আন্তোইন ডি সেইন্ট জুঁপেরী (নামের প্রকৃত উচ্চারন)
লেখকের অন্যান্য বইঃ The Aviator, Southern Mail, Night Flight…
ফ্রেঞ্চ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদঃ ক্যাথরিন উডস
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদঃ মুরাদুল ইসলাম
প্রথম পাঁচ অধ্যায়ঃ লিংক
———————————————————————————————————
অধ্যায়- ছয়
কথক ছোট রাজপুত্রের সাথে সূর্যাস্ত নিয়ে কথা বললেন।
অহ! ছোট রাজপুত্র, আস্তে আস্তে আমি তোমার ছোট দুঃখী জীবন সম্পর্কে জানতে পারছি…অনেকদিন ধরে তুমি আনন্দ খোঁজে পাও শুধুমাত্র সূর্যাস্ত দেখায়। এটা আমি জানতে পারি চতুর্থদিন সকালে, যখন তুমি আমাকে বললে,
“আমার সূর্যাস্ত খুব ভাল লাগে। চল আমরা একটি সূর্যাস্ত দেখে আসি।”
“কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হবে”, আমি বললাম।
“অপেক্ষা ! কীসের জন্য?”
“সূর্যাস্তের জন্য। সময় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
প্রথমে এই কথায় তুমি অবাক হলে। তারপর নিজে নিজে হাসলে। আমাকে বললে, “আমার সব সময় মনে হয় আমি বাড়িতে আছি।”
ঠিক তাই। এটা সবাই জানে যখন আমেরিকায় দুপুর তখন ফ্রান্সে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
তুমি যদি উড়তে পারো এবং সোজা ফ্রান্সে চলে যেতে পারো তাহলে তুমি সূর্যাস্ত দেখতে পারবে, দুপুর থেকে গিয়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের ব্যাপার ফ্রান্স বহুদূরে অবস্থিত। কিন্তু আমার ছোট রাজপুত্র, তোমার ছোট্ট গ্রহে চেয়ার সামান্য কয়েক পা ঘুরালেই ব্যাপারটা হয়ে যেত। তুমি দেখতে পেতে দিনের শেষ এবং গোধূলী যখন ইচ্ছা তখন…
একদিন, তুমি আমাকে বলেছিলে, “আমি ৪৪ বার সূর্যাস্ত দেখেছি!”
এবং একটু পরে তুমি যোগ করেছিলে,
“তুমি জানো- যারা খুব দুঃখী তারা সূর্যাস্ত পছন্দ করে।”
“তাহলে তুমি কি খুব দুঃখী ছিলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “৪৪ তম সূর্যাস্ত দেখার দিন?”
কিন্তু ছোট রাজপুত্র কোন উত্তর দিল না।
———————————————————————————————————
অধ্যায়-সাত
কথক ছোট রাজপুত্রের জীবনের গোপন কথা জানতে পারল।
পঞ্চম দিনে – আবারো ভেড়াটিকে ধন্যবাদ দিতে হয় যার জন্য – ছোট রাজপুত্রের জীবনের গোপন কথা আমার কাছে প্রকাশিত হয়। সহসাই ছোট রাজপুত্র আমাকে প্রশ্ন করে বসল, “ভেড়া যদি ছোট ঝোপ খেতে পারে তাহলে কি ফুলও খায়?”
সে এমনভাবে প্রশ্নটা করল যেন মনে হচ্ছে তা গভীর চিন্তাধারায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎ উন্মোচিত হল।
আমি উত্তরে বললাম, “ভেড়া তার সামনে যা পায় তাই খায়।”
“যে ফুলের কাঁটা আছে সেগুলিও খায়?”
“হ্যা…। যে ফুলের কাঁটা আছে সেগুলিও খায়।”
“তাহলে কাঁটা কী কাজে লাগে?”
আমি জানতাম না। আমি তখন ইঞ্জিন থেকে একটা স্ক্রু খোলার চেষ্টা করছিলাম। আমি মারাত্বক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। আমার কাছে এটি পরিস্কার ছিল যে ইঞ্জিনে বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। আমার কাছে আর সামান্য পানি বাকী ছিল। তাই ভয়াবহ খারাপ অবস্থায় পড়ার চিন্তায় ভীত ছিলাম।
“কাঁটাগুলো কী কাজে লাগে তাহলে?”
