মুরাদুল ইসলাম » অবশ্যপাঠ্য » জিরার্দ ও তার মিমেটিক তত্ত্বের জগত

জিরার্দ ও তার মিমেটিক তত্ত্বের জগত

মিমেটিক ডেজায়ার ও রেনে জিরার্দ

রেনে জিরার্দের কথা হলো, মানুষের নিজের কোন ডেজায়ার নেই। সে অন্যের ডেজায়ার অনুকরণ করে। এই অনুকরণ দুইটা ধরণে হতে পারে। প্রথম ধরণে যার ব্যবহার বা আচার অনুকরণ করা হচ্ছে তার সাথে প্রতিযোগীতামূলক দ্বন্দ্বের তেমন কোন সম্ভাবনা নাই। দুইজন দুই সময় বাস্তবতার ভূমিতে অবস্থান করেন। যেমন, কীয়ের্কেগার্ড সক্রেটিসকে দেখে তার মতো হতে চেয়েছিলেন। কীয়ের্কেগার্ডের সারা জীবনই গেছে সক্রেটিস হতে হতে। স্কুল অব সিভিক ভার্চ্যুতে পড়ার সময় তিনি সক্রেটিসের মত সহপাঠীদের সাথে কথোপকথন চালাতে গিয়ে ঝগড়া করেছেন পর্যন্ত। তার সক্রেটিক পদ্বতির তর্কের সাথে না পেরে অনেক ছেলেই ঝগড়ার পথে হাঁটত।

এই সক্রেটিসকে যে তিনি মডেল ধরে এগিয়ে গেলেন, তাতে সক্রেটিসের সাথে তার দ্বন্দ্বের কোন সম্ভাবনা ছিল না।

আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, অনুকরণ ক্ষতিকর দ্বন্দ্বের তৈরী করতে পারে, যখন মডেল ও অনুকরণকারীর লক্ষ্য হয়ে যায় একই বস্তু। যেমন, একজন পিএইচডি ছাত্র, তার সুপারভাইজরকে মডেল ধরে এগিয়ে একই কাজের ক্ষেত্রগুলোতে হানা দিয়ে ফেইম, চাকরির সুবিধা ইত্যাদিতে ভাগ বসাতে চাইলেন। তখন তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা থাকে।

মানব সভ্যতার মূল দ্বন্দ্বটা এই ধরণের অনুকরণ বা মিমেসিস এর ফলেই উদ্ভূত। একটা জিনিস অন্যদের ভালো লাগছে, তাই আমারো ভালো লাগছে। সবার ভালো লাগছে তাই এটি পাবার জন্য শুরু হচ্ছে প্রতিযোগীতা। এই প্রতিযোগীতার ফলেই সংঘাত।

আরেকটা পর্যায় আছে এই মিমেসিসের, যা ভয়ংকর আত্মবিধ্বংসী। যখন যিনি অনুকরণ করছেন তিনি তার মডেলের প্রতি এতই অবসেসড হয়ে যান যে নিজের স্বত্তাকে তিনি ভুলে যান বা ত্যাগ করেন, এর পরিবর্তে তিনি নিজেকে তার মডেল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন। এই ভয়ংকর অবস্থায় ব্যক্তিটি তার মডেলের জন্য হিংসাত্মক ও নিজের জন্যও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার অডিপাস কমপ্লেক্সে বলেছিলেন যে, শিশুর মধ্যে তার মায়ের প্রতি একটা অবচেতন যৌন আকাঙ্খা থাকে, এবং একসময় সে বুঝতে পারে তার আকাঙ্খার সামনে বাঁধা হচ্ছেন তার বাবা।  এবং এর ফলে সে তার বাবাকে খুন করতে চায়, অবচেতনে। এই জটিলতা তার বড় কালেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। জিরার্দ ফ্রয়েডকে মনে করতেন অসাধারণ অভজার্ভার, যিনি কাহিনীটা ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাজে ব্যাখ্যাদাতা, যিনি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। জিরার্দ অডিপাস কমপ্লেক্সের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তার কথায়, হ্যা শিশুর মায়ের প্রতি অবচেতন যৌনাকাঙ্খা তৈরী হয়, কিন্তু এটা তার মাকে দেখে নয়, বরং বাবাকে দেখে। বাবাকে সে মডেল হিসেবে নেয়, এবং বাবার ডেজায়ার অনুকরণ করেই তার ডেজায়ারের উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ, এখানে মিমেসিস ঘটে। বাবা তার মডেল ও প্রতিদ্বদ্বী হয়ে উঠেন। আর তখনই ঐ অবচেতন কমপ্লেক্সিটি বা জটিলতাটার সৃষ্টি হয়।

মানব সমাজে মিমেসিস উদ্ভূত এই প্রতিযোগীতামূলক জটিলতার সমাধান আদিম মানব সমাজ আসলে বের করেছিল, যার দ্বারা সমাজকে সাময়িক ভাবে সুস্থির করা যায়। এটা হলো হিউম্যান স্যাক্রিফাইস বা মানব উৎসর্গ করার রীতি। প্রায় সব মানব সমাজেই মানুষকে উৎসর্গ করার রীতি ছিল।
অনুকরণ ও মিমেসিসের কারণে দ্বন্দ্ব সংঘাত জনিত জটিলতায় সমাজে সমস্যা দেখা দেয় নানা ভাবে। যখন খুব তীব্র হয়ে উঠে সমস্যা তখন মানুষ হঠাৎ অদ্ভূত ভয়ংকর কোন অপরাধের জন্য একজন লোককে দায়ী করে। তাকে দোষী বলে ঘোষনা দেয়া হয়। এরপর তাকে হত্যা করা হয় করা হয়।
এরপরে সমাজ কিছুটা সুস্থির হয়। এবং পরে আবার অস্থির হয়, এবং একই স্কেইপগোটিং প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

