সিক্রেট লাইফ অব প্রোনাউনসঃ লেখা বিশ্লেষণ

লেখা আমরা কীভাবে লেখি এর উপর বিশ্লেষণ চালিয়ে লেখক সম্পর্কিত অনেক কিছুই জানা যায়। লেখকের মানসিক অবস্থা, সততা, লেখকের পরিচয় ইত্যাদি ইত্যাদি। সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট জেমস প্যানেবেকারের কাজ এটাই, লেখা বিশ্লেষণ করা। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ন আমেরিকান সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট।

 

 

ছবিঃ জেমস বি প্যানেবেকার।

 

লেখার দুইটা পার্ট থাকে। একটা হচ্ছে মূল শব্দাবলী। অর্থাৎ, যেসব শব্দ মূল বক্তব্যটাকে ধারণ করে। সাধারণ একজন লেখা সম্পর্কে ভাবলে মনে করবেন এই সব মূল শব্দাবলীই লেখক সম্পর্কে, লেখকের মানসিক-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিতে পারে। জেমস প্যানেবেকার আসলে কাজ করতেন মানুষের ট্রমা নিয়ে এবং এই ট্রমাজনিত দুরাবস্থা সে কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে। ট্রমা বলতে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ঐ ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া কোন অনাকাঙ্খিত ভয়ানক ঘটনা। প্যানেবেকার দেখেছিলেন লোকেরা যখন তাদের ট্রমা নিয়ে বিস্তারিত লিখেন তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। এটা বের করার পর তার দেখার ইচ্ছে হলো এই লেখার ভিতরে কী আছে যা লোকদের মানসিক অবস্থার সাথে যুক্ত। এই সম্পর্ক বের করতে তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্য নেন। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন লেখার মূল শব্দাবলীই গুরুত্বপূর্ন। এই মূল শব্দাবলী নিয়েই গবেষণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি দেখতে পান এই মূল শব্দাবলী নয়, সাহায্যকারী শব্দাবলীই লেখক সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিতে পারে।

 

 

লেখার দ্বিতীয় পার্ট হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের সাহায্যকারী শব্দ বা ফাংশন ওয়ার্ড। যেমন,  আমি, আমরা, তুমি, সে ইত্যাদি। এগুলি আমরা যদিও বেশী ব্যবহার করি তথাপি অগ্রাহ্য করে যাই। জেমস প্যানেবেকার, তার কলিগ ও ছাত্ররা গবেষণা করে দেখেছেন লেখা বিশ্লেষণ করে লেখক সম্পর্কে জানতে গেলে এই ফাংশন শব্দগুলিই সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ন।

 

ইংরাজিতে ফাংশন ওয়ার্ড আছে ৫০০ এর কম।

 

প্রোনাউনঃ আই, ইউ, দে ইত্যাদি।

 

প্রিপোজিশনঃ টু, ফর, অফ ইত্যাদি।

 

আর্টিকেলসঃ এ, এন, দি।

 

সাহায্যকারী ক্রিয়াঃ এম, ইজ, আর ইত্যাদি।

 

এই শব্দাবলী একজন মানুষ কীভাবে ব্যবহার করছে তার লেখায় তার দ্বারা বের করা যায় তার লেখার উদ্দেশ্য কী, লেখাটিতে সে সৎ কি না, তার মানসিক অবস্থা কী, পাঠকদের সাথে সে কীভাবে যোগাযোগ করতে চাচ্ছে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন সব তথ্য। শুনতে শার্লক হোমসীয় অদ্ভুত কাজ মনে হলেও জেমস প্যানেবেকার, তার কলিগ ও ছাত্ররা এ নিয়ে রীতিমত গবেষণা করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে, প্রায় ত্রিশ বছর। সিক্রেট লাইফ অব প্রোনাউনস বইটি আসলে প্যানেবেকারের কাজ, এবং এ সংস্লিষ্ট সাম্প্রতিক রিসার্চের এক তথ্য সমাহার। বইটি একই সাথে লিংগুইস্টিকসের আগ্রহীদের কাছে চমৎকার বলে বিবেচীত হতে পারে, আবার সাধারণ পাঠকদের কাছেও হতে পারে আগ্রহ উদ্দীপক এক বই।

 

 

আমি

 