ছোট রাজপুত্র কোন প্রশ্ন করলে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামে না। আমি ইঞ্জিনের স্ক্রু নিয়ে বিরক্ত ছিলাম। তাই যা মাথায় আসল তাই বললাম উত্তরে,
“কাঁটাগুলো কোন কাজেই লাগে না। ফুলের কাঁটা থাকে অন্যকে জ্বালাতে…।”
এরপর কয়েক মুহুর্ত নিরবতায় কাটল। তারপরই লিটল প্রিন্স আমার দিকে তাকাল এবং বেশ রুষ্টভাবে বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। ফুলেরা দূর্বল সাধারণ সৃষ্টি। তারা মনে করে তাদের কাঁটাগুলো ভয়ংকর অস্ত্র…”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি নিজে নিজে বলছিলাম, “এবার যদি এই স্ক্রু না খুলে তাহলে আমি একে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দেব।” আবারো ছোট রাজপুত্র আমার চিন্তায় ব্যঘাত ঘটাল।
“এবং তুমি আসলে বিশ্বাস কর ফুলেরা……”
“অহ! না…আমি চিৎকার করে উঠলাম। না, না , না! আমি আসলে কিছু বিশ্বাস করি না। তখন আমার মাথায় যা এসেছে তাই উত্তর দিয়েছি। তুমি কি দেখছ না আমি গুরুত্বপূর্ন কাজে ব্যস্ত।”
সে বজ্রাহতের মত আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল, “গুরুত্বপূর্ন কাজ!”
সে তখন আমার দিকে তাকিয়ে দেখল আমার হাতে হাতুড়ি, আঙুল কালো হয়ে গেছে ইঞ্জিনের গ্রীজে, আমি নিচু হয়ে আছি ছোট কুৎসিত একটি বস্তুর দিকে…
“তুমি ঠিক বড়দের মত কথা বলছ।”
তার এই কথা আমাকে লজ্জিত করল। কিন্তু সে আরো বলে যেতে লাগল, “তুমি একটার সাথে আরেকটা সব কিছু মিশিয়ে ফেল…তুমি গুলিয়ে ফেল সবকিছু”
সে খুব রেগে গিয়েছিল। তার সোনালী কোকড়ানো চুল গুলি বাতাসে উড়ছিল তখন।
“আমি একটি গ্রহ সম্পর্কে জানি যেখানে একজন লাল মুখের ভদ্রলোক থাকে। সে কখনো কোন ফুলের গন্ধ শুকে দেখে নি। সে কখনো আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে দেখে নি। সে কখনো কাউকে ভালোবাসে নি। সে জীবনে কিছু করে নি শুধু সংখ্যা যোগ করে গেছে। এবং সব সময়, প্রতিদিন বার বার সে তোমার মতই বলে আমি গুরুত্বপূর্ন কাজে ব্যস্ত আছি। এই কথায় সে নিজে নিজে গর্ব বোধ করে। কিন্তু আসলে সে তো মানুষই না – সে একটা মাশরুম।”
“কী একটা?”
“একটা মাশরুম!”
ছোট রাজপুত্র তখন প্রচন্ড রাগে সাদা হয়ে গেছে।
“ফুলেরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কাঁটা তৈরী করছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভেড়ারা তাদের খেয়ে চলেছে একই রকম। এবং এটা কোন গুরুত্বপূর্ন বিষয় না জানা যে ফুলেরা কেন কষ্ট করে এই কাটা তৈরী করে যেগুলি তাদের কোন কাজেই লাগে না? ফুল এবং ভেড়াদের এই যুদ্ধটা কি গুরুত্বপূর্ন না? এটা কি সেই মোটা লালমুখো ভদ্রলোকের অংক করা থেকে গুরুত্বপুর্ন বিষয় না? এবং আমি যদি জানি যে ফুলটা শুধুমাত্র আমার গ্রহেই জন্মে আর কোথাও না, একদিন সকালে ভেড়াটিকে তাকে ধ্বংশ করে ফেলল না বুঝেই। আহ! তুমি মনে কর তা গুরুত্বপূর্ন না!”
