কোন মানুষ দূর্ভাগ্যে পতিত হলে অন্য বেশীরভাগ লোকেরাই বলে থাকে বা বিশ্বাস করে দূর্ভাগ্যবান লোকটি নিশ্চয়ই অতীতে কোন খারাপ কাজ করেছিল। এই খারাপ কাজের ফলস্বরূপ সে দূর্ভাগ্যে পতিত হয়েছে। অর্থাৎ, এই দূর্ভাগ্য তার প্রাপ্য ছিল।
আমরা ধরে নেই পৃথিবীতে একটা ন্যায্য বা ন্যায় ব্যবস্থা আছে। যেখানে যে খারাপ কাজ করে সে শাস্তি পায় এবং যে ভালো কাজ করে সে পুরস্কৃত হয়। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে রূপকথার গল্প দাঁড় করানো, সাহিত্য ফিল্মের বেশীরভাগ গল্পই এই প্যাটার্নের।
কিন্তু এই ধারনাটি আমাদের একটি বিভ্রান্তি। পৃথিবী ন্যায় নয়। এখানে খারাপ কাজের জন্য কেউ শাস্তি পাবে, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার পাবে এমন হয় না সব সময়। বেশীরভাগ লোকেই খারাপ কাজ করে পার পেয়ে যায়। প্রচুর লোক ভালো কাজ করেও দূর্ভাগ্যে পতিত হয়।
সোশ্যাল সাইকোলজিতে আমাদের এই বিভ্রান্তিকে “জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফ্যালাসি” বা “ন্যায্য পৃথিবীর বিভ্রান্তি” বলে ডাকা হয়।
১৯৬৬ সালে মেলভিন লার্নার ও ক্যারোলিন সিমনস ক্লাসিক একটি পরীক্ষা করেন। ৭২ জন মহিলাকে দেখানো হলো আরেকজন মহিলা একটি কাজ করতে গিয়ে ভুল করলে বৈদ্যুতিক শক খাচ্ছেন।
বৈদ্যুতিক শকের মাত্রা বাড়তে থাকে, এবং মহিলাটি চিৎকার করতে থাকেন। (আসলে এটি সত্যি ছিল না অভিনয় ছিল, কিন্তু যারা দেখছিলেন তারা জানতেন সত্যি সত্যি হচ্ছে।)
যারা দেখছিলেন তারাই ছিলেন পরীক্ষার সাবজেক্টস। এদেরকে যখন অপশন দেয়া হলো যে তারা পরীক্ষাটি বদলাতে চান কি না তখন বেশীরভাগেই বৈদ্যুতিক শক বন্ধ করে দিতে চাইলেন। অর্থাৎ, তারা অমানবিক মানুষ ছিলেন না। স্বাভাবিক মানবিক মানুষই ছিলেন।
কিন্তু যখন তাদের এরকম কোন অপশন দেয়া হলো না তখন সম্পূর্ন ভিন্ন একটি ব্যাপার দেখলেন মেলভিন লার্নার। সাবজেক্টস অর্থাৎ, সেই ৭২ জন মহিলা যখন ভোক্তভোগীর দুরাবস্থা পরিবর্তন করতে পারছেন না, তখন তারা ধরে নিতে থাকলেন এ শাস্তি ঐ মহিলাটির প্রাপ্য ছিল।
পরীক্ষকেরা ঐ শক খাওয়া মহিলাকে মূল্যায়ন করতে বললেন দেখতে থাকা ৭২ জনকে। বেশীরভাগেই মহিলাকে খারাপভাবে মূল্যায়ন করলেন। যদিও তাদের কাছে কোন প্রমাণ ছিল না তথাপি তারা ধরে নিলেন মহিলাটির প্রাপ্য ছিল এ শাস্তি।
লার্নার এই পরীক্ষাটির আইডিয়া পেয়েছিলেন মানসিক অসুস্থদের হাসপাতালে কাজ করার সময়। তিনি দেখেছিলেন তিনিসহ অন্য ডাক্তার, নার্স, আর্দালী এরা মানসিক ভাবে অসুস্থ রোগীদের দূর্ভাগ্য নিয়ে অনেক সময় মজা করে, অনেক সময় তাদের অপমানও করে। যদিও এই ডাক্তারেরা এবং অন্যসব সহকারীরা অমানবিক মানুষ ছিলেন না। মানবিক মানুষই ছিলেন। তবুও তারা এমন আচরণ কেন করেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই লার্নার পরীক্ষাটি করেছিলেন।
লার্নার পরীক্ষার উপসংহারে বলেন, যখন আমরা কোন অন্যায় বা দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতে দেখি তখন তা সমাধান করতে চাই। কিন্তু যখন দেখা যায় সমাধান আমাদের হাতে নেই তখন আমাদের যে ন্যায্য বা ন্যায় পৃথিবীর ধারণা আছে তা বজায় রাখতে ভাবতে থাকি যে দূর্ভাগ্যপীড়িত লোকটি কোনভাবে দোষী। আমরা একটি ব্যাখ্যা চাই, এবং সে ব্যাখ্যা আমরা তৈরী করি যাতে আমাদের ন্যায় পৃথিবীর ধারণাটি অক্ষুন্ন থাকে।
লার্নার সমাজ ও মেডিসিনের ক্লাস করাতেন ছাত্রছাত্রীদের। তিনি দেখতে পান যে ছাত্রছাত্রীরা মনে করে গরীব লোকেরা হচ্ছে “অকর্মা ও অলস” তাই তারা গরীব। অর্থাৎ দারিদ্রতা তাদের প্রাপ্য।
এ থেকে লার্নার আরেকটা পরীক্ষার আইডিয়া পেলেন। দুটি লোক একটি কুইজের সমাধান করল। শেষে তাদের মধ্যে একজনকে সম্পূর্ন দৈবচয়নে বড় অংকের টাকা পুরস্কার দেয়া হলো।
দর্শকদের বলা হলো যে, পুরস্কার লটারী তথা দৈবচয়নে দেয়া হয়েছে।