রিসার্চে দেখা গেছে যেসব কবিরা সুইসাইড করেছেন এবং যেসব কবিরা সুইসাইড করেন নি, তাদের মধ্যে হতাশা জাতীয় নেগেটিভ শব্দের ব্যবহার প্রায় সমান, কিন্তু সুইসাইড করা কবিরা অন্যদের চাইতে “আমি” শব্দটি ব্যবহার করতেন বেশী।

 

সাধারণত “আমি” যারা বেশী ব্যবহার করে তাদের নার্সিসিস্ট মনে করে লোকেরা। কিন্তু সাইকোলজির ওয়ার্ড এনালাইসিসের গবেষণা বলে আরো ভিন্ন কিছু কথা।

 

প্রতি বছর শতকরা ৫% মানুষ মারাত্মক রকমের ডিপ্রেশনে ভুগতে পারে। এই ধরণের ডিপ্রেশন তার মানসিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থায় খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে, এবং অনেকেই এর কারণে আত্মহত্যা করে। ডিপ্রেশনের একটা শক্তিশালী থিওরী বলে, ডিপ্রেসড মানুষেরা তার নিজের আবেগ বা ইমোশনে এতো তীব্রভাবে নজর দিতে থাকে যে, এটা প্যাথোলজিক্যাল স্তরে পৌছে যায়। তারা তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, একাকীত্ব ইত্যাদিতে এতো এতো সচেতন হয়ে উঠে যে বাইরের দুনিয়ার দিকে তাদের নজর থাকে না। তখনই ডিপ্রেশন চূড়ান্ত মাত্রার দিকে যেতে থাকে।

 

নিজের দিকে অতি নজর দেয়ার প্রোনাউন হচ্ছে আমি বা আই। আমি, আমার ইত্যাদি ফার্স্ট পার্সন সিংগুলার নাম্বার প্রোনাউন ব্যবহার করে বেশী ডিপ্রেসড মানুষেরা। যত বেশী ডিপ্রেসড তত বেশী আমি বা আমার সে ব্যবহার করবে লেখায় বা কথায়।

 

লেখকদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার বেশী, আবার তার মধ্যে সফল কবিদের ভেতর আরো বেশী। পাবলিশড কবিরা অন্য ধরণের শিল্পী ও লেখকদের চাইতে তাড়াতাড়ি মরেন বলে রিসার্চ বলে, এবং এর ২০ ভাগই আত্মহত্যায়।

 

“I shut my eyes and all the world drops dead;

I lift my lids and all is born again.

(I think I made you up inside my head.)

– Sylvia Plath

 

সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করেছেন এমন কবিদের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত একজন।

 

 

ছবিতে সিলভিয়া প্লাথ।

 

বাংলা সাহিত্যের কবি জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যা করেছেন কি না এ নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। জীবনানন্দের লেখায় “আমি” সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে কেউ সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করতে পারেন কবি ইচ্ছে করেই ট্রামের নিচে পড়েছিলেন কি না, এ ব্যাপারে।

 

 

সত্য মিথ্যার সাথে আই বা আমির সম্পর্কঃ

 

ডিপ্রেশনের সাথে আই যেমন সম্পর্কিত তেমনি আবার আমি বা আই সত্য – মিথ্যা বক্তব্য চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে। যেহেতু আই ব্যক্তির নিজের কাছাকাছি শব্দ, তাই এই শব্দ বেশী ব্যবহার বক্তব্যে থাকলে তা সত্য হবার সম্ভাবনা বেশী।

 

আবার মিথ্যা বলার সময় মানুষ আই বা আমি এড়িয়ে চলতে চায়। এটা এড়িয়ে চলা মানে এক ধরণের দূরত্ব তৈরী করা। মিথ্যা বলার সময় এই দূরত্ব রাখতে চায় মানুষ।

 

[সাইকোলজিস্ট ড্যান আরিয়ালির অনেস্ট ট্রুথ এবাউট ডিজওনেস্টি বইতে, অসততা যতটা সম্ভব দূরে থেকে করে লোকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই জন্য, যখন কেউ টাকা সংস্লিষ্ট দূর্নীতি করে তখন সরাসরি টাকা নিতে তার যত অস্বস্থি হয়, এই টাকা অন্যভাবে নিলে হয় না। যেমন, কোন গিফট আকারে, বা সরাসরি টাকা নেবার সময়ও খামে, টেবিলের নিচ দিয়ে। সে একটা দূরত্ব রাখতে চায়।]