কথা বলার সাথে সাথে তার মুখ রাগে সাদা থেকে লালে পরিবর্তিত হল।
“কেউ যদি একটি ফুল ভালোবাসে, এর মাত্র একটি গাছ যদি লক্ষ লক্ষ তারাদের কোন একটিতে জন্মে এবং একমাত্র পুষ্প নিয়ে ফুটে থাকে, তাহলে ঐ তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকাই সে ব্যক্তির খুশি থাকার জন্য যথেষ্ট। সে নিজে নিজে বলতে পারবে, ওখানে কোথাও আমার ফুল আছে। কিন্তু যদি কোন ভেড়া ফুলগাছটি খেয়ে ফেলে তাহলে তার সকল তারাগুলি হয়ে যাবে অন্ধকার। এবং তুমি মনে কর তা গুরুত্বপূর্ন না?
সে আর কোন কিছু বলতে পারল না। তার কথাগুলি আটকে গেল।
রাত পড়ে এসেছিল। আমি আমার হাত থেকে যন্ত্রপাতিগুলো ফেলে দিলাম। এবং সেই মুহুর্তে আমার হাতুড়ি, আমার স্ক্রু, অথবা পানির পিপাসা কিংবা মৃত্যু ভয় সব ভুলে গেলাম। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং একটু নাড়িয়ে বললাম, “যে ফুলকে তুমি ভালোবাস তা বিপদে নেই। আমি তোমার ভেড়ার জন্য একটি মুখবন্ধ এঁকে দেব। আমি তোমার ফুলের চারিদিকে দেয়ার জন্য বেড়া একে দেব…আমি……”
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে আমি তার কাছে পৌছাব, যেখানে আমি তার আগে আগে যেতে পারি, এবং তার সাথে হাতে হাত রেখে আরেকবার চলতে পারি।
এটা ছিল এমনই এক গোপন জায়গা, দুঃখভূমি।
———————————————————————————————————
অধ্যায় – আট
ছোট রাজপুত্রের গ্রহে গোলাপ আবির্ভূত হল।
আমি শীঘ্রই এই ফুল সম্পর্কে ভালোভাবে জানলাম। ছোট রাজপুত্রের গ্রহে ফুলগুলি ছিল খুব সাধারণ। তাদের পাঁপড়ির একটি মাত্র বলয় থাকত, তারা তেমন বেশি জায়গা নিত না, কারো কোন ক্ষতি করত না। একদিন সকালে ঘাসের মাঝে তাদের দেখা যেত এবং রাত নামার সাথে সাথে তারা আবার নিরবে ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু একদিন ছোট রাজপুত্র দেখতে পেল কেউ জানে না এমন এক জায়গা থেকে আসা একটি বীজের মধ্য থেকে একটি অংকুর বের হয়েছে। যা গ্রহের অন্য সব গাছের ছোট অংকুরের চেয়ে আলাদা। এটা হতে পারত নতুন ধরনের কোন বাওবাব।
শীঘ্রই ছোট গুল্ম তার বড় হওয়া বন্ধ করে দিল এবং ফুল দেয়ার জন্য তৈরী হতে শুরু করল। ছোট রাজপুত্র ফুলের কুঁড়ির সামনে ছিল তখন, তার মনে হল হয়ত কোন বিস্ময়কর চেহারা বের হতে চলেছে। কিন্তু ফুলটি তার সৌন্দর্য সাজাতে কেবল সবুজ রঙের সাহায্য নিতে চাইল না। সে অত্যন্ত সর্কতার সাথে রঙ নির্বাচন করল। সে একটি একটি করে তার পাঁপড়িগুলো সাজালো। সে কুচকানো অবস্থায় পপি ফুলের মত পৃথিবীর সামনে যেতে রাজি ছিল না। সে শুধুমাত্র চাইছিল তার পূর্ন ঔজ্জ্বল্যে বিকশিত হতে। আসলেই সে ছিল এক চমৎকার সৃষ্টি । এবং তার এই অসাধারণ সাজসজ্জা স্থায়ী হল অনেক দিন।
তারপর একদিন ঠিক সূর্যোদয়ের সময়, সে দেখা দিল।
শ্রমসাধ্য সাজসজ্জার পর জাগ্রত হয়ে সে হাই তুলে বলল, “আহ! আমি এই মাত্র জেগেছি। আমাকে ক্ষমা করো। আমার পাঁপড়িগুলো ঠিক মত সাজানো না এখনো…”
কিন্তু ছোট রাজপুত্র তার মুগ্ধতা লুকিয়ে রাখতে পারল না, “আহ! তুমি কত সুন্দর!”
