ক্রিস হারমানের বই এ পিপল’স হিস্টরী অব দ্য ওয়ার্ল্ড থেকে বাংলা ভাষান্তর।
শ্রেণীর পূর্বে
২১ শতকের এই যে পৃথিবীতে আমরা প্রবেশ করেছি তা হচ্ছে লোভ, ধনী ও গরীবের মধ্যে আকাশ পাতাল বৈষম্য, বর্নবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদী সব মতবাদ, হিংসাত্মক চর্চা এবং ভয়ানক সব যুদ্ধের। এটা বিশ্বাস করা খুব সহজ যে এমনই ছিল সব সময়। অন্যথা হতে পারে না। এই ধরনের ধারণা তুলে ধরেছেন অসংখ্য দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং মনস্তাত্ত্বিকেরা। তারা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরতেছেন অভিজাততন্ত্র, অধীনতা মেনে নেয়া, লোভ এবং হিংস্রতাকে। এবং আরো কেউ কেউ এগুলিকে দেখেছেন সমগ্র প্রাণীজগতের মধ্যে, সমাজ-জীববিজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য যা জিনতত্ত্বের নিয়ম হিসেবে প্রানীদের মধ্যে রয়েছে। [১] প্রচুর জনপ্রিয় ‘বৈজ্ঞানিক’ পেপারব্যাক আছে যারা তুলে ধরে মানুষকে ‘নগ্ন শিম্পাঞ্জি’ হিসেবে (দেসমন্ড মরিস)[২], ‘হত্যা আকাঙ্খা’ যুক্ত প্রানী হিসেবে (রবার্ট অদ্রে) [৩] এবং আরো স্পষ্টভাবে ‘সেলফিশ জীনের’[৪] প্রভাবগ্রস্থ প্রানী হিসেবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা, যারা অসংখ্য প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছিলেন রেকর্ডকৃত ইতিহাসেরও আগে তাদের সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি এর সাপেক্ষে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে এমন কঠিন চিত্র আঁকা সম্ভব না। বৈজ্ঞানিক গবেষনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল জানাচ্ছে তাদের সমাজ প্রতিযোগীতা, বৈষম্য এবং শোষনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এই সব ধারণা আসলে ইতিহাসের তৈরী বা বলা যায় সাম্প্রতিক ইতিহাসের নির্মান। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে পাওয়া পৃথিবীব্যাপী যে মানব আচরনের চিত্র তা মাত্র পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষনা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার সমাজের যেসব চিত্র পাওয়া যায় তা ১৯ এবং ২০ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত একই ধরনেরই ছিল। নৃতত্ত্ববিদ রিচার্ড লি বিষয়টার এভাবে সারমর্ম করেনঃ
রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সামাজিক অসাম্যের উদ্ভবের পূর্বে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ছোট ছোট সম্পর্কযুক্ত দল হিসেবে বাস করত। তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা ছিল জমি ও সম্পদের সামগ্রীক মালিকানার, আদান প্রদান ভিত্তিক খাদ্য বন্টন এবং অপেক্ষাকৃত সাম্যবাদী রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে। [৫]