 

 

পারফরমেটিভসঃ

 

এখন আপনি তো পেয়ে গেলেন কীভাবে মিথ্যা বলা লোককে চিনে নিবেন, কিন্তু এখানে খুশি হবার আগে আপনার জানা উচিত ভাষা খুবই জটিল জিনিস। শুধু আই এর ব্যবহার দিয়েই মিথ্যা চিহ্নিত করা তাই সব সময় ঠিক হবে না, বরং এটি আপনাকে হিন্ট দিতে পারে।

 

পারফরমেটিভ হচ্ছে এক ধরণের ভাষার ব্যবহার, যা সম্পর্কে প্রথমে বলেছিলেন দার্শনিক জন অস্টিন। যেসব বক্তা পারফরমেটিভ ব্যবহার করেন তারা সত্যের আদলে মিথ্যা বলেন সুকৌশলে। এটি সবচাইতে বেশী করেন রাজনীতিবিদরা, বা তাদের এটি করতে হয়। তারা সব সময় ইচ্ছা করে বা সচেতনভাবে করেন এমন না। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী বা যিনি মিথ্যা বলছেন তিনি নিজেই ঐ মিথ্যায় বিশ্বাস করেন, ফলে বুঝতে পারেন না তিনি মিথ্যা বলছেন।

 

যেমন, আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে একটি বই হাতে নিয়ে বললাম, “আমি চাই আপনারা বিশ্বাস করুন যে আমি একটি বোমা হাতে ধরে আছি।”

 

এই বাক্যে পারফরমেটিভের ব্যবহার হয়েছে।

 

লাল রঙের অংশ কিন্তু সত্য। অর্থাৎ আমি সত্যি সত্যি চাই আপনারা বিশ্বাস করুন। বাকী অংশ মিথ্যা, কিন্তু প্রথম অংশ সত্য।

 

যেমন মনিকা লিওনেস্কির সাথে সেক্স স্ক্যান্ডালের পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেনঃ

 

But I want to say one thing to the American people. I want you to listen to me. I’m going to say this again: I did not have sexual relations with that woman, Miss Lewinsky.

 

এই লাল রঙ করা অংশগুলি কিন্তু সত্য। তিনি আসলেই আমেরিকান লোকদের ওয়ান থিং বলতে চান। তিনি আসলেই চান তারা তার কথা শুনুক। তিনি আসলেই আবার তাদের কথাটি বলতে চান।

 

কিন্তু পরে যে কথাটি বলেছেন তিনি তা মিথ্যা। অর্থাৎ মনিকা লিওনেস্কির সাথে তার সেক্সুয়াল সম্পর্ক ছিল।

 

বিল ক্লিনটনের ডিনায়াল ও পারফরমেটিভের ব্যবহার – ইউটিউব ভিডিওঃ


আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পারফরমেটিভ বেশী ব্যবহার করেন তা হচ্ছে, বিলিভ মি।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিলিভ মি ব্যবহার নিয়ে একটা ইউটিউব ভিডিওঃ

 

আমি ও সম্পর্কঃ

 

অন্যতম সেরা ও বিখ্যাত একটি ইংলিশ রক ব্যান্ড দি বিটলস। এর উত্থান, তুমুল জনপ্রিয় হওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়া সঙ্গীতাঙ্গনের একটি বড় ঘটনা।

 

তাদের লিরিকগুলি লিখেছিলেন জন লেনন ও পল ম্যাকার্টনি বেশীরভাগ। এরপর তারা যৌথভাবে কিছু গানও লিখেন। ২৫ টার মত গান লিখেন জর্জ হ্যারিসন ব্যান্ডটির শেষ বছরে, যে হ্যারিসনকে বাংলাদেশী হিসেবে আমরা শ্রদ্ধার চোখে দেখি আলাদাভাবে, আমাদের দেশের বিপদে তার সাহায্যের জন্য।

 

বিটলসের লিরিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রথমদিকে তাদের গানে আই, আমি ইত্যাদির ব্যবহার ছিল বেশী। প্রথমদিকের গান ছিল পার্সোনাল আবেগ অনুভূতি নিয়ে। পরে গানগুলিতে আমির ব্যবহার কমতে থাকে। নেগেটিভ ইমোশনের প্রভাব পড়তে থাকে বেশি।