ফুল মিষ্টিভাবে উত্তর দিল, “আমি খুব সুন্দর না? এবং আমি ঠিক সুর্য উঠার সাথে সাথে জন্মেছি।”
ছোট রাজপুত্র সহজেই বুঝতে পারল, সে খুব একটা বিনয়ী না – কিন্তু কি সুন্দর ভাবে সে দোল খাচ্ছে।
ফুল একটু পর বলল, “আমার মনে হয় এখন সকালের নাস্তার সময় হয়েছে। তুমি যদি আমার প্রয়োজনের ব্যাপারটা দয়া করে একটু দেখো…”
ছোট রাজপুত্র এ কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেল। সে পানি দেয়ার জারটা খোঁজতে গেল। তাহলেই সে কেবল ফুলের তত্ত্বাবধান করতে পারে।
…এরপর শীঘ্রই ফুল আত্মগর্বে মুগ্ধ হয়ে ছোট রাজপু্ত্রকে যন্ত্রণা দেয়া শুরু করল। যখন সত্যটা জানা থাকে, তার সাথে মানিয়ে চলা বেশ কঠিন হয়। যেমন একদিন যখন সে তার চারটি কাঁটা নিয়ে কথা বলছিল, তখন সে ছোট রাজপুত্রকে বলল,
“বাঘকে তার থাবা নিয়ে আসতে দাও!
ছোট রাজপুত্র বলল, “আমার গ্রহে কোন বাঘ নেই। আর বাঘেরা লতা পাতা খায় না।”
ফুল মিষ্টভাবে উত্তর দিল, “আমি ফুল, কোন লতাপাতা না।”
“ঠিক আছে। আমি এর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি…”
“আমি বাঘকে ভয় পাই না। ফুল বলে চলল, “তবে আমার বাতাসের শক্ত প্রবাহের ভয় আছে। আমার মনে হয় তোমার কাছে আমার জন্য কোন পর্দা নেই?”
“বাতাসের শক্ত প্রবাহের ভয়- এটা আসলে একটা ফুলের জন্য দূর্ভাগ্যের বিষয়।” ছোট রাজপুত্র বলল। এবং যোগ করল, “ফুলেরা খুব জটিল সৃষ্টি…”
“রাতে আমাকে একটি কাচের গোলকের মধ্যে ভরে রাখবে। তোমার এখানে খুব ঠান্ডা। আমি যেখান থেকে এসেছি…”
এই পর্যন্ত বলে সে থেমে গেল। সে বীজের ভেতর থেকে এসেছে। সে অন্য কোন পৃথিবী সম্পর্কে কিছু জানে না। হঠাৎ এই সত্য উন্মোচন হয়ে পড়ায় সে লজ্জিত হল এবং বেশ কয়েকবার কাশির মত শব্দ করল যাতে ছোট রাজপুত্র বুঝতে না পারে।
“পর্দা?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।
“হ্যা। এটা আমার দরকার যখন তুমি আমার সাথে কথা বল…” ফুল উত্তর দিল।
তার ফুল আরো কয়েকবার কাশল যাতে ছোট রাজপুত্রের ভেতর অনুতাপ আসে।
ছোট রাজপুত্র তার শুভ ইচ্ছা, যা তার ভালবাসার সাথে অবিচ্ছেদ্য ছিল সেগুলির দিকে লক্ষ্য না দিয়ে ফুলকে সন্দেহ করতে শুরু করল। যেগুলো গুরুত্বপূর্ন না সেই কথাগুলিকেই সে সিরিয়াসলি নিয়েছিল, এবং এজন্য সে হয়ে পড়ল অসুখী।
সে একদিন আমাকে বলেছিল, “আমার তার কথাগুলি ধরা উচিত হয় নি। কারো ফুলের কথা ধরা উচিত না। উচিত ফুলের দিকে তাকানো, তার সুগন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া।”
আমার ফুল পুরো গ্রহ সুগন্ধে ভরে দিয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না কীভাবে তার এই সৌন্দর্য আনন্দে উপভোগ করতে হয়। যে বাঘের কথাটি আমাকে বিব্রত করেছে, আমার উচিত ছিল তাতে কেবন সমব্যথী হওয়া।
এবং সে আত্মবিশ্বাসের সাথে আরো বলে গেল,