অন্যভাবে বলতে গেল, মানুষেরা পরষ্পরের সাথে সাহায্য ও সহযোগীতামূলক একটা ব্যবস্থায় ছিল, কোন শাসক শাসিত এবং ধনী ও গরীব ছিল না। লী যা বলেন তা ১৮৮০ সালে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস বর্নিত ‘প্রাথমিক কম্যুনিজম’ এর মত শোনায়। আমাদের প্রজাতি (হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ) ১০০০০ বছরেরও বেশী সময়ের। এর ৯৫ ভাগ সময় সে যেভাবে জীবন যাপন করেছে তা উঠে আসে নি তথাকথিত “মানব প্রকৃতি” এর চিত্রায়নে। আমাদের বায়োলজিতে এমন কিছুই নেই যে যা বর্তমান সমাজ তৈরীর জন্য দায়ী। আমরা বর্তমান বাজে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি এর জন্য মানব প্রকৃতিকে তাই দোষারূপ করার অবকাশ নেই।
আমাদের প্রজাতির উৎপত্তি অনেক আগে, সেই ১০০,০০০ বছর পূর্বে। আমাদের দূর পূর্বপুরুষদের উদ্ভব হয় আফ্রিকায় কোন একটি অঞ্চলে প্রায় চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন বছর পূর্বে এক প্রজাতির শিম্পাঞ্জি হতে। কোন এক অজানা কারণে আমাদের এই পূর্বপুরুষেরা গাছে বসবাস করা ত্যাগ করে মাটিতে নেমে আসে। যেমন আমাদের নিকঠাত্মীয় সাধারণ শিম্পাঞ্জি এবং বনোবোরাও (বা পিগমি শিম্পাঞ্জি) নেমে এসেছিল। তারা ভূমিতে হাঁটতে শুরু করে, একসাথে পরস্পর সহযোগীতার সাথে কাজ করতে থাকে। আমাদের দূর পূর্বপুরুষদের এই সহযোগীতা ছিল অন্য স্তন্যপায়ী প্রজাতিদের চাইতে অনেক বেশী। তারা একসাথে মিলে বিভিন্ন হালকা যন্ত্র বানাল (যেমন মাঝে মাঝে শিম্পাঞ্জিরা বানায়) মাটি খোঁড়ার জন্য, ছোট অন্য প্রানীদের শিকারের জন্য এবং বড় শিকারীদের ভয় দেখানো, পোকামাকড় সংগ্রহ, ফলমূল সংগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা সহযোগীতার মাধ্যমে এগুতে লাগল। মূল বিষয়টা ছিল একে অন্যের সাথে সহযোগীতা, প্রতিযোগীতা নয়। যারা এই ধরনের সহযোগীতামূলক আচরনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত না এবং এই নতুন ধরনের মানসিক অবস্থায় ভারসাম্য রাখতে পারে নি তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা পেরেছে তারা টিকে থেকেছে এবং পুনরোৎপাদন করেছে।
মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের এই বিবর্তন স্তন্যপায়ী জীব হিসেবে আমাদের জীনতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার অন্য সব স্তন্যপায়ী প্রানীদের চাইতে করেছে আলাদা। অন্য স্তন্যপায়ীদে কিছু বিশেষ দৈহিক বৈশিষ্ট্য আছে যেমন প্রতিরক্ষার জন্য বড় দাঁত এবং থাবা, নিজেকে গরম রাখার জন্য পশম, দ্রুত পালিয়ে যাবার জন্য লম্বা পা ইত্যাদি, এগুলি আমাদের নেই। পক্ষান্তরে প্রথমদিকের মানুষ জিনতাত্ত্বিকভাবে এমনভাবে তৈরী ছিল যেন সে তার চারপাশের পৃথিবীর সাথে মানিয়ে নিতে পারে। যেমন হাত দিয়ে সে কোন জিনিসকে ধরতে পারে, আকৃতি দিতে পারে, গলায় শব্দ তৈরীর মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, পর্যবেক্ষন করতে পারে, তার চারপাশের পৃথিবী দেখতে এবং বুঝতে পারে, দীর্ঘ সময়ের শিশুকালে সে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা আয়ত্ব করতে পারে। এর জন্য দরকার ছিল বড় মস্তিষ্কের এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষমতা ও আকাঙ্খা। এর জন্য তারা ভাষাও তৈরী করে, ভাষা যোগাযোগের এক বিরাট মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, এবং এই বৈশিষ্ট্যটি অন্যসব প্রানীদের চাইতে আলাদা এবং এর মাধ্যমেই সে কোন জায়গায় উপস্থিত না হয়েও এর সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে সক্ষম হয়- এবং তার চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে সচেতন হয় আর নিজে এক সচেতন সত্তা হয়ে উঠে পৃথিবীতে। [৬] আধুনিক মানুষের উৎপত্তি, সম্ভবত আফ্রিকায় প্রায় ১৫০,০০০ বছর আগে, এবং সেটাই ছিল এই সমগ্র প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়।
এর পরের ৯০০০০ বছরে আমাদের পূর্বপুরুষের দলগুলি আস্তে আস্তে আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং এরই এক পর্যায়ে নিয়েনডারথ্যাল মানবের উদ্ভব হয়।[৮] প্রায় ৬০,০০০ বছর পূর্বে তারা পৌছে যায় মধ্যপ্রাচ্যে। ৪০,০০০ বছরের মধ্যে তারা পশ্চিম ইউরোপে পৌছে যায় এবং কোনভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলি এবং অষ্ট্রেলিয়াকে বিভক্তকারী সমুদ্র অতিক্রম করে ফেলে। ১২০০০ বছর আগে তারা বেরিং বরফ উপত্যকা পার হয়ে আমেরিকায় পৌছে যায়, এবং সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে কেবলমাত্র এন্টার্কটিকা ছাড়া। যেসব ছোট ছোট দল বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল তারা দীর্ঘদিন অন্য কোন দলের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। বরফ গলে যাওয়ায় বেরিং উপত্যকা পার হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় আর সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ার বিচ্ছিন্নতা আরো বাড়ে। তাদের ভাষা আলাদা হয়ে উঠে। তারা ভিন্ন ধরনের জ্ঞান এবং ভিন্ন সংস্থা গড়ে তোলে। গড়ে তোলে ভিন্ন সংস্কৃতি। পরিবেশের প্রভাবে তাদের মধ্যে ভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্ট্যও দেখা দেয়। যেমন, চোখের রঙ, চুল, ত্বকের রঙ ইত্যাদি। কিন্তু এই বিভিন্ন গ্রুপগুলির মধ্যে জিনতাত্ত্বিক ব্যবস্থা রয়ে যায় পুরোপুরি অপরিবর্তিত। তাদের ভিতরের বুদ্ধিমত্তা, অন্যের ভাষা শেখার ক্ষমতা ইত্যাদি রয়ে যায় একইরকম। মানব প্রজাতি পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে থাকলেও তারা তাই একই প্রজাতিই রয়ে যায়। কোন গ্রুপ কীভাবে তার অবস্থা উন্নত করেছে তা তার ভিতরের ক্ষমতা থেকে নয়, যেহেতু সব দলেরই ভিতরের ক্ষমতা এক ছিল, বরং তাদের ঐ নির্দিষ্ট পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলার প্রবণতা এবং পরস্পরের সাথে সহযোগীতা দলগুলিকে উন্নত করেছে। এই অভিযোজন এর জন্যই মূলত বিভিন্ন সমাজে এসেছে বিভিন্ন ধরনের প্রথা, আচরন, পুরান, এবং রীতি।