 

লেনন ও ম্যাকার্টনী যেসব যৌথ গান লিখেছেন এগুলিতে তাদের একজনের কোন আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় নি। যৌথ কাজ সাইকোলজির গবেষণার এক ইন্টারেস্টিং বিষয়। তিনটা হাইপোথিসিস আছে যৌথ কাজ আসলে কী হয় এ নিয়ে।

 

১। কাজটি দুইজনের কাজের এভারেজ একটা কাজ হয়।

 

২। কাজটি দুইজনের কাজের চাইতে বাজে একটি কাজ হয়।

 

৩। কাজটি দুজনের কাজের চাইতে ভিন্নধর্মী একটা আলাদা কাজ হয়।

 

শেষের হাইপোথিসিসটিই বেশী হতে দেখা যায়। বিটলসের লিরিকের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে।

 

এছাড়া, আমি আমার বেশী ব্যবহারের সময়ে তাদের বা ব্যান্ড মেম্বারদের সম্পর্ক ছিল ভালো, দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে আমি ও আমারের ব্যবহার কমেছে।

 

পার্সোনাল সম্পর্কে গভীর থাকলে লোকজন আমি ও আমার ইত্যাদি শব্দ বেশী ব্যবহার করে। আর দূরত্ব তৈরী হলে আমি ও আমারের ব্যবহার কমিয়ে দেয়। তাই ভাষা থেকেই বুঝা যায় দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে।

 

[একটি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন আপনি, সাইকোলজিস্টদের এই কথা সত্য কি না। কারো সাথে সম্পর্ক খুব গভীর ভালো ছিল পরে খারাপ হয়েছে এমন হয়ে থাকলে, মেসেজ হিস্টরী পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারেন চাইলে, আমি ও আমারের সাথে কোন কো-রিলেশন আছে কি না।]

 

 

স্টাইল ম্যাচিং-

 

প্যানেবেকার ও তার ছাত্ররা দেখেছেন যে কোন কাপল যখন ফাংশন ওয়ার্ড একই হারে বা প্রায় সমান সমান ব্যবহার করে কথাবার্তায় তখন তাদের ডেটিং এ যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

 

তারা দশ জন নারী ও দশজন পুরুষ নিয়ে একটি পরীক্ষা করেন। একটা রুমে দশজন নারীকে বসানো হয়, স্পিড ডেটিং এর জন্য। অন্য দশ জন পুরুষ এসে তাদের সবার সাথে চার মিনিট করে কথা বলে। সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড হয়।

 

এই কথাবার্তা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেন কাদের কাদের কথাবার্তা ফাংশন ওয়ার্ড ব্যবহারের হার সমান সমান প্রায়। যাদের সমান সমান, তারা অনুমান করেন এরা ডেটিং এ যাবে।

 

পরে দেখা যায় তাদের অনুমান ঠিক হয়েছে। ওরা ডেটিং এ গেছে। তাদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেছে তাদের পরস্পরকে ভালো লেগেছে ইত্যাদি।

 

কিন্তু সাইকোলজিস্টদের ধারণা এই ভালো লাগার উৎস সমান হারে আমি আমার সহ ফাংশন ওয়ার্ডের ব্যবহার।

 

একইভাবে তারা অন্য কিছু কাপলের টেক্সট ম্যাসেজ হিস্টরী নিয়েও পরীক্ষা করে দেখেছেন, যারা বিভিন্ন ডেটিং সাইট ব্যবহার করত। যত বেশী আই ওয়ার্ড তারা ব্যবহার করেছে উভয়ে, তত বেশী তাদের সম্পর্ক হবার সম্ভাবনা তৈরী হয়। এই একই হারে বা প্রায় সমান সমান ফাংশন ওয়ার্ড ব্যবহার দ্বারা ম্যাচিংকে তারা নাম দিয়েছেন স্টাইল ম্যাচিং।

 

 

 

শেয়ারড ট্রমা ও আইঃ

 

জেমন্স প্যানেবেকার তার গবেষণার জন্য উপকরণের অনেক অংশ সংগ্রহ করেন অনলাইন ব্লগ পোস্ট, ইমেইল ইত্যাদি থেকে। নাইন ইলেভেন অর্থাৎ আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিধ্বংসী বিমান হামলার পরে লাইভ জার্নাল নামের এক ব্লগ সাইটে সাধারণ ব্লগারদের ব্লগ পোস্ট তিনি ও তার কলিগেরা সংগ্রহ করছিলেন এনালাইজ করার জন্য।

 

বিস্ময়কর ভাবে তারা দেখতে পান সেসব পোস্টে “আই” ওয়ার্ডের ব্যবহার হঠাৎ করে প্রচুর কমে গেছে। এবং এইসব পোস্টে উই তথা আমরা শব্দের ব্যবহার প্রচুর বেড়ে গেছে।

 

এটা হয়েছিল, ট্রমার পরে মানুষ যখন বুঝতে পারে অন্যরাও একই বিপদে আছে তখন তাদের মনে একটা স্বস্তি আসে। এখানে উই বা আমরা শব্দের ব্যবহার তাই বেড়ে গেছে, শেয়ারড ট্রমার কারণে।

 

 

 

আই ওয়ার্ড ও ক্ষমতাসম্পর্কঃ

 

প্যানেবেকার দেখেছেন কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে এনালাইস করে যে, যখন তিনি তার অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনকে ইমেইল করেন তখন তিনি আই ওয়ার্ড ব্যবহার বেশী করেন। ডিন উত্তরে আই ওয়ার্ড কম ব্যবহার করে উত্তর দেন। আবার তার ছাত্ররা যখন তাকে ইমেইল করে তখন তারা বেশী আই ওয়ার্ড ব্যবহার করে। অন্যদিকে ছাত্রদের ইমেইল রিপ্লাই দেবার সময় তিনি কম আই ওয়ার্ড ব্যবহার করেন। এ থেকে আই ওয়ার্ডের সাথে ক্ষমতা সম্পর্ক নির্নয় করেছেন প্যানেবেকার। তার মতে সামাজিক শ্রেণীবিভাগ বা হায়ারার্কিতে যে উপরে থাকে সে কম আই ওয়ার্ড ব্যবহার করে। কারণ সে উপর থেকে তাকায় তাই পুরাটা তাকে দেখতে হয়। তার নিচে থাকা লোক তার সাথে যোগাযোগের সময় বেশী আই ওয়ার্ড ব্যবহার করে। কারণ নিচের অবস্থানে থাকা লোক নিজেরটা নিয়েই তার সাথে যোগাযোগ করছে।

 

 

কারা আই ওয়ার্ড বেশী ব্যবহার করেঃ

 

বিভিন্ন সময়ে প্যানেবেকার যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তাতে সংক্ষেপে এরকম একটি তালিকা করা যায়-

 

১। নারীরা।

 

২। অনুসারীরা (লিডাররা না)।

 

৩। সত্যবাদীরা।

 

৪। যুবক/যুবতী।

 

৫। গরীব।

 

৬।হতাশ।

 

৭। ভীত।

 

৮। অসুস্থরা।

 

 

এই তালিকা দেখে বুঝা যায় হুট করে আমি বেশী দেখে যেকোন একটা ধরে নেয়া যাবে না। এর আগে, পেছনে কিছু কার্যকারণ যদি থাকে গোয়েন্দার হাতে, তবেই তিনি আমি’র বেশী ব্যবহার দেখে একজন ব্যক্তির অবস্থা বিচার করতে পারবেন। যেমন তিনি কোনভাবে বুঝতে পারলেন অন্যান্য স্ট্যাটাসে বা আচরণে যে লোকটি হতাশ থাকার সম্ভাবনা আছে, আবার দেখলেন সে আমিও অতি ব্যবহার করে, এক্ষেত্রে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর একটা কার্যকারণ থাকে। তখন তিনি ধরতে পারেন লোকটি হতাশ আছে।

 

কেউ আমি ব্যবহার করছে না দেখে ১০০ ভাগ নিশ্চিত আপনি হতে পারবেন না যে সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু অন্য কোনভাবে আপনি যদি বুঝতে পারেন সে মিথ্যা বলছে, আর তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করেও দেখেন আমি ব্যবহার কম আছে, তখন আপনার ধারণাটিকে শক্ত করতে পারেন যে বক্তব্যটি মিথ্যাই।

 

 

লেখা থেরাপিঃ

 

