দার্শনিক বজলু ও আমাদের দর্শন শিক্ষা

প্লেটো

আমাদের বন্ধু বজলুর রশীদ বজলু কীভাবে ফিলসফার হয়ে গেল তা বলা মুশকিল। অন্য কিছুর কারণ বলা গেলেও কে কীভাবে যে দার্শনিক হয়ে যায় তা বলা যায় না। বজলু দার্শনিক হয়ে যাবার আগে বাড়ি থেকে বের হতো না। ঘরদোর বন্ধ করে কীসব কঠিন বইটই পড়ত। তখন আমাদের ইন্টার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। বজলু কয় বিষয়ে যেন ফেল করেছিল আমার ঠিক মনে নেই। তবে এই ফেল এর ধাক্কার কারনে সে দার্শনিক হয়ে গেছে এমন ধারণা অবশ্য আমরা করি নি। বজলু একাডেমিক পড়ালেখাকে পাত্তা দেবার ছেলে না।

বজলু দার্শনিক হয়ে যাবার পরে আমরা মাঝে মাঝে ওর কাছে যেতে শুরু করেছিলাম দর্শন শিক্ষার জন্য। সে বলত, সবার জন্য দর্শন শিক্ষা জরুরী। আমাদেরও তাই মনে হত, বিশেষত যখন খারাপ অবস্থায় আমরা পড়ে যেতাম, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখতাম তখন আমরা দর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারতাম।

বজলু আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাত এবং তার অর্জিত জ্ঞান থেকে আমাদের শিখিয়ে ধন্য করত। বজলুর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন এখনো অব্যাহত আছে আমাদের।

শিবুর ঘটনা দিয়েই শুরু করি। একবার শিবু বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে গেল। লিখতে যখন বসেছি তখন লিখেই ফেলি যদিও ব্যাপারটা বেশ স্পর্শকাতর। একটা মেয়ের সাথে শিবুর বেশ রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল তখন। আমাদের উৎসাহে এবং তার শরীরস্থ হরমোনের প্রভাবে শিবু মেয়েটাকে নিয়ে রোমান্টিক সব স্বপ্ন দেখত। এরপরে একদিন সেই মেয়েটাকেই আরেকটা ছেলের হাত ধরাধরি করে হেটে যেতে দেখা গেল। দেখল শিবুই। তারপর থেকে তার “এ জীবন আর রেখে কী হবে” অবস্থা। আমরা তাকে বুঝালাম, হয়ত এই ছেলেটি মেয়েটির কোন ধরনের ভাই। কেউ কেউ বলল, হয়ত ছেলেটি অন্ধ, চোখে দেখে না। কিন্তু শিবু তো বুঝে না।

আমরা বুঝলাম শিবু তথা শিবরাম প্রসাদকে নিয়ে বজলুর কাছে যেতে হবে। বজলু ফিলসফার মানুষ। সে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই শিবু বুঝবে। আবার প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পাবে।

সেদিন আমরা গিয়ে দেখি বজলু একটা বই পড়ছে। আমাদের দেখে সে বই পাশে রেখে বেশ উদাসভাবে তাকাল। আমরা খুব দ্রুত শিবুর দুরাবস্থার কথা তার কাছে খুলে বললাম। বজলু সব শুনে বলল, বুঝেছি। হাত যখন ধরেছে, হেটেও গেছে তখন কারণ তো একটা আছেই। এটা নিয়ে একটা জোকস শুনাই তোদের।

এক আশি বছরের ভদ্রলোক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন, ডাক্তার আমার চব্বিশ বছরের বউ প্রেগনেন্ট। আমরা বাচ্চা প্রত্যাশা করছি।

ডাক্তার বললেন, তাহলে আপনাকে একটা গল্প বলি শুনেন। এক লোক গেল হরিণ শিকারে। কিন্তু বন্দুকের বদলে ভুল করে নিয়া গেল তার ছাতা। জঙ্গলে হরিণ দেখা মাত্র সে ছাতা খুলে মারল গুলি। তারপর পটাশ!

ভদ্রলোক বললেন, পটাশ কী?

বিরক্ত মুখে ডাক্তার বললেন, হরিনটা গুলি খেয়ে ধুম করে মরে গেল।

ভদ্রলোক বললেন, এটা অসম্ভব! নিশ্চয়ই আর কেউ গুলি করছে।

ডাক্তার বললেন, এটাই আপনারে বুঝাতে চাচ্ছি আমি। গুলি আর কেউ করেছে।

অর্থাৎ, গুলি যখন হয়েছে, হরিণও যেহেতু মারা গেছে এবং যেহেতু আমাদের শিকারীর হাতে বন্দুক নাই তার বদলে ছাতা, ফলে আর কেউ গুলি করছে এটা নিশ্চিত, যুক্তিমতে। এটাকে বলে আর্গুমেন্ট অব এনালজি

জোক শুনেও শিবু হাসে না। আমরা বজলুর দিকে তাকাই। আকারে ইংগিতে বুঝাই এই লাইনে বুঝালে শিবুর অবস্থা আরো খারাপ হবে। তাকে অন্য লাইনে বুঝাতে হবে। আমাদের ইশারা বুঝে বজলু তখন শিবুর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই সত্যি তো দেখেছিস ছেলেটার হাত ধরে মেয়েটা হেটে গেছে?”