প্রায় সব প্যাগান ধর্মের দেবতাদের দেখলে তাদের দুইটা বিপরীত চরিত্র দেখা যায় একই সাথে। তারা প্রচুর ভালো করার ক্ষমতা রাখেন, আবার প্রচুর হিংসাত্মক কাজও তারা করার ক্ষমতা রাখেন। এটা হয়েছে কারণ এইসব দেবতারা আসলে মানুষ ছিলেন। তাদের খারাপ কাজের জন্য দোষী ও সমাজের জন্য ভয়ংকর তকমা দিয়ে খুন করা হয়েছিল। খুন করেছিল স্কেইপগোটার মানুষের দল, তথা মব। আবার তাদের খুন করার পর সমস্যার সমাধান হয়েছে ভেবে তারা শান্তি পেয়েছিল। সমাজে আসলেই শান্তি নেমে এসেছিল অল্প দিনের জন্য হলেও। এরপর লোকেরা এই ব্যক্তিকে দেবতারূপ দিয়েছে। তাকে পূজা করা শুরু করেছে। এবং একইসাথে থাকে শান্তি আনয়নকারী ও ভয়ংকর হিসেবে মনে রেখেছে।

এই যে স্কেইপগোটিং মেকানিজম বা পদ্বতি এর মাধ্যমেই আমাদের বর্তমান মানব সমাজ সভ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক সভ্য মানুষের সভ্যতার মূল স্তম্ভ হচ্ছে স্কেইপগোটিং। এই পদ্বতি সম্ভবত মানুষের আদি পুরুষ হোমিনিডদের মধ্যেও ছিল।

এই স্যাক্রিফাইসই রিচুয়ালের মূলে। যখন কোন রিচুয়ালে স্যাক্রিফাইস করা হয় তখন সেই প্রাচীন স্যাক্রিফাইসকেই স্মরণ করা হয়, যা জনপদে শান্তি নিয়ে এসেছিল।

জিরার্দের স্কেইপগোটিং আইডিয়ার আরেকটা মূল কথা হলোঃ যারা স্কেইপগোটিং করছে তারা যেন কখনোই বুঝতে না পারে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে খুন করা হচ্ছে, এই ব্যবস্থাটা সমাজে থাকতো। তারা যদি বুঝতে পারতো একজন নির্দোষকে মারা হচ্ছে তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা তার গুরুত্ব হারায় এবং স্কেইপগোটিং মেকানিজম কাজ করবে না। এর জন্য সমাজে তৈরী হয়েছে মিথের গল্প। মিথের গল্পগুলি লেখা হয়েছে স্কেইপগোটারদের দিক থেকে। অর্থাৎ স্কেইপগোটার লোকেরা লিখেছে কীভাবে তারা একটি ভয়ংকর লোককে বা দানবকে হত্যা করে সমাজকে বাঁচিয়েছে। এইসব গল্পে তাই স্কেইপগোটিং পাওয়া যায় না, বরং ব্যক্তিটির নানা দোষ দেখা যায়, তার ভয়ংকর দানব রূপ দেখা যায়, এবং তার নিধন দেখা যায়। এর মাধ্যমে মূল কাহিনীকে চাপা দিয়ে ভিন্ন এক কাহিনী তৈরী করা হয়।

এজন্য মিথের গল্প উলটা করে পড়তে বলেন জিরার্দ, সত্যটা বুঝার জন্য। যেমন, অডিপাসের মিথে আমরা দেখতে পাই দূর্ভাগ্য ক্রমে অডিপাস তার বৃদ্ধ বাবাকে খুন করে। তার মা জোকাস্ট্রাকে বিয়ে করে। এর ফলে রাজ্যে দূর্ভিক্ষের মত দেখা দেয়। ডেলফির মন্দিরের ওরাকল থেকে বানী আসে, সেখানে অডিপাসের পাপের কথা বলা হয়। অডিপাস দুর্দশায় পতিত হয়, যে দুর্দশা তার সন্তানাদি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। জিরার্দ বলেন, এই গল্পের সত্যিকার কাহিনী এটা নয়। এখানে, আসলে থিব নগরীতে এক ধরণের পোকার আক্রমনে শস্যহানি হয়েছিল, দূর্ভিক্ষ হয়েছিল। এর জন্য তৎকালীন লোকেরা অডিপাস নামক এক নির্দোষ যুবককে মিথ্যা অভিযোগে স্কেইপগোট বানিয়ে হত্যা করে। তার হত্যার ন্যায্যতা দেয়ার জন্যই ভয়াবহ অভিযোগ করা হয় তার উপর। মিথের গল্পে অডিপাসের দিক থেকে, অর্থাৎ স্কেইপগোট যাকে বানানো হয়েছে তার দিক থেকে কোন তথ্য নেই।
অন্যের ডেজায়ার অনুকরণ করা এড়ানো মানুষের পক্ষে অসম্ভব, এবং সমাজে মানুষদের মধ্যে ভিন্নতাহীনতা বা একইরকমতা মিমেসিসকে তীব্র করে তোলে। এইসব অবস্থাকে মিথে প্লেগ, দূর্ভিক্ষ ইত্যাদি নামে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এইসব দূর্যোগে যেমন মানুষ অভিন্ন হয়ে উঠে, একইরকম হয়ে উঠে, সেইরকম ঐসব সমাজে মানুষ একইরকম হয়ে উঠেছিল। একইরকমতার ফলে তাদের ডেজায়ার বা আকাঙ্খাও একইরকম হয়। একইরকম আকাঙ্খা হলে আকাঙ্খিত বস্তুর জন্য দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগীতা বেশি তীব্র হবে। তখনই তৈরী হয় ক্যাওস বা নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি। আর এই নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণ পেতেই একজন লোককে স্কেইপগোট বানিয়ে হত্যা করা হয়।