লেখা একটা মারাত্মক জিনিস। আগেই উল্লেখ করেছি ট্রমা নিয়ে লেখা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে এমন দেখেছেন সাইকোলজিস্টেরা। লেখা একই সাথে চিন্তাকে পরিস্কার করে। এবং যে বিষয় নিয়ে আপনি লিখছেন তা মনে রাখতে প্রচুর সাহায্য করে। যারা ট্রমার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন লেখায় বা কথায় তাদের চাইতে যারা তাদের ট্রমাকে লুকিয়ে রাখে তাদের ক্ষেত্রে ট্রমা বেশী ক্ষতি করতে পারে বলে দেখেছেন সাইকোলজিস্টেরা।

 

 

 

শেষের কবিতা বিশ্লেষণঃ

 

 

জেমস প্যানেবেকারের রিসার্চ প্রাপ্ত ইনসাইট ব্যবহার করে কোন লেখা বা বক্তব্য যেমন বিশ্লেষণ করা যায়, তেমনি বিশ্লেষণ করা যায় সাহিত্যের কোন চরিত্রকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস শেষের কবিতার চরিত্র অমিত ও লাবণ্যের কথাবার্তা এই প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উপন্যাসে অমিত বেশী “আমি” ব্যবহার করেছে কথাবার্তায়। লাবণ্যের প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি সে আমি ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্যানেবেকারের রিসার্চ মতে আমি’র বেশী ব্যবহার হচ্ছে ফিমেল প্যাটার্ন। অর্থাৎ অমিত শেষের কবিতা উপন্যাসে ফিমেল প্যাটার্নে কথা বলেছে আসলে।

 

তাদের দুজনের “আমি” ব্যবহারের সংখ্যা প্রায় এরকমঃ

 

নাম  আমি ব্যবহার
অমিত ৬৪ বার

 

লাবণ্য ৩৪ বার

 

 

অমিতের চরিত্রটি উপন্যাসে একজন আত্মগর্বী ব্যক্তির। সে নিজেকেই কেবল দেখতে পায় যেন। তার অতি আমি ব্যবহার চরিত্রের এই দিকটারও প্রকাশ।

 

অতি আমিত্বের কারণে অমিত শেষতক দূর্বল একটি চরিত্র, ক্ষমতার মাত্রায় লাবণ্য তার চাইতে বেশী ক্ষমতা রাখে। অমিতকে শেষে তাই সে ফিরিয়ে দিতে পারে, এবং শোভনলালের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয় আমরা দেখতে পাই। শোভনলালের কথোপকথন তো উপন্যাসে নাই বললেই চলে। সে একবার আমি ব্যবহার করেছে, উপন্যাসের শুরুর দিকে। তারপর তাকে আর দেখা যায় না উপন্যাসে। শেষে সে লাবণ্যকে যে চিঠি দেয় সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং।

 

শোভনলালের চিঠিঃ

 

শিলঙ কাল রাত্রে এসেছি। যদি দেখা করতে অনুমতি দাও তবে দেখতে যাব। না যদি দাও কালই ফিরব। তোমার কাছে শাস্তি পেয়েছি, কিন্তু কবে কী অপরাধ করেছি আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝতে পারি নি। আজ এসছি তোমার কাছে সেই কথাটি শোনবার জন্যে, নইলে মনে শান্তি পাই নে। ভয় কোরো না। আমার আর-কোনো প্রার্থনা নেই।

 

দুইবার ‘তোমার’ ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু চিঠিটিতে সে আমি ব্যবহার করে নি। একবার আমার ব্যবহার করেছে।

 

এর উত্তর চিঠিতে লাবণ্যের চিঠিঃ

 

তুমি আমার সকলের বড়ো বন্ধু। এ বন্ধুত্বের দাম দিতে পারি এমন ধন আজ আমার হাতে নেই। তুমি কোনোদিন দাম চাও নি; আজও তোমার যা দেবার জিনিস তাই দিতে এসেছ কিছুই দাবি না করে! চাই নে বলে ফিরিয়ে দিতে পারি এমন শক্তি নেই আমার, এমন অহংকারও নেই।

 

এখানেও সরাসরি আমি ব্যবহার হয় নি। তুমি, তোমার ব্যবহার হয়েছে তিনবার, দুইবার ব্যবহার হয়েছে আমার। শোভনলালের সাথে লাবণ্য ফিমেল প্যাটার্নেই উত্তর দিয়েছে।