“প্রকৃত সত্য হল আমি জানতাম না কীভাবে কোন জিনিস বুঝতে হয়! আমার উচিত ছিল কথায় নয় কাজে বিচার করা। সে আমার দিকে তার সৌন্দর্য এবং ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। ফুলেরা খুব স্ববিরোধী। এবং আমি ছিলাম অনেক ছোট এটা জানার পক্ষে যে তাকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়…”
———————————————————————————————————
অধ্যায় – নয়
ছোট রাজপুত্র তার গ্রহ ত্যাগ করল…
আমি বিশ্বাস করি, গ্রহ থেকে পালানোর জন্য সে কোন একদল পরীযায়ী হিংস্র পাখির সাহায্য নিয়েছিল। বিদায়ের দিন সকালে সে তার গ্রহের সব কিছু ঠিক মত সাজাল। সে তার গ্রহের সব সক্রিয় আগ্নেয়গিরি পরিস্কার করল। তার দুটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছিল। এগুলি তার সকালের নাস্তা গরম করার জন্য ছিল সুবিধাজনক। তার আরো একটি মৃত আগ্নেয়গিরি ছিল। কিন্তু সে যেমন বলে , “কেউ কখনো জানে না কী হবে” তাই সে মৃত আগ্নেয়গিরিও পরিস্কার করল। ঠিকঠাকমত পরিস্কার করা অবস্থায় থাকলে আগ্নেয়গিরি কোন ধরনের অগ্নুৎপাত ছাড়া নিয়ন্ত্রিত ভাবে এবং ধীরে জ্বলতে থাকে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হল চিমনিতে আগুনের মত।
আমাদের পৃথিবীতে আমরা আগ্নেয়গিরি পরিস্কার করতে পারি না কারণ আমরা অনেক ছোট। এজন্যই আগ্নেয়গিরি এখানে সমস্যার সৃষ্টি করে।
ছোট রাজপুত্র অত্যন্ত বিমর্ষভাবে শেষ বাওবাবের ঝোঁপটাও তুলে ফেলল। সে বিশ্বাস করেছিল, যে সে আর কখনো ফিরবে না। কিন্তু শেষদিনে এই পরিচিত কাজগুলি তার কাছে অর্থবহ এবং মূল্যবান মনে হল। যখন সে শেষবারের মত ফুল গাছে পানি দিচ্ছিল এবং ফুলকে গ্লাস টিউব দিয়ে ডেকে দিতে যাচ্ছিল তখন সে অনুভব করল তার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
“বিদায় …” সে ফুল কে বলল।
কিন্তু ফুল কোন উত্তর দিল না।
“বিদায়…” সে আবার বলল।
ফুল কাশল। এমন না যে তার খুব ঠান্ডা লেগেছে।
“আমি বোকার মত আচরন করেছিলাম…আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সুখী হওয়ার চেষ্টা করো…” ফুল শেষপর্যন্ত তাকে বলল।
ছোট রাজপুত্র ফুলের মুখে অভিযোগের অনুপস্থিতি দেখে অবাক হল। সে হতভম্ব হয়ে গ্লাস টিউব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে এই মধুর নিরবতাকে বুঝতে পারল না।
ফুল তাকে বলল, “অবশ্যই আমি তোমাকে ভালবাসি। এটি আমার ব্যর্থতা যে তোমাকে বুঝাতে পারি নি। তা গুরুত্বপূর্নও না। কিন্তু তুমি আমার মতই বোকা ছিলে। সুখী হওয়ার চেষ্টা করো…আর গ্লাস টিউবেরও দরকার নেই, ওটা আমার লাগবে না।”
“কিন্তু বাতাস…”
“আমার এত বেশি ঠান্ডা লাগে নি। ঠান্ডা রাতের বাতাস তাই আমার জন্য ভাল হবে। আমি একটি ফুল।”
“কিন্তু পশুপাখি…”
“হুম…আমাকে কিছু শুয়োপোকা সহ্য করতে হবে যদি আমি চাই প্রজাপতির সাথে পরিচিত হতে। তাদের অনেক সুন্দর মনে হয়। এবং শুয়োপোকা কিংবা প্রজাপতি ছাড়া কে আসবে আমার কাছে? তুমি থাকবে অনেক দূরে… এবং বড় প্রাণীদের নিয়ে আমি মোটেও ভীত নই। আমার থাবা আছে।”
সে শান্তভাবে তার চারটি কাঁটা দেখাল। এবং যোগ করল,