সত্যজিৎ রায়ের গল্প দুই ম্যাজিশিয়ানে মিমেটিক ডেজায়ার

দুই ম্যাজিশিয়ান সত্যজিৎ রায়ের একটি গল্প। গল্পটিতে একজন উচ্চাকাঙ্খী ম্যাজিশিয়ান সুরপতি ট্রেইনে করে যাচ্ছে লখনৌ শহরে যাদু দেখাতে। এই প্রথম তার বাংলার বাইরে যাদু দেখাতে যাওয়া এবং কিছুদিন আগেই সে কলকাতায় দারুণ শো করেছে।

ট্রেইনে বসে সুরপতি ভাবছিল তার যাদু শেখায় আসার কথা। তখন জানতে পারা যায় গ্রামে একজন বুড়ির যাদু “ভানুমতির খেল” দেখেই যাদু শেখার প্রতি আকৃষ্ট হয় সুরপতি। এখানে সুরপতি মিমেটিক ডেজায়ার তৈরী হয়েছে বুড়ির যাদু দেখে।

এরপর এক বিয়েতে সুরপতি দেখে খাটি যাদুকর ত্রিপুরা চরণ মল্লিকের যাদু। ত্রিপুরা চরণ হাত সাফাই নয়, আদি ও অকৃত্রিম যাদুই দেখাতেন। তার যাদুর ডাকে আংটি পড়ে থাকা আধুলি মাথায় নিয়ে হেঁটে চলে আসত।

এটা দেখে সুরপতির মাথা ঘুরে যায়। সে ত্রিপুরা বাবুর শিষ্য হয়ে যাদু শিখতে থাকে। এখানে সুরপতি ত্রিপুরা বাবুর যাদু দেখে পুনরায় তার মিমেটিক ডেজায়ারের বশবর্তী হয়েছে।

ত্রিপুরা বাবু গরীব ছিলেন। টাকা কামাই করার যাদুটা তিনি জানতেন না। তার যাদুতে হাত সাফাই ও তথাকথিত গ্ল্যামার ছিল না। একদিন সুরপতি কলকাতায় আসা ইতালিয়ান যাদুশিল্পী শেফাল্লোর যাদু দেখে। সাথে মাদাম পেলার্মোর যাদু। এই যাদু ও চাকচিক্য দেখে সুরপতির মন মজে যায়।
তখন সে ত্রিপুরা বাবুর পথ ছেড়ে এদের মতই হতে চায়। অর্থাৎ, এখানে আবার তার মিমেটিক ডেজায়ার কাজ করেছে।

কিন্তু তিন ক্ষেত্রেই যাদের সে অনুকরণ করছে তারা ছিলেন ভিন্ন তলে। যেমন, গ্রামের বুড়ি, তিনি ভানুমতির খেল দেখিয়েছিলেন, সুরপতির সাথে তার আর দেখাও হয় নি। পরবর্তীতে ত্রিপুরা বাবুর কাছে সে যাদু শিখেছে কিন্তু নির্মোহ ত্রিপুরা বাবু যাদুকে শিল্প মনে করতেন। ফলে তাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগীতামূলক দ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। তৃতীয়ত, ইতালিয়ান যাদুশিল্পী শেফাল্লো ও মাদাম পেলার্মো শো করতে এসেছিলেন কলকাতায়, তাদের দেখে সুরপতির তাদের মত হবার আকাঙ্খা তৈরী হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও শেফাল্লো ও পেলার্মো ভিন্ন তলে, তারা তো শো করে চলে যাবেন দেশে। ফলে তিন ক্ষেত্রেই সুরপতির মিমেটিক ডেজায়ার কোন দ্বন্দ্ব তৈরী করে নি তার মডেল তথা যাকে সে অনুকরণ করছে তাদের সাথে। কিন্তু গল্পের শেষের দিকে কাহিনী হঠাৎ বদলে যায়, ও আমরা মিমেটিক ডেজায়ারের দ্বন্দ্বমুলক রূপও দেখতে পারি।

হঠাৎ সুরপতি দেখে একজন লোক তার কামরায় দ্রুত এসে বসলেন। রিজার্ভ কামরা, বাঁধা দিতে গিয়েও সুরপতি থেমে যায়। কারণ বৃদ্ধ লোকটি আর কেউ নন। স্বয়ং ত্রিপুরা চরণ মল্লিক। সুরপতি অবাক হয় কারণ সে জানত তিনি গাড়ি চাপা পড়ে কবেই মারা গেছেন।