শিবু বিরসমুখে বলে, হ্যা।

বজলু বলল, “এরপরে সিদ্ধান্ত নিলি ছেলেটির সাথে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক আছে?”

শিবু কিছু বলে না। তার চোখে জলের উপস্থিতি আমরা টের পাই।

বজলু উদাস হয়। সে বলে, “এটা হলো ইন্ডাকটিভ লজিক। কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করে জেনারালাইজ সিদ্ধান্ত নেয়া। শার্লক হোমস এরকম করত।”

উপস্থিত আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। এমনকী শিবুও। কারণ শার্লক হোমসে আমরা পড়েছি ওর পদ্বতির নাম ডিডাকশন।

আমি বললাম, “কিন্তু হোমসেরটা কী সাইন্স অব ডিডাকশন ছিল না?”

বজলু বলল, “ওটা লিখেছিলেন বোধহয় লেখক। কিন্তু হোমসের ওটা ডিডাকটিভ লজিক নয়, ইনডাকটিভ লজিক। তোদের বুঝানোর জন্য একটা জোক বলি।

বজলু বলতে শুরু করে, একবার শার্লক হোমস আর ওয়াটসন বেড়াতে গেছেন। তারা ঘুমিয়েছিলেন রাতে। হঠাৎ মাঝরাতে শার্লক খোঁচা দিয়ে ওয়াটসনকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয় ওয়াটসন, উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে বলো তুমি কী দেখতে পাও?”

ওয়াটসন তাকিয়ে বললেন, আমি লাখ লাখ তারা দেখছি।

এবং এ থেকে তুমি কী সিদ্ধান্তে আসলে?

ওয়াটসন এক মুহুর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে আমি বুঝতে পারছি মিলিয়ন গ্যালাক্সি এবং প্রায় বিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্র, জ্যোতিষবিদ্যার দিক থেকে দেখলে বুঝতে পারছি শনি সিংহ বলয়ের কাছে, সময়ের কথা চিন্তা করলে বলা যায় এখন প্রায় তিনটা বাজে, আবহাওয়াবিদ্যার দিক থেকে দেখলে বলা যায় আগামী কাল বেশ রৌদ্রজ্জ্বল দিন হবে, আর ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে দেখলে আমি দেখছি সৃষ্টিকর্তার মহান বিস্তৃত সৃষ্টি। তার সামনে আমরা কত ক্ষুদ্র। তা তুমি কী বুঝতে পারছো হোমস?

শার্লক হোমস বললেন, বুরবক! আমাদের তাবু চুরি হয়ে গেছে!

শার্লক এইভাবে সিদ্ধান্তে আসে। এটাকে ইন্ডাকটিভ লজিক বলে।

শিবুর লজিকও একইরকম। সে মেয়েটাকে একটা ছেলের হাত ধরে যেতে দেখে একটা সিদ্ধান্তে চলে গেছে। জেনারালাইজ একটি সিদ্ধান্ত। তা সত্যি কী না আমরা জানি না।

বজলুর কথা শেষ হলে দেখলাম শিবু বেশ নড়েচড়ে বসেছে। আমাদের আব্দুস সালাম একটা প্রশ্ন করল বজলুকে, “তাহলে ডিডাকটিভ লজিক কীরকম?”

বজলু বলল, “এটা এমন, সব মানুষ মরণশীল। সক্রেটিস একজন মানুষ। অতএব, সক্রেটিস মরণশীল।”

আব্দুস সালাম বলল, “এটা ঠিকই আছে।”

বজলু বলল, “ঠিক আছে। তবে এটার ভুল ব্যবহার ভুল যুক্তি তৈরী করে। যেমন, কেউ যদি বলে, সব মানুষ মরণশীল। সক্রেটিস মরণশীল। অতএব, সক্রেটিস মানুষ। এই যুক্তি হয় না। কারণ জগতে অনেক মরণশীল জিনিস আছে, যা মানুষ নয়। যেমন, একটা ছাগলের বাচ্চা।”

বজলুর আলোচনায় আমাদের উৎসাহ বাড়ে। এইসময় শিবু আস্তে করে বজলুকে একটা প্রশ্ন করে বসে, “তাহলে তুই বলছিস ইনডাকটিভ লজিক ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে আসা ঠিক না?”