প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বেও বিভিন্ন দলগুলির মধ্যে মৌলিক কতগুলি বিষয়ে মিল ছিল। এর কারণ তারা প্রায় একইভাবে খাবার, আশ্রয় এবং পোশাক আশাকের ব্যবস্থা করত। প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ এবং সেগুলিকে নিজেদের ব্যবহার উপযোগী করে তুলত। এই সমাজকে সাধারনত বলা হয় শিকার-সংগ্রহ সমাজ বা একটু ভালোভাবে বললে খাদ্য সংগ্রহ সমাজ। [৯]
পৃথিবীর বিস্তীর্ন প্রান্তরে এই লোকদের অল্প কিছু টিকে ছিল কয়েকশ বছরের আগ পর্যন্ত। এবং আরো অল্প কিছু টিকেছে লেখা শুরু হবার সময়কাল পর্যন্ত। নৃতত্ত্বে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং নৃতত্ত্ববিদ রিচার্ড লী তার গবেষনার মাধ্যমে এটা দেখাতে পেরেছেন আমাদের প্রজাতির ইতিহাসের প্রায় নব্বই ভাগ সময় কেমন ছিল।
পশ্চিমা যে চিত্র তুলে ধরা হয় মানুষ ছিল সংস্কৃতিহীন হিংস্র জন্তু বিশেষ, প্রাকৃতিক অবস্থায় বাস করছে পরস্পরের সাথে রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, টিকে থাকার জন্য, এবং এই জন্য তাদের জীবন ছিল হিংস্র ও সংক্ষিপ্ত; এই চিত্র ঠিক নয়। বাস্তব চিত্র এর চাইতে ভিন্ন। [১১]
মানুষেরা ত্রিশ চল্লিশ জনের দল হিসেবে থাকতো, এবং কখনো অন্য দলের সাথে মিশে এমন দল প্রায় দুইশ সদস্যের পর্যন্ত হতো। এবং বর্তমান কৃষিভিত্তিক বা শিল্পভিত্তিক তথাকথিত সভ্য সমাজের বসবাস করতে থাকা হাজারো মানুষের চাইতে তাদের জীবন কঠিন ছিল না। একজন নৃতাত্ত্বিক তো তাদের সেই সময়টাকে বলেছেন “প্রকৃত প্রাচূর্যপূর্ন সমাজ”। [১২]
ছিল না কোন শাসক, কোন মালিক এবং শ্রেনী বিভাগ। কংগোর এমবুতি পিগমিদের নিয়ে লিখতে গিয়ে টুমবাল যেমন লিখেছিলেন, “কোন নেতা নেই, নেই কোন আনুষ্ঠানিক পরিষদও নেই। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই…হয়ত অন্যদের চাইতে অগ্রসর একজন বা দুজন পুরুষ বা মহিলা দায়িত্ব নেয় কিন্তু তা ভালোর জন্যই। আইনের ব্যবস্থাটা সেখানে সহযোগীতামূলক।[১৩] মানুষেরা পরস্পরের সাথে সহযোগীতামূলক ব্যবস্থায় ছিল যাতে কোন একজন নেতাকে না মানতে হয় জীবন ধারনের জন্য এবং যাতে ব্যবস্থাটি জটিল না হয়ে পড়ে। আর্নস্টাইন ফ্রিইডল তার গবেষণা থেকে বলেন, “পুরুষ ও মহিলা সারাদিন কীভাবে ব্যয় করবে তা তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারতঃ শিকারে যাবে, ফলমূল সংগ্রহে যাবে অথবা কার সাথে যাবে ইত্যাদি।” [১৪]
ইলিয়নর লীকক তার গবেষণা থেকে বলেন, “জমির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না এবং শ্রমের ক্ষেত্রে ভাগ বিভাজন ছিল না। মানুষেরা তার দায়িত্বের কাজগুলি সম্পর্কে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিত। আর দলগতভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে দলের সবার একটা সম্মতির ব্যবস্থা ছিল।” [১৫] আচরন নির্ধারিত হতো বদান্যতার মাধ্যমে স্বার্থপরতার মাধ্যমে নয়। প্রত্যেকেই অন্যদের সাহায্য করত। সংগৃহীত খাবার তারা সবার সাথে ভাগ করে নিত। লী বলেন, “খাবার কখনো একটা পরিবার খেয়ে ফেলত না, সব ক্ষেত্রেই দলের সব সদস্যদের সাথে তা ভাগ করে নেয়া হত। এই নীতির কারণেই সব পরিবেশে সব জায়গাতেই শিকার-সংগ্রহ সমাজ ছিল। [১৬] তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, “কালাহারি মরুভূমির কুং[১৭] মানুষেরা (যাদের বলা হয় বুশম্যান) খুবই সাম্যবাদী সমাজের এবং এই অবস্থা বজায় রাখার জন্য তারা কিছু সাংস্কৃতিক নিয়ম তৈরী করেছে, প্রথমত অহংকারী এবং উগ্রদের কমিয়ে ফেলা এবং দ্বিতীয়ত দূর্ভাগ্যবানদের সাহায্য করে টিকে থাকতে সহায়তা করা।[১৮] প্রথমদিকের একজন জেসুইট মিশনারী একবার কানাডার মোন্টাগনাইসে দেখেছিলেন কিছু শিকার-সংগ্রহ সমাজের মানুষকে। তিনি লিখেন, “যে দুই দুঃশাসক আমাদের অনেক ইউরোপিয়ানকে দোজখ ও যন্ত্রনা দিয়ে চলেছে তারা এসব জঙ্গলে শাসন করে না, আমি বলছি উচ্চাকাঙ্খা এবং লালসার কথা…এই দুই শয়তানের একটির কাছেও এদের কোন লোক নিজেকে সমর্পন করে দেয় নি সম্পদশালী হবার জন্য।” [১৯]
খুবই কম যুদ্ধ ছিল সে সমাজে, এ নিয়ে ফ্রিইডল লিখেনঃ
জায়গা দখলের জন্য এক দলের সাথে তার প্রতিবেশী দলের যুদ্ধের চিহ্ন পাওয়া যায় না। শিকার-সংগ্রহ সমাজে যুদ্ধের পেছনে, যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণের পেছনে খুবই নগন্য সময় ব্যয় করেছে মানুষ। দলের মধ্যে যদি সমস্যার উদ্ভব হতো তাহলে তাদের আলাদা করে ভিন্ন দল করে দেয়া হত, এবং এভাবেই সমস্যা মিটানো হত। [২০]
ইতিহাসের পূর্বের সময়কালে, অস্ট্রালোপিথেকাসের- প্রথম দু পায়ে হাঁটা শিম্পাঞ্জি- আবির্ভাবের পর থেকে লেখা শেখার সময়কাল পর্যন্ত আমাদের প্রজাতি “হত্যার আকাঙ্খা” নিয়ে ছিল, তারা হিংস্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করেছে, পানির কুয়া নিয়ে যুদ্ধ করেছে কারণ আফ্রিকায় প্রচন্ড সূর্যের তাপে কুয়াগুলি শুকিয়ে যেত, আমরা দিন শেষে আসলে কেইনের সন্তান, অর্থাৎ বাইবেলের গল্পের সেই কেইন যে তার ভাই আবেলকে হত্যা করেছিল; ইত্যাদি যে বলেন অনেকে, যেমন অর্ড্রে, এগুলিকে ভুল প্রমাণ করে উপরে প্রাপ্ত প্রমানগুলি।
“মানব প্রকৃতি” বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে তা তৈরী হয়েছে শিকার-সংগ্রহ সমাজের দীর্ঘ পরিক্রমায়, এবং আকৃতি নিয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। লী এ ব্যাপারে ঠিক কথাই বলেনঃ
সাম্যবাদী সহযোগীতার দীর্ঘ সময়কালই আমাদের ইতিহাস নির্মান করেছে। আমরা যেমন দেখি বিভিন্ন সমাজে অভিজাততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, মানুষে মানুষে বৈষম্য, অসাম্য ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তেমনি মানবজাতির ইতিহাসে এমন চিহ্ন রয়েছে যে আমাদের গভীরে আছে সাম্যবাদী চিন্তা, আমাদের গভীরে আছে সহযোগীতার আকাঙ্খা, এবং সবাই মিলে বসবাস করার তাড়না। [২২]
মার্গারেট থ্যাচারের প্রিয় অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিখ ভন হায়েক বলেছিলেন ভিন্ন কথা। তিনি অভিযোগ করেছিলেন মানুষের ভেতরে আছে আদিম অনুভূতি এবং পাশবিক সব প্রবণতা এর কারণ তারা আগে ছোট ছোট দল হয়ে থাকত এবং দলের জন্য যা ভালো মনে করত তাই করত। পরিচিতদের ভালো করার প্রবৃত্তি এর থেকে জন্ম নেয়। [২৩]
