জিরার্দিয়ান দৃষ্টিকোন থেকে মাদক বিরোধী অভিযান

বাংলাদেশে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে এবং প্রায় একশো মানুষ মারা গেছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে। বন্দুকযুদ্ধ বলা হলেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজন মানুষ অপরাধী হলেও বিচার পাবার অধিকার তার আছে।

মাদক ব্যবহার এমন একটি সমস্যা যা সমাজের অন্য অনেক সমস্যার সাথে যুক্ত, তা মাদকসেবী এবং অসেবী সবাই নিশ্চয়ই জানেন। সাইকো-সোশ্যাল নানা কারণ একজনকে মাদক গ্রহণে প্রভাবিত করে। একটা আনজাস্ট সমাজে, বেকারত্ব প্রবণ, দুর্নীতি আক্রান্ত উচ্চাবিলাষীদের সমাজে মাদক গ্রহণের মাত্রা বেশী থাকে। আবার মাদক ব্যবহার ছিনতাই, ধর্ষণ জাতীয় অপরাধও বাড়ায়। সুতরাং, মাদকের ব্যবহার অবশ্যই একটি গুরুতর ও জটিল সমস্যা। এর সমাধানও তাই সহজ হয় না।

বর্তমান বাংলাদেশে আর্থ সামাজিক অবস্থা খুব যে ভালো তা নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত বেকাররা কোটাকে সমস্যা ধরে নিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন। কিন্তু কোটা মূল সমস্যা নয়। দেশে অটোমেশনের কারণে জবলেস গ্রোথ হচ্ছে, শিক্ষিতদের মধ্যে কার্যকর স্কিলের অভাব রয়েছে, আর দুর্নীতি তো আমাদের দেশের প্রিয় বান্ধবী হয়ে গলায় ঝুলে আছেন অনেক কাল ধরে।

এহেন অবস্থায় নির্বাচনের আগে আগে সরকারের মাদক বিরোধী অভিযান ছিল, ধরা যায় জনসমর্থন আদায়ের এক চেষ্টা। মিডলক্লাস সমস্যার সমাধান চায়। মাদক নির্মূল হচ্ছে দেখে, মাদক বিরোধী তীব্র অভিযানে তাদের সমর্থন ছিল। এমনকী হত্যা যেগুলি হচ্ছিল, মানবাধিকার সংগঠনদের মতে, বিনা বিচারে হত্যা, এতেও মানুষের বেশীরভাগের সমর্থন ছিল, ফেইসবুকের মন্তব্য প্রতিক্রিয়া দেখে এমনই মনে হয়।

যারা শুরু থেকে এর বিরোধীতা করেছিলেন তারা সব সময়ই ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে হত্যার বিরোধী, কারণ তারা চান যেকোন লোক অপরাধী হলেও যেন বিচার পায়।

কয়দিন আগে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল মারা গেছেন বন্দুকযুদ্ধে। আর তখন থেকেই পত্রিকাগুলি নিউজ করতে শুরু করেছে ভুল তথ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মানুষেরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন এমন খুন মেনে নেয়া যায় না।

যারা আগে মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যায় সায় দিয়েছিলেন, তারাও বলছেন এই লোক তো মাদক ব্যবসায়ী না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এর মাঝে একটি অডিও ভাইরাল হয়েছে কথোপকথনের। এটা দেখে আবেগী হয়ে আবার প্রচুর প্রচুর লোক মাদক বিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেছেন।

এদের অবস্থান বিনা বিচারে লোক হত্যা বিরোধী নৈতিক কোন অবস্থান নয়। বরং তাদের অবস্থান একটা অপরাধহীন লোককে কেন হত্যা করা হবে, এই প্রশ্নে। সবার বলছি না, তবে মোটের উপর এমনই।

এই যখন অবস্থা, তখন অবস্থাটিকে ভালো ভাবে বুঝতে ফ্রেঞ্চ দার্শনিক, কালচারাল ক্রিটিক রেনে জিরার্দের (১৯২৩-২০১৫) স্কেইপগটের ধারণা সামনে আনা যেতে পারে। জিরার্দ এর কথা মতে, মানুষেরা কালে কালে তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য আনার জন্য কোন একজন ব্যক্তিকে বড় কোন অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করত। এরপর সবাই মিলে তাকে হত্যা করত। তাকে হত্যা করা হতো স্কেইপগট হিসেবে। এবং এরপরে অল্প সময়ের জন্য সমাজে স্থিরতা, একতা আসতো।

ছবিঃ সিজারের মৃত্যু, ভিনসেনজো কামুচ্চিনি। ১৮০৪-০৫ এর মধ্যে আঁকা।

এভাবেই সব সমাজে, কালে কালে লোকেরা স্কেইপগট বানিয়ে হত্যা করেছে। এইভাবেই মানব সভ্যতা তৈরী হয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যাপূর্ন সমাজের প্রেক্ষিতে মাদকব্যবসায়ীরা স্কেইপগট। তাদের যখন হত্যা শুরু হলো তখন যে প্রায় সবাই সমর্থন দিয়েছে, এটা হলো স্কেইপগোটারদের সমর্থন। তারা ভেবেছে এইসব ঘৃণ্য লোকেরা এমন শাস্তিরই যোগ্য।

জিরার্দের স্কেইপগট হাইপোথিসিসের একটা মেজর পয়েন্ট হলো, স্কেইপগোটাররা যেন কখনো বুঝতে না পারে তারা যাকে হত্যা করছে সে নির্দোষ। এটা বুঝতে পারলে স্কেইপগোটিং মেকানিজম আর কাজ করবে না। অর্থাৎ সমাজের অস্থিরতা কমবে না।

এইজন্য মিথের গল্পসমূহ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে দোষী ব্যক্তিকে দানবের রূপ দেয়া হয়েছে। অনেক কিছু সরিয়ে নেয়া হয়েছে, এবং উপস্থাপন করা হয়েছে যে সমাজের জন্য ক্ষতিকর দানবটিকে একসময় হত্যা করা হয়। এভাবেই মিথের গল্প পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে গিয়েছে স্কেইপগোটাররা, যারা সবাই মিলে নির্দোষ একটা লোককে অপবাদ দিয়ে হত্যা করেছিল।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, চলতে থাকা স্কেইপগোটিং মেকানিজম ভেঙ্গে দিয়েছে একরামুল সাহেবের অডিও। এই অডিও এবং তার হত্যা পরবর্তী মিডিয়া রিপোর্ট স্কেইপগোটার সাধারণ লোকদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে যাকে তারা হত্যা করেছে সে ব্যক্তি নির্দোষ।

ছবিঃ উইলিয়াম হলম্যান হান্টের আঁকা দি স্কেইপগট ছবি। ১৮৫৪-৬।

সুতরাং, স্কেইপগোটিং মেকানিজম আর কাজ করবে না।

এখন থেকে আর যত হত্যা হবে বন্দুকযুদ্ধে, এগুলি কেবল মানবাধিকার কর্মী বা অল্প সংখ্যক সচেতন লোকই সন্দেহের চোখে দেখবেন না, সাধারণ লোকজন যারা একরামুল হত্যা নিয়ে অবহিত হয়েছেন তারাও সন্দেহের চোখে দেখবেন।

সমাজে এই অভিযান ভীতির তৈরী করবে, এবং সরকার এই কর্মকান্ড চালিয়ে গেলে তার জনপ্রিয়তা হারাবে প্রচুর।