এরপর এই দুজনকে মূল্যায়ন করার জন্য বলা হলো দর্শকদের।
দেখা গেল বেশীরভাগ দর্শকেরা পুরস্কার প্রাপ্ত লোককে বেশী প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান, কুইজ সমাধান করতে বেশি পারদর্শী ইত্যাদি বলছেন। লার্নার এ নিয়ে আরো অনেক কাজ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
লার্নারের পরে এ নিয়ে আরো গবেষণা হয়েছে, এবং আমাদের এই ন্যায় পৃথিবী জনিত বিভ্রান্তির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যাক রুবিন ও লেটিটিয়া এন সার্ভে চালিয়ে দেখতে চেয়েছেন যারা ন্যায় পৃথিবীতে বিশ্বাস করে তাদের বৈশিষ্ট্য কেমন। তারা দেখতে পেয়েছেনঃ
১। যাদের ন্যায় পৃথিবীর ধারণা যত শক্ত তারা তত বেশী ধর্মানুসারী।
২। তারা বেশী অথোরিটারিয়ান।
৩। বেশী কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল।
৪। তারা রাজনৈতিক নেতাদের গুণকীর্তনে বেশী সচেষ্ট।
৫। সমাজে বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যাপারে তারা সন্তুষ্ট এবং এর গুণকীর্তনে সচেষ্ট।
৬। দূর্ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খারাপ।
৭। এবং সমাজ পরিবর্তনের কাজে জড়াতে বা সামাজিক সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য কিছু করার প্রয়োজন তারা কম অনুভব করে।
২০০৯ সালের একটা স্টাডিতে দেখা যায়, হলোকাস্টের স্মৃতিচারনা ইত্যাদি ইহুদিবিদ্বেষ বাড়াতে পারে। যখন মানুষ এমন হিংস্র নির্যাতনের ইতিহাস জানতে পারে, তখন অন্য কোনভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে না পেরে গড়ে ধরে নেয় হয়ত এই ইহুদি লোকগুলি কোনভাবে দোষী ছিল।
পৃথিবী ন্যায় নয় এই সত্য মানুষের জন্য অস্বস্থিকর। তাই তারা কর্ম এবং কর্মফল জনিত বিভ্রান্তির মাধ্যমে এই সত্য দেখতে চায় না। মানুষ নিরাপত্তার অনুভূতি চায়, সে ভাবতে চায় যে সে যেহেতু খারাপ কিছু করছে না তাই সে দূর্ভাগ্যে পতিত হবে না।
যারা দূর্ভাগ্যে পতিত হয়েছে, যে রেইপের ভিক্টিম হয়েছে বা অন্য কোন দূর্ঘটনা, সেক্ষেত্রে তার কোন দোষ ছিল এটা ভেবে মানুষ স্বস্তি পেতে চায়।
এই স্বস্তি যে, সে যেহেতু এইসব কাজ করে নি তাই তার এমন দূর্ভাগ্য হবে না।
মানুষ মনে করতে চায় সফলতা আসে কঠোর পরিশ্রম এবং ভার্চ্যু বা সদগুণের ফলে। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে এমনটা সত্য নয়। সফলতার জন্য কোন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণীতে, কোন সময়ে ও কোন স্থানে জন্ম হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ন। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এই ফ্যাক্টরগুলো বদলানো সম্ভব নয়।
কঠোর পরিশ্রম ব্যতিরেকে ধান্দাবাজী দিয়ে এই দুনিয়ার সমাজে সফলতা বলে যে ধারণা আছে সেটি কেউ অর্জন করতে পারে। এবং প্রায়ই তা হয়ে থাকে। কিন্তু এর জন্য ঐ ধান্দাবাজ বা অন্যায়কারীকে কোন শাস্তি পেতে হয় না প্রায়ই। বরং তখন অন্য মানুষেরা ন্যায় পৃথিবীর বিভ্রান্তিতে পড়ে ভাববে যে লোকটি নিশ্চয়ই পরিশ্রম করেছে, সাধনা করেছে, তার সদগুণ আছে, সে প্রতিভাবান; তাই সে আজ এগুলি অর্জন করে নিল।
জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফ্যালাসি আমাদের মারাত্মক একটি বায়াস। যার জন্য দূর্ভাগ্যবান ভালো মানুষদের আমরা খারাপ মনে করি ও একরকম ঘৃণা করি। এবং ধান্দাবাজ সফলদের ক্ষেত্রে মনে করি তারা নিশ্চয়ই ভালো কাজ করেই সফল হয়েছে।
এই ফ্যালাসি থেকে সচেতন থাকা দরকারী।
কেউ দূর্ভাগ্যে পতিত হলে আমরা যেন মনে না করি অতীতে সে ভয়ানক কোন দুষ্কর্ম করেছিল তাই তার ফল পেল সে। এরকম ভাবলে তা হবে ভুল চিন্তা, এবং অনৈতিক চিন্তা।
ইমেজঃ জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফ্যালাসি; Source: Theemotionmachine.com