বার্নে, ফ্রয়েড ও মহিলাদের সিগারেট খাওয়া

ফিল্মে দেখবেন নারী স্বাধীনতা দেখাতে দেখানো হয় নারীরা সিগারেট খাচ্ছেন। খুবই ভালোভাবে এটা দেখা যায় ভারতীয় বাংলা ফিল্ম গয়নার বাক্সে। তিনটা জেনারেশনের মহিলারে দেখানো হয়েছে সেই ফিল্মে। শেষ জেনারেশনের মহিলা যিনি, তিনি স্বাধীন। তার স্বাধীনতা বুঝাতে তার সিগারেট টানা দেখানো হয়। স্মৃতি থেকে বললাম।

আরো অনেক ফিল্মে এমনটা দেখা যায়। কিন্তু এটা কেন?

এডওয়ার্ড বার্নে হলেন বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাগনা। তিনি ফ্রয়েডের অবচেতন বা আনকনশাস ডেজায়ারের তত্ত্বাবলী মানুষের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। নিয়ন্ত্রণ বলতে পন্য বিক্রির জন্য ম্যানিপুলেশন।

প্রোপাগান্ডা শব্দটি জর্মনরা ব্যবহার করে এর খারাপ একটা ভাবমূর্তি তৈরী করেছে। বার্নে এর জন্য তার কর্পোরেট ম্যানিপুলেশনের নাম দিয়েছিলেন পাবলিক রিলেশন। এখনো তা আছে। এডওয়ার্ড বার্নেকে বলা হয় পাবলিক রিলেশনের ফাদার।

আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির চেয়ারম্যান জর্জ হিল একবার গেলেন এডয়ার্ড বার্নের কাছে। সমাজে নারীদের সিগারেট খাওয়ারে খারাপ হিসেবে দেখা হত তখন। জর্জ হিল বার্নেকে গিয়ে বললেন, “আমাদের অর্ধেক মার্কেট হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কারণ পুরুষেরা নারীদের পাবলিকলি সিগারেট খাওয়ার উপরে সামাজিক আপত্তি দিয়া রাখছে। আপনি কি আমাদের হেল্প করতে পারেন এই বিষয়ে?”

বার্নে বললেন, “আমারে চিন্তা করতে দেন।”

এরপরে তিনি বললেন, “একজন সাইকোএনালিস্টের এর কাছ থেকে জানতে হবে  মহিলারা সিগারেটরে কী হিশাবে দেখেন। এতে আপনার আপত্তি আছে কি?”

টোবাকো কোম্পানির কোম্পানির চেয়ারম্যান বললেন, “খরচ কত লাগবে?”

এডওয়ার্ড বার্নে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে সেরা সাইকোএনালিস্ট এ এ ব্রিলকে হায়ার করলেন। মোটা অংকের বিনিময়ে ঐ ভদ্রলোক তার রিপোর্ট দিলেন। তিনি বললেন, “সিগারেট হইতেছে পুরুষাঙ্গ বা পুরুষ যৌন ক্ষমতার প্রতীক। তাই সিগারেটরে যদি পুরুষ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে এর বিপরীতে নিয়া দেখানো ও প্রচার করা যায় তবেই মহিলারা সিগারেট খাইবেন বেশী। কারণ তখন সিগারেটটাই হয়ে যাবে মহিলাদের পুরুষাঙ্গ বা ঐ ক্ষমতা।”

প্রতি বছর নিউ ইয়র্কে ইস্টার ডে প্যারেড হত। হাজার হাজার লোক সমবেত হতেন সেখানে। বুদ্ধিমান ম্যানিপুলেটর এডওয়ার্ড বার্নে এক বুদ্ধি বের করলেন। তিনি সেখানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। একদল ধনী ইয়াং মহিলারে তিনি সেট করলেন, যারা সেখানে বসে তাদের কাপড়ের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করবে এবং তার সিগনাল পেয়ে খুবই নাটকীয়ভাবে সিগারেটে আগুন ধরাবে ও ধুম্রপান করবে প্রকাশ্যে।

বার্নে প্রেসরে জানালেন যে তিনি খবর পেয়েছেন একদল মহিলা সমঅধিকারের প্রতিবাদ হিসেবে এইভাবে সিগারেট খাবেন প্রকাশ্যে এবং এই সিগারেট এর নাম দিলেন তিনি “স্বাধীনতার মশাল” (টর্চেস অব ফ্রীডম)।

তিনি জানতেন এই ধরনের ঘটনায় একটা হইচই হবে। মিডিয়া, ফটোগ্রাফার উপস্থিত থাকবে। তাই তিনি স্বাধীনতার মশাল নামক স্লোগানটিও তৈরী করে দিলেন।

মনিকা বেল্লুচ্চি
মেলেনা ছবির একটি দৃশ্য।

পরদিনের পত্রিকাতে ঘটনাটির খবর ফলাও করে প্রচার হলো। নারী স্বাধীনতা পক্ষে, স্বাধীনতার মশাল হিসেবে জায়গা করে নিল সিগারেট। আর বাড়তে লাগল নারীদের সিগারেট খাওয়া।

মানুষের ভেতরের, তার অবচেতনের ডেজায়ারগুলি ম্যানিপুলেট করে তারে এমন জিনিসের ভোক্তা বানানো যায়, যার কোন দরকারই নাই তার। এডওয়ার্ড বার্নে এই বিষয়ে ছিলেন একজন এক্সপার্ট বিশেষ, এবং প্রথম সফল একজন। আগেই বলেছি তাকে বলা হয় পাবলিক রিলেশনের ফাদার। অস্ট্রিয়ান সাইকোলজিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড ছিলেন একদিকে তার মামা আর অন্যদিকে ফুফা। ফ্রয়েডের সাথে তার যোগাযোগ ছিল সবসময়। তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্বাবলী দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি নিজেকে ভাবতেন দুর্দশাগ্রস্ত কর্পোরেশনের জন্য একজন সাইকোএনালিস্ট। তার চিন্তা সব সময় ছিল হাজার হাজার মানুষ নিয়ে, অর্থাৎ ক্রাউড সাইকোলজি। এক্ষেত্রে তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্ব ব্যবহার করেন কার্যকরভাবে এবং  এর মাধ্যমে আমেরিকায় একটি কনজিউমারিস্ট কালচার গড়ে তুলতে বিশাল অবদান রাখেন। বিবিসি’র ডকুমেন্টারী সেঞ্চুরী অব দ্য সেলফের প্রথম পর্ব হ্যাপিনেস মেশিন তার এসব কার্যাবলী নিয়েই।

ফ্রয়েডের বই আমেরিকা থেকে এডয়ার্ড বার্নে-ই প্রকাশ করেছিলেন। মামা ফ্রয়েডকে তিনি রয়ালটি পাঠিয়ে দিতেন। প্রচারনার জন্য তিনি ফ্রয়েডকে আমন্ত্রণ জানান আমেরিকা ভ্রমণে আর পত্রিকায় “বাড়িতে স্ত্রী’দের মানসিক অবস্থা” “একজন শিশু কী ভাবে” ইত্যাদি প্রবন্ধ লিখতে বলেন, ৩০০০ শব্দ, প্রতিটি ১০০০ ডলার। ফ্রয়েড এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

 


আরেকটি লেখাঃ আমরা সিগারেট খাই কেন?