ত্রিপুরা বাবুর সাথে সুরপতির কথোপকথন হয়। ত্রিপুরা বাবু কথাবার্তায় জানিয়ে দেন আসল যাদু ছেড়ে চাকচিক্যের লোক ভুলানো যাদুতে সুরপতি চলে যাওয়ায় তিনি মনক্ষুন্ন হয়েছেন।

এরপর ত্রিপুরা বাবু এক দাবী করে বসেন বা অদ্ভুত এক জিনিস চেয়ে বসেন। তিনি সুরপতিকে বলেন, সুরপতির পরিবর্তে লখনৌতে যাদু দেখাতে তিনি নিজে যেতে চান। সুরপতি রাজী হয় না, প্রথমে প্রত্যাখান করে। ত্রিপুরা বাবু তখন সম্মোহনী যাদু শক্তির সাহায্যে সুরপতির হাত অবশ করে দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি চাইলে সে যাদুই দেখাতে পারবে না, মঞ্চে অপদস্ত হবে। ভয়ে সুরপতি রাজী হয়।

সুরপতির সাথে ত্রিপুরা বাবুর এই সংঘাত দেখিয়ে দেয়, যখন আকাঙ্খা একই তলে থাকে তখন অনুকরনকারী ও যাকে অনুকরণ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে মারাত্মক সংঘাত হতে পারে।

মেটাফিজিক্যাল ডেজায়ার বা ধ্বংসাত্মক ডেজায়ার ও প্রেস্টিজ ফিল্ম

মিমেটিক ডেজায়ারে যখন অনুকরণকারী নিজের অস্তিত্ব ভুলে যায়, এবং নিজেকে তার মডেল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে তখন তাকে বলে ধ্বংসাত্মক ডেজায়ার। এর চমৎকার উদাহরণ আছে ক্রিস্টোফার নোলানের বিখ্যাত ফিল্ম প্রেস্টিজের চরিত্র এঞ্জিয়ারের মধ্যে।

রবার্ট এঞ্জিয়ার আরেক ম্যাজিশিয়ান আলফ্রেড বরডেন এর যাদু ‘ট্রান্সপোর্টেড ম্যান’ দেখে, এবং এতে তার মিমেটিক ডেজায়ার তীব্রভাবে জেগে উঠে, এবং সে এই যাদু শেখার চেষ্টা করতে থাকে। সে এই যাদু দেখাতে চায়।

বরডেন যে যাদুটি দেখাচ্ছিল তা সিম্পল ট্রিক। একইরকম দুইজন মানুষ দুইদিকে। একজন বল ছুঁড়ে দরজার আড়ালে লুকায়। অন্যজন অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে বল ধরে। দুইজন লোকই একইরকম দেখতে। তাই লোকে ভাবে একই লোক শুন্যের মধ্য দিয়ে গিয়ে বলটি ধরেছে।

এঞ্জিয়ার এই ম্যাজিকটির ট্রিক জানতে চায়, তখন এঞ্জিনিয়ারের যাদু প্রকৌশলী জেমস কাটার জানায় এটা সিম্পল ট্রিক। দুই দিকে একইরকম দুজন লোক। কিন্তু এঞ্জিনিয়ার তা বিশ্বাস করতে চায় না।

প্রেস্টিজ
ছবিঃ পোস্টারে বামে হিউজ জ্যাকম্যান অর্থাৎ এঞ্জিনিয়ার। মাঝখানে নায়িকার ছবি দ্বারা বুঝানো হয়েছে ডেজায়ার। আর ডানে ক্রিস্টিয়ান বেল বা বরডেন। তাদের শত্রুতার মূলে যে এঞ্জিয়ারের মেটাফিজিক্যাল ডেজায়ার, তার এক উপস্থাপন পোস্টারটি।

 

এই বিশ্বাস করতে না চাওয়ার কারণ তার মিমেটিক ডেজায়ারের তীব্রতা, ডেজায়ার তখন মেটাফিজিক্যাল স্তরে পৌছে গেছে। এর কারণেই সে মনে করতে থাকে হয়ত বরডেন এমন কোন যাদুকরী ট্রিক আবিষ্কার করেছে যাতে সত্যিই অদৃশ্য হয়ে অন্য দরজা দিয়ে বের হওয়া সম্ভব।

এই ম্যাজিক ট্রিক জানার জন্য এঞ্জিয়ার মরিয়া হয়ে উঠে। এই যে অবসেশন তার তৈরী হয়, মেটাফিজিক্যাল ডেজায়ার স্টেইজে এসে এমন অবসেশন তৈরী হয় অনুকরণকারীর। সে বাস্তবতার বাইরে চলে যায় তার ডেজায়ারের তাড়নায়। ফিল্মে দেখা যায় এঞ্জিয়ার টেসলার কাছে যায়। ট্রান্সপোর্টেড ম্যান যাদু দেখানোর জন্য যন্ত্র তৈরী করে। তার গার্লফ্রেন্ড হারায়, এবং এক ভয়ানক, মর্মান্তিক বাস্তবতায় পতিত হয়।

প্রেস্টিজ ফিল্মটি মিমেটিক ডেজায়ার, এবং এ জনিত সংঘাত, প্রতিযোগিতা ও শত্রুতার ফল কতো মারাত্মক হতে পারে তার এক দারুণ চিত্রায়ন।

আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মিমেটিক ডেজায়ার ও স্কেইপগোটিং

সোশ্যাল মিডিয়া তথা আমাদের ফেইসবুকে সবার প্রোফাইল একইরকম। একইরকম ভাবে প্রোফাইল পিকচার রাখার জায়গা, কভার পিকচার রাখার জায়গা, মেসেঞ্জার, স্ট্যাটাস দেবার জায়গা ইত্যাদি। এই একইরকমতা মিমেটিক ক্রাইসিস, প্রতিযোগীতামূলক দ্বন্দ্বের পক্ষে চরম সহায়ক।

একইরকম একজন বেশী লাইক পাচ্ছে, কমেন্ট পাচ্ছে তার স্ট্যাটাসে এটা দেখে অন্যদের মনে লাইক কমেন্টের জন্য মিমেটিক ডেজায়ার তীব্র হয়। সেও একইরকম লাইক চায়, কমেন্ট চায়।  কারো কারো ক্ষেত্রে এই ডেজায়ার মেটাফিজিক্যাল স্তরে পৌছে যায় এবং সে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে তার মডেলের এক প্রতিরূপে পরিণত হতে পারে, এবং মডেলের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাত তার তৈরী হতে পারে। এছাড়া কেবল লাইক কমেন্ট নয়, অন্যের সাফল্য, অর্জন, জীবন যাপন, সুখ বা খ্যাতি অথবা ভোগ বিলাস দেখেও ঐসবের জিনিসের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ও  ওর মতো হতে চাওয়ার বাসনা তৈরি হয় বাকীলোকদের মনে।

ফেইসবুক ভার্চুয়াল সমাজে একইরকমতার দরুণ মিমেটিক ডেজায়ার, এবং সেইসব ডেজায়ারের অপূর্নতা (কারণ সবাই তো লাইক কমেন্ট, বা ঐ সব সফলতা, অর্জন পাবে না একইরকম) জায়গাটিকে স্কেইপগোটিং এর জন্য আদর্শ জায়গায় পরিণত করেছে। অল্পদিন পরে পরেই বা সবসময়েই তাই সোশ্যাল মিডিয়া কমিউনিটির একজন স্কেইপগোট দরকার হয়। এই স্কেইপগোট হয় পত্রিকার নিউজের কোন ব্যক্তি, কোন দেশী বিদেশী সেলিব্রেটি, বা অন্য কিছু, যাকে নিয়ে গণহারে ট্রল করা হয়।

স্কেইপগোটিং এর জন্য রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসি, বা ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমানকে বেছে নেবার উদাহরণ এখানে দেয়া যায়। তাদের কাজ অনেকের কাছে হাস্যকর লাগতে পারে, আবার কারো কারো কাছে ভালোও লাগতে পারে। কিন্তু যখন এনাদের নিয়ে ট্রলিং শুরু হয়, একজন নিরপেক্ষ অবজার্ভার যদি লক্ষ করেন তাহলে দেখতে পাবেন কী তীব্র উৎসবের সাথে লোকে এতে অংশ নেয়। ফটোশপ করে পোস্টার বানায়, ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বের করে মজা করে। এই মবের কর্মকাণ্ডই যেকোন সমাজের স্কেইপগোটারদের কর্মকান্ডের একটা ভার্চুয়াল রূপ। এর মাধ্যমে তারা যেন একজন দোষীকে সবাই মিলে শাস্তি দেয়।

কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পেছনে তো একজন ব্যক্তি আছেন, এবং তার মিমেটিক ডেজায়ারের অপূর্নতা জনিত অস্থিরতা পুরো ভার্চুয়াল কম্যুনিটির সামগ্রিক অস্থিরতা বাড়ায়। এটা কমাতেই দরকার হয় কোন একটা ব্যক্তি বা বিষয়কে একত্রে মিলে দোষারূপ করে ভার্চুয়ালি হত্যার।  একত্রে মিলে ট্রল করা তথা ভার্চুয়াল স্কেইপগোটিং প্রক্রিয়া ভার্চুয়াল সমাজের মিমেটিক ডেজায়ারের অপূর্ণতা জনিত অস্থিরতা কাটায়।

কিন্তু এই স্থিরতা স্থায়ী হবার উপায় নেই। কারণ ভার্চুয়াল সমাজ একেবারে সংঘবদ্ধ নয়। আবার এতো বেশী একইরকমতা এখানে যে খুব দ্রুতই আবার মিমেটিক ডেজায়ার ইউজারদের গ্রাস করতে থাকে ও তারা অস্থির হয়ে উঠে। কম্যুনিটির সামগ্রিক অস্থিরতা বাড়ে ও তারা হন্যে হয়ে স্কেইপগোট খুঁজতে থাকে। স্কেইপগোটিং এর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকলে সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেইসবুকে লোকেরা আগ্রহ হারাবে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় কন্টিনিউয়াস বা নিয়ত একটা স্কেইপগোটিং প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

 

বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে মিমেটিক ডেজায়ার

বাংলা সাহিত্যের একটি চমৎকার উপন্যাস কপালকুণ্ডলা। এই উপন্যাসে যার মিমেটিক ডেজায়ার উপন্যাসটিকে শেষের দিকে নিয়ে যায় তিনি হলেন নবকুমারের প্রথম স্ত্রী পদ্মাবতী। যার অন্য নাম মতিবিবি বা লুৎফ উন্নিসা। লুৎফ উন্নিসার যখন নবকুমারের সাথে দেখা হয় মেদিনীপুরে, একটি দূর্ঘটনার পরে, সেই সময়ে তাকে দেখে লুৎফ উন্নিসার কোনরূপ ডেজায়ারের জন্ম হয় নি। দেখতে পাওয়া যায় হালকা রসিকতার সাথে তিনি কথা বলছেন, আর নবকুমারও “মুখরার কথায় কেন না উত্তর করিবেন” ভেবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। নবকুমারের পরিচয় পাওয়ার পরে আমরা দেখি যে প্রদীপ নিবিয়া যায়, অর্থাৎ লুৎফ উন্নিসা ধাক্কার মত খান। কিন্তু তখনো তার আকর্ষণ জন্মে নি নবকুমারের প্রতি তা বুঝা যায় কারণ তিনি এর পরেও একই রসিকতার চালে কথা বলছিলেন।

লুৎফ উন্নিসার ডেজায়ারের উৎপত্তি হয় নবকুমারের নতুন স্ত্রী কপালকুণ্ডলাকে দেখে। তার কপালকুণ্ডলাকে দেখা এবং তৎপরবর্তী অনুভূতিই এই উপন্যাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন অংশ।

“কপালকুণ্ডলা দোকান ঘরের আর্দ্র মৃত্তিকায় একাকিনী বসিয়াছিলেন। একটী ক্ষীণলোক প্রদীপ জ্বলিতেছে মাত্ৰ— আবদ্ধ নিবিড় কেশরাশি পশ্চাদ্ভাগ অন্ধকার করিয়া রহিয়াছিল। মতিবিবি প্রথম যখন তাঁহাকে দেখিলেন, তখন অধর পার্শ্বে ও নয়ন প্রান্তে ঈষৎ হাসি ব্যক্ত হইল। ভাল করিয়া দেখিবার জন্য প্রদীপটী তুলিয়া কপালকুণ্ডলার মুখের নিকট আনিলেন। তখন সে হাসি হাসি ভাব দূর হইল –মতির মুখ গম্ভীর হইল ;–  অনিমিষ লোচনে দেখিতে লাগিলেন। কেহ কোন কথা কহেন না। —মতি মুন্ধা, কপালকুণ্ডলা কিছু বিস্মিতা।”

কপালকুণ্ডলাকে দেখার পর মতিবিবির আকর্ষণ জন্মে নবকুমারের প্রতি। এইজন্য তিনি জাহাঙ্গীরকে মেহের-উন্নিসার কাছে একরকম ছেড়ে দেন। তিনি চলে আসেন নবকুমারকে পাবার জন্য। তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন, কপালকুণ্ডলাকে নবকুমারের কাছে বিশ্বাসঘাতিনী প্রমাণ করার বুদ্ধি করেন, এবং শেষপর্যন্ত কাপালিকের সাথে ষড়যন্ত্র করতে প্রবৃত্ত হন।

লেখক ষষ্ট পরিচ্ছেদে এভাবে উল্লেখ করেছেন মতিবিবি তথা লুৎফ উন্নিসার মনের অবস্থা,

“ক্ষেত্রে বীজ রোপিত হইলে আপনিই অঙ্কুর হয়। যখন অঙ্কুর হয়, তখন কেহ জানিতে পারে না–কেহ দেখিতে পায় না। কিন্তু একবার বীজ রোপিত হইলে, রোপণকারী যথায় থাকুন না কেন, ক্রমে অঙ্কুর হইতে বৃক্ষ মস্তক উন্নত করিতে থাকে। অদ্য বৃক্ষটি অঙ্গুলি-পরিমেয় মাত্র, কেহ দেখিয়াও দেখিতে পায় না। ক্রমে তিল তিল বৃদ্ধি। ক্রমে বৃক্ষটি অর্দ্ধ হস্ত, এক হস্ত, দুই হস্তপরিমিত হইল; তথাপি, যদি তাহাতে কাহারও স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা না রহিল, তবে কেহ দেখে না, দেখিয়াও দেখে না। দিন যায়, মাস যায়, বৎসর যায়, ক্রমে তাহার উপর চক্ষু পড়ে। আর অমনোযোগের কথা নাই,-ক্রমে বৃক্ষ বড় হয়, তাহার ছায়ায় অন্য বৃক্ষ নষ্ট করে,-চাহি কি, ক্ষেত্র অনন্যপাদপ হয়।