বজলু বলে, উনিশ শতকের দার্শনিক কার্ল পপার ইন্ডাকটিভ লজিকের সমালোচনা যা করেছিলেন, তা একটা কৌতুকের মাধ্যমে বলি তোদের। বুঝবি ভালো।

দুই বন্ধু নাস্তা তৈরী করছে। এক বন্ধু বলল, একদিকে বাটার লাগানো ব্রেড হাত থেকে পড়লে বাটার লাগানো অংশই মেঝের দিকে পড়ে। এটা দেখেছিস কি?”

দ্বিতীয় বন্ধু বলল, “দূর! এসব ভুয়া কথা। বাটার লাগানো অংশ মেঝের দিকে পড়লে পরিষ্কার করতে অসুবিধা। তাই ওটা মানুষের বেশী মনে থাকে। ফলে মানুষের এমন ধারণা হয়েছে সব সময় বাটার লাগানো অংশই নিচের দিকে পড়ে।

প্রথম বন্ধু বলল, “তাহলে প্রমান হয়ে যাক। এই দেখ…বলে সে তার একদিকে বাটার লাগানো ব্রেড নিচে ফেলে দিল।

কিন্তু বাটার লাগানো অংশ নিচের দিকে পড়ল না। অন্য অংশই মেঝের দিকে মুখ করে পড়েছিল।

দ্বিতীয় বন্ধু বলল, “দেখলি তো। আমি আগেই বলেছিলাম।”

প্রথম বন্ধু বলল, “আরে না, আমি ঠিক বলেছি। এবার শুধু আমি ভুল দিকে বাটার লাগিয়েছিলাম।”

জোক বলে একটু থেমে বজলু বলল, খেয়াল করে দেখ, দ্বিতীয় বন্ধু যে লজিক দিয়েছে তা এতই ভ্রান্ত যে এটা ভুল প্রমাণ করার জায়গাই সে রাখে নি। অর্থাৎ এটি লজিকই হয় নি। এর দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌছা যায় না বাটার লাগানো অংশ সবসময় নিচে পড়ে।

বজলুর আলোচনা শোনে শিবু যেন একটু বুঝতে পারল তার সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে। হতে পারে ঐ ছেলেটি মেয়েটির কোন ধরনের আত্মীয়। হয়ত তারা অন্যভাবে হাত ধরাধরি করে গিয়েছিল। হয়ত এটা থেকে এমন কোন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না ঐ ছেলেটির সাথে মেয়েটির কোন প্রেমের সম্পর্ক আছে। শিবুর মুখ থেকে অল্প অল্প করে কেটে যেতে থাকল দুঃখের ছায়া।

সেদিন আমরা বজলুর বাসা থেকে ফিরে আসার সময় বজলু শিবুর কাধে হাত রেখে বলল, “যা দেখা যায় তা থেকে সিদ্ধান্তে চলে আসা ভুল হতে পারে। একসময় মনে করা হত পৃথিবীর সব সোয়ান বা রাজহাঁস হচ্ছে শাদা। তারপর হঠাৎ একদিন এক দ্বীপে আবিষ্কার হলো কালো রাজহাঁস। সেদিন থেকে বুঝা গেল সব রাজহাঁস শাদা না, পূর্বের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।”

 

                   —————-গল্প সমাপ্ত—————————-

প্লেটো

প্লেটো এন্ড এ  প্লাটিপাস ওয়াক ইন টু এ বার বইয়ে কৌতুকের মাধ্যমে দর্শন বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই বইটা পড়ার পর এরকম কিছু একটা লেখার ইচ্ছা হয়েছিল। উপরিউক্ত গল্পখানা এই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এই গল্পখানা লেখার পরে এক বন্ধুর অতি অনুরোধের কারণে একটি রম্য মিডিয়ায় দিতে হয়। সে ঐটার সাথে কিছুটা যুক্ত। কিন্তু রম্যের সম্পাদক সম্ভবত একে প্রকাশের মত মনে করেন নাই (কারণ এতে হাসার মত কিছু নাই সম্ভবত), তাই এখনো ঐ প্ল্যাটফরমের মারফতে বহিঃর্বিশ্বের মুখ দেখে নাই গল্পটি। তো আমি ভাবলাম আর দেরী করে লাভ নাই, অপ্রকাশিত গল্প রাখলে কামড়ায়। তারা নিয়ত এইরকম অভিযোগ করতে থাকে,  আমি কি প্রকাশের যোগ্য না, আমারে প্রকাশ করবেন কবে? আমি বহিঃর্বিশ্ব দেখতে চাই, ধুলায় মাটিতে খেলাধুলা করতে চাই, ইত্যাদি। এই অভিযোগ থেকে বাঁচতেই এখানে প্রকাশিত হইল।