আইজ সিলেটের মধুশহীদে ইস্কন অনুসারীদের সাথে এলাকার মুসল্লীদের একখানা সংঘর্ষ হইছেন।
ইট পাটকেল নিঃক্ষেপ ইত্যাদির এক পর্যায়ে পুলিশেরা ঠিক সময়ে পৌছাইয়া যান, তাই হতাহতের সংখ্যা বাড়ে নাই। অনেকে আহত হিছেন। গ্রেফতারও হইছেন।
এই সংঘর্ষের কারণ ছিল, জুম্মার নামাযের সময়ে ইস্কন মন্দিরে বাদ্য বাজানো। মন্দির এবং মসজিদ কাছাকাছি।
হামলা শেষ হওয়ার পরে শুরু হইছে আসল খেলা। ফেইসবুকেই মূলত। এখানে কে দোষী, কে নির্দোষ এইসব নিয়া আলোচনা চালাইয়া যাইতেছেন মুসলমান এবং হিন্দু ধর্মের উৎসাহী কিছু লোকেরা। তাদের তর্ক বিতর্ক আরেক ফেইসবুক দাঙ্গায় রূপ নিতেছে।
এদের অনেকে উশকানি দিয়া চলতেছেন অনেক ক্ষেত্রে। তারা মনে করতেছেন, তাদের এই দোষী নির্দোষের বিচার দেখার জন্য খাড়াইয়া আছে জনতা। এক পত্রিকার নিচে কমেন্ট দেখলাম, একটা একটা হিন্দু ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।
সাম্প্রদায়িক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সংখ্যাগুরুর প্রথম, প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব হইল সংখ্যালঘুরে প্রটেক্ট করা, তাইলেই দাঙ্গাটা আর লাগবে না। দোষ গুণ যার যাই হোক, এগুলা আপনারা বিচার করবেন পরিস্থিতি ঠান্ডা হইবার পরে; যাতে পরবর্তীতে এমন বাজে পরিস্থিতি তৈরী হইবার উপক্রম না হয় আর। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুর দোষ যদি আপনে বাইর করেন, আর সংখ্যাগুরুর আক্রমণরে জাস্টিফিকেশন দেন, তাইলে পুনরায় সংঘর্ষ হইতে পারে একই জায়গায় বা আরেক জায়গায়। তখন আপনে নিশ্চিত থাকেন সংখ্যালঘুরা মাইর খাবে। কারণ সংখ্যাগুরু আপনে, আপনে সংখ্যায় বেশী, আপনারা একটা কইরা চিমটা দিলে ওরা নাই হইয়া যাবে। আর সবচেয়ে বড় এবং বিপদজনক কথা হইল, আপনি যাদের নিজ ধর্মের বইলা “আমরা” মনে করতেছেন, তাদের মধ্যে কে কোন কারণে হামলা লাগাইতে চাইতেছে তা আপনে বুঝতে পারবেন না। এইটা বুঝার কোন তরিকা ইহলোকে তইরি হয় নাই।
বঙ্গবন্ধু তার জীবনে দাঙ্গা দেখছেন। ১৯৪৭ সালে যে দুইখানা দেশ পাওয়া গেল ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান, এইগুলা দাঙ্গায় মরা মাইনষের ব্লাডে চুবানো। যেইভাবে জিলাপিরে তেলে চুবাইয়া বিরান করা হয় ওইভাবে রক্তে চুবাইয়া এই দুইখানা দেশ হইছেন।
বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীর এক জাগায় লেখছেন,“একদল লোককে দেখেছি যারা দাঙ্গা হাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই।”
এখন চিন্তা কইরা দেখেন সেই অরাজক পরিস্থিতির কথা, যখন আপনাদের কথায়, নিজেদের ফেইসবুক তর্ক বিতর্কের ল্যাঞ্জা ধরে দাঙ্গা লাইগা যাবে। তখন সংখ্যালঘুর অনেক নিরীহ মানুষরেও আপনেরা মারতে থাকবেন। সংখ্যাগুরুর যে দুই একজন নিরপরাধ লোকের জীবন বিপন্ন হইবে না, এমন না। দাঙ্গার নিয়মই এই, মারার সময় তা কে নিরীহ আর কে হারামী তার বিচার করে না। তো এইসব জীবনের দায়ভার কি আপনেরা নিবেন, হে ফেইসবুক বিচারকেরা?