লুৎফ-উন্নিসার প্রণয় এইরূপ বাড়িয়াছিল। প্রথম একদিন অকস্মাৎ প্রণয়ভাজনের সহিত সাক্ষাৎ হইল, তখন প্রণয়সঞ্চার বিশেষ জানিতে পারিলেন না। কিন্তু তখনই অঙ্কুর হইয়া রহিল। তাহার পর আর সাক্ষাৎ হইল না। কিন্তু অসাক্ষাতে পুন: পুন: সেই মুখমণ্ডল মনে পড়িতে লাগিল, স্মৃতিপটে সে মুখমণ্ডল চিত্রিত করা কতক কতক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। বীজে অঙ্কুর জন্মিল। মূর্তিপ্রতি অনুরাগ জন্মিল। চিত্তের ধর্ম এই যে, যে মানসিক কর্ম যত অধিক বার করা যায়, সে কর্মে তত অধিক প্রবৃত্তি হয়; সে কর্ম ক্রমে স্বভাবসিদ্ধি হয়। লুৎফ-উন্নিসা সেই মূর্ত্তি অহরহ: মনে ভাবিতে লাগিলেন। দারুণ দর্শনা-ভিলাষ জন্মিল; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সহজস্পৃহাপ্রবাহও দুর্নিবার্য্য হইয়া উঠিল। দিল্লীর সিংহাসনলালসাও তাঁহার নিকট লঘু হইল। সিংহাসন যেন মন্মথশরসম্ভূত অগ্নিরাশিবেষ্টিত বোধ হইতে লাগিল। রাজ্য রাজধানী, রাজসিংহাসন, সকল বিসর্জ্জন দিয়া প্রিয়জন-সন্দর্শনে ধাবিত হইলেন, সে প্রিয়জন নবকুমার।”

এখানে ক্ষেত্রে বীজ রোপিত হওয়া অর্থে নবকুমারের সাথে সাক্ষাৎ বলা হলেও (রোমান্টিক মিথ্যা একে ধরলাম।), মূলত এই বীজ রোপিত হয়েছিল কপালকুণ্ডলাকে দেখে। কপালকুণ্ডলার আকাঙ্খিত বস্তু হিসেবে নবকুমারকে মনে করেছিলেন মতিবিবি, এবং এই ডেজায়ার তখন তার মনেও জন্ম নেয় তীব্র ভাবে। সেই অংকুর থেকেই আস্তে আস্তে হয় বৃক্ষ। লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনীর ধারা অনুসরণ করে লুৎফ ন্নিসার আকাঙ্ক্ষা ধরতে পারলেও, এর কারণ ধরতে পারেন নি। কারণ ধরতে না পারলেও অবজার্ভার হিসেবে তিনি সতর্ক ছিলেন, ফলে ধরা সম্ভব হলো লুৎফ উন্নিসার মিমেটিক ডেজায়ারের উৎপত্তির কারণ। (বড় লেখকদের সব সময় ভাল ব্যাখ্যাকার হতে হয় না, কিন্তু ভালো অবজার্ভার হতে হয়।)
শেষপর্যন্ত এই ডেজায়ারের প্রক্রিয়াস্বরূপই বলা যায়, কপালকুণ্ডলা, ও নবকুমার জলে ভেসে যান।

অবশ্য কাপালিককেও বিবেচনা করা যায় মিমেটিক ডেজায়ার জনিত আলোচনায়। কাপালিক ভৈরবীর উপাসক, তার কাছে মানুষ বলি দিয়ে সে শক্তি অর্জন করতে চায়। এই মানুষ বলি দেবার রীতি, জিরার্দিয়ান দৃষ্টিকোন থেকে স্কেইপগট মেকানিজম থেকেই শুরু হয়েছিল। যাইহোক, কাপালিকের এই শক্তির প্রতি ডেজায়ার তৈরী হয়েছে অন্য কাপালিকদের দেখে, একথা বলা যায়। তাদের দেখেই সে সাধনপদ্বতি শিখেছে। কপালকুণ্ডলাকে সে বড় করেছিল বলির উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথ হারানো পথিক নবকুমারকে পেয়ে তার মনে ভিন্ন চিন্তার উদয় হয়। সে নবকুমারকে বলি দিতে যায়। কিন্তু কপালকুণ্ডলার সাহায্যে নবকুমার পালিয়ে যান, এবং উঁচু টিলা থেকে পড়ে গিয়ে কাপালিকের দুই হাত নিঃশক্তি হয়। কিন্তু, এতেও কাপালিক দমে নি। সে আবার ফিরে আসে, কপালকুণ্ডলাকে ধরে নেবার জন্য। স্বপ্নে দেবী এসে তাকে জানান দেন যে কপালকুণ্ডলাকে বলি না দিলে তিনি আর কোন পূজা নেবেন না। এই স্বপ্ন হচ্ছে কাপালিকের ডেজায়ার পূর্ন করার তাড়না। এই তাড়নাতেই সে দূর্বল হস্তদ্বয় নিয়েও ছুটে এসেছিল কপালকুণ্ডলাকে ধরে নিতে।

কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে প্রধান দুই চরিত্র নবকুমার ও কপালকুণ্ডলা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে মূল দুই চরিত্র হলো মতিবিবি ও কাপালিক। তাদের ডেজায়ারই উপন্যাসকে গতি দিয়েছে। এছাড়া কপালকুণ্ডলার মধ্যে বা নবকুমারের মধ্যে প্রেমজনিত কোন ডেজায়ারও নেই।
সব শেষে জলে ভেসে গিয়ে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের মৃত্যুকে স্কেইপগোটিং এর সাথে মেলানো যায়। লেখক এখানে, এইভাবে তাদের মৃত্যু দিয়ে উপস্থিত ডেজায়ার জনিত সংঘাতের অবসান করতে চেয়েছেন। কপালকুণ্ডলার জলে পড়ে যাওয়া ছিল ইচ্ছাকৃত আত্মউৎসর্গই, দেবীর কাছে। আর নবকুমার তাকে খুঁজতে জলে নেমে ভেসে যান।

