দ্য ব্রাদারসাম ম্যান (২০০৬) একখান নরওয়েজিয়ান ফিল্ম, যা আমি আজ (জানু ৮, ২০১৮) রাতে দেখি। এই ফিল্মের মূল চরিত্র আন্দ্রেজ। আন্দ্রেজ এমন একটা দুনিয়ায় বাস করে, যে দুনিয়ার সব লোকই সুখী। তারা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে (যেমন, সোফা কিনা) নিয়ে সুখী হাসাহাসি করে, গল্পগুজব করে, কর্মক্ষেত্রে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে, কিন্তু আলটিমেটলী তাদের আবেগ নাই, অনুভূতি নাই।
চক পলানিউক ও ডেভিড ফিঞ্চারের মিলিত উপস্থাপন ফাইট ক্লাবে যে কনজিউমারিস্ট বা ভোগবাদী-বস্তুবাদী কালচারে বিপর্যস্ত এক সমাজ আমরা দেখছিলাম, সেইরকমই এক সমাজে বাস করে আমাদের নায়ক, আন্দ্রেজ।
আন্দ্রেজের ভিতরে আবেগ অনুভূতি থাকে। তার চিন্তার ক্ষমতা থাকে। সে অল্প অল্প ভাবে বুঝতে শুরু করে যে যেই সমাজে সে আছে সেই সমাজের কিছু ঠিক নাই। সে ভালো চাকরি পায়, ভালো গার্লফ্রেন্ড পায়। সেই গার্লফ্রেন্ড সব সময় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কনসেপ্ট নিয়া বিজি থাকে। খানা খাদ্যের কোন টেস্ট নাই, সবই রোবট রোবট। রোবট রোবট সম্পর্ক ও জীবন যাপন।
একদিন টয়লেটে সে একটা লোকরে এসব নিয়া অভিযোগ করতে শুনতে পায়। এবং তার ভিতরে প্রশ্নগুলি বাসা বাঁধে। কেন খাবারে টেস্ট নাই? কেন সব কিছু এইরকম?
এইভাবে আসলে সমাজে একজন দার্শনিকের জন্ম হয়। দার্শনিক চিন্তা করেন। অন্য সবার মতো জীবন যাপন নিয়াই তিনি তুষ্ট ও হ্যাপি থাকেন না। তারে চিন্তায় অনেক সময় ক্লু দেয় অন্য দার্শনিকেরা। হয়ত অনেক আগের প্রাচীন কোন চিন্তক। আমাদের আন্দ্রেজ বাথরুমে যে লোকটার কথা শুনছিল সেই ঘটনাকে এই অন্য দার্শনিকের ক্লু দেয়া ধরা যায়। অথবা আন্দ্রেজের চিন্তারে উসকে দেয়া।
আন্দ্রেজ শহরের সুখী জীবন যাপনে মিশতে যায়। কিন্তু দেখে যে এগুলি পুরাটাই অর্থহীনতায় ভরা।
যে লোক টয়লেটে কথা বলতেছিল তারে ফলো করতে করতে গিয়ে আন্দ্রেজ দেখে ঐ লোকের বেইজমেন্ট থেকে খুবই সুন্দর মিউজিক ভাইসা আসে।
পরে আন্দ্রেজ সে বেইজমেন্টে যায় এবং জায়গাটা খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে সে ক্লান্ত হয়। [এই গর্ত খোড়া হোল বা রিফিফি‘র কথা মনে করায়।]
আমরা দেখি অন্য দিকে আরেক পৃথিবী। যেইখানে গান আছে, পাখির ডাক আছে, শিশুদের কান্না হাসির শব্দ আছে। আন্দ্রেজ হাত বাড়াইয়া ঐ পৃথিবী থেকে কিছু খাবার নিয়া আসে, ও খায়।
সে দেখে যে এই খাবারে টেস্ট আছে।
এদিকে আইন শৃঙ্খলার লোকেরা আসে ও আন্দ্রেজরে ধরে নিয়ে যায়।
আন্দ্রেজের নিজের মুক্তির জন্য এইসব চেষ্টা তার ফিলোসফিক্যাল জার্নি। এক বা দুইবার সে ট্রেনের নিচেও ঝাঁপ দেয়। কিন্তু কয়েকটা ট্রেইন উপর দিয়া গেলেও সে বাইচা থাকে।
এখানে আমরা বুঝতে পারি মূল গল্পটা হইল, এই শহরের লোকেরা একটা কম্পিউটার গেইমের মতো বাস্তবতায় আছে। সিমুলেশন হাইপোথিসিস এর মতো। যা একজিজটেন্স বা ট্রুমান শো’তেও ছিল।
আন্দ্রেজ শহরের সুখী লোকদের শিশুদের কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বিব্রত হয়। কারণ এই উত্তর তাদের জানা নাই। তাদের শহরে শিশু নাই, শিশুদের কান্নাও নাই।
প্রতিটি লোকসমাজে এইরকম কিছু বাস্তবতা আছে। এই যে আমাদের জীবন, তার বাস্তব সত্য হইল অস্বস্থিকর। ডেভিড বেনাটারের মতো দার্শনিকেরা যখন এইসব নিয়া কথা বলেন তখন লোকে বিব্রত হয়। বা অন্য অনেক প্রশ্ন আছে যা নিয়া সমাজের লোকজন ভাবে না, ভাবতে চায় না।
তারা সুখী সুখী একটা লাইফ চায়। কম চিন্তার, কম ভাবনার। একেবারে চিন্তাহীন হইলে ভালো হয়, এমন।
কিন্তু এইসব সমাজের মধ্যে আন্দ্রেজের মতো লোকদেরও জন্ম হয়। যারা সমাজরে দেখতে চায়, দেখতে চায় যে তারা যে জীবন যাপন করছে তা আসলে কী। তখন তার সামনে জীবনের এবসার্ডিটি ধরা পড়ে।
সে একটা পেইনের ভিতর দিয়ে যায়, তার মুক্তির জার্নি, ফিলোসফিক্যাল জার্নি। দে লিভ ফিল্মে অন্যভাবে এই পেইনের দৃশ্যায়ন ছিল, একটা ভায়োলেন্ট ফাইটের মাধ্যমে, যেখানে নায়ক তার বন্ধুরে সত্য দেখাইতে যায়।
দ্য ব্রাদারসাম ম্যানে ব্যক্তির কৌতুহল, নিজ থেকে মুক্ত হবার বাসনা, এবং সেই সংস্লিষ্ট পেইনের উপস্থাপন হয়েছে।
এইভাবে দার্শনিকের জন্ম হয়।
কিন্তু দার্শনিকরে সমাজ কী করে?
সক্রেটিসকে নিয়ে হাসাহাসি করত তার সময়ের লোকেরা। তারে নিয়া ব্যঙ্গাত্বক নাটক লেখা হইত। এবং এরই ধারাবাহিকতায় তাকে তারা হত্যা করে।
আন্দ্রেজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার আমরা দেখি। আন্দ্রেজরে ধইরা নিয়া যাওয়া হয়। তারে একজন উর্ধ্বতন ব্যক্তি বলেন, এখানে বেশীরভাগ লোকই সন্তুষ্ট ও হ্যাপি আছে।