“দেরী করো না। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ চলে যাবে। এখন যাও।”
সে এভাবে বলল কারণ সে চাইছিল না ছোট রাজপুত্র তার চোখের পানি দেখুক। সে ছিল এমনি এক গর্বিত ফুল।
———————————————————————————————————
অধ্যায়-১০
ছোট রাজপুত্র রাজার দেখা পেল।
ছোট রাজপুত্র তাকে প্রতিবেশী গ্রহাণু যেমন ৩২৫, ৩২৬, ৩২৭, ৩২৮, ৩২৯ এবং ৩৩০ এ গেল। সে জ্ঞাণ অর্জনের জন্য প্রত্যেকটিতে ভ্রমণ করা শুরু করেছিল। প্রথমটিতে থাকতেন একজন রাজা। রক্তবর্নের রাজকীয় লম্বা পোষাক পরিহিত অবস্থায় তিনি তার সাধারন কিন্তু মহিমান্বিত সিংহাসনে বসা ছিলেন।
“আহ! এই তো একটি সাবজেক্ট!” বলে ছোট রাজপুত্রকে দেখামাত্রই তিনি চিৎকার করে উঠলেন।
ছোট রাজপুত্র মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে সে আমাকে প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলল?
ছোট রাজপুত্র জানত না কীভাবে পৃথিবী রাজাদের জন্য সহজ হয়ে গেছে। তাদের কাছে প্রতিটি মানুষই এক একটা সাবজেক্ট
“সামনে আসো বৎস, যাতে তোমাকে আমি আরো ভালোভাবে দেখতে পারি।” রাজা শেষপর্যন্ত কারো ‘রাজা’ হওয়ার গর্বে গর্বিত ছিলেন
ছোট রাজপুত্র চারপাশে বসার মত কোন জায়গা আছে কি না দেখতে লাগল। কিন্তু সমস্ত জায়গা ছিল ঠাসা এবং রাজার লম্বা পোষাকের অংশে পরিপূর্ণ। তাই ছোট রাজপুত্র দাঁড়িয়ে রইল। সে ছিল খুব ক্লান্ত তাই হাই তুলল
রাজা বললেন, “একজন রাজার সামনে হাই তোলা শিষ্টাচার পরিপন্থি কাজ। তবু, তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।”
ছোট রাজপুত্র লজ্জিত ভাবে বলল, “আমি আটকাতে পারি নি। আসলে আমি অনেক ক্লান্ত, লম্বা ভ্রমণ করে এসেছি…”
রাজা বললেন, “আহ! তাহলে ঠিক আছে। আদেশ করছি, আরো হাই তোল। আমি অনেকদিন কারো হাই তোলা দেখি না। হাই তোলা দেখাও এখন আমার উৎসাহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আদেশ করছি। হাই তোল। আবার হাই তোল এখন।”
ছোট রাজপুত্র এবার পুরোপুরি লজ্জিত হয়ে বিড় বিড় করে বলল, “এটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে…আমি পারবো না আর…”
“হুম! হুম! তাহলে আমি তোমাকে আদেশ করছি কোন এক সময় তুমি হাই তুলবে…অন্য কোন সময় –”
রাজাকে কিছুটা বিরক্ত মনে হল।
রাজারা এইজন্যই যে লোকজন তার আদেশ মান্য করবে। কোন অবাধ্যতা সহ্য করবেন না। তিনি একজন শক্তিশালী রাজা। তিনি যেহেতু একজন ভাল মানুষ ছিলেন তাই তার আদেশ গুলিও হত যুক্তিসংগত।
তিনি উদাহরণ স্বরুপ বলবেন, আমি যদি কোন সেনাপতিকে আদেশ দেই নিজেকে সামুদ্রিক পাখিতে পরিণত হতে, এবং সেনাপতি যদি আমার কথা না শোনে, তাহলে সেটা সেনাপতির দোষ না, দোষ আমার।
“আমি কি বসতে পারি?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।
“আমি তোমাকে বসতে আদেশ করছি –” বললেন রাজা। এবং তার রাজকীয় পোষাকের কিছু ভাঁজ করলেন।
ছোট রাজপুত্র ভাবছিল, “গ্রহটা খুব ছোট। তাহলে এই রাজা কীসের উপর রাজত্ব করেন?”
সে বলল, “স্যার! আমি কি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?”
রাজা বললেন, “আমি তোমাকে আদেশ করছি আমাকে প্রশ্ন করতে।”
“স্যার …আপনি কীসের উপর রাজত্ব করেন?”
মহিমান্বিত সরলতার সাথে রাজা উত্তর দিলেন, “সব কিছুর উপরে।”
“সবকিছুর উপরে?”
রাজা তার গ্রহ, আশপাশের গ্রহ এবং তারাদের প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
“এই সব কিছুর উপরে?” ছোট রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল।
“হ্যা। এই সব কিছুর উপরে।”
আমার শাসন শুধু যে অসীম তাই না, এটা সার্বজনীনও।
“তারাগুলো আপনার আদেশ মানে?”
“অবশ্যই মানে। ঠিকঠাক মত মানে। আমি তাদের অবাধ্যতা করতে দেই না।” রাজা উত্তর দিলেন।
এই রকম ক্ষমতা ছোট রাজপুত্রের কাছে ছিল অদ্ভুত ব্যাপার। তার যদি এরকম ক্ষমতা থাকত তাহলে সে সুর্যাস্ত দেখতে পারত, দিনে ৪৪ বার না, ৭২ বা তার ও বেশি, হয়ত ১০০ বা ২০০ বার, চেয়ার না সরিয়েই। ছোট রাজপুত্রের তার পরিত্যাগ করে আসা গ্রহটার কথা মনে পড়ল এবং তার খারাপ লাগল। সে সাহস সঞ্চার করে রাজাকে বলল,
“আমি সূর্যাস্ত দেখতে চাই। দয়া করে সূর্যকে বলুন অস্ত যেতে…”
“আমি যদি কোন সেনাপতিকে বলি ফুল থেকে ফুলে প্রজাপতির মত উড়ে যেতে অথবা একটি ট্রাজিক নাটক লিখে ফেলতে অথবা নিজেকে সামুদ্রিক পাখিতে পরিণত করতে এবং সেনাপতি যদি আমার আদেশ মানতে না পারে তাহলে দোষটা কার হবে? আমার না সেনাপতি?” রাজা প্রশ্ন করলেন।
“আপনার।” ছোট রাজপুত্র দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল।
“ঠিক। একজনকে সেই কাজই দিতে হবে যা সে করতে পারবে। তুমি যদি তোমার মানুষদের বলো সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপ দিতে তাহলে তারা জেগে উঠবে এবং তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। আমার অধিকার আছে বাধ্যতা পাওয়ার কারণ আমার আদেশ গুলো যুক্তিসংগত।”
“কিন্তু আমার সূর্যাস্ত?” ছোট রাজপুত্র কোন কিছু চাইলে বা জিজ্ঞেস করলে তা সহজে ভুলে না।
“তুমি তোমার সূর্যাস্ত দেখতে পাবে। আমি আদেশ দিয়ে দেব। কিন্তু আমার রাজত্বের বিজ্ঞান মতে সূর্যাস্তের জন্য কিছু শর্তের প্রয়োজন আছে। শর্ত গুলো পূরণ হলেই তুমি সূর্যাস্ত দেখতে পাবে।”
“এটা কখন হবে?” ছোট রাজপুত্র প্রশ্ন করল।
“হুম! হুম!” শব্দ করে রাজা মোটা বর্ষ পঞ্জি দেখে বললেন, “হুম! হুম! এটা হবে আজ সন্ধ্যা ৮ টা ২০ মিনিটে। তখন তুমি দেখতে পাবে আমার আদেশ কীভাবে মানা হয়।”
ছোট রাজপুত্র হাই তুলল। তার হারানো সূর্যাস্তের জন্য তার দুঃখ হল। সে কিছুটা বিরক্তও হতে শুরু করেছিল।
“আমার এখানে করার কিছু নেই। আমি বরং আমার পথেই চলে যাই”, সে রাজাকে বলল।
“না যেও না।” গর্বিত রাজা বললেন, “আমি তোমাকে মন্ত্রী বানাব।”
“কীসের মন্ত্রী?”