মানব প্রকৃতি সত্যিকার অর্থে স্থির কিছু না, খুবই পরিবর্তনশীল। আমাদের বর্তমান সমাজে কিছু মানুষের মাঝে দেখা যায় অত্যধিক লোভ এবং প্রতিযোগীতার মনোভাব যা হায়েকের কথার সাথে মিলে। এবং শ্রেনী সমাজেও তা ছিল- সবচেয়ে ভয়াবহ সব হিংস্রতা, নির্যাতন, গনধর্ষন, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি। কিন্তু যখন মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করে জীবন যাপন করত তখন তাদের আচরন ভিন্ন ছিল কারণ তখনকার অবস্থায় সহযোগীতা এবং পরস্পরকে সাহায্য করা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারত না।
শিকারী এবং সংগ্রহকারীরা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল ছিল দারুনভাবে। সংগ্রহকারীরা যেসব খাদ্যবস্তু সংগ্রহ করে আনত, তাই ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কারণ শিকার পাওয়া যেত না সব সময়। শিকার সহজ কাজ ছিল না তখনো। তাই শিকারীরা তাদের প্রতিদিনের জীবন যাপনে সংগ্রহকারীদের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং এই কারণে তারা শিকার করলে তা সংগ্রহকারীদের সাথে ভাগ করে নিত। আবার শিকারে ক্ষেত্রে কোন পুরুষ একা একা গিয়ে নায়কের মত শিকার করে আনবে এমন ব্যবস্থাও ছিল না। শিকারীদের দল তৈরী হত কয়েকজন পুরুষ মিলে। কখনো তাতে সাহায্যের জন্য নারী এবং শিশুরাও থাকত। তারা একসাথে মিলেই শিকার করত। অর্থাৎ এখানেও সহযোগীতার ব্যাপারটি ছিল। এই সহযোগীতা ছাড়া শিকার ও সংগ্রহ সমাজের মানুষেরা অল্প দিনও টিকে থাকতে পারত না।
এখানে মহিলাদের উপর পুরুষদের কতৃর্ত্ব ছিল না। কিন্তু সব সময়েই লিঙ্গভেদে নারী ও পুরুষের কাজ ভাগ করা ছিল। পুরুষেরা বেশীরভাগ করত শিকারের কাজ আর নারীরা করত সংগ্রহের কাজ। এর কারণ ছিল একজন গর্ভবতী মহিলা বা ছোট দুগ্ধ পান রত শিশু সন্তান আছে যে মহিলার সে শিকারে অংশ নিতে পারবে না, এতে তার শিশু বিপদে পড়তে পারে। আর শিশু যদি বেঁচে না থাকে তাহলে দলের ভবিষ্যত সদস্য থাকবে না। এর জন্যই মহিলারা করত সংগ্রহের কাজ। কিন্তু এই কাজ ভাগ কখনোই পুরুষের কতৃত্বের পরিচয় প্রকাশ করত না, যেরকমটা এখন আমরা দেখে থাকি। পুরুষ এবং মহিলা উভয়ে মিলেই গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলি নিত, যেমন কখন দল স্থান পরিবর্তন করবে, বা অন্য কোন দলের সাথে মিশবে কি না ইত্যাদি। যারা সন্তান উৎপাদন করত সেই নারী ও পুরুষের মধ্যে তেমন কোন বন্ধনও থাকত না। যেকোন সময় তারা একজন আরেকজনকে ছেড়ে যেতে পারত তাদের নিজের এবং সন্তানের জীবন বিপন্ন না করে। পুরুষ কতৃত্বের যে ব্যাপারটিকে এখন তথাকথিত মানব প্রকৃতির অংশ ধরা হয় তা সেই সমাজে ছিলই না।
সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোন ধারনাই ছিল না, যা আমরা এখন অবশ্যম্ভাবী বলে ধরে নেই। দলগুলি তাদের প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহের উপযোগী জায়গাতেই তাদের আসন গাড়ত। দলের সদস্যরা সেই এলাকাতে ঘুরে বেড়াত গাছ থেকে গাছে খাদ্যের জন্য বা বিভিন্ন জায়গায় শিকারের জন্য। যখন সেই জায়গায় খাদ্য আর পাওয়া যেত না তখন তারা অন্যত্র যেতে মনস্থ করত এবং এই স্থানত্যাগের সময় তারা তেমন কিছুই সাথে নিয়ে যেত না। হয়ত বেশী হলে কোন সদস্য নিল তীর বা ধনুক, কেউ একটি থলে এবং দুয়েকটি ক্ষুদ্র অলংকার বা মণি। বস্তুগত সম্পত্তির যে ধারণা পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে মানুষ এখন গড়ে তুলেছে সমাজের প্রধান এক ভিত্তি হিসেবে তা সেই সময়ের সমাজে ছিল না।
মানুষের গত কয়েক হাজার বছর প্রধানত হচ্ছে কীভাবে বিভিন্ন সমাজ এবং তাদের চিন্তা উন্নত হলো। ইতিহাস রচিত হয়েছে অসংখ্য পুরুষ ও মহিলাকে নিয়ে, যারা তাদের নিজের জন্য একটি সুন্দর জীবন চেয়েছেন, তাদের পরিজনের জন্য চেয়েছেন, প্রিয়জনের জন্য চেয়েছেন, এর জন্য তারা কখনো কখনো পৃথিবী যেমন আছে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন আর কখনো চেয়েছেন পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে, এই পরিবর্তনে তারা সব সময় সফল হন নি, বেশীরভাগ সময়েই ব্যর্থ হয়েছেন, সফলও হয়েছেন অল্প কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু তবুও এই অসংখ্য পরস্পর সম্পর্কিত গল্পগুলির মধ্য থেকে দুইটি বিষয় তাদের বিশেষত্ব নিয়ে ধরা পড়ে। এক দিকে মানুষ তার জীবনকে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পেরেছে, সেই আদিম অবস্থা যা “প্রারম্ভিক সমাজতন্ত্রের” অংশ ছিল তাও পেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠানের তৈরী হয়েছে যারা সুবিধাপ্রাপ্ত কতিপয়ের পক্ষ হয়ে বেশীরভাগ লোককে শোষন করে।
আমরা যদি এই দুই ধরনের পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রাখি, তাহলে দেখতে পাবো এই ২১ শতকের শুরুতে আমরা পৃথিবীটাকে কেমন দেখছি। এখন পৃথিবীতে এত বেশী উৎপাদন সম্ভব যা আমাদের দাদা-দাদীরা কল্পনাও করতে পারতেন না কিন্তু তবুও সমাজে বৈষম্য, শোষন, দুর্বলকে নির্যাতন বেড়েছে। কোটি কোটি মানুষ কঠিন দারিদ্রের মধ্যে দিনাতিপাত করছে, কোটি কোটি মানুষ বাস করছে নিরাপত্তাহীনতায়। যুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে। এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে মানুষের জীবনই পড়ছে হুমকির মুখে। সবার জন্য তাই মূল প্রশ্নটা হওয়া উচিত, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেরকমভাবে প্রারম্ভিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাস করেছেন হাজার হাজার বছর, তারই ধারাবাহিকতায় আমরা কি বর্তমান শোষনমূলক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবীর সম্পদ ব্যবহার করে মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরন করতে পারব।
কিন্তু আগে আমাদের দেখতে হবে কীভাবে শ্রেনী শাসন এবং রাষ্ট্রের জন্ম হলো।