকেট বিক্রি করে ধনীদের কাছ থেকে প্রফিট করা। কিন্তু গরীবদের তারা একেবারে বাদ দিতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা কিভাবে জানবে কার পকেটে কত টাকা আছে? এর জন্য সাধারণ সিটগুলি একটু অসুবিধাজনক করে দেয়, যাতে যাদের বাজেট কম তারা এইসব সাধারণ সিটেই ভ্রমণ করেন ও টাকাওয়ালারা দামি সিটে।
মানুষের দানে সিগন্যালিং, মানুষ কেন দান করে?