 

পিটার থিয়েল ও জিরার্দিয়ান পৃথিবী

বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসায় বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ন নামদের একটি পিটার থিয়েল। ছিলেন পেপলের কো-ফাউন্ডার, ফেইসবুকের প্রথম বাইরের ইনভেস্টর, এবং লিখেছেন জিরো টু ওয়ান নামে একটি দারুণ বই, যা টেক দুনিয়ায় গুরুত্ব সহকারে পাঠ করা হয়।

রেনে জিরার্দ দ্বারা প্রভাবিত অনেকের মধ্যে একজন পিটার থিয়েল। তার বই জিরো টু ওয়ানে, তার ইনভেস্টিং ফিলোসফিতে সরাসরি প্রভাব রয়েছে জিরার্দিয়ান দৃষ্টিকোণের। জিরো টু ওয়ান বইয়ের একটি মূল অবস্থানই হচ্ছে অহেতুক প্রতিযোগীতা এড়িয়ে চলা। থিয়েল তার বইতে কার্ল মার্ক্স ও শেক্সপিয়রের প্রতিযোগীতা বিষয়ক ভিন্ন দুই চিন্তা দেখিয়েছেন। কার্ল মার্ক্স মনে করতেন ভিন্নতা দ্বন্দ্বের মূলে। মানুষ যুদ্ধ করে ভিন্নতার জন্য। প্রলেতারিয়েত শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণীর চাইতে ভিন্ন, তাদের চিন্তা ভিন্ন, আদর্শ ভিন্ন। এই ভিন্নতাই তাদের দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধের মূলে, ভিন্নতা যত বেশী যুদ্ধ তত তীব্র। কিন্তু শেক্সপিয়র রোমিও এন্ড জুলিয়েটে যে চিত্র দেখিয়েছেন তাতে দেখা যায় মানুষ যুদ্ধ করে কারণ তারা একইরকম। রোমিও এন্ড জুলিয়েট শুরুই হয় মন্টেগু এবং ক্যাপুলেট পরিবারের একইরকমতার কথা বলে। তাও তারা যুদ্ধ করে, যুদ্ধ তীব্র হয় এবং প্রচন্ড সংঘাতের এক পর্যায়ে তারা ভুলে যায় কেন যুদ্ধ শুরু করেছিল। একইরকমতা দ্বন্দ্ব তৈরী করে কারণ এই অবস্থায় বেশি মিমেটিক ডেজায়ার উৎপন্ন হয়, আর তখন সবাই একই জিনিসের পিছনে ছুটে। তীব্র সংঘর্ষমূলক প্রতিযোগীতা বা দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত খারাপ ফলই বয়ে আনে, যেমন রোমিও এন্ড জুলিয়েটেও হয়েছিল।
অহেতুক প্রতিযোগীতা এড়ানোর জন্য মিমেটিক থিওরী কীভাবে বাস্তবে কাজ করছে তা বুঝা গুরুত্বপূর্ন। রেনে জিরার্দের মিমেটিক থিওরী বাস্তব পৃথিবীতে কীভাবে কাজ করে; এবং কীভাবে এটি নিজের উপর কাজ করছে, কতো গভীরভাবে কাজ করছে, সেটা বুঝতে পারাই সবচাইতে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ন কাজ।

জিরার্দ মিমেটিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তার পুরো চিন্তা প্রক্রিয়া সাজিয়েছেন এবং মানব সমাজ, সভ্যতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার প্রথম বই ডিসিট, ডেজায়ার এন্ড দ্য নভেলে তিনি দস্তয়ভস্কি, প্রাউস্ত, স্টেন্ডাল ইত্যাদি ঔপন্যাসিকের উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন তার ত্তত্বের আলোকে, বইটি সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তাকে বিখ্যাত করে তোলে। ভায়োলেন্স এন্ড দ্য সেকরেড বইতে মিথলজি দ্বারা, থিয়েটার অব এনভি বইতে শেক্সপিয়র দ্বারা, আই সি সাটান ফল লাইক লাইটনিং বইতে বাইবেল দ্বারা নিজের চিন্তা উপস্থাপন করেছেন। থিংস হিডেন সিন্স দি ফাউন্ডেশন অব দি আর্থ বইতে তার সব আইডিয়া একসাথে পাওয়া যায়। দ্য জিরার্ড রিডার বইতে দেখা যায় তার পুরো চিন্তা কেরিয়ারের সময়ের সাথে বিবর্তন।


(এই লেখাটি রেনে জিরার্দের চিন্তার সহজ ব্যাখ্যা, এবং তার তত্ত্ব ব্যবহার করে সাহিত্য ও সমাজ আলোচনা। এর আগেও দুইটি সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনা  (ক্রসফায়ারে হত্যা, রামপালের দীঘি) জিরার্দের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলাম। এই লেখাটির রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করছি ইন্টারনেট এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলসফিতে থাকা গ্যাব্রিয়েল আন্দ্রেদ এর প্রবন্ধটিকে। )


Image: Christ of St John of the Cross, Salvador Dali

 

“If you scapegoat someone, it’s a third party that will be aware of it. It won’t be you. Because you will believe you are doing the right thing.”

~René Girard

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং