আমাদের সিগারেট খাওয়ার কারণ কী?

পুরুষ ময়ুর

মানুষ সিগারেট খায় কেন তা নিয়ে আমি অল্প ভাবছিলাম। সিগারেট খাওয়ায় দৃশ্যত কোন লাভ নাই, ক্ষতি আছে। কিন্তু তাও অনেক অনেক লোকে সিগারেট খান। আমার পূর্ববর্তী ভাবনায় একটা ব্যাখ্যা বের করেছিলাম সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাক্ষাৎকার থেকে। ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে জীবন আকাঙ্খা এবং মৃত্যুর জন্য আকাঙ্খা দুইটাই পাশাপাশি কাজ করে। মানুষ সচেতন বা অচেতনভাবে তার অজৈব অস্তিত্বহীনতায় ফিরে যেতে চায়। এই কথার প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছিল, মানুষের সিগারেট খাওয়া বা কোন ধরনের মাদক গ্রহণ আসলে তার মৃত্যু আকাঙ্খারই বহিঃপ্রকাশ।

ফ্রয়েডের এই চিন্তা আমি পূর্ববর্তী কয়েকটি লেখায় ব্যবহার করেছি। ক্রিস্টোফার নোলানের শর্ট ফিল্ম ডুডলবাগ নিয়ে আলোচনায় বা ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস অথবা ভায়োলেন্ট গেইম এর আলোচনায়।

সিগারেট বা মাদক গ্রহণের সামাজিক অনেক কারণ আছে। যেমন বেকার এবং হতাশাগ্রস্তদের মধ্যে মাদকাসক্তি বেশী দেখা যায়। কিন্তু এই সামাজিক কারণ না বিবেচনা করে মানুষের বিবর্তন বা প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য থেকে এর ব্যাখ্যা দেখা হবে এই লেখায়। উপরে ফ্রয়েডের কথার সূত্রে যে ব্যাখ্যা, তা প্রমাণ করা অসম্ভব।  প্রমাণ ও অপ্রমাণের সূত্রে এদের না বেঁধে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখার চেষ্টা হিসেবে নিতে হবে।

এই ইভ্যলুশনারি ব্যাখ্যা একমাত্র সত্য বলে ধরার কোন কারণ নেই। আরো নানাভাবে হয়ত মানুষের আত্মবিনাশী কাজকে ব্যাখ্যা করা যায় এবং হয়ত সেগুলো বেশী যুক্তিযুক্ত হতে পারে । তথাপি, এই ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ন এবং তা চিন্তাশীলদের মানব প্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

 

রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পরা

 

অনেক আগের একটি জনপ্রিয় বাংলা গান আছে। যার কথাগুলো এরকম-

 

রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা

জলন্ত সিগারেট ঠোটে ধরা

লালশার্ট গায়ে তার বুক খোলা

সানগ্লাস কপালে আছে তোলা

রাখোনা কেন ডেকে ওই দুটি চোখ?

হে যুবক।

দৃষ্টিতে যেন সে রাসপুতিন

খুন হয়ে যাই আমি প্রতিদিন

নাম-ধাম জানিনা তার কিছু

তবুও নিলাম আমি তার পিছু

কালো সানগ্লাসটায় কেন এত সুখ?

হে যুবক।

রুক্ষ এলোমেলো চুল গুলোয়

মনটা চায় যেন হাত বুলোই

দু’হাতে আদর করি মুখটাকে

হৃদয়ে বেধেঁ রাখি সুখটাকে

তোমাকে দেখি শুধু না ফেলে পলক

হে যুবক।

এই গানের কথা লিখেছেন মিল্টন খন্দকার, সুরও করেছেন তিনি। গেয়েছেন ডলি সায়ন্তনী। গানে রাশিয়ার রহস্য পুরুষ রাসপুতিনের কথা এসেছে। তার সম্পর্কে নানা ধরনের কিংবদন্তী চালু আছে, বিশেষত নারীদের আকৃষ্ট করার তার রহস্যময় ক্ষমতা বিষয়ে।

সিগারেট খাওয়া একসময় চালু ফ্যাশনের মত ছিল। এটি সেই সময়ের গান। বর্তমানে অবস্থার বদল হয়েছে। এখন ফিল্মে সিগারেট খাওয়া দেখালে দর্শকদের সাবধান করে বানী দিতে হয়। ভারতের চিত্র পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ এর বিরোধীতায় মামলা পর্যন্ত লড়েছেন। তার কথা ছিল, সিগারেট বিরোধী প্রচারনা চালানোর দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, তাকে জোর করে এতে বাধ্য করানো হবে কেন?

রঙচটা জিন্সের প্যান্ট গানটিতে একজন যুবকের বর্ননা দেয়া হয়েছে। যিনি রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পরেছেন, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে, লাল শার্টের বোতাম খোলে রেখেছেন। তার সানগ্লাস কপালে তোলা। তার মাথার চুল রুক্ষ, এলোমেলো।

উপরোক্ত বর্ননায় যে যুবক, তিনি সাধারণ বিবেচনায় ভদ্র কোন যুবক নন বলেই মনে হয়। যিনি গানটা গাচ্ছেন, অর্থাৎ নায়িকা এই যুবকের প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন। রাসপুতিনের দিকে যেভাবে তৎকালীন রাশিয়ার সম্ভ্রান্ত নারীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেরকম। নায়িকা গানে বলছেন তিনি ঐ যুবকের পিছু নেন এবং তার যুবককে কী কী করতে ইচ্ছে করে ইত্যাদি।

এরকম গান বাংলায় অনেক হয়েছে যেখানে নায়ক নায়িকার সৌন্দর্য নিয়ে বলছে অথবা নায়িকার পিছু নিয়েছে গান গাইতে গাইতে। নায়কের সৌন্দর্য বিষয়ক গান বেশী নাই মনে হয়। এই কারণে রঙ চটা জিন্সের প্যান্ট একটি গুরুত্বপূর্ন গান বিবেচিত হতে পারে।

কিন্তু এই গানের প্রসঙ্গ এখানে আনার উদ্দেশ্য হচ্ছে সিগারেট। যেইসব ক্রাইটেরিয়া তাকে আকৃষ্ট করেছে, নায়িকা বলছেন তার মধ্যে সিগারেট এসেছে।  এটা গ্রহনযোগ্য এবং জনপ্রিয় গান তাই, বাস্তব জীবনের নায়িকাদের মনেও জ্বলন্ত সিগারেটের আকৃষ্টকারক ক্ষমতা গৃহীত হয়েছিল ধরে নেয়া যায়।

আমাদের সিগারেট খাওয়ার কারণ

“Every morning in Africa, a gazelle wakes up, it knows it must outrun the fastest lion or it will be killed. Every morning in Africa, a lion wakes up. It knows it must run faster than the slowest gazelle, or it will starve. It doesn’t matter whether you’re the lion or a gazelle-when the sun comes up, you’d better be running.” – African Proverb

একটা বনে আছে গ্যাজেল; যা এক ধরনের এন্টিলোপ এবং সিংহ। সিংহ গ্যাজেল শিকার করে খায়। আবার গ্যাজেল খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে। ফলে সেইসব গ্যাজেলই সিংহ শিকার করতে পারে যারা খুব স্লো। ধরা যাক, খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে এমন একটা গ্যাজেলের সাথে একটি সিংহ মুখোমুখি হলো। সেই গ্যাজেল নিশ্চিত জানে এই সিংহ তাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু সিংহ যদি তাকে দৌড়ায় তাহলে শক্তি ও সময়ের অপচয় হবে দুজনেরই।

এই অবস্থায় এমন কোন পথ অবলম্বন করতে হবে গ্যাজেলকে, যাতে সিংহকে আগেই বুঝিয়ে দেয়া যায়, “তুমি আমার সাথে দৌড়ে পারবে না। বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। অন্যত্র দেখো।”

সিংহকে এটা বুঝাতে গ্যাজেল সিগনালিং এর আশ্রয় নেয়। সে তখন খুবই অদ্ভুত একটা কাজ করে। খুবই আস্তে আস্তে দৌড়াতে থাকে। যেন সে হেলায় দৌড়াচ্ছে। এবং মাঝে মাঝে পা তুলে লাফ দিতে থাকে। এটা বিপদজনক। কারণ যেকোন সময় সে পড়ে যেতে পারে। আর পড়ে গেলে সিংহ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অর্থাৎ, মৃত্যু নিশ্চিত।

কিন্তু গ্যাজেল এই বিপদজনক কাজটিই করে। করে সিংহ কে বুঝায়, “দেখো, আমি এভাবে লাফিয়েও ব্যালেন্স রাখতে পারি। তুমি আমার সাথে পারবে না।”

এই অবস্থায় সিংহ দেখে গ্যাজেল ভয়াবহ ঝুঁকি নিচ্ছে। তখন তার বিশ্বাস জন্মে আসলেই ঐ গ্যাজেলটি খুব দ্রুত দৌড়ে পারদর্শী। একে ধরার চেষ্টা করে লাভ নেই। সে অন্যত্র চেষ্টা করতে চলে যায়। এই ধরনের বিশ্বাস জন্মানোর জন্য গ্যাজেলের জীবন-মরণ ঝুঁকিটি নিতে হয়। অন্যথায় সিংহ বিশ্বাস করবে না।

প্রাণীদের জন্য এমন দ্রুত সিগনালিং দরকার হয়।

আমোতজ জাহাবি নামে একজন ইজরাইলি বায়োলজিস্ট ১৯৭৫ সালে একটি পেপার পাবলিশ করেন, যাতে তিনি বলেন পুরুষ প্রাণীরা বিপদজনক ঝুঁকি নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে আকৃষ্ট করতে চায়। এটা তার এক সিগনালিং।