দাঙ্গা কি, কত ভয়াবহ হইতে পারে তা বুঝতে শিখেন। যেই দেশখানায় আছেন, আর নিয়মিত গর্বে আটখানা হন, ফুটানি মারেন তার ইতিহাস পড়েন। উপমহাদেশের ইতিহাস পড়েন। দাঙ্গারে ঘৃণা করতে শিখেন । কীভাবে দাঙ্গা না লাগে সেই চেষ্টায় নিয়োজিত করেন নিজেরে, সংখ্যাগুরুরা মূলত। যেহেতু আপনেরা বেশী সংখ্যায়, দায়ভারও আপনাদের বেশী।
দাঙ্গা নিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেইখা গেছেন, “কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়।
একট কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমান। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।”
পল্লীকবি জসীম উদদীনের আত্মজীবনী তিনি উৎসর্গ করেছিলেন যাদের, তন্মধ্যে দুইজন ব্যক্তির নামোল্লেখ আছে উৎসর্গপত্রে, যারা হিন্দুদের বাঁচাইতে গিয়া মারা গেছিলেন। এদের একজন জিন্নাত আলী মাষ্টার, আরেকজন আমির হোসেন চৌধুরী। জিন্নাত আলী মাষ্টারের পরিবারের লোকেরাও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হইতে বাঁচাইতে গিয়া মারা যান। জসীম উদদীন তার আত্মজীবনী জীবন কথা এনাদের সবাইকে উৎসর্গ করেছেন তাদের ত্যাগের কথা স্মরণ কইরা।
জাতির জনক একবার মহাত্মা গান্ধীরে এক প্যাকেটে কইরা কিছু ছবি দিছিলেন। সেগুলা তার ফটোগ্রাফার বন্ধু ইয়াকুব সাহেব তুলছিলেন বিহার দাঙ্গার কালে। সেই ছবিগুলাতে ছিল মুসলমান মাইয়াদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীর আছে, বস্তি, মসজিদে আগুন জ্বলছে ইত্যাদি।
পরে ইন্ডিয়া স্বাধীন হইলে দাঙ্গা পরিস্থিতি ঠিক করতে মহাত্মাজী ঘোষনা দিছিলেন দাঙ্গা হইলে, মুসলমানদের মারলে তিনি অনশন করবেন। মহল্লায় মহল্লায় তখন হিন্দিভাষী লোকেরা মিছিল লইয়া বাইর হইল, মুসলমানকো মাত মারো, বাপুজী অনশন করেগা। হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই।
সংখ্যাগুরুরেই প্রথমে আগাইয়া আসতে হয় সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিরসনে। পাকিস্তানে (পূর্ব+পশ্চিম) তৎকালীন মুসলিম লীগের কর্মীরা (যারা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক ছিলেন মূলত) চেষ্টা কইরা যাইতেছিলেন দাঙ্গা যাতে না লাগে। বঙ্গবন্ধু এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন।
আমাদের দেশে আইন আদালত আছে, পুলিশ বিচার আছে। কেউ কারো ধর্ম পালনে বাঁধা দিলে, ব্যঘাত সৃষ্টি করলে তার নামে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারে যান। আর অনলাইনে যারা উশকানি দেয় এদের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইমের দফতরে রিপোর্ট করেন, অনলাইনেই করতে পারবেন।
পুন্যভূমিতে যুগ যুগ ধইরা লোকে শান্তিতে বসবাস কইরা আসতেছেন। এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সামনেও থাকবে, যদি আপনারা সবাই সচেতন থাকেন। সবাই, সংখ্যাগুরু এবং লঘুরা; উশকানিতে জড়াইয়েন না।