“বিচারমন্ত্রী।”
“কিন্তু এখানে বিচার করার ত কেউ নেই।”
“আমরা জানি না। আমি আমার রাজ্যের পুরোটা ঘুরে দেখি নি। আমি অনেক বৃদ্ধ। আমাকে বয়ে নেওয়ারও কিছু নেই। এবং হাঁটলে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই।”
“অহ! আমি দেখেছি চারপাশ।” ছোট রাজপুত্র আবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল। এদিকেও কিছু নেই, ওদিকও নেই কিছুই।
রাজা বললেন, “তাহলে তুমি নিজেকে বিচার করবে। এটি সব থেকে কঠিন কাজ। নিজেকে বিচার করা অন্যকে বিচার করার থেকে অনেক বেশি কঠিন। তুমি যদি নিজেকে সত্যিকার ভাবে বিচার করতে সক্ষপম হও, তাহলে তুমি সত্যিকার অর্থেই একজন প্রজ্ঞাবান লোক।দ
“হ্যা। কিন্তু আমি যেকোন জায়গা থেকে নিজেকে বিচার করতে পারি। নিজেকে বিচার করার জন্য আমার এই গ্রহে থাকতে হবে না।” ছোট রাজপুত্র বলল।
“হুম ! হুম! আমার কাছে ভাল কিছু কারণ আছে এটা বিশ্বাস করার যে এই গ্রহে একটি বৃদ্ধ ইঁদুর আছে। আমি তার শব্দ শুনেছি রাতে। তুমি এই বৃদ্ধ ইঁদুরকে বিচার করতে পারবে। সময় সময় তুমি তাকে মৃত্যুদন্ড দিবে। তাই তার জীবন তোমার বিচারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কিন্তু আবার তুমি তাকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ক্ষমা করে দিবে, মিতব্যয়ীতার জন্য। কারণ আমাদের তো একটাই মাত্র ইঁদুর আছে।”
“আমি কাউকে মৃত্যদণ্ড দিতে পছন্দ করি না। আমি এখন আমার নিজের পথে যাচ্ছি।” ছোট রাজপুত্র বলল।
রাজা বললেন, “না।”
ছোট রাজপুত্র ঐ গ্রহ ছেড়ে আসার সমস্ত আয়জোন শেষ করে ফেলেছিল এবং বৃদ্ধ রাজার মনে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে তার ছিল না।
“মহামান্য, আপনি যদি চান আমি আপনার আদেশ মান্য করি তাহলে আমাকেও যুক্তিসংগত আদেশ দিন। যেমন- আদেশ দিন এক মিনিটের মধ্যে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যেতে।”
রাজা কোন উত্তর দিলেন না।
ছোট রাজপুত্র এক মুহুর্তের জন্য দ্বিধায় ছিল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে গ্রহ ত্যাগ করল।
রাজা চিৎকার করে বললেন, “আমি তোমাকে আমার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করলাম।”
তার ছিল চমৎকার কর্তৃত্ব ক্ষমতা।
ছোট রাজপুত্র ভ্রমণ করতে করতে নিজেকেই বলল, “বড়’রা – আসলেই অদ্ভুত!”