যেমন, পুরুষ ময়ুরের লম্বা সুদৃশ্য লেজ থাকায় তার কোন সুবিধা নেই। উপরন্তু এটি বিপদজনক। সে শিকারী প্রাণীর চোখে বেশী পড়বে। তার চলাফেরা, লাফ দেয়া, দৌড় ধীর হবে। কিন্তু এই লেজ দেখেই স্ত্রী ময়ুর তার দিকে আকৃষ্ট হয়। স্ত্রী ময়ুর বুঝতে পারে, এই ময়ুরের বড় লেজ আছে এবং তা নিয়ে সে সদর্পে টিকে আছে। অর্থাৎ তার জীন ভালো। এর দ্বারা ভালো সন্তান উৎপাদন সম্ভব। বার্ড অব প্যারাডাইজের ক্ষেত্রেও একই বৈশিষ্ঠ্য দেখা যায়। তারা নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে বিপরীত লিঙ্গকে সিগনাল দেয়, দেখো এগুলো করেও আমরা টিকে থাকতে পারি। আমাদের জীন ভালো। আসো আমরা আমাদের ভালো জীন ছড়িয়ে দেই।

আরো লেখাঃ মঞ্চের পেছনে জীন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে 

মানবের পুরুষ সন্তানেরা সিগারেটের দিকে আকৃষ্ট হয় সাধারণত টিনেজ বয়সে। এই বয়সে তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন জন্মে। ফলে, তার মধ্যে সিগনালিং এর প্রবৃত্তি জেগে উঠে।

সিগারেট খাওয়া তার এক আত্মবিধ্বংশী কাজ, এক সিগনাল প্রচেষ্টা। বিজ্ঞানী জ্যারেড ডায়মন্ড এভাবেই জাহাবির রিসার্চের উপর ভিত্তি করে মানব পুরুষের আত্মবিধ্বংশী কাজকে ব্যাখ্যা করেন।

পুরুষ ময়ুর
ছবিঃ পুরুষ ময়ুর

মানবের পুরুষ সন্তানেরা কবিতা লেখাও শুরু করে টিনেজ বয়সে। কবিতা বা আর্টিস্টিক কাজের প্রেরণাতেও বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করার একটা প্রবণতা কাজ করে। আর্টিস্টিক কাজ নানা ধরনের হয়, যেমন ছবি আঁকা, ভাস্কর্য ইত্যাদি। কিন্তু ওগুলোর চাইতে কবিতা লেখার চেষ্টাটা সহজ, তাই কবিতার প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। আর্ট বা তৈরী করার এই ক্ষমতা বিপরীত লিঙ্গকে সিগনাল দেয় এই ছেলের বুদ্ধিমত্তা আছে। সে ভবিষ্যতে সম্পদ তৈরী করতে পারবে, তার জীন ভালো।

 

 

জ্যারেড ডায়মন্ড  ও আমোতজ জাহাবি

জ্যারেড ডায়মন্ড একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী ও লেখক। অসাধারন এবং পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ন বুদ্ধিজীবিদের একজন। তার বই গানস, জার্মস এন্ড স্টিলের জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। থার্ড শিম্পাঞ্জি তার অসাধারন আরেকটি বই। থার্ড শিম্পাঞ্জির একটি ভার্শন আছে তরুন পাঠকদের জন্য। বইটি অবশ্যপাঠ্য।

জ্যারেড ডায়মন্ডঃ কীভাবে ধনী হওয়া যায় 

জ্যারেড ডায়মন্ড
ছবিঃ জ্যারেড ডায়মন্ড

 

আমোতজ জাহাবি একজন ইজরাইলি ইভ্যলুশনারি বায়োলজিস্ট। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন এবং সেখানকার জুলজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক। সোসাইটি ফর দি প্রটেকশন অব নেচার ইন ইজরায়েল এর একজন প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মেইট সিলেকশনঃ এ সিলেকশন ফর এ হ্যান্ডিকাপ তার প্রধান কাজ।

 

আমোতজ জাহাবি
ছবিঃ আমোতজ জাহাবি

 

 

শেষকথা

এই ধরনের ব্যাখ্যা মানব চরিত্র বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। অথবা আমাদের নিজেদের অভ্যাস বা কোন কাজ আমরা করি কেন। তা যে সব সময় শতভাগ সত্যি হবে এমন নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে  নিজেদের সম্পর্কে, নিজেদের কাজ সম্পর্কে আমরা আরো বেশী বুঝতে পারব, ভিন্ন ভাবে ভাবতে পারব। ফলে বাজে কোন অভ্যাস, অথবা আমাদের নিরন্তর বোকামি; যার মধ্যে মানবজাতি পতিত, তা থেকে হয়ত অল্প দূরে থাকতে পারব।

আরো পড়ুন, জব মার্কেট ও অর্থনীতিতে কিভাবে সিগন্যালিং কাজ করে।