বাংলা ফিল্মে প্রেম ও জাত পাতের বিচার

আগেকার বাংলা ফিল্ম যারা দেখেছেন তারা লক্ষ করে থাকবেন এমন গল্প থাকত যেখানে নায়িকা খুব ধনীর মাইয়া। নায়িকার বাপরে বলা হইত বিজনেস ম্যাগনেট। কলেজের প্রথম দিনে ধাক্কা খাইয়া কিংবা গাড়ি ঠিক করাতে যাইয়া নায়িকার লগে প্রেম হইত নায়কের। নায়ক তার মারে নিয়া থাকেন। তার বাপ কোথায় সে জানে না।

প্রেম আস্তে আস্তে গভীর হইতে থাকে। ফিল্মও তার সাথে সাথে জটিল হইতে থাকল। এরপর আস্তে আস্তে বের হইতে লাগল থলের বেড়াল। দেখা গেল এই নায়কের বাপ আগে আছিল বড় ব্যবসায়ী। নায়িকার বাপের ভাই বা বস। নায়িকার বাপ কৌশলে তারে খুন করছে বা জেলে ঢুকাইছে ধোঁকা দিয়া।

প্রতিশোধ পর্বের পর নায়ক নায়িকার মিলন হইত।

এইখানে লক্ষণীয় বিষয় নায়ক এবং নায়িকার ক্লাস। যদিও প্রথমে নায়করে দর্শকদের গরীব ছোটলোক মনে হইছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সে আসলে বড় জাতের পোলা। তার বাপও ধনী ছিল। ফলে নায়িকার লগে তার মিলনে বড়লোক ছোটলোকরে বিয়া করে নাই। বড়লোক বড়লোকেই বিয়া হইছে। মানে ক্লাস ঠিক রাখা হইছে।

একইভাবে রাজা রাজড়ার ফিল্মেও দেখা যাইত রাজার পোলা এক বেদেনীর প্রেমে পড়ে। প্রেম, ক্লাইম্যাক্স, জোছনার ফাঁকি দেয়া ইত্যাদির পর শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকার মিলন হইত। তার আগে বেঁদে সর্দার জানাইতেন এই মাইয়া আসলে তার না, সে কুড়াইয়া পাইছে বা কারো কাছ থেকে পাইছে। বিভিন্ন সূত্রে তখন বের হইত এ আসলে রাজারই ভাইয়ের মাইয়া।

Chandan
ছবিঃ ঢাকাই সিনেমা পোস্টার থেকে নেয়া

এখানেও রাজার জাতে রাজার জাতে বিয়া হইল। রাজার জাতে ছোটজাত বিয়া করে নাই।

বাংলাদেশের ফিল্ম ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ফিল্ম বেদের মেয়ে জোছনায় দেখা যায় জোছনা বঙ্গরাজের শ্যালক কাজী সাহেবের মাইয়া। তাকে দশ বছর বয়সে সাপে কাটে। বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তাকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। এক নিঃসন্তান বেদে সন্তান থাকে পায় এবং বাঁচিয়ে তোলে। সে বেঁদেনী হিসেবে বড় হয় এবং ঘটনাক্রমে তার প্রেম হয় বঙ্গরাজের ছেলের সাথে। আত্মীয়তার হিসেবে এই বঙ্গরাজের ছেলে তার ফুপাত ভাই।

আর জোছনা আসলে বেদের মেয়ে না, সে বঙ্গরাজের শ্যালক কাজী সাহেবের মাইয়া।

আরেক ধরনের ফিল্মে দেখা যাইত ধনীর মাইয়া আর তার চাকরের ছেলে হয় একই দিনে। কেউ চক্রান্ত করে বা অন্য কোনভাবে এই দুই সন্তান বদল হইয়া যায়। ধনীর মাইয়া চলে যায় গরীবের ঘরে, আর গরীবের ছেলে আসে ধনীর ঘরে। তারা বড় হয়। এবং কাকতালীয়ভাবে একে অন্যের প্রেমে পড়ে। প্রেম মানেই যেহেতু ঘাত প্রতিঘাত, তাই অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর তাদের মিলন হয়। এর আগে অবশ্য ধনী জানতে পারেন ঐ মাইয়াটা তার মাইয়া, আর তার ঘরে বড় হওয়া পোলাটা তার পোলা নয়। ফলে এখানেও জাতে জাতে ভারসাম্য রাখা হয়, একটু অন্যভাবে। একজন জাতে উত্তীর্ন হয় ছোট থেকে ধনীর ঘরে মানুষ হয়ে। আরেকজন গরীবের ঘরে বড় হইলেও তার ব্লাড তো ধনীর।

এইরকম একটা ক্লাস মেইনটেন করা হইত অধিকাংশ ফিল্মে। কিছু ফিল্মে দেখা যাইত ধনীর হারাইয়া যাওয়া পোলা বস্তির মাস্তান। সেই বস্তিরই আরেক মাইয়া তারে লাভ করে। কিন্তু বস্তির গুন্ডা নায়ক তারে পাত্তা দেয় না। পাকেচক্রে সে প্রেমে পড়ে আরেক ধনী মাইয়ার। সেই ধনী আবার তার বাপরে মারছে বা এরকম কিছু একটা। শেষকালে বস্তির গুন্ডা নায়ক্র আসল পরিচয় বের হইত, সে তার মা কিংবা বাপরে খুঁজে পাইত। নায়ক নায়িকার মিলনও হইত। আর শেষ দৃশ্যে নায়করে বাঁচাইতে গিয়া গুলি খাইয়া মারা যাইত বস্তির সেই মাইয়া, যে নায়করে ভালোবাসত। তারে সাইড নায়িকা হিসেবে গন্য করা হইত। তার খাঁটি লাভ তারে আত্মত্যাগেই নিয়া গেল।

এখানে ক্লাসের ভারসাম্য রাখা হইল আরো রূক্ষভাবে। দেখতে পাওয়া গেল, গরীব ধনীরে লাভ করলেও তারে পাইতে পারবে না। বিয়া দিবার সময় সিনেমার চালকেরা ঠিক ঠাক জাত মিলাইলেন।

ধনীর মাইয়া/পোলা যেসব ক্ষেত্রে গরীবের পোলারে বিয়া করছে বাংলা ফিল্মে সেসব ক্ষেত্রে দেখা যাবে বিপরীতে থাকা নায়ক/নায়িকা স্কুল মাস্টারের সন্তান। স্কুল মাস্টার আমাদের সমাজে সম্মানের পেশা। শিক্ষকরে গুরুর সম্মান দেয়ার একটা নিয়ম প্রচলিত। সেই হিসেবে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা আছে। যদিও এখন কিছুটা কমেছে মনে হয়। আগে আরো বেশি ছিল। সেই হিসাবে শিক্ষকের সন্তানদের সাথে ধনী মাইয়া বা পোলার বিয়া হইত।

ফিল্মে বিয়ার ক্ষেত্রে এইরকম জাত মিলানি আমাদের সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সমাজে এইরকম জিনিসই স্বাভাবিক, ক্লাস মেইনটেন করে বিয়া দেয়া। ফিল্মে প্রেম, একশন ইত্যাদি আনলেও নির্মাতারা সমাজের এই নিয়মটা ভাঙতে যান নাই। প্রেমের বিয়াতেও তাদের ক্লাস সচেতনতা বিদ্যমান ছিল।

এই ধরনের ফিল্ম হিট হইছে। বড়লোকের মাইয়া ছোটলোকের পোলারে বিয়া করলে দর্শক নাও নিতে পারে, যেহেতু অবচেতনে এটা তারা প্রত্যাশা করে না। এমন ধারনা হয়ত নির্মাতাদের ছিল।