অন্যের লেখা নিজের নামে মাইরা দেয়ার চুরিকে বলা হয় বাংলায় কুম্ভীলক বৃত্তি। ভাষা সেবক হিসেবে একে কুম্ভীলকতা বলতে পারি। কুম্ভীলক নামটি এলো কোথা থেকে বুঝতে পারলাম না। কুম্ভ মানে কলস, ঘট। কুম্ভকার মানে কুমার বা কুম্ভ নির্মাতা। কুম্ভশাল মানে কুমোরশাল। কুম্ভক শ্বাসরোধমূলক যোগসাধনা বিশেষ। কুম্ভকর্ন রাবণরাজের ছোট ভাই যে ছয়মাস ঘুমাত, এবং যাকে আমরা অনুসরন করতে চাই প্রায়ই।
এই শব্দ গুলির সাথে কুম্ভিল বা কুম্ভীলকের মিল পাওয়া যায় না। কুম্ভীলকের পেছনের গল্পটা জানা যেতে পারলে ভালো লাগত। ইংরাজিতে একে বলে প্লেজিয়ারিজম বা প্লেজারিজম।
স্ল্যাভো জিজেক একবার কট খেয়েছিলেন প্লেজিয়ারিজমে বড় অদ্ভুতভাবে। ২০১৪ এর সেপ্টেম্বরে, তখন আমি জিজেক নিয়ে জানতে শুরু করেছি। ক্রিটিক্যাল থিওরীতে নিউজটা পাই। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি আর্টিকেল লেখছিলেন, আইসিস ইজ এ ট্রু ডিসগ্রেস টু ফান্ডামেন্টালিজম। তার পয়েন্ট ছিল আইসিস ছহী ফান্ডামেন্টালিস্ট হইতে পারল না। তিনি আমিশ আর তিব্বতীয়ান বৌদ্ধদের সাথে তুলনা করে দেখাইছিলেন। আইসিস বিষয়ে এটা একটা গুরুত্বপূর্ন ও ব্যতিক্রমী লেখা। যাইহোক, সেই লেখায় কিছু প্যারাগ্রাফ তিনি তার নিজেরই পূর্ব প্রকাশিত বই ভায়োলেন্স থেকে তুলে দিয়েছিলেন। এনওয়াই টাইমসের কিছু পাঠক তা ধরতে পারেন ও জানান প্রতিক্রিয়ায়। ফলে পত্রিকাটি জানায় এমন জানলে তারা প্রকাশ করতো না লেখাটি। এই ঘটনা নাম পায় সেলফ-প্লেজিয়ারিজম নামে।
বলা বাহুল্য, স্ল্যাভো জিজেক এতে অবাকই হন।
এর আগেও দুইবার জিজেকের নামে অভিযোগ উঠে, তবে সেগুলি ছিল কেয়ারলেস মিসটেক। এ নিয়ে বলতে গেলে চমস্কি জিজেকের তর্কযুদ্ধের কথা আসে। লিংগুইস্টিক এবং এনার্কিস্ট নোম চমস্কি ক্রিটিক্যাল থিওরীস্টদের পছন্দ করেন না। জ্যাক লাকা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, সেলফ এওয়ার চারলাটান। বাংলায় হয়ত, আত্মসচেতন হাতুড়ে চিকিৎসক।
তার অভিযোগের প্রধান হলো, কন্টিনেন্টাল এই থিওরিস্টেরা কী বলেন তা তিনি বুঝতেই পারেন না। তাদের হাত পা নাড়িয়ে কথা বলা, মুখ চোখের ভাব ভঙ্গী এগুলি তার কাছে মনে হয় এম্পটি পশ্চারিং। তারা বড় বড় দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করেন, এবং এগুলির অর্থোদ্ধারই করা যায় না। জিজেক সম্পর্কে কী ভাবেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এইতো চূড়ান্ত উদাহরন, তার কথার মধ্যে আমি কিছু দেখি না।
ইন্টারভিউটা প্রকাশ হয় ২০১২ সালে, ভেটেরান্স আনপ্লাগড সাইটে। চমস্কি জ্যাক লাকা সম্পর্কে এভাবে বলেন, অনুবাদ করলামঃ
‘জ্যাক লাকার সাথে আসলে আমার পরিচয় ছিল। তাকে একরকম পছন্দই করতাম। দেখা স্বাক্ষাত হয়েছে কিন্তু সত্যি বলতে আমি তাকে আপাদমস্তক হাতুড়ে ডাক্তারই ভেবেছি, টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী করছে, যেমন প্যারিসের অনেক বুদ্ধিজীবিরা করে থাকেন। কেন যে এই বস্তু এত ইনফ্লুয়েনশিয়াল, আমার বিন্দুমাত্র বুঝে আসে না। এগুলিতে ইনফ্লুয়েনশিয়াল কিছু আমি দেখি না।’
লাকা কীভাবে লেকচার দিতেন তা এই ভিডিও দেখলে ধারনা পাওয়া যাবে।
লাকা’কে চমস্কির চারলাটান বলা অবশ্য কেবল ২০১২’র ঘটনা নয়, ১৯৯৫ সালেই তিনি এমন বলেছিলেন। যাইহোক, ২০১২ এর সেই ইন্টারভিউ এর পরে জিজেক প্রতিউত্তর দিলেন। চমস্কির সমালোচনার পয়েন্ট ছিল জিজেক-লাকা এদের এম্পিরিক্যাল কোন পয়েন্টই নাই। অর্থাৎ, বিজ্ঞান, তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক অবস্থান।
জিজেক উত্তরে বলেন, চমস্কির প্রতি আমার সব সম্মান রেখেই বলছি, যদিও তিনি আমাদের এম্পিরিক্যালি তথ্য উপাত্ত দিয়ে ঠিক হতে বলেন, লাকানিয়ান অনুমান ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার কথা বলেন কিন্তু বর্ননায় তার মত এমন এম্পিরিক্যালি রং মানুষ আমি কমই দেখেছি!
কম্বোডিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির ফলোয়ার খেমার রাগদের নিয়ে চমস্কির লেখার সমালোচোনা করে তিনি বলেন ঐ লেখাটি এম্পিরিক্যালি রং এর দারুণ উদাহরণ। খেমার রাগকে তিনি ডিফেন্ড করেন এই বলে যে এগুলি পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা। কিন্তু পরে যখন তিনি মানতে বাধ্য হলেন খেমার রাগ অত ভালো ছিল না, তখন তিনি আবার উলটা পথ ধরলেন, বললেন যে তখনকার সময়ে আমাদের কাছে যা ডাটা ছিল সে অনুযায়ী ঐ অবস্থান ঠিক ছিল। তাই আমরা জানতাম না। জিজেক বলেন এই লাইনের চিন্তা তিনি পুরোপুরি প্রত্যাখান করেন।
চমস্কি এর প্রতিউত্তরে বলেন, জিজেক যা বলেছেন তা ভুল, ঐ লেখায় এমন কিছুই পান নি জিজেক যা এম্পিরিক্যালি রং। তিনি বলেন, জিজেক কাল্পনিক কথা বলেন, এবং ২০০৮ সালে আমার কথা নামে একটি রেসিস্ট কথাও প্রচার করেছেন কিন্তু আমি তখন প্রতিবাদ করতে আগ্রহ বোধ করি নি, যদিও হার্পার ম্যাগাজিনের সম্পাদক স্যাম স্টার্ক জিজেকের সাথে যোগাযোগ করেন। তখন জিজেক বলেন যে তিনি আমার নামে ঐ কথা স্লোভানিয়ান এক পত্রিকায় পেয়েছেন! এক অতি অসাধারন সোর্স, যদি আদৌ তা থেকে থাকে!
এই হলো জিজেকের নামে আরেক প্লেজিয়ারাজিমের উদাহরণ। তবে এটা সাধারণ প্লেজিয়ারিজম নয়, মিসকোটও নয়, একেবারে ভুল কথা মুখে বসিয়ে দেবার মত অভিযোগ। তাও চমস্কির মত ব্যক্তির অভিযোগ।
জিজেক অবশ্য এর উত্তরে বলেন এজন্য তিনি আগেই ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি মন্তব্যটি স্লোভানিয়ান মিডিয়ায় পেয়েছিলেন, এবং মনে করেন না এটি রেসিস্ট।
কুম্ভীলকতা নিয়ে লেখতে গিয়ে এই তর্কযুদ্ধের বা বক্তব্য-পালটা প্রতিক্রিয়ার কথা আসল। আগ্রহীরা আরো দেখতে পারেন বিস্তারিত।
শেষকথা হলো, কুম্ভীপাক একটি নরকের নাম হিন্দু শাস্ত্রমতে। যারা আসলেই লেখা চুরি করে, অন্যের লেখা হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দেন তাদের স্থান এই নরকে হবে কি